মানব সৃষ্টির আদি থেকেই এমন কিছু লোক ছিলেন যারা জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করে, সকল প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে আল্লাহ প্রদত্ত অহি-র বিধানকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। প্রয়োজনে নিজের অমূল্য জীবন কুরবানী করেছেন। যেমন প্রতাপান্বিত কাফির সম্রাট ফেরাঊনের অধীনে থেকেও তার স্ত্রী আসিয়া ছিলেন ইসলামের শাশ্বত আদর্শে উজ্জীবিত। এ আদর্শের জন্য তিনি নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুনিয়াবী জৌলুস ও শান-শওকত তাকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। অতীব নিষ্কলুষ ও নির্মল চরিত্রের অধিকারী অতি সুদর্শনা উম্মু হাবীবা (রাঃ)ও ছিলেন ইসলামী আদর্শের জন্য নিবেদিত প্রাণ এক মহিয়সী মহিলা। মক্কার কুরাইশ বংশের তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা আবু সুফিয়ানের বিত্ত-বৈভব ও সামাজিক উচ্চ মর্যাদা, প্রতিপত্তি উম্মু হাবীবাকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনি। বরং ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে দ্বীন-ঈমান রক্ষার খাতিরে দেশ ত্যাগের সীমাহীন কষ্ট অকাতরে সহ্য করেন তিনি। বিদেশ-বিভূঁইয়ে গিয়ে জীবনের সর্বাধিক প্রিয় মানুষ, জীবনের একমাত্র অবলম্বন প্রথম স্বামী দ্বীন ত্যাগ করে খৃষ্টান হয়ে গেলেও উম্মু হাবীবা (রাঃ) ছিলেন ইসলামের উপর অটল ও অবিচল। জীবনের এই কঠিনতম মুহূর্তেও তিনি আদর্শচ্যুত হননি, বিচ্যুত হননি ইসলামের আলোকময় পথ থেকে। তাঁকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি পার্থিব কোন আকর্ষণ, কোন মায়াজাল। এই মহিয়সী রমণী উম্মুল মুমিনীন উম্মু হাবীবা (রাঃ)-এর জীবনী আমরা এখানে আলোচনার প্রয়াস পাব।
নাম ও বংশ পরিচয় :
তাঁর প্রকৃত নাম রামলাহ মতান্তরে হিন্দ। তবে প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধ মতে তাঁর নাম রামলাহ। কুনিয়াত বা উপনাম উম্মু হাবীবা।১ পূর্ণ বংশ পরিচিতি হচ্ছে রামলাহ বিনতু আবী সুফিয়ান ছাখার ইবনে হারব ইবনে উমাইয়াহ ইবনে আব্দে শাম্স ইবনে আব্দে মানাফ ইবনে কুছাই।২ তাঁর মাতার নাম ছাফিয়াহ বিনতু আবীল ‘আছ ইবনে উমাইয়াহ ইবনে আব্দে শাম্স। যিনি ওছমান ইবনু আফফান (রাঃ)-এর ফুফু ছিলেন।৩ কারো মতে উম্মু হাবীবা (রাঃ)-এর মাতার নাম আমিনা বিনতু আব্দিল উযযা ইবনে হিরবান ইবনে আওফ ইবনে ওবায়দ ইবনে ‘আবীজ ইবনে আদী ইবনে কা‘ব।৪
জন্ম ও শৈশব :
উম্মু হাবীবা (রাঃ) নবুওয়াতের ১৭ বছর পূর্বে মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন।৫ তাঁর শৈশবকাল সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।
বিবাহ ও ইসলাম গ্রহণ :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ফুফাত ভাই ওবায়দুল্লাহ ইবনু জাহাশ এর সাথে উম্মু হাবীবার প্রথম বিবাহ হয়।৬ ওবায়দুল্লাহ ইবনু জাহাশ ছিলেন হারব ইবনু উমাইয়ার মিত্র। বিবাহের পরে ইসলামের প্রাথমিক দিকে উম্মু হাবীবা ও ওবায়দুল্লাহ দ্বীনের দাওয়াত পেয়ে একই সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন।৭ ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাশের ঔরসে ও রামলার গর্ভে মক্কায় হাবীবা নামক এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে । এ মেয়ের নামানুসারে রামলার উপনাম হয় উম্মু হাবীবাহ।৮
হিজরত ও প্রথম স্বামীর ইন্তিকাল :
