মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
হামদ ও সালাতের পর!
আল্লাহর সবচেয়ে’ বড় নেয়ামত
মুজাদ্দিদে আলফেসানি রহ. বলেন, আল্লাহ তাআলার সকল নেয়ামত আপন স্থানে বড়। তবে আল্লাহর সবচে’ বড় নেয়ামত হল, মুহাম্মদ  এর অস্তিত্ব। এর দলিল হল, আল্লাহ বান্দাকে অসংখ্য নেয়ামত দিয়েছেন কিন্তু সরাসরি খোঁটা দেন নি। পক্ষান্তরে নবীজি -কে পাঠিয়ে তিনি আমাদেরকে খোঁটা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,
لَقَدْ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ
আল্লাহ ঈমানদারদের উপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছেন। (সূরা আল ইমরান ১৬৪)
এর দ্বারা বুঝা গেল, নবীজি -এর অস্তিত্বই আমাদের জন্য সবচে’ বড় নেয়ামত।
মহব্বত ও ইতাআ’ত
নবীজি  সম্পর্কে আমাদের মৌলিকভাবে দুটি কাজ করতে হয়। এক. তাঁকে মহব্বত করতে হয় পরিপূর্ণ অন্তর দিয়ে। দুই. তাঁর ইতাআ’ত বা অনুসরণ করতে হয় পরিপূর্ণ শক্তি দিয়ে। এই দুই গুণ যে ব্যক্তি বা জাতির মাঝে থাকবে, দুনিয়া আখেরাতে সফলতা তার সামনে চোখ ধাঁধিয়ে ধরা দিবে।
সাহাবায়ে কেরামের ইতিহাস দেখুন। তারা একসময় ছিলেন আইয়ামে জাহিলিয়াত তথা মূর্খতার যুগের নাগরিক। কিন্তু তাঁদের মাঝে উক্ত গুণ দুটি চলে এসেছিল। তাঁরা হয়ে ওঠলেন মানবেতিহাসের সবচেয়ে’ শ্রেষ্ঠ ও সোনালী মানুষ।
এমনিতে সাহাবায়ে কেরামের গুণ-বৈভব ছিল আকাশচুম্বি। যার বিবরণ দিতে হলে লক্ষ-কোটি পৃষ্ঠার প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু যদি এই লক্ষ-কোটি পৃষ্ঠার একটা শিরোনাম দেয়া হয় তাহলে শিরোনাম দাঁড়াবে এই- فلما أحبه القوم بكل قلوبهم أطاعوه بكل قواهم   অর্থাৎ তাঁরা নবীজিকে মহব্বত করেছেন পরিপূর্ণ অন্তর দিয়ে তাপ তাঁর ইতাআত বা অনুসরণ করেছেন পরিপূর্ণ শক্তি দিয়ে। 
আল্লাহ আমাদেরকে এই তাওফিক দান করুন। আমীন।
আল্লাহর এক আরেফ চমৎকার বলেছেন,
محمد ؐ کی محبت دین حق کی شرط اول ہے
اس میں ہو اگر خامی تو سب کچھ نامکمل ہے
মুহাম্মদ -এর প্রতি মহব্বত সত্য ধর্মের প্রধান শর্ত;
যদি এতে ত্রুটি থাকে তবে সবই অপরিপূর্ণ।
মহব্বত কাকে বলে?
এক্ষেত্রে দুটি পরিভাষা আছে। এক. মহব্বত। দুই.ইশক। মহব্বতের আতিশয্যকে বলা হয়, ইশক। আমরা নবীজি  -কে ইশক-মহব্বত করব। প্রশ্ন হল, মহব্বত কাকে বলে?  জুনাইদ বোগদাদি রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মহব্বত কাকে বলে? উত্তরে তিনি বলেন,
دخول صفات المحبوب على البدل من صفات المحب
অর্থাৎ, মহব্বতের মধ্যে দুই পক্ষ থাকে। যিনি মহব্বত করেন, তার নাম-মুহিব্ব বা আশেক। যাকে মহব্বত করা হয়, তার নাম- মাহবুব বা মা’শুক। মহব্বত বলা হয়, মুহিব্ব বা আশেক নিজের মধ্যে বিদ্যমান স্বভাবগুলোকে বিসর্জন দিবে। সেই স্থানে গ্রহণ করবে মাহবুব বা মা’শুকের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যকে। (সালওয়াতুল আ’রেফীন ১৯৮)
মুহিব্ব বা আশেক মনে করবে, আমার ইচ্ছা ইচ্ছা নয়, মাহবুবের ইচ্ছাই ইচ্ছা। আমার রুচি রুচি নয়, মাহবুবের রুচিই রুচি। আমার চাওয়া চাওয়া নয়, মাহবুবের চাওয়াই চাওয়া।
মহব্বতের এই পরিচয় সাহাবায়ে কেরামের মাঝে পরিপূর্ণ মাত্রায় ছিল। তাঁরা নিজেদের কামনা-বাসনা, আবেগ-উচ্ছ্বাস, উৎসাহ-উদ্দীপনা, রাগ-ক্ষোভ; এক কথায় সব কিছুই মাটি করে দিয়েছিলেন নবীজি -এর আনুগত্যের সামনে। একেই বলা হয়, প্রকৃত মহব্বত। এটাই প্রকৃত ভালোবাসা।
এজন্য আরেফ বিল্লাহ হাকীম আখতার রহ. বলেন, একটি লাইটের প্রতি দূর থেকে তাকালে মনে হয় যেন একটা আলোর গোলা। তার উপরে যে কাঁচ থাকে তা ওই আলোর মাঝে এমনভাবে বিলীন হয়ে যায় যে, দূর থেকে ওই কাঁচ বুঝা যায় না। অনুরূপভাবে মুহিব্ব বা আশেক তার মাহবুব বা মাশুকের মহব্বতে নিজেকে তাঁর মাঝে একেবারে বিলীন করে দেয়ার নাম মহব্বত।
ہم ترے شوق میں یوں خود کو گنوا بیٹھے ہیں
جیسے بچے کسی تہوار میں گم ہو جائیں
‘আমি তোমার মহব্বতে নিজেকে হারিয়ে বসেছি; যেমন শিশু বড় ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যায়।’
