সৃষ্টিতে হাত দিয়ে, বদলে দিয়ে বসে আছে মানুষ,
আমরা আজো ধর্মের নামে কাটাছেঁড়া করি
-----
একটা প্রাণীর জেনেটিক কোডে যখন পরিবর্তন করা হয়, তখন সৃষ্টিতে হাত দেয়া হয়ে যায়।
এখন এমন অসংখ্য প্রাণী, উদ্ভিদ ও জীবাণু আছে, যেগুলোর গায়ে অন্য প্রাণীর/উদ্ভিদের/জীবাণুর জিন ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিষয়টা এমন: প্রতিটা জীব মূলত কোষ দিয়ে তৈরি। প্রতিটা কোষের আছে কেন্দ্র। প্রতিটা কোষকেন্দ্রে ওই জীবের সমস্ত জৈবিক বৈশিষ্ট্য লেখা থাকে, কোড আকারে।
মজার ব্যাপার হল, মানুষের এই জিন-লেখনী যেমন চারটা প্রকৃত অক্ষর দিয়ে (সরলার্থে) লেখা থাকে, ঠিক তেমনি একটা বটগাছেরও। সেই একই চার অক্ষর দিয়ে লেখা। অর্থাৎ চারটা ভিন্ন ভিন্ন যৌগ দিয়ে।
এখন, সাধারণত, প্রতিটা প্রাণ তো প্রথমে শুরু হয় এক কোষ থেকে। প্রত্যেক প্রাণী বা উদ্ভিদের প্রথমে একটা কোষই থাকে। সেটাই লক্ষ লক্ষ কোটি কোষে পরিণত হয়। আলাদা আলাদা অঙ্গে আলাদা আলাদা কাজে লেগে পড়ে।
যেহেতু অক্ষর মিলে যাচ্ছে, তাই বটগাছের বা বক পাখির বা কুমিরের কিছু দৈহিক বৈশিষ্ট্য মানুষের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া শুধু যে সম্ভব তাই না, বহু বহুবার এই ধরনের কাজ করা হয়েছে (মানুষের ক্ষেত্রে না, অন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষেত্রে)।
অসংখ্যবার।
হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষবার। মানুষের সাথে হওয়াটা অমানবিক, কিন্তু অন্য জীব ও জড়’র সাথে ঠিকই হয়েছে।
প্রশ্ন হল, ফলাফল কি ফলেছে? কুমিরের বৈশিষ্ট্য বটগাছে বা এমন কিছু? অনেক ক্ষেত্রেই ফলেছে। এটাও অসংখ্যবার।
এমনকি এর ফলে কোন কোন প্রাণীর কিছু জৈবিক, প্রাকৃতিক, খোদায়ি বৈশিষ্ট্যকে পুরোপুরি কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে। কোন কোনটায় একেবারে বদলে দেয়া হয়েছে।
কখনো ভেবেছি কি,
লেয়ার মুরগির ডিম থেকে লেয়ার মুরগির ফার্ম কেন করতে পারি না? ব্রয়লার মুরগির ডিম নিয়ে ব্রয়লার মুরগির ফার্ম নিজে কেন করতে পারি না?
কেন বাচ্চা কিনতে হয়?
কারণ, কোম্পানিগুলো ওই ডিম বা ওই মুরগিগুলো থেকে পরবর্তী প্রজন্ম জন্মানোর জিন কেটে বাদ দিয়েছে।
কখনো ভেবেছি কি,
যে মুরগি ৩ বছরে দেড় কেজি হবার কথা, সেটা ২১ দিনে কীভাবে হয়? শুধু কি খাবারের গুণে? শুধু কি অষুধের গুণে? শুধু কি হাইব্রিড (বড়’র পর বড়’র প্রজন্ম ক্রস) এর গুণে?