মক্কার সার যমীনে মুসলমানদের বসবাস কঠিন হয়ে পড়লে উম্মু হাবীবা ও তাঁর স্বামী ওবায়দুল্লাহ অন্যান্য মুসলমানদের সাথে জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে সুদূর হাবাশায় (আবিসিনিয়ায়) বর্তমান ইথিওপিয়ায় হিজরত করেন। কিন্তু এ হিজরত উম্মু হাবীবা (রাঃ)-এর জন্য মোটেই সুখকর ছিল না। দ্বীনের খাতিরে স্বজন ও জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে তাঁর জীবনে দুর্দশা নেমে আসে। হিজরত তাঁর জন্য বয়ে নিয়ে আসল দুঃখ-বেদনার অথৈ পাথার। হিজরতের ফলে আবু জাহলের নির্মম অত্যাচার থেকে মুক্তি পেলেও দাম্পত্য জীবনে নেমে এল এক অসহনীয় বিপর্যয়। দুর্বল চিত্তের লোক স্বামী ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাশ দ্বীনের জন্য এত তাকলীফ স্বীকার করতে অপ্রস্ত্তত হয়ে খৃষ্টান ধর্মে ফিরে যেতে উদ্ধত হন। যেজন জীবনের সবচেয়ে আপন, সার্বক্ষণিক সঙ্গী সে স্বামী দ্বীন-ধর্ম ত্যাগ করে পূর্বের ধর্মে ফিরে যায়। উম্মু হাবীবা (রাঃ) বলেন, একদা স্বপ্নে আমি আমার স্বামী ওবায়দুল্লাহকে বিকৃত চেহারায় বিভৎস অবস্থায় দেখে ভয় পেয়ে গেলাম এবং বললাম, আল্লাহ্র কসম তার অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেছে। সকালে সে আমাকে বলল, আমি বিভিন্ন ধর্মের প্রতি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু খৃষ্টান ধর্মের চেয়ে উত্তম কোন ধর্ম পাইনি। আমি ঐ ধর্মে ছিলাম। অতঃপর মুহাম্মাদের ধর্মে প্রবেশ করি। আমি পুনরায় পূর্বের ধর্মে প্রত্যাবর্তন করছি। উম্মু হাবীবা (রাঃ) তখন তার স্বপ্নের কথা স্বামীকে বললেন। তিনি স্বামীকে বুঝানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে শুনল না। মদ্যপানের দিকে ঝুঁকে পড়ল। আকণ্ঠ নিমজ্জিত করে মদ্যপান করতে লাগল।৯
ওবায়দুল্লাহ ধর্মান্তরিত হওয়ার পর স্ত্রী উম্মু হাবীবাকেও তার পদাঙ্ক অনুসরণের জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু উম্মু হাবীবার পর্বতসম ঈমানের কাছে তার সকল কোশেশ ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়। আল্লাহ্র পথে দ্বীনে হক্বের উপরে দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকেন। স্ত্রীর কাছে নিজের আদর্শিক ব্যর্থতা ও পরাজয়ের আঘাত ওবায়দুল্লাহ্র মনে বিশেষভাবে নাড়া দিচ্ছিল। সে কল্পনাও করেনি যে বিদেশ বিভূঁইয়ে একজন সাধারণ মহিলা স্বামীর আদেশ উপেক্ষা করতে সাহস করবে। কিন্তু আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য পাগলপরা ও দ্বীনে হক্বের জন্য নিবেদিতা উম্মু হাবীবা (রাঃ) সে সাহস প্রদর্শন করলেন। স্বামীর জন্য ইসলামের শাশ্বত আদর্শ ত্যাগ করতে রাযী হ’লেন না। ওবায়দুল্লাহ এর প্রতিশোধ হিসাবে স্ত্রীর নিকট থেকে দূরে সরে গেলেন। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ যন্ত্রণা উম্মু হাবীবা (রাঃ) অনুভব করলেও মুষড়ে পড়লেন না। আল্লাহ্র প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও দ্বীনে হক্বের প্রতি অবিচলতা, ইসলামের শাশ্বত আদর্শের জন্য নিবেদিতা উম্মু হাবীবা (রাঃ) তাই স্বামীর প্রেম-ভালবাসা উপেক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ভালবাসা তাকে ইসলামের সার্বজনীন আদর্শ থেকে, সত্যপথ থেকে একটুও সরাতে পারেনি, টলাতে পারেনি। উম্মু হাবীবা (রাঃ) কর্মের মাধ্যমে প্রমাণ করলেন যে, প্রয়োজন বোধে দ্বীনে হক্বের জন্য স্বামীর ভালবাসা ও স্বজনের সুতীব্র আকর্ষণও কুরবানী দিতে হয়।
উল্লেখ্য, উম্মু হাবীবার ১ম স্বামী ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাশ আবিসিনিয়ায় খৃষ্টান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।১০
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) -এর সাথে বিবাহ :
উম্মু হাবীবা (রাঃ) ৬ষ্ঠ মতান্তরে ৭ম হিজরীতে আবিসিনিয়ায় অবস্থান কালে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।১১ উম্মু হাবীবা (রাঃ) বলেন, ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাশের মৃত্যুর পর একদা আমি স্বপ্নে দেখলাম, জনৈক আগন্তুক এসে আমাকে বলছে, হে উম্মুল মুমিনীন! এতে আমি শঙ্কিত হ’লাম। আর আমি মনে মনে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করলাম যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বিবাহ করবেন। অতঃপর আমার ইদ্দতকাল সমাপ্ত হওয়ার অব্যবহিত পরেই আমি দেখলাম, বাদশাহ নাজ্জাশীর দূত আমার দরজায় দন্ডায়মান। সে আমার গৃহে প্রবেশের জন্য আমার অনুমতি চাচ্ছে। দূত হিসাবে আবরাহা নাম্নী এক দাসী স্বীয় পরিচ্ছদে আমার নিকটে এসেছে। সে আমাকে বলল, বাদশাহ আমাকে একথা বলে পাঠিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আপনাকে বিবাহ করার জন্য পত্র পাঠিয়েছেন। অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমর ইবনু উমাইয়াকে নাজ্জাশীর নিকট পাঠান উম্মু হাবীবাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে।১২ তখন আমি বললাম, আল্লাহ তোমাকে উত্তম জিনিস দ্বারা সুসংবাদ দান করুন। আবরাহা বলল, বাদশাহ আপনাকে বিবাহের অলী (অভিভাবক) নিযুক্ত করে পাঠাতে বলেছেন। তখন আমি খালিদ ইবনু সাঈদ ইবনিল আছকে অলী নিযুক্ত করে পাঠালাম। এই সুসংবাদ প্রদানের জন্য তিনি বাদী আবরাহাকে রৌপ্যের দু’টি চুরি এবং একটি আংটি উপহার দেন।১৩ উল্লেখ্য, খালিদ ইবনু সাঈদ ছিলেন উম্মু হাবীবার পিতা আবু সুফিয়ানের চাচাত ভাই।১৪
সন্ধ্যায় বাদশাহ নাজ্জাশী জা‘ফর ইবনু আবী তালেব ও অন্যান্য মুসলমানদের ডেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে উম্মু হাবীবা (রাঃ)-এর বিবাহ পড়িয়ে দেন। তিনি রাসূলে করীম (ছাঃ)-এর পক্ষ থেকে উম্মু হাবীবাকে ৪০০ দীনার মতান্তরে ৪ হাযার দেরহাম মহর প্রদান করেন। তিনি উপস্থিত সবাইকে খানার (ওলীমার) দাওয়াত দেন এবং খাদ্য খাওয়ান।১৫
উম্মু হাবীবার নিকট মহরের সম্পদ আসলে তা থেকে ৫০ মিছকাল তিনি আবরাহা নাম্নী বাদীকে প্রদান করেন, যে তাঁকে বিবাহের সুসংবাদ প্রদান করেছিল। বাদী তা নিতে অস্বীকার করলে উম্মু হাবীবা (রাঃ) বলেন, আমার কাছে কোন সম্পদ নেই, আমাকে যা দেওয়া হয়েছে, তা থেকে তুমি এটা গ্রহণ করো। তখন আবরাহা বলল, বাদশাহ এ থেকে কোন কিছু গ্রহণ করতে কঠোরভাবে বারণ করেছেন। আর আমি তাঁর অন্ন-বস্ত্রে জীবন যাপন করছি। তাছাড়া আমি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর দ্বীনের অনুসরণ করছি এবং আমি আল্লাহ্র প্রতি আত্মসমর্পণ করেছি। সুতরাং আপনার নিকট আমার অনুরোধ আপনি রাসূলের নিকট পৌঁছে আমার সালাম দিবেন এবং তাঁকে অবহিত করবেন যে, আমি তাঁর দ্বীনের অনুসরণ করছি। এ কথা বলে সে ঐ মাল ফেরৎ দিল।১৬ অতঃপর সে আমার প্রতি আরো বন্ধুভাবাপন্ন হ’ল। সে-ই আমাকে সফরের জন্য প্রস্ত্তত করে দিল। এরপর সে যখনই আমার নিকট আসতো, তখন বলতো, আপনার নিকট আমার প্রয়োজন ভুলে যাবেন না। উম্মু হাবীবা বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে এসে আবরাহার কথা বললে তিনি মুচকি হাসলেন এবং সালামের উত্তরে বললেন, ‘ওয়া আলাইহাস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’।১৭ বাদশাহ নাজ্জাশী বিবাহের পর উম্মু হাবীবাকে প্রস্ত্তত করার জন্য স্বীয় স্ত্রীদের নির্দেশ দেন। তারা কনের প্রয়োজনীয় সাজ-সজ্জা, সুগন্ধি ও অনেক মাখন নিয়ে আসে। উম্মু হাবীবা সেসব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য মদীনায় নিয়ে আসেন।১৮
বাদশাহ নাজ্জাশী নিজেই উম্মু হাবীবা (রাঃ)-কে মদীনায় প্রেরণের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন এবং তাঁকে শুরাহবিল ইবনু হাসনার সাথে প্রেরণ করেন।১৯ উম্মু হাবীবা (রাঃ) যখন মদীনায় আসেন তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৩০ বছরের কিছু বেশী।২০
তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চাচাত বোন। রাসূলের স্ত্রীদের মধ্যে তিনি ছিলেন রাসূলের বংশের অতি নিকটবর্তী। রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের মধ্য উম্মু হাবীবা (রাঃ)-কে সর্বাধিক মহর প্রদান করা হয়েছে। আর তাঁকে রাসূল বিবাহ করেছেন যখন তিনি রাসূলের নিকট থেকে অনেক দূরে ছিলেন।২১
আবিসিনিয়ায় উম্মু হাবীবা (রাঃ)-এর স্বামী ধর্মান্তরিত হওয়ার পর মৃত্যুবরণ করলে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তাঁর পিতা আবূ সুফিয়ান মক্কার প্রভাবশালী কুরাইশ নেতা এবং সে তখন কাফির। সে ছিল চরম ইসলাম বিদ্বেষী এবং ইসলাম ও মুসলমানদের কঠিনতম শত্রু। আর উম্মু হাবীবা (রাঃ) মুসলিম। এমতাবস্থায় মক্কায় তাঁর পরিবারের নিকটে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না। আবার ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাশের চেয়ে ভাল ও উম্মু হাবীবার জন্য উপযুক্ত কাউকে না পাওয়ায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান ও বিবাহ করেন।২২
চেহারা ও চরিত্র মাধুর্য :
উম্মু হাবীবা (রাঃ) অতি সুদর্শনা ছিলেন। ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, আবু সুফিয়ান (রাঃ) স্বীয় কন্যার রূপের গৌরব করতেন। আবু সুফিয়ান বলতেন, عندى أحسن العرب وأجمله أم حبيبة بنت ابى سفيان، ‘আমার নিকটে আরবের উত্তম ও সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা হচ্ছে উম্মু হাবীবা বিনতু আবী সুফিয়ান’।২৩ উম্মু হাবীবা (রাঃ) যেমন সুশ্রী ছিলেন, তেমনি ছিলেন নির্মল ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী এবং খুব নম্র-ভদ্র স্বভাবের মহিলা। সরলতা ও কোমলতা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।২৪
ইবাদত-বন্দেগী ও সুন্নাতের অনুসরণ :
উম্মু হাবীবা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতেন এবং সাধ্যানুযায়ী নিজের জীবনে সেগুলো পালন করতেন। তাঁর পিতা আবু সুফিয়ান পরবর্তীতে মুসলমান হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পিতার ইন্তিকালের তিন দিন পরে উম্মু হাবীবা (রাঃ) খশবু চেয়ে নিয়ে স্বীয় গন্ডদেশ ও বাহুতে লাগালেন এবং বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশ মুমিন মহিলার জন্য তিন দিনের বেশী কারো জন্য শোক পালন করা জায়েয নয়। শুধু স্বামীর জন্য ৪ মাস ১০ দিন শোক পালন করবে।২৫
উম্মু হাবীবা (রাঃ) অতি ইবাদতগুযার ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতি দিন ১২ রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করবে, জান্নাতে তার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করা হবে’।২৬ উম্মু হাবীবা একথা শুনেছিলেন। এরপর সারাজীবন নিয়মিত প্রতিদিন তিনি ১২ রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করতেন।২৭
ইলমী খেদমত :