আমাদের শায়খ ও মুরশিদ মাহবুবুল ওলামা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা.বলেন, মহব্বত হল, অন্তরের একপ্রকার ঢেউ বা উচ্ছ্বাস যা মাহবুবের কাছে পৌঁছার আগ পর্যন্ত থামে না। মহব্বত হল, অন্তরের একপ্রকার আগুন যা মাহবুব পর্যন্ত পোঁছা ছাড়া নিভে না।
এজন্য আল্লাহর আরেফ বলেন,
محبت محبت کرتے ہو لیکن
 محبت نہیں جس میں شدت نہیں ہے
‘মহব্বতের দাবী সত্য নয়; যদি না থাকে আতিশয্যতা।’
মহব্বতের পথে চলতে হলে যা জানতে হয়
যে কোনো রাস্তায় চলতে হলে তার মাঝে অবস্থিত বাধা-বিপত্তিগুলো জানতে হয়। সেগুলো এড়িয়ে চলতে হয়। অন্যথায় মনজিলে মাক্সুদ পর্যন্ত পৌঁছা যায় না। মহব্বত হল, একটি রাস্তা। মাহবুব পর্যন্ত পৌঁছার রাস্তা। আশেক তার মাশুক পর্যন্ত পৌঁছার রাস্তা। এই রাস্তার মাঝে অবস্থিত বাঁধাগুলো কী কী– তা যদি জানা থাকে তাহলে এই রাস্তাটা অতিক্রম করা সহজ হবে। নবীজি  হাদিসের মধ্যে কিছু জিনিস সম্পর্কে বলেছেন, لَيْسَ مِنَّا অর্থাৎ, এটা আমাদের রাস্তা নয়। لَيْسَ مِنی  বা لَيْسَ مِنْ أُمَّتِيঅর্থাৎ, কেউ যদি এই পথে চলে তাহলে সে আমাকে মহব্বতকারী নয়। কেউ যদি এই পথে চলে তাহলে সে আমার আমার উম্মতভুক্ত নয়। সে আহ্লুস সুন্নাহ ওয়াল জা’মাত নয়।
মুহতারাম হাজিরীন! আজকের মজলিসে আমরা এজাতীয় কিছু হাদিসের আলোচনা করব– ইনশা আল্লাহ। প্রত্যেকটি হাদিস আমরা নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখব। আল্লাহ না করুন, যে স্বভাবগুলো আলোচনা করা হবে সেগুলো যদি আমাদের মাঝে পাওয়া যায় তাহলে পরিত্যাগ করার ব্যাপারে সচেষ্ট হব– ইনশা আল্লাহ। বরং আমি বলব, আমাদের অবস্থা যেন এমন হয় যেমনটি কবি বলেছেন–
میں نے فانیؔ ڈوبتی دیکھی ہے نبض کائنات
جب مزاج یار کچھ برہم نظر آیا مجھے
‘আমি তো গোটা বিশ্ব তলিয়ে যেতে কিংবা ডুবে যেতে দেখেছি; যখন দেখেছি আমার প্রিয়তম আমার কোনো ব্যাপারে নারাজ বা অসন্তুষ্ট।’
আমাদের অবস্থা যেন এমন হয়– মাহবুবকে পাওয়ার জন্য, নবীজি  পর্যন্ত পৌঁছার জন্য প্রয়োজনে নিজের মনকে শাসন করব, ইচ্ছাকে ত্যাগ করব, বিলাসিতাকে বিসর্জন দিব, অলসতাকে দূরে ঠেলে দিব, গাফলতির চাদর খুলে ফেলব, ট্রেন্ড গুঁড়িয়ে দিব; মানুষের কথায় কান দিব না, সমাজের প্রথায় মন দিব না, চোখ রাঙ্গানিকে ভয় করব না, বন্ধুদের ডাকে সাড়া দিব না তবু আমাদের প্রকৃত মাহবুবকে জয় করবই এবং যে সকল ক্ষেত্রে নবীজি  বলেছেন, لَيْسَ مِنَّا অর্থাৎ, এটা আমাদের রাস্তা নয়। لَيْسَ مِنی অর্থাৎ, কেউ যদি এই পথে চলে তাহলে সে আমাকে মহব্বতকারী নয় সে সকল কাজ বা স্বভাব যে কোনো মূল্যে ত্যাগ করবই। হে আল্লাহ, আপনিই একমাত্র তাওফিকদাতা।
যাই হোক, এসম্পর্কিত হাদিসগুলো এখন পেশ করা হচ্ছে, আমরা শোনার জন্য, বুঝার জন্য এবং আমল করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি।
১. যে আমার সুন্নতের প্রতি বিমুখ হবে…
যেমন আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেছেন,
فمنْ رغِب عَنْ سُنَّتِي فَلَيسَ مِنِّى
‘যে আমার সুন্নতের প্রতি বিমুখ হবে সে আমার উম্মতভুক্ত নয়।’ (বুখারী ৪৭৭৬)
মুহাদ্দিসিনে কেরাম বলেন, এখানে দুটি বিষয়। একটি হল, যে সুন্নতের ওপর আমল করতে পারে না তবে নিজেকে এজন্য অপরাধী মনে করে করে। এ কারণে সে মনে মনে লজ্জিত থাকে। সুফিয়ানে কেরাম বলেন, এই ব্যক্তি হল ওই আশেকের মত যে নিজের মহবুবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে না কিন্তু এর জন্য সে মনে মনে লজ্জিত থাকে। এ জাতীয় ব্যাক্তি উক্ত হাদিসের আওতায় পড়বে না।
আরেকটি হল, সুন্নত দেখতে পারে না; বরং সুন্নাতের নাম শুনলে, সুন্নাত দেখলে সে খুব বাজেভাবে রিঅ্যাক্ট করে। যেমন সে বলে, যত সব ফালতু কাজ সব দাঁড়িওয়ালারাই করে। এ জাতীয় ব্যাক্তি উক্ত হাদিসের আওতায় পড়ে যাবে। চিন্তা করে দেখুন, কেয়ামতের দিন যে লোকটিকে দেখে নবীজি  বলবেন, একে আমি চিনি না, এ আমার উম্মত নয়; তার অবস্থাটা কেমন হবে!