নাহ। এদের জিন থেকে যেমন বংশ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপাদান বাদ দেয়া হয়েছে, তেমনি এদের জিনে (ওই চার অক্ষরের অসংখ্য কোডে) এমন কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে, যার ফলে তারা এমনটা ফল দেয়।
এবার ভাবুন,
আমাদের শরীরের প্রতিটা কোষ গত পনের বিশ বছরের বেশি সময় ধরে গড়ে উঠেছে এমন একটা প্রাণীর মাংসে,
যে প্রাণী,
আল্লাহ্’র প্রি-সেট প্রাণী নয়, বরং তার সৃষ্টির মূল জায়গায় হাত দিয়ে মানুষ বদলে দিয়েছে, আর সেই বদল খেতে খেতে আমাদের দেহ তৈরি হয়েছে।
ভাবুন,
পৃথিবীজুড়ে গোল্ডেন রাইস খাওয়ানোর কথা।
একটা জীবাণু, ব্যাক্টেরিয়ার কোষেও জিন আছে, ধানগাছের কোষেও আছে। এখন, ধানগাছের কোষে জীবাণুর ওই জৈবিক গুণটাকে যুক্ত করা হয়েছে। কারণ, গোল্ডেন রাইসে ভিটামিন এ আছে। সেটা ধানের গুণে নয়, বরং জীবাণুর সত্ত্বার গুণে! এই চালটাকে আমরা কী বলব, জীবাণু, নাকি চাল? সে তো দুটাই!
এই ভিটামিন এ ৬ লাখ ৭০ হাজার বাচ্চার অকালে মারা যাওয়া ঠেকাবে, বিজ্ঞানীদের হিসাব।
২০০৫ সালে আরেক গোল্ডেন রাইস হল, আরো গবেষণা করে, যেটায় ২৩ গুণ বেশি ওই গুণ আছে!
তেরো বছর দুটা কোম্পানির যৌথ গবেষণা হয়। তারা সাদা গোলাপের প্রতিটা কোষের যে মূল উপাদান, জিন, সেটা বদলে দিয়ে নীলচে গোলাপ এনেছে। পৃথিবীতে কখনো প্রাকৃতিক নীলচে গোলাপ ছিল না, কিন্তু এখন ‘প্রাকৃতিক’ নীলচে গোলাপ মানুষ তৈরি করেছে! হ্যা, যে গোলাপটা নিজেও নীল, তার বংশও হবে নীল!
জেলিফিশের গা থেকে বেরোয় সবুজ আলো।
জেলিফিশের সেই জীবসত্ত্বা কোষ লেভেলে যুক্ত করে এখন সবুজ আলোর বিড়াল বানানো হয়েছে। সবুজ ইঁদুর বানানো হয়েছে।
এটা কি জেলি ফিশ, নাকি বিড়াল?
এমন তো না, আল্লাহ্ গজব পাঠিয়ে বিনাশ করে দিয়েছেন, সৃষ্টিতে হাত দিলি কেন! এমন তো না, আমরা জাতিসংঘ সদরদপ্তর অবরোধ করে পৃথিবীতে খেলাফত কায়েম করে ফেলেছি, তবু সৃষ্টিতে হাত দিতে দেইনাই!
মানুষ অলরেডি ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলেছে লক্ষ লক্ষবার।
এইটা কি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির সময়?
এইটা কি ওযুর মাসআলায় ভিন্ন ভিন্ন ফিরকায় বেটে যাবার সময়?
এইটা কি ভিনদেশি বা ভিনধর্মীকে মানুষও মনে না করার সময়?
আমরা যত আনরিজনেবল লুক নিয়ে আসব নিজেদের ভিতরে, তত বেশি পৃথিবীর মানুষ দলে দলে আমাদের ছুঁড়ে ফেলবে। কারণ তাদের চোখে, যারা রিজনেবল ভাবতে জানে না, তারা সঠিক ধর্মই হতে পারে না।
এরা জেলিফিশ আর বিড়ালকে এক করে নতুন মাছ-পশু বানিয়ে ফেলল, জীবাণু আর চালকে এক করে নতুন উদ্ভিদাণু বানিয়ে ফেলল, তাও অনেক আগে, বোরিং হয়ে গেছে-
আমরা ধর্মবিশ্বাসটা একটু অ্যাডজাস্ট করতে পারলাম না!
সহনশীলতা অ্যাডজাস্ট করতে পারলাম না!
এদের ওপর বোমা মারলাম, আমরা টিকব কীভাবে?
কিন্তