মূল
মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর
জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী
জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী
অনুবাদ ও সম্পাদনা
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
শুরুর কথা
লৌহ-কলম-কিতাব তোমার অস্তিত্বের স্মারক…
لَوح بھی تُو قلم بھی تُو تیرا وجود الکتاب
گُنبدِ آ بگینہ رنگ تیرے محیط میں حباب
گُنبدِ آ بگینہ رنگ تیرے محیط میں حباب
شوکتِ سنجر و سلیم تیرے جلال کی نمود
فقرِ جنید و با یزید تیرا جمال بے نقاب
فقرِ جنید و با یزید تیرا جمال بے نقاب
تیری نگاہِ ناز سے دونوں مراد پاگئے
عقل و غیاب و جستجو عشق حضور و اضطراب
عقل و غیاب و جستجو عشق حضور و اضطراب
‘লৌহ-কলম-কিতাব তোমার অস্তিত্বের স্মারক
আকাশের এই স্বচ্ছতা তোমার অস্তিত্বের স্মারক
সঞ্জর ও সেলিমের শান-শওকত তোমার তেজোদীপ্ততার স্মারক
জুনাইদ ও বায়েজিদের দরবেশি তোমার সৌন্দর্যের স্মারক
তোমার দূর দৃষ্টিতে পেয়েছে মন্জিল,
এই বিবেক এই ইশক এবং এই তলব ও এই দরদ।’
পূর্ববর্তী-পরবর্তীদের সর্দার নবীকুল শিরোমনি, মুত্তাকীদের সম্রাট হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা আহমাদ মুজতাবা ﷺ-এর বরকতময় পবিত্র সত্ত্বা গোটা বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে আগমন করেছে। সেই মানবতার মহান বন্ধু যিনি সর্বত্র ব্যক্তি পূজার স্থলে আল্লাহর দাসত্ব কায়েম করেছেন। সংশয়যুক্ত বিশ্বাসকে সংশয়মুক্ত করেছেন। যিনি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রকৃতির পূজার স্থানে প্রকৃতিকে অনুগত করার শিক্ষা দিয়েছেন। রাজনীতিতে যিনি রাজতন্ত্রের পরিবর্তে জনকল্যানমুখী ধারা চালু করেছেন। যিনি কল্পনার পিছে না ছুটে বাস্তবতার দিকে ধাবিত হতে শিখিয়েছেন। সমাজে জুলুম-অন্যায়ের স্থলে ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মক্কার কুরাইশ নেতারা যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি আমাদের কাছে আসলে কী চাও?’
জবাবে তিনি বলেন,
كلمة واحدة تعطونيها تملكون بها العرب ، وتدين لكم بها العجم
‘শুধুই একটি জিনিস চাই। তা হল, তাওহিদের কালেমা পাঠ করুন। এতে করে আপনারা গোটা আরবের মালিকানা লাভের পাশাপাশি আজমের (অনারবের) ওপরও প্রাধান্য লাভ করতে পারবেন।’
অতপর সময়ই প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তিনি মানবতার শূন্য থলে সুমহান চরিত্রের মনি-কাঞ্চন দ্বারা পূর্ণ করে দিয়েছেন। মজলুম জাতিকে যাবতীয় জুলম নির্যাতন থেকে মুক্তি দিয়েছেন। গন্ড-মুর্খদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেন। পশুপালের রাখালদের মানবতার পাহারাদার বানিয়েছেন। দুনিয়ার পণ্যকে আল্লাহর সওদায় রূপান্তরিত করেছেন। আত্মপূজারীকে আল্লাহর আবেদ বানিয়েছেন। মন্দিরের পুরোহিতকে প্রভূর রাহের মুজাহিদ বানিয়েছেন। শত্রুকে মিত্রে পরিণত করেছেন। কঠোর হৃদয়ের লোকগুলোকে নম্রতা ও ভদ্রতার প্রতীক বানিয়েছেন। অলস ও অর্বাচীন মানুষগুলোকে কর্মঠ-কর্মী বানিয়েছেন …। জীবন সায়াহ্ণে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চেয়েছেন, ‘আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহ পাকের পয়গাম পূর্ণরূপে পৌঁছে দিয়েছি?’ সঙ্গে সঙ্গে একলাখ পঁচিশ হাজার সাহাবী সমস্বরে বলে উঠেছেন,
نشهد أنك بلغت الرسالة، وأديت الأمانة، ونصحت الأمة
‘নিশ্চয় নিশ্চয়। আমরা দীপ্ত কন্ঠে স্বাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আপনার প্রতি আরোপিত রেসালাতের দায়িত্ব পূর্ণরূপে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। যাবতীয় আমানত আদায় করে দিয়েছেন এবং উম্মতের কল্যাণ সাধন করেছেন।’
এমন গুণ-সৌন্দর্যের সম্রাট রাসূলের সাথে ইশক-মহব্বত তথা প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন করা ও বজায় রাখা ঈমানের প্রধান দাবী। কবির ভাষায়–
نہ جب تک کٹ مروں میں خواجۂ بطحاؐ کی حرمت پر
- خدا شاہد ہے کامل میرا ایماں ہو نہیں سکتا
نماز اچھی، حج اچھا، روزہ اچھا، زکوٰۃ اچھی
مگر میں باوجود اس کے مسلماں ہو نہیں سکتا
‘যতক্ষণ পর্যন্ত মদিনার দুলাল হযরত মুহাম্মাদ ﷺ-এর সম্মানে তাঁর ভালবাসায় জীবন বিসর্জন দিতে পারব না। আল্লাহ পাক সাক্ষী ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কামেল মুমিন হতে পারব না। আমার ঈমান পূর্ণতা পাবে না। আমার নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত সব কিছু যত সুন্দরই হোকনা কেন; এতকিছু সত্ত্বেও আমি প্রকৃত মুসলিম বলে গণ্য হতে পারব না।’
মোজাম্বিক সফরকালে জনাব মুহাম্মদ আমীন সাহেব একদিন আমাকে বললেন, ‘হযরত! আপনি তো ইশকে-এলাহী (আল্লাহপ্রেম) সম্পর্কে বই লিখেছেন। এবার ইশকে-রাসুল তথা নবীপ্রেম বিষয়ে একটি বই লিখুন। তার আদেশ পালনার্থে পর্তুগাল সফরে বিচারপতি মুসা সাহেবের বাসায় অবস্থানকালে এই বই লেখার সিংহভাগ কাজ সমাপ্ত হয়। যদিও এই বিষয়ে লেখকগণ অনেক বই লিখেছেন। তবুও সামান্য সুতা নিয়ে হযরত ইউসুফ আ.-কে কিনতে যাওয়া সেই বুড়ির মতই আমিও সেই উদ্দেশ্যে এ বিষয়ে কলম ধরেছি, যেন আল্লাহ পাক আমাকেও সেই সৌভাগ্যবানদের কাতারে শামিল করে নেন। আমার এই সামান্য প্রচেষ্টা কবুল করে কেয়ামতের দিন তিনি তাঁর শাফায়াত দান করেন। কবির ভাষায়,
وَمَا مَدَحْتُ مُحَمَّداً بِمَقَالَتِى
وَلٰكِنْ مَدَحْتُ مَقَالَتِى بِمُحَمَّدٍ
‘আমার এই রচনার মাধ্যমে আমি নবী করিম ﷺ-এর প্রশংসা করি নি। বরং হযরত মুহাম্মাদ ﷺ-এর নামে রচনা লেখার কারণে তাঁর নামের বরকতে আমার রচনা সম্মানিত ও মূল্যায়িত হয়েছে।’
رَبَّنَا لاَ تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا
‘হে আমাদের পালনকর্তা, যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা ভুল করি, তবে আমাদেরকে অপরাধী করো না।’
পরিশেষে সুধী পাঠক মহলের প্রতি বিশেষ নিবেদন রইল, এই বইয়ের কোথাও কোনো ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে সে ব্যাপারে অবগত করতে মর্জি হয়।
দোয়া করি, দোয়া চাই।
ফকির জুলফিকার আহমাদ নকশবন্দী
—————————————————————————
অধ্যায়-১
‘মুহাব্বত’ শব্দের বিশ্লেষণ
আল্লাহ তাআলা তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টির মাঝে এক ধরণের ‘চুম্বক’ তৈরি করে রেখেছেন। নি:স্প্রাণ বস্তু তথা জড়পদার্থের ক্ষেত্রে এই চুম্বককে বলা হয় ‘আকর্ষণ’ আর প্রাণীর ক্ষেত্রে বলা হয়, ঝোঁক টান বা অনুরাগ। প্রসিদ্ধ প্রবাদ রয়েছে– الجنس يميل إلى الجنس ‘প্রত্যেক শ্রেণি তার সমশ্রেণির দিকে ঝোঁকে।’ এই ঝোঁক বা অনুরাগের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে তাকে বলা হয় ‘মুহাব্বাত’। মুহাব্বাত শব্দটি ‘হাব্বাতুন’ শব্দ থেকে নির্গত। যার শাব্দিক অর্থ দানা, বীজ। আর বাস্তবতা হল, এই বীজ জমিতে বপন করলে তা মাটির নিচে লুকিয়ে যায় এবং আলো-বাতাস ও পানির পরশ পেলে চারা হয়ে গজিয়ে ওঠে। পর্যায়ক্রমে তা ফুল-ফলে ছেয়ে যায়। অনুরূপভাবে মহব্বতের বীজ হৃদয়-ভূমিতে উদগত হলে ধীরে ধীরে তা ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়ে উঠে। মনোবিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে একমত যে, কোনো প্রিয় ও কাংখিত বস্তুর দিকে হৃদয়ের আকষর্ণ সৃষ্টি হওয়াকেই মহব্বত বলে।
— ইমাম গাজালী রহ. মহব্বতের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে, ‘মহব্বত হচ্ছে, এমন বস্তুর দিকে হৃদয়ের ঝোঁক বা অনুরাগ তৈরি হওয়া যা দ্বারা মজা বা স্বাদ অর্জন হয়।’
— মোল্লা মাহমূদ কাশানীর ভাষায়, ‘মহব্বত হচ্ছে, সুন্দর কিছু লাভের জন্য ভেতরের টান অনুভূত হওয়া।’
— সাইয়্যেদ মহাম্মাদ যওকী রহ. মহব্বতর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘মহব্বত হচ্ছে একটি চুম্বকীয় আকর্ষণ, যা একে অপরকে নিজের দিকে টানে। কারও মাঝে রূপ-সৌন্দর্যের সামান্য ঝলক দেখেই তার প্রতি ঝোঁক তৈরি হওয়া। হৃদয়ে আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়া। তাকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠা। অস্থির হয়ে যাওয়া। দিন রাত তার ধ্যানে মগ্ন থাকা। তার প্রেম সাগরে হাবুডুবু খাওয়া। সামন্য বিচ্ছেদে অস্থির হয়ে যাওয়া। বারবার দর্শণ ও মিলনেও পরিতৃপ্ত না হওয়া। তার খেয়ালে নিজের খেয়াল, তার সন্তুষ্টিতে নিজের সন্তুষ্টি এবং তার অস্তিত্বের মাঝে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়া। এই সব কিছুই হচ্ছে মহব্বতের কারিশমা। মহব্বতের রাজত্ব বিশ্ব ব্যাপি। গোটা বিশ্বে প্রতিটি বস্তুই মহব্বতের শেকলে আবদ্ধ। মহব্বতই সৃষ্টিজগতের শুরু। মহব্বতই সৃষ্টি জগতের শেষ। প্রতিটি অনুপরমানুতে মহব্বতের নিদর্শন বিদ্যমান। খনিজসম্পদ, জড়পদার্থসহ যাবতীয় কিছু ‘মহব্বতের’ খাঁচায় আবদ্ধ।