ইলমে হাদীছে উম্মু হাবীবা (রাঃ) অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও উম্মুল মুমিনীন যয়নাব বিনতু জাহাশ (রাঃ)-এর নিকট থেকে হাদীছ শ্রবণ করেন। তাঁর নিকট থেকে স্বীয় কন্যা হাবীবা, ভ্রাতা মু‘আবিয়া, উৎবাহ, ভ্রাতুষ্পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনু উৎবাহ ইবনে আবী সুফিয়ান, ভাগ্নে আবু সুফিয়ান ইবনু সাঈদ ইবনিল মুগীরাহ ইবনিল আখনাস আছ-ছাক্বাফী, তাঁর গোলাম সালিম ইবনু শাওয়াল, ইবনুল জাররাহ, ছাফিয়া বিনতু শায়বাহ, যয়নাব বিনতু উম্মে সালমা, উরওয়াহ ইবনে যুবাইর, আবু ছালেহ আস-সিমান, শুতাইর ইবনু শাকাল, আবুল মালীহ ‘আমীর আল-হুযালী প্রমুখ হাদীছ বর্ণনা করেন।২৮ তাঁর নিকট থেকে বর্ণিত হাদীছ সংখ্যা ৬৫টি।২৯
ইন্তিকাল :
উম্মু হাবীবা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ইন্তিকালের পরে অনেক দিন বেঁচে ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে উম্মু হাবীবা (রাঃ) আয়েশা (রাঃ)-কে ডেকে বললেন, আমাদের মাঝে সতীনের সম্পর্ক ছিল। আমাদের কোন ভুল-ত্রুটি হ’লে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করে দিন। অর্থাৎ আপনিও আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন আয়েশা বললেন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আপনাকে মুক্ত করে দিয়েছেন। উম্মু হাবীবা বললেন, আপনি আমাকে খুশি করেছেন। আল্লাহ আপনাকে খুশি করুন। তিনি উম্মু সালমার নিকটও অনুরূপ বলে পাঠান। উম্মু সালমাও ঐরূপ অভিন্ন কথা বলেন।৩০ তিনি স্বীয় ভ্রাতা মু‘আবিয়া ইবনু আবী সুফিয়ানের খিলাফতকালে ৪২ মতান্তরে ৪৪ হিজরীতে ৭৩ বছর বয়সে মদীনায় ইন্তিকাল করেন।৩১ মদীনার ‘মাকবারাহ বাবুছ ছাগীর’ নামক কবর স্থানে উম্মু সালমা আসমা বিনতু ইয়াযীদ আল-আনছারিয়ার কবরের পার্শ্বে তাঁকে সমাহিত করা হয়।৩২
উপসংহার :
উম্মুল মুমিনীন উম্মু হাবীবা (রাঃ) ছিলেন মুসলিম কন্যা-জায়া-জননীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। ইসলামের জন্য তিনি যে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অবিচলতার অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন তা সকলের জন্য অনুসরণীয়। এই মহিয়সী মহিলার জীবনী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের মাতা-ভগ্নিগণ নিজেদেরকে আদর্শ রমনী হিসাবে তৈরী করলে সমাজে দেড় হাযার বছর পূর্বের সেই সোনালী যুগের শান্তি-সুখ ফিরে আসবে। কোন মেয়ে হবে না ধর্ষিতা, হবে না এসিড সন্ত্রাসের নির্মম শিকার। এ নিপীড়িত সমাজে যৌতুকের বলি হবে না কোন মেয়ে, পিতা-মাতাও হবেন না বিবাহযোগ্য কন্যা ঘরে থাকার কারণে চিন্তিত-বিমর্ষ। অতএব আসুন! আমরা উম্মু হাবীবার ঘটনাবহুল জীবনী থেকে ইবরাত হাছিল করি এবং আমাদের জীবনকে ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজাই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
– ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
_____________________
১. ইবনু হাজার আসক্বালানী, আল-ইছাবাহ ফী তাময়ীযিছ ছাহাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, তা.বি.), পৃঃ ৮৪।
২. হাফেয শামসুদ্দীন আয-যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড (বৈরুত : মুআসসাসাতুর রিসালাহ, ৩য় প্রকাশ, ১৪০৫ হিঃ/১৯৮৫ খৃঃ), পৃঃ ২১৮-১৯।
৩. মুহাম্মাদ ইবনু সা‘দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯০ খৃঃ/১৪১০ হিঃ), পৃঃ ৭৬; অলীউদ্দীন মুহাম্মাদ আল-খাতীব আত-তাবরিযী, আল-ইকমাল ফী আসমা-ইর রিজাল (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী, তা.বি.), পৃঃ ৫৯২।