২. যে বড়দের সম্মান করে না…
উবাদা ইবন সামিত রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ  বলেছেন,
لَيْسَ مِنْ أُمَّتِي مَنْ لَمْ يُجِلَّ كَبِيرَنَا وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيَعْرِفْ لِعَالِمِنَا حَقَّهُ
‘সে আমার উম্মতভুক্ত নয় যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না এবং আমাদের ছোটকে স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমের হক জানে না।’ (মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/১৪)
বাবা-মাকে বেশি বিরক্ত করলে তাঁরা যেমন বলেন, ‘যা তুই এমন করলে আমি আর তোর মা বা বাবা নই’, তেমন নবীজীও বলছেন, বড়কে অশ্রদ্ধা করলে তোমরাও আমার উম্মত নও। বাবা-মার এমন কথায় যেমন আমরা তাঁদের সন্তানতালিকা থেকে বাদ পড়ি না, আমরাও তেমন নবীর উম্মত থেকে বাদ যাব না বটে। কিন্তু এটা এতই অপ্রিয় ও নিন্দনীয় কাজ যে আমি যেন এমন স্বভাব নিয়ে মহান চরিত্রবান নবীর উম্মত হবার যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলি।
ভেবে দেখুন,রাসুলুল্লাহ  গুরুজনের প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ এতই অপছন্দ করতেন যে এমন কঠিন কথা বলে আমাদের সচেতন করতে চেয়েছেন। বড়দের অসম্মান না করতে আমাদের সাবধান করেছেন। বড়কে সম্মান করার অর্থ চলাফেরা ও কথাবার্তায় তাঁদের প্রতি সম্মান বজায় রাখা। সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাঁদের অগ্রাধিকার দেয়া। কোনো কাজ করতে গিয়ে তাঁদের সামনে রাখা। পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা যানবাহনে বা সভা- সমাবেশে বড়দের জন্য আসন ছেড়ে দেওয়া। রাসুলুল্লাহ  বলেছেন, বড়দের প্রতি এভাবে আদব দেখাতে পারলে প্রকারন্তরে তুমি আল্লাহকে সম্মান করেছ।
إِنَّ مِنْ إِجْلَالِ اللَّهِ : إِكْرَامَ ذِي الشَّيْبَةِ الْمُسْلِمِ
‘বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা আল্লাহকে সম্মান করারই নামান্তর।’ (আবু দাউদ ৪৮৪৩)
প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইমাম কাজী আবু ইয়া‘লা রহ. একবার পথচলার সময় তাঁর শিষ্যকে বললেন, ‘তুমি যখন কোনো শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির সঙ্গে পথ চলবে তখন তাঁর কোন দিকে থাকবে?’ আমি বললাম, আমার তা জানা নেই। তিনি বললেন, ‘তাঁকে ইমামের স্থানে রাখবে। অর্থাৎ তুমি থাকবে ডান দিকে আর বাম দিক তার জন্য ছেড়ে দেবে। যাতে করে থুথু ফেলা বা নাক পরিষ্কারের প্রয়োজন হলে তিনি অনায়াসে বাম দিকে তা করতে পারেন।’
সুতরাং বড়দের প্রতি কতটা বিনয়ী ও শ্রদ্ধাপরায়ণ হতে হবে। কতটা ভক্তি ও সম্মান দেখিয়ে তাঁদের দো‘আ নিতে হবে। বড় যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তোমার চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্নও হন, তবুও তাঁকে ছোট করে কথা বলবে না। তাঁর সামনে ভুলেও বড়াই দেখাবে না। তুমি যদি আজ তাঁকে অশ্রদ্ধা করে মনে কষ্ট দাও, কালই কিন্তু তোমার চেয়ে ছোট কারও কাছ থেকে একই ব্যবহার পেয়ে যাবে। তখন ঠিকই বুঝতে পারবে তিনি তোমার আচরণে কেমন মর্মযাতনায় ভুগেছিলেন। বড়দের দেখে সালাম দিবে। অকারণে তাঁদের সামনে চেঁচামেচি বা শোরগোল করবে না। তাঁরা কিছু চাইলে দূর থেকে নিক্ষেপ না করে সবিনয়ে গিয়ে তোমার ডান হাত দ্বারা দিবে।  রাসুলুল্লাহ  বলেছেন,
مَا أَكْرَم شَابٌّ شَيْخاً لِسِنِّهِ إِلاَّ قَيَّضَ اللَّه لَهُ مَنْ يُكْرِمُهُ عِنْد سِنِّه
‘কোনো যুবক যদি কোনো বৃদ্ধকে তার বার্ধক্যের কারণে সম্মান করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার বার্ধক্যের সময় তাকে সম্মান করবে এমন লোক নিয়োজিত রাখবেন।’ (তিরমিযি ২০২২)
এজন্যই প্রসিদ্ধ আছে,  بی‌ادب محروم گشت از لطف رب বেয়াদব আল্লাহর ফজল ও করম থেকে মাহ্রুম হয়।
আসলে মুসলিম মানেই ভদ্র হবে, মার্জিত হবে, শিষ্টাচারপূর্ণ হবে।الـأدب هو الدين كله ভদ্রতা মানেই দীনদারি। الدين كله خلق দীনের সবটাই জুড়ে রয়েছে চরিত্রশিক্ষা।
৩. যে ছোটকে স্নেহ করে না…
উক্ত হাদিসের দ্বিতীয় অংশ ছিল, وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَاযে আমাদের ছোটকে স্নেহ করে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। কিছু লোক এমন আছে যারা ছোট বাচ্চা দেখলে ঝাড়ি মারে। ধমক দেয়। এটা ঠিক নয়। আবার অনেক অভিভাবক আছেন যারা শিশুদের সাথে কোমল আচরণ করেন না, তাদের কথাও মনোযোগ দিয়ে শোনেন না। কেবল হু, হ্যাঁ করে যান। এটাও ঠিক নয়। আলই’য়াযু বিল্লাহ, আমরা তো আমাদের নবীজী  থেকে হয়ে বড় যায় নি। তিনি তো শিশুদের ওপর রাগ করতেন না। ঝাড়ি দিতেন না। তাদের সঙ্গে কর্কশ ভাষায় কথা বলতেন না। বরং কেউ কোনো শিশুর ওপর রাগ করলে তিনি তার উপর রাগ করতেন।  তিনি ছোটদেরকে আদর করে কাছে বসাতেন। তাদেরকে চুমো দিতেন। কোলে তুলে নিতেন। এমনকি কোনো শিশু তাঁর কোলে পেশাব করে দিলেও তিনি কিছু বলতে ন না।