–কাজী মুহাম্মাদ সুলাইমান মনসুরপুরী ‘রহমাতুল লিল আলামীন’ নামক গ্রন্থে হাদিস শরীফ والحب أ ساسي-এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, মহববত হচ্ছে হৃদয়ের শক্তি। আত্মার খোরাক। চোখের শীতলতা। শরীরের প্রাণ। অন্তরের জান। জীবনের সফলতা …। মোট কথা, মহব্বতই হচ্ছে জগতের সব কিছুু।’
এই মহব্বত থেকেই সম্পর্ক তৈরি হয়। অর্থাৎ কারও দিকে মন ঝুঁকে পড়ে। ইচ্ছাশক্তি সেই সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে দেয়ার ফলে হৃদয়ে টান ও আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। এর পর তৈরি হয় জ্বলন। সর্বদা জ্বলন। স্থায়ী জ্বলন। হৃদয়ব্যাথায় বিরহ বেদনায় জর্জরিত হয়ে যায় এবং তা বৃদ্ধি পেতে পেতে চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সর্বত্র মহাব্বতের (প্রেমের) প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হতে থাকে। দুঃখ কষ্ট সহনীয় হয়ে ওঠে। প্রতিবন্ধকতা ক্ষীন দৃষ্টিগোচর হয়। মিলনের লগ্ন ঘনিয়ে আসে। প্রিয়তমের কল্পনা ছাড়া সব কিছু খতম হয়ে যায়। এবং শুধুই প্রিয়তমের প্রেম তখন তার ওপর রাজত্ব করতে থাকে।
বিখ্যাত দার্শনিক আবু আলি ইবনু সীনা দাবী করেছেন যে, মহব্বত পৃথিবী, মহাকাশ, মহাশূণ্য, খনিজদ্রব্য, জ্বালানি, জীবজন্তু ও জড়বস্তু তথা সব কিছুর মাঝেই ছড়িয়ে আছে। এমনকি গণিতবিজ্ঞানীরা বলেন, সংখ্যাগুলোর মধ্যে ‘প্রেমিকসংখ্যা’ হয়ে থাকে। অর্থাৎ, কিছু সংখ্যা এমন আছে যেগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে।
মহব্বত কী?
কোন কোনো গবেষক বলেন, মহব্বতের সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব নয়। তার অনুভব কেবল হৃদয় দ্বারাই করা সম্ভব। তাই মহব্বতের বিদ্যমানতাই তার সংজ্ঞা। তাই বলা যায় মহব্বত হচ্ছে এক ধরণের আকর্ষণ বা আবেগ যা কেবল হৃদয় দিয়েই উপলব্ধি করা যায়। জ্ঞান-বিবেক দিয়ে নয়। এজন্যই খাজা ইয়াহইয়া মুয়াজ রাজী রহ. বলেছেন,
المحبة حالةلايعبرعنها مقالة
‘মহব্বত হচ্ছে এমন এক অবস্থা যা ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না।’
محبت حال است و حال هرگز قال نباشد
‘মহব্বত একপ্রকার হালতের নাম; যা কখনও শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা যায় না।’
তারপরও কোনো কোনো শায়েখ সালেকিনদের ফায়দার প্রতি লক্ষ রেখে মহব্বতের নানারূপ ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। যেমন–
১. জনৈক ব্যক্তি শায়েখ আবু বকর শিবলী রহ.-কে জিজ্ঞেস করে, ‘হযরত! মহাব্বত কী জিনিস?’