৪. আবু আবদুল্লাহ আল-হাকিম আন-নাইসাপুরী, আল-মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৪১১ হিঃ/১৯৯০ খৃঃ) পৃঃ ২২।
৫. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ৮৪।
৬. মাহমূদ শাকির, আত-তারীখুল ইসলামী, ১ম ও ২য় খন্ড (বৈরুত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৪১১হিঃ/১৯৯১খৃঃ), পৃঃ ৩৬০।
৭. আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৭৬।
৮. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২২।
৯. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২১; আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৭৭।
১০. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২০; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয, পৃঃ ১৪৫।
১১. আবুল ফিদা ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২য় খন্ড, ৪র্থ জুয (কায়রো : দারুর রাইয়ান, ১ম প্রকাশ, ১৪০৮ হিঃ/১৯৮৮ খৃঃ), পৃঃ ১৪৬।
১২. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২০।
১৩. আল-মুস্তাদরাক আলাছ ছহীহাইন, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২২-২৩; আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড, পৃঃ ৭৮-৭৯; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, ২২০-২১।
১৪. সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ জরদানী, ফাতহুল আল্লাম বিশারহি মুরশিদিল আনাম, ১ম খন্ড (কায়রো : ৪র্থ প্রকাশ, ১৪১০ হিঃ/১৯৯৯খৃঃ), পৃঃ ২৩২।
১৫. আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ৮৪; আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৩।
১৬. আত-তাবাকাতুল কুবরা ৮ম খন্ড, পৃঃ ৭৮; আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৩; আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ৮৪।
১৭. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৩; আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড পৃঃ ৭৮।
১৮. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৩; আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড পৃঃ ৭৮।
১৯. আবূদাঊদ হা/২১০৭, ‘বিবাহ’ অধ্যায়, ‘মহর’ অনুচ্ছেদ; নাসাঈ, ‘বিবাহ’ অধ্যায় ‘মহরে ন্যায়নীতি’ অনুচ্ছেদ; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২১।
২০. আত-তাবাকাতুল কুবরা, ৮ম খন্ড পৃঃ ৭৮।
২১. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২১৯।
২২. আত-তরীখুল ইসলামী, ১ম ও ২য় খন্ড, পৃঃ ৩৬০।
২৩ . ছহীহ মুসলিম হা/৬৩৫৯ ‘কিতাবুল ফাযায়িল’ ‘আবু সুফিয়ানের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ।
২৪. তালিবুল হাশেমী, মহিলা সাহাবী, অনুবাদ : আবদুল কাদের (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী, ২য় প্রকাশ, ১৯৯০), পৃঃ ৬৯।
২৫. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৩৩০, ৩৩৩১ ‘বিবাহ’ অধ্যায়, ‘ইদ্দত’ অনুচ্ছেদ।
২৬. মুসলিম, তিরমিযী, মিশকাত হা/১১৫৯।
২৭. মহিলা সাহাবী, পৃঃ ৭০।
২৮.আল-ইছাবাহ, ৪র্থ খন্ড, ৮ম জুয, পৃঃ ৮৫; সিরারু আ‘লামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২১৯।
২৯. সিয়ারু অ‘ালামিন নুবালা, ২য় খন্ড, পৃঃ ২১৯।
৩০. আল-মুস্তাদরাক, ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ২৪; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালাহ, ২য় খন্ড, পৃঃ ২২২।