ছোটদের প্রতি নবীজীর ভালোবাসা
— একদিনের ঘটনা। হাদিসের একাধিক কিতাবে ঘটনাটি এসেছে। নবীজী ﷺ খেতে বসেছিলেন। কিন্তু খানা তখনও শুরু করেন নি। উম্মে কায়েস বিনতে মিহসান রাযি. তার শিশুপুত্রটিকে কোলে করে রাসূলের সাথে দেখা করতে আসলেন। শিশুটিকে দেখে নবীজী ﷺ তার দিকে এগিয়ে এলেন। পরম আদরে কোলে তুলে নিয়ে খাবারের জায়গায় গিয়ে বসলেন। শিশুটি নবীজীর আদর পেয়ে তাঁর কোলেই পেশাব করে ভিজিয়ে দিল।
এ ঘটনায় নবীজি মুচকি হাসলেন। তাঁর চেহারায় বিরক্তি প্রকাশ পেল না। তিনি পানি আনার জন্য একজনকে বললেন। পানি আনা হলে যে যে জায়গায় পেশাব পড়েছিল সেখানে পানি ঢেলে দিলেন।
একদিকে নবীজী -এর শান ও মহান মর্যাদার কথা ভাবুন, আরেকদিকে এই ঘটনাটি দেখুন। এতেই বুঝা যায়, নবীজীর হৃদয়ে ছোটদের প্রতি কী পরিমাণ মায়া ছিল!
— আনাস রাযি. নবীজীর খেদমত করতেন। আট বছর বয়স থেকে নবীজীর খেদমত করেছেন। এতটুকুন বালকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের ভুলত্রুটি হওয়া একান্তই স্বাভাবিক। কিন্তু নবীজী কখনো তার গায়ে হাত তোলেন নি, এমনকি কখনো এমন কথাও বলেননি যে, আনাস! তুমি এই কাজটি কেন করেছ, আর ঐ কাজটি কেন করনি। অথচ আমরা পানি আনতে একটু দেরি হলেই ছোট্ট কাজের ছেলে বা মেয়ের সাথে কত খারাপ ব্যবহার করি।
— হযরত আবু হুরাইরা রাযি. বলেন, নবী কারীম  তাঁর নাতি হাসানকে চুমু খেলেন। সেখানে আকরা ইবনে হাবিস রাযি. নামে এক সাহাবী বসা ছিলেন। হাসানকে চুমু খাওয়া দেখে তিনি বললেন, আমার দশটি সন্তান রয়েছে। আমি তাদের কাউকে চুমু খাই নি। নবীজী তার দিকে তাকিয়ে বললেন, مَن لا يَرحَمْ لا يُرحَمْ যে দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হবে না। (বুখারী ৫৬৫১)
— আরেক হাদিসে আছে, হজরত আয়েশা রাযি. বলেন, এক গ্রাম্যব্যক্তি নবী করিম  -এর কাছে এলো। নবীজি তাকে বললেন, তোমরা কি তোমাদের শিশুদেরকে চুমু খাও? সে বললো, ‘জী না।’ নবী করিম  বললেন, أَوَ أَمْلِكُ لَكَ أَنْ نَزَعَ اللَّهُ مِنْ قَلْبِكَ الرَّحْمَةَ ؟ তোমাদের অন্তরে যদি দয়া-মায়া না থাকে, তাহলে আমার কী করার আছে! (বুখারী ৫৬৫২)
— আমরো জানি, নবীজী -এর ঘরেও শিশু ছিল। হাসান রাযি. ও হুসাইন রাযি.। নবীজী তাঁদেরকে কেমন আদর করতেন! আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ  হাসান ও হোসাইন দুইজনকে দুই কাঁধে নিয়ে আমাদের সামনে এলেন এবং একবার এর গালে আদর করছিলেন আরেকবার ওর গালে আদর করছিলেন। এক সাহাবী বলে উঠলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি কি এদেরকে খুব ভালোবাসেন? নবীজী  উত্তর দিলেন, مَنْ أَحَبَّهُمَا فَقَدْ أَحَبَّنِي وَمَنْ أَبْغَضَهُمَا فَقَدْ أَبْغَضَنِي যে এদের ভালোবাসবে সে আমাকে ভালোবাসল, আর যে এদের প্রতি বিদ্বেষ রাখবে সে যেন আমার প্রতি বিদ্বেষ রাখল। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৯/১৮০)
— এমন ঘটনাও আছে যে, হাসান রাযি. ও হুসাইন রাযি. অনেক সময় রাসূলে কারীম -এর পিঠে চড়ে বসতেন, তাঁকে ঘোড়া বানিয়ে তারা খেলতেন। এমন চমৎকার দৃশ্য দেখে একদিন এক সাহাবী মজা করে বলে উঠলেন, نِعْمَ الْمَرْكَبُ رَكِبْتَ يَا غُلَامُবৎস! তুমি দারুণ সাওয়ারি পেয়েছ! নবীজী তখন উত্তর দিলেন, وَنِعْمَ الرَّاكِبُ هُوَ আরোহীও দারুণ! (তিরমিযী ৩৭৪৬)
নামাযের মত ইবাদতেও এমনটি ঘটত যে, নবীজী  সিজদায় গিয়েছেন আর হাসান বা হুসাইন রাযি. তাঁর পিঠে চড়ে বসেছেন। ফলে তিনি দীর্ঘ সময় সিজদায় থাকতেন। অপেক্ষা করতেন কখন তারা পিঠ থেকে নামবে। (নাসাঈ ১১৪১)
দেখুন, আর আমরা কী করি? মসজিদে কোনো বাচ্চাকে দেখলে এমন ধমক লাগাই যে, তার শিশু মনে মসজিদের ব্যাপারেই ভয় ঢুকিয়ে দেই। তখন সে মনে করে মসজিদে গেলে বড়দের ধমক খেতে হয়। অবশেষে এই শিশুটা আর নামাযের অভ্যাস করতে পারে না। এমনিতে অবুঝ শিশুকে মসজিদে নিয়ে আসা নিষেধ। একটু বুঝমান হলে তাকে মসজিদে আসার অভ্যাস করাতে হয়। কিন্তু যদি কোনো অবুঝ শিশু মসজিদে চলে আসে তাহলে তার সঙ্গে পুলিশি-আচরণ করে তার কচি অন্তরে নামাযের ব্যাপারে অনীহা সৃস্টি করা যাবে না। যদি তা করেন তাহলে لَيْسَ مِنْ أُمَّتِي সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়-এর আওতায় পড়ে যাবেন। আল্লাহ আমাদের প্রত্যককে হেফাজত করুন। আমীন।