জবাবে তিনি বলেন,
كأس لها وهج إذا استقر في الحواس وسكن في النفوس تلاشت
‘মহব্বত এমন একটি আগুনের পেয়ালা যা ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকে। যখন তা অনুভবে জেঁকে বসে, নফসকে পেয়ে বসে তখন সে একেবারে নি:শেষ করে ছাড়ে।’ অর্থাৎ তার সমস্ত অস্তিত্ব বিলীন করে তার প্রেমাস্পদের রঙে রাঙিয়ে তোলে।
২. হযরত বায়জিদ বোস্তামী রহ. বলেন,
اَلْمَحَبَّةُ إِسْتِقْلَالُ الْكَثِيْرِ مِنْ نَفْسِكَ وَ إِسْتِكْثَارُ الْقَلِيْلِ مِنْ حَبِيْبِكَ
‘মহব্বত বলা হয় নিজের পক্ষ থেকে বেশি দিয়েও কম দিয়েছি মনে করা এবং প্রিয়তমের পক্ষ থেকে কম পেয়েও বেশি পেয়েছি মনে করা।’
এজন্যই প্রবাদে বলে, طل من الحبيب وابل প্রেমাস্পদের দিক থেকে বর্ষিত সামান্য শিশিরপাতও মুষলধার-বৃষ্টিতুল্য।
যেমন আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাকে মহব্বত করেন। যার প্রমাণ এই যে, তিনি বান্দাকে সীমাহীন নাজ-নেয়ামত দেয়ার পরও বলেছেন,
قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ‘
‘দুনিয়ার ধনম্পদ অতি সামান্য।’
পপক্ষান্তরে বান্দা যখন তাঁর যিকির করে তখন যদিও এই যিকির তাঁর শানের তুলনায় অতি তুচ্ছ, কিন্তু তিনি একে বলে দিচ্ছেন, এটা বেশি! যেমন তিনি বলেন,
وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا
‘যারা আল্লাহর বেশি যিকির করে।’
জনৈক কবি বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন যে,
گرچه اندک انعام توباشد بسیار
ورچه بسیارکنم شکر توباشد اندک
‘আপনি কম নেয়ামত দিলেও মনে হয় প্রচুর পেয়েছি; আর আপনার শোকর প্রচুর আদায় করলেও মনে হয় কম করেছি।’
৩. সাইয়েদুত তায়েফা হযরত জুনাইদ বাগদাদী রহ. বলেছেন,
دخول صفات المحبوب على البدل من صفات المحب
‘মহব্বত হচ্ছে প্রেমিকের সকল গুণ বিলীন হয়ে প্রেমাস্পদের সকল গুণ তার মাঝে চলে আসা।’
এই কথাটাই অন্য একজন একটু এভাবে বলেছেন,
اَلْمَحَبَّةُ مَحْوُ الْمُحِبِّ لِصِفَاتِهِ وَإثْبَاتُ الْمَحْبُوْبِ بِذَاتِهِ
‘মহব্বত হল প্রেমিকের সবকিছু বিলীন হওয়ার পর তার মাঝে প্রেমাস্পদের সত্ত্বা বিরাজ করা।’
যেমন, বাল্ব জলানোর পর দূর থেকে সেটিকে একটি আগুনের পিন্ড বলে মনে হয়, তার কাঁচ বা অন্য কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না। তেমনি মহব্বতের কারণে প্রেমিকের সব কিছু বিলীন হয়ে কেবল তার প্রেমাস্পদের গুণাবলী নজরে আসে।
বর্ণিত আছে, একবার কেউ একজন মজনুকে বলেছিল, ‘ঐ দেখ, লায়লা আসছে…।’
সঙ্গে সঙ্গে মজনু আচমকা বলে ওঠে, ‘আমিই তো লায়লা।’
কবির ভাষায়–
لیلی و من یکےبودیم دونمودیم
نہ بودشد آں نمود ایک شدیم
عشق وعا شق محوگردد ایں مقام
خود ہماں معشوق ماند والسلام
‘আমি আর লায়লা তো একজনই ছিলাম। কেবল দু’জন দেখা যাচ্ছিল। এই দুই দেখা যাওয়াটা বিলুপ্তির পর আমরা এক হয়ে গেছি। কেননা এমন অবস্থানে এসে ইশক ও আশেক খতম হয়ে যায়। শুধু প্রেমাস্পদ রয়ে যায়।’
৪. হযরত শায়খ আব্দুল কাদেও জিলানী রহ. বলেন,
المحبة حجابٌ بين المحب والمحبوب، فإذا فني المحبُّ عن المحبة ، وُصل بالمحبوب