৪. যে আমাদের আলেমের হক জানে না…
উক্ত হাদিসের শেষ অংশ ছিল, وَيَعْرِفْ لِعَالِمِنَا حَقَّهُযে আমাদের আলেমের হক জানে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। আব্দুল্লাহ ইবন মুবারক রহ. বলতেন,
مَنِ اسْتَخَفَّ بِالْعُلَمَاءِ ذَهَبَتْ آخِرَتُهُ، وَمَنِ اسْتَخَفَّ بِالْأُمَرَاءِ ذَهَبَتْ دُنْيَاهُ، وَمَنِ اسْتَخَفَّ بِالْإِخْوَانِ ذَهَبَتْ مُرُوءَتُهُ
যে ব্যক্তি আলেম-ওলামাকে ছোট করবে তার আখেরাত বরবাদ হবে, যে ব্যক্তি দুনিয়াদার নেতাদেরকে উপহাস করবে তার দুনিয়া নষ্ট হবে আর যে ব্যক্তি ভাই-বন্ধুকে হেয় প্রতিপন্ন করবে তার ব্যক্তিত্ব খাটো হয়ে যাবে।
তাঁকে নবীজীর ওয়ারিশ হিসেবে মুল্যায়ন করুন। খতিব বাগদাদী রহ. এই মর্মে একটি সুন্দর হাদিস এনেছেন, রাসুলুল্লাহ  বলেছেন,
أَكْرِمُوا الْعُلَمَاءَ فَإِنَّهُمْ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ فَمَنْ أَكْرَمَهُمْ فَقَدْ أَكْرَمَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ
তোমরা ওলামায়েকেরামকে সম্মান কর। কেননা তাঁরা আম্বিয়ায়েকেরামের ওয়ারিশ। যে ব্যক্তি তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখাবে সে যেন আল্লাহ ও তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখাল।
ওলামায়েরকেরামের সঙ্গে থাকুন
আল্লাহর বান্দারা! এজন্য বেশি বুঝার চেষ্টা করবেন না। বরং ঈমান বাঁচাতে হলে, আখেরাত ঠিক রাখতে হলে, নিজেকে গোমরাহ হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে ওলামায়েকেরামের সঙ্গে থাকুন। রাসুলুল্লাহ  বলেছেন,
الْبَرَكَةُ مَعَ أَكَابِرِكُمْ
যারা দীনের লাইনে তোমাদের চেয়ে বড়। তাঁদের সঙ্গে থাক। এর মধ্যেই বরকত। (সহিহ ইবনু হিব্বান ৫৫৯)
নবীজীﷺ وَيَعْرِفْ لِعَالِمِنَا حَقَّه,বলেছেনযে আমাদের আলেমের হক জানে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।
উম্মতের প্রতি ওলামায়েকেরামের চাইতে দরদী আর কেউ নয়
এজন্য আবারো বলছি, কথাটা অন্তরে মরণ পর্যন্ত মনে রাখবেন, আপনাদের জন্য দরদী, হিতাকাঙ্খী ওলামায়ে কেরামের চাইতে বেশি আর কেউ নয়। ইয়াহইয়া ইবনু মুয়ায রহ. বলেন, ওলামায়েকেরাম উম্মতের প্রতি আমাদের মা-বাবার চাইতেও বেশি দয়ালু। এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন, কিভাবে? তিনি উত্তর দিলেন,
  لأنَّ آباءهم وأمَّهاتهم يحفَظُونهم من نار الدنيا،والعلماء يحفَظُونهم من نار الآخِرة
কেননা, তাদের বাবা-মা তাদেরকে দুনিয়ার আগুন থেকে বাঁচিয়ে রাখে আর ওলামায়েকেরাম তাদেরকে আখেরাতের আগুন থেকে হেফাজত করে।
৫. যে ব্যক্তি বিভিন্ন মাধ্যমে ভাগ্যের ভালো-মন্দ যাচাই করে…
সম্মানিত হাজেরিন! নবীজী যাদের সম্পর্কে বলেছেন, لَيْسَ مِنَّا এরা আমাদের মধ্য থেকে নয়। তারা কারা? এই মর্মে আমরা ইতিপূর্বে চার শ্রেণীর কথা জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে আরো হাদিস আছে। একেকটি হাদিস ‘ইনশাআল্লাহ’ বলা হবে, আর আমরা মনে মনে তাওবা করতে থাকব এবং দোয়া করতে থাকবো যে, হে আল্লাহ! নবীজী যাদের ব্যাপারে বলেছেন, এরা আমাদের মধ্য থেকে থেকে নয়, আপনি আমাদেরকে সেসব হতভাগাদের অন্তর্ভুক্ত করবেন না। আমীন। যাই হোক, এব্যাপারে আরেকটি হাদিস বলা হচ্ছে, সকলেই মনোযোগ দিন।
ইমরান ইবনু হুসাইন রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ  বলেছেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَطَيَّرَ أَوْ تُطُيِّرَ لَهُ ، أَوْ تَكَهَّنَ أَوْ تُكُهِّنَ لَهُ ، أَوْ سَحَرَ أَوْ سُحِرَ لَهُ ، وَمَنْ أَتَى كَاهِنًا ، فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ ، فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ ﷺ
যে ব্যক্তি পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করলো, অথবা যার ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করার জন্য পাখি উড়ানো হল, অথবা যে ব্যক্তি ভাগ্য গণনা করলো, অথবা যার ভাগ্য গণনা করা হলো, অথবা যে ব্যক্তি যাদু করলো অথবা যার জন্য যাদু করা হলো অথবা যে ব্যক্তি কোন গণকের কাছে আসলো অতঃপর সে [গণক] যা বললো তা বিশ্বাস করলো সে ব্যক্তি মূলতঃ মুহাম্মদ ﷺ এর উপর যা নাযিল করা হয়েছে তা অস্বীকার করল। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১২০)
আরবে পাখি উড়িয়ে, তীর দ্বারা বিশেষ পদ্ধতিতে ভাগ্য গণনা করা হত। আমাদের সমাজেও রাশিফল বের করার নামে ভাগ্য নির্ণয় করার বেশ কিছু পদ্ধতি চালু আছে। জ্যোতিষী, গণক, টিয়া পাখি, বানর, সাপুড়িয়ার সাপ, সোলেমানিয়া তাবিজের কিতাব ইত্যাদির মাধ্যমে রাশিফল নির্ণয় করা হয়। কিছু পত্রিকায় তো রাশিফল নামে একটা পাতাই বরাদ্দ করে রাখে। প্রথম আলো পত্রিকা তো এজাতীয় যত শয়তানি আছে, সবগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকে। রাশিফল নামে তারা বিশেষ সংখ্যা বের করে। এসবই হারাম, কবিরা গুনাহ। এমনকি হাদিসে এটাকে শিরকও বলা হয়েছে। শিরক বলতে এখানে ছোট শিরক উদ্দেশ্য। যার দ্বারা মুশরিক হয় না, তবে এটা শক্ত কবিরা গুনাহ এবং এটা মানুষকে ধীরে ধীরে বড় শিরকের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
হাদিস শরিফে এসেছে,  রাসুলুল্লাহ  বলেছেন, কুলক্ষণ বা দুর্ভাগ্যের ধারণা যে ব্যক্তিকে তার স্বীয় প্রয়োজন, দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে দূরে রাখলো, সে মূলতঃ শিরক করলো। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, এর কাফ্ফারা কী? উত্তরে তিনি বললেন, তোমরা এ দোয়া পড়বে,
اللهم لاَ خَيْرَ إلا خَيْرُكَ وَلاَ طَيْرَ إلا طَيْرُكَ وَلاَ إِلَهَ غَيْرُكَ
হে আল্লাহ, আপনার মঙ্গল ব্যতীত কোন মঙ্গল নেই। আপানার অকল্যাণ ছাড়া কোন অকল্যাণ নেই। আরা আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। (আহমদ ৭০৪৫)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই গুনাহ থেকেও বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
৬. যে ব্যক্তি যাদু করে…
যে ব্যক্তি যে ব্যক্তি যাদু করে কিংবা যার জন্য যাদুকর অন্যের বিরুদ্ধে যাদু করে– নবীজী -এর ভাষায়; لَيْسَ مِنَّا এরা আমাদের মধ্য থেকে নয়। যাদুটোনা করা, আরেকজনের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে তাবিজ করা এসবই এর অন্তর্ভুক্ত হবে।
এমনিতে তাবিজ যদি কোরআনের আয়াত কিংবা হাদিসের কোনো দোয়ার মাধ্যমে হয় এবং অন্যের ক্ষতির উদ্দেশ্যে না হয় তাহলে এটা জায়েয আছে। আমাদের দেশে তো তাবিজের কিতাব হিসেবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বইয়ের নাম হল, সোলেমানিয়া তাবিজের কিতাব। সুলাইমান আলাইহিসসালামের দিকে নিসবত করে এর নাম রাখা হয়েছে। বইটির বিকৃত বানান বা উচ্চারণের মধ্যেই একজন নবীর সঙ্গে জঘন্য বেয়াদবি প্রকাশ পায়। উপরন্তু বইটিতে কুফরী ও শিরকি কথার অভাব নেই। অবশ্য কিছু সহিহ কথাও আছে। যাই হোক, যারা আমল করতে পারেন তাদের জন্য হল আমল। এক্ষেত্রে এটাই মূল সুন্নত। আর যারা আমল করতে সক্ষম নয় যেমন, শিশুরা আমল করতে পারে না, তাদের জন্য হল তাবিজ বা শরিয়তসম্মত ঝাড়-ফুঁক করা যেতে পারে। তবে তা হতে হবে অবশ্যই কোনো দীনদার আলেম থেকে। হিন্দু। বৌদ্ধ, মগ, চাকমা, টিপরা, কামরুকামাক্ষা এসব অমুসলিমদের থেকে তাবিজ গ্রহণ করা মানেই ছোট শিরকে জড়িয়ে পড়া। আর তা যদি হয় আরেকজনের ক্ষতির উদ্দেশ্য তাহলে এটা তো চুরির ওপর সীনাজুরি। নবীজী -এর ভাষায়; لَيْسَ مِنَّا এরা আমাদের মধ্য থেকে নয়। অনেক সময় তো মানুষকে প্রাণে মেরে ফেলার জন্যও যাদুটোনা করা হয়। এটা তো কাউকে সরাসরি মেরে ফেলার মতই আরো জঘন্য অপরাধ। এমনকি ইসলামী খেলাফত থাকলে এই অপরাধের শাস্তি হত, মৃত্যুদণ্ড। হাদিসে এসেছে, حَدُّ السَّاحِرِ ضَرْبَةٌ بِالسَّيْفِ যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তলোয়ারের আঘাতে গর্দান উড়িয়ে দেয়া। ইমাম আযম আবু হানিফা রহ ও এরকম ফতওয়া দিতেন যে, যাদুকর যদি তার যাদুটোনা দ্বারা কাউকে মরে ফেলে তাহলে তার শাস্তি হল, মৃত্যুদণ্ড।
৭. যে ব্যক্তি অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য রাখে…
সম্মানিত হাজেরিন! আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। সামনের আলোচনা ‘ইনশাআল্লাহ’ সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করা হবে। এখন এই মর্মে চতুর্থ হাদিস পেশ করা হচ্ছে, যেখানে নবীজী  বলেছেন, لَيْسَ مِنَّاএরা আমাদের মধ্য থেকে নয়। তারা কারা? রাসুলুল্লাহ  বলেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا، لَا تَشَبَّهُوا بِالْيَهُودِ، وَلَا بِالنَّصَارَى، فَإِنَّ تَسْلِيمَ الْيَهُودِ الْإِشَارَةُ بِالْأَصَابِعِ، وَتَسْلِيمَ النَّصَارَى الْإِشَارَةُ بِالْأَكُفِّ
যে ব্যক্তি অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য রাখে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। তোমরা ইয়াহূদী ও খৃষ্টানদের সাথে সদৃশ অবলম্বন করো না। কারণ ইয়াহূদীদের অভিবাদন হল, আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করা আর খৃষ্টানদের অভিবাদন হল, হাতের তালু দিয়ে ইশারা করা। (তিরমিযি ২৬৩৮)