‘প্রেমিক- প্রেমাস্পদের মাঝে বিদ্যমান পর্দাটাই হল ‘মহব্বত’। প্রেমিক তার প্রেমের মাঝে বিলীন হয়ে গেলে উভয়ে এক হয়ে যায়।’
জনৈক খোদা প্রেমিক বলেন- حب (প্রেম) শব্দটি দু’টি বর্ণ দ্বারা গঠিত। (ح) হা এবং (ب) বা। হা দ্বারা রুহের প্রতি আর বা দ্বারা বদনের (শরীর) প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাই যারা মহব্বতের (প্রেমের) পথে পা বাড়ায় তাদের তন-মন সব কিছু বিসর্জন দিয়ে দিতে হয়।
৫. হযরত হুসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ বলেন,
حقيقة المحبة قيامك مع محبوبك بخلع أوصافك
‘মহব্বতের হাকিকত (মূলতত্ব) হচ্ছে, তুমি নিজের গুণাবলী ছেড়ে প্রেমাস্পদের সত্ত্বায় বিলীন হয়ে যাবে।’
৬. হযরত সিররি সাকতি রহ.-এর ভাষায়,
‘মহববত হল প্রেমিক তার প্রেমাস্পদকে বলবে তুমিই আমি, অর্থাৎ একে অপরের মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়ার নামই হচ্ছে প্রেম। বা মহব্বত।
৭. হযরত আবু আব্দুল্লাহ করশী রহ.-এর ভাষায় মহব্বত হচ্ছে,
حقيقة المحبة أن تهب لمن أحببت كُلّك ولا يبقى لك منك شي
‘নিজের কাছে কিছুই না রেখে সবকিছু প্রেমিকার কাছে সমর্পন করা। এমনকি ‘তোমার’ বলতে কোনো কিছুু থাকবে না।’
যার প্রকৃষ্ট উপমা স্বয়ং হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাযি. তিনি তাঁর সমুদয় সম্পদ স্বীয় প্রেমাস্পদ হযরত মুহাম্মাদ ﷺ-এর খেদমতে পেশ করেছিলেন।
৮. হযরত আবু আলী রোদবারী রহ. মহব্বত সম্পর্কে বলেন,
ما لم تخرج من كليتك لم يدخل في حد المحبة
‘তুমি যে নাগাদ নিজের ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে না পড়বে। সে নাগাদ তুমি মহব্বতের গন্ডির মাঝে প্রবেশই করতে পারবে না।’
৯. হযরত রুওয়ায়েম রহ. বলেন,
الموافقة في جميع الأحوال يعني موافقة الحبيب في المشهد والمغيب
‘সর্বাবস্থায় প্রেমাস্পদের অনুকরণ-অনুসরণ করার নামই হচ্ছে মহব্বত বা প্রেম।’
জনৈক কবি বলেন,
وَلَوْ قُلْتَ لِي مُتْ مُتُّ سَمْعًا وَطَاعَةً
وَقُلْتُ لِدَاعِي الْمَوْتِ أَهْلًا وَمَرْحَبَا
وَقُلْتُ لِدَاعِي الْمَوْتِ أَهْلًا وَمَرْحَبَا
‘তুমি যদি বল, মরে যাও, তাহলে তোমার নির্দেশ পালনে মরে যেতে পারি। আর যমদূতকে বলতে পারি ‘খোশ আমদেদ’ স্বাগতম।’
১০. হযরত আবু বকর কাসানী রহ. বলেন,
إيثار المحبوب على جميع المصحوب
‘মহব্বত (প্রেম) হল, সবকিছুর ওপর প্রেমিকাকে প্রাধান্য দেয়া।’
১১. খাজা ইয়াহইয়া মুয়াজ রহ.-এর ভাষায়,
حقيقة المحبة أنها لا تزيد بالبر ولا ينقص بالجفاء
‘মহব্বতের হাকিকত হচ্ছে, প্রেমিকার পক্ষ থেকে জুলুম-অন্যায়ের কারণে তা একটুও কমবে না এবং ভাল ব্যবহার আর উপঢৌকনের কারণে বিন্দুমাত্রও বৃদ্ধি পাবে না। অর্থাৎ সর্বাবস্থায় তা একই রকম থাকবে।’
১২. হযরত শিবলী রহ.-কে পাগল মনে করে কারাগারে পাঠানো হয়। কয়েকজন ব্যক্তি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কারা?’ জবাবে তারা বলে, ‘আমরা আপনার বন্ধু।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাদের লক্ষ করে পাথর ছুঁড়ে মারতে লাগলে তারা ছুটে পালাতে শুরু করে। তখন তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘হে আমার বন্ধুত্বের দাবীদারগণ! তোমরা যদি প্রকৃত বন্ধুই হতে তাহলে বন্ধুর পক্ষ থেকে সামান্য আঘাতে ভয়ে পলায়ন করতে না।’