৮. যে নারী পুরুষের সাথে এবং যে  পুরুষ নারীর সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে…
এই মর্মে আরেকটি হাদিস আছে, বিশেষ করে যুবসমাজের উদ্দেশ্যে পেশ করা হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ  বলেছেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِالرِّجَالِ مِنَ النِّسَاءِ، وَلَا مَنْ تَشَبَّهَ بِالنِّسَاءِ مِنَ الرِّجَالِ
যে সব নারী পুরুষের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং যে সব পুরুষ নারীর সাদৃশ্য অবলম্বন করে, তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। ( মুসনাদে আহমদ ২/৬৫৮০)
৯. যে ব্যক্তি প্রতারণা করে…
রাসূলুল্লাহ  একদিন স্তুপ করে রাখা খাদ্যশস্যের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি স্তুপের ভেতর হাত প্রবেশ করালে আঙ্গুলগুলো ভিজে গেল। স্তুপের মালিককে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কী? মালিক উত্তর দিল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! বৃষ্টির পানিতে তা ভিজে গিয়েছিল। নবী করীম বললেন, তবে তা উপরে রাখলে না কেন, যেন মানুষ তা দেখতে পায়? مَنْ غشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا যে প্রতারণা দেয় সে আমার দলভুক্ত নয়। (মুসলিম ১০১)
১০. যে ব্যক্তি মুসলমানের বিপক্ষে অস্ত্র ধারণ করে…
অনুরূপ আরেকটি হাদিস আছে, যেটির ওপর আমল করলে আমাদের দেশে আর কোনো সমস্যাই থাকবে না। কেননা একটা রাষ্ট্রের মূল সমস্যা হল দু’টি। দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস। আর রাসুলুল্লাহ বলেছেন,
مَنْ حَمَلَ عَلَيْنَا السِّلَاحَ ، فَلَيْسَ مِنَّا ، وَمَنْ غَشَّنَا ، فَلَيْسَ مِنَّا
সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আমাদের উপর অস্ত্র তোলে। আর যে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়। (মুসলিম ১০২)
দেখুন, এই একটি হাদিসে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি উভয়টারই সলিউশন আছে। যদি দেশের প্রত্যেক সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজ একথা চিন্তা করত যে, আমি আমার এই জাতীয় কর্মকাণ্ডের কারণে তাঁর উম্মত থেকে খারিজ হয়ে যাচ্ছি, যার সুপারিশ ছাড়া আখেরাতে নাজাতের কল্পনাও করা যায় না; তাহলে এই দেশে কোনো সন্ত্রাসী অস্ত্র পকেটে রাখার এবং কোনো দুর্নীতিবাজ জনগণের সঙ্গে দুর্নীতি করার সাহস করত না। এজন্যই ওলামায়েকেরাম বলেন, যে যত বড় মুমিম সে তত ভাল সুনাগরিক। আল্লাহ আমাদেরকে সুনাগরিক হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।
১১. মৃত্যুশোক প্রকাশে যে মহিলা বিলাপ করে কাঁদে …
এবার বিশেষত মা-বোনদের উদ্দেশ্যে একটা হাদিস। আমরা স্বাভাবিকভাবেই কারো মৃত্যুতে ব্যাথিত হই এবং আমরা কান্নাকাটি করি। এটা নিষেধ নয়। তবে অনেক সময় মহিলারা কী করে? তারা মৃতের জন্য কাঁদতে গিয়ে বিলাপ করে কান্নাকাটি করে, বুক চাপড়ায়, মুখমণ্ডলে আঘাত করে, কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। আবার অনেক পুরুষ বা মহিলা আছে শোক পালন করতে গিয়ে চুল মুণ্ডন করে ফেলে। আরো কত কী করে! এগুলো সীমালঙ্ঘন। রাসুলুল্লাহ বলেছেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ حَلَقَ وَمَنْ سَلَقَ وَمَنْ خَرَقَ
মৃত্যুশোক প্রকাশে যে মহিলা মাথা মুড়িয়ে বিলাপ করে কাঁদে এবং কাপড় ছিঁড়ে ফেলে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (আবু দাউদ ৩১৩০)
অপর হাদিসে নবীজী  বলেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ، أَوْ شَقَّ الْجُيُوبَ، أَوْ دَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ
যারা (মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশে) গালে চপেটাঘাত করে, জামার বক্ষ ছিন্ন করে বং জাহিলী যুগের মত চিৎকার দেয়, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়। (বুখারী ১২৯৭)
১২. যে ব্যক্তি মোচ কাটে না…
মুহতারাম হাজেরিন! রাসুলুল্লাহ  যে সকল হাদিসেلَيْسَ مِنَّا কিংবা لَيسَ مِنِّى বলে আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে, এটা আমার রাস্তা নয়, এরা আমাদের দলভুক্ত নয়, এরা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়, এরা আমাকে মহব্বতকারী নয়; সে সকল হাদিস আপনাদের সামনে পেশ করা হচ্ছে। আরো কিছু হাদিস আপনাদের সামনে পেশ করার উদ্দেশ্যে আমি নোট করে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আলোচনা একটু দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে বিধায় এই মর্মে এখান থেকে কিছু হাদিস এবং শুধু তরজমা পেশ করা হচ্ছে। হাদিসের আজমতের প্রতি খেয়াল রেখে আমরা পরিপূর্ণ মনোযোগটা এদিকে ধরে রাখার চেষ্টা করি এবং আল্লাহর কাছে পানাহ চাই যে, তিনি যেন আমাদেরকে এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত না করুন। আমীন।
যায়েদ ইবনু আরকাম রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ -কে বলতে শুনেছি,
مَنْ لَمْ يَأْخُذْ شَارِبَهُ فَلَيْسَ مِنَّا
যে ব্যক্তি মোচ কাটে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (তিরমিযি ২৬৫৮)
সুতরাং পুরুষেরা জেনারেলদের মত মোচ রাখবেন না। মোচ ছোট করে রাখবেন।
১৩. যে ব্যক্তি কোন স্ত্রীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে  প্ররোচিত করে …
আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেছেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ خَبَّبَ امْرَأَةً عَلَى زَوْجِهَا أَوْ عَبْدًا عَلَى سَيِّدِهِ
যে ব্যক্তি কোন স্ত্রীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে অথবা দাসকে তার মনিবের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (আবু দাউদ ২১৭৫)
১৪. যে ব্যক্তি ছিনতাই করে …
জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ  বলেছেন,
مَنِ انْتَهَبَ نُهْبَةً مَشْهُورَةً فَلَيْسَ مِنَّا
যে ব্যক্তি অন্যের মাল ছিনতাই করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (আবু দাউদ ৪৩৪০)
১৫. যে ব্যক্তি সুন্দর সূরে কোরআন পাঠ করে না…
আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْآنِ
যে ব্যক্তি সুন্দর সূরে কোরআন পাঠ করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (বুখারী৭০১৯)
অথচ আমাদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যার সুন্দর করে তেলাওয়াত করা তো দুরের কথা; বরং তেলাওয়াতই করতে পারে না কিংবা পারলেও সহিহ করে পারে না। আর এভাবেই কবরে চলে যাচ্ছে! আল্লাহর বান্দা! আল্লাহর কাছে কী জবাব দিবেন?
১৬. যে ব্যক্তি অত্যাচারী শাসকের সহযোগিতা করে…
কা‘ব ইবন উজরা রাযি. থেকে বর্ণিত যে, একদিন রাসূলুল্লাহ  হুজরা থেকে আমাদের কাছে বের হয়ে এলেন। আমরা সেখানে ছিলাম নয় জন। পাঁচজন আরব আর চারজন আনারব (বা এর বিপরীত)। তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
اسْمَعُوا هَلْ سَمِعْتُمْ أَنَّهُ سَيَكُونُ بَعْدِي أُمَرَاءُ فَمَنْ دَخَلَ عَلَيْهِمْ فَصَدَّقَهُمْ بِكَذِبِهِمْ وَأَعَانَهُمْ عَلَى ظُلْمِهِمْ فَلَيْسَ مِنِّي وَلَسْتُ مِنْهُ وَلَيْسَ بِوَارِدٍ عَلَىَّ الْحَوْضَ وَمَنْ لَمْ يَدْخُلْ عَلَيْهِمْ وَلَمْ يُعِنْهُمْ عَلَى ظُلْمِهِمْ وَلَمْ يُصَدِّقْهُمْ بِكَذِبِهِمْ فَهُوَ مِنِّي وَأَنَا مِنْهُ وَهُوَ وَارِدٌ عَلَىَّ الْحَوْضَ
তোমরা শোন, তোমরা কি শুনেছ যে আমার মৃত্যুর পরে অচিরেই এমন কিছু শাসক হবে, যারা তাদের কাছে যাবে এবং তাদের মিথ্যাচারকে সমর্থন করবে আর তাদের যুলুমে তাদের সহযোগীতা করবে তারা আমার নয় এবং আমিও তাদের নই। তারা হাওযে কাওছারে আমার কাছে পৌছাতে পারবে না। কিন্তু যারা তাদের কাছে যাবে না, তাদের যুলুমের ক্ষেত্রে তাদের সহযোগীতা করবে না এবং তাদের মিথ্যাচারের সমর্থন করবেনা তারা আমার আর আমিও তাদের, তারা হাওযে কাওছারে আমার কাছে আসতে পারবে। (তিরমিযী ২২৬২)
১৭. যে ব্যক্তি সাম্প্রদায়িকতার প্রতি মানুষকে আহবান করে…
জুবাইর ইবনু মুতই’ম থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ বলেছেন,
لَيْسَ مِنّا مَنْ دَعَا إِلَى عَصَبِيّةٍ، وَلَيْسَ مِنّا مَنْ قَاتَلَ عَلَى عَصَبِيّةٍ، وَلَيْسَ مِنّا مَنْ مَاتَ عَلَى عَصَبِيّةٍ
যে ব্যক্তি আসাবিয়াতের (সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়বাদ, গোত্রবাদ) দিকে ডাকে বা আসাবিয়াতের কারণে লড়াই-যুদ্ধ করে বা আসাবিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (আবু দাউদ ৫১২১)
যে কথাগুলো আজকের মজলিসে আলোচনা হল, আল্লাহ আমাদের সকলকে আমল করার তাওফিক দান করুন। যে কোনো অবস্থায় আমরা যেন আমাদের নবীজীর সুন্নতকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারি, আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই হিম্মত দান করুন। আমীন।
وہ مرد نہیں جو ڈر جائیں حالات کے خونی منظر سے
جس دور میں جینا مشکل ہو اس دور میں جینا لازم ہے
পরিবেশের কারণে যে ঘাবড়ে যায়, পিছিয়ে যায়, সে তো মর্দে মুমিন নয়। মর্দে মুমিন তো সে যে পরিবেশকে পাল্টে দেয়।
Top