এই বিষয়কেই জনৈক কবি তার ভাষায় এভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন,
بلا از دوست عطاست و از بلا نالیدن خطاست
‘বন্ধুর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত কষ্টটাও এক অমূল্য উপঢৌকন। আর বন্ধুর উপঢৌকন-অনুদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া চরম ধৃষ্টতা। মহা অন্যায়।’
تو از جفا وستم برمن آنچه خواهی کن بکن
که من نه کنم دامنت رها اے دو ست
‘হে বন্ধু! তুমি যত ইচ্ছা আমার প্রতি দুঃখ-যাতনা চালিয়ে যাও, আমি কোনোক্রমেই তোমার আচঁল ছেড়ে দিব না। কারণ তোমার কাছ থেকে পাওয়া সবকিছুই আমার জন্য অমূল্য উপহার।’
১৩. জনৈক আল্লাহপ্রেমিক বলেছেন,
من سكر بكأس المحبة لا يصحو إلا بمشاهدة محبوبه
‘প্রেমের সুধাপানে যে ব্যক্তি মাতোয়ারা সে কেবল প্রেমাস্পদের সান্নিধ্য লাভেই চৈতন্য ফিরে পেতে পারে।’
১৪. উল্লেখিত যাবতীয় সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার সারাংশ হযরত শিবলী রহ.-এর উক্তির মাঝে বিদ্যমান। তিনি বলেন,
المحبة إيثا رما يحب المحبوب وإن كرهت
وكراهة ما يكره المحبوب وإن أحببت
‘মহব্বতের আসল অর্থ হচ্ছে প্রেমাম্পদ যা কিছু পছন্দ করে তার সবকিছুই তোমারও পছন্দ করা যদিও তা তোমার অপ্রিয় হয়। আর প্রেমাম্পদ যা কিছু অপছন্দ করে সেগুলোকে তোমারও অপছন্দ করা যদিও সেগুলো তোমার অতি প্রিয় হয়।’
১৫. এই পর্যায়ে এসে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে,
اَلْمَحَبَّةُ مَحْوُ الْمُحِبِّ لِصِفَاتِهِ وَإثْبَاتُ الْمَحْبُوْبِ بِذَاتِهِ
‘মহব্বত হচ্ছে ,প্রেমিক তার নিজস্ব সব কিছু বিসর্জন দিয়ে প্রিয়তমের সব কিছু সাদরে বরণ করে নিবে।’
১৬. এই ফকিরের নিকট মহব্বত তথা প্রেম হচ্ছে, এমন এক অস্থিরতা যা প্রেমাস্পদের সান্নিধ্যলাভ ছাড়া প্রশমিত হয় না। এটি এমন এক আগুন যা প্রেমাস্পদের দর্শন ছাড়া শীতল হয় না। জনৈক প্রেমিক সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে- সে একদিন নির্জনে অতি উচ্চস্বরে কাঁদছিল আর চিৎকার করে করে বলছিল, ‘আগুন! আগুন!! আগুন!!!’ লোকজন ছুটে এসে দেখে সেখানে আগুনের কোনো নাম-নিশানাও নেই। তখন তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কই, কোথায় আগুন লেগেছে?’ তখন সে তার দু’হাত স্বীয় বুকে রেখে বলে ওঠে, ‘এই যে এই এখানে আগুন লেগেছে …।’
نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ
‘এটা আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত অগ্নি, যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে।’
তাই বলা যায় প্রেমিকের যে অসুস্থতা প্রিয়তমের পরশে বিদূরীত হয়ে যায় সেটাই মহব্বত। তাকেই বলে প্রেম। এটি এমন পিপাসা, যা কখনও নিবারণ হবার নয়। কবির ভাষায়,
شَرِبْتُ الْحُبَّ كَأْسًا بَعْدَ كَأْسٍ
فَمَا نَفِدَ الشَّرَابُ وَمَا رَوِيتُ
‘আমি একের পর এক প্রেমের পেয়ালা পান করে চলেছি। কিন্তু না কখনও সেই প্রেমের সুধা শেষ হয়েছে না আমার তৃষ্ণা নিবারণ হয়েছে …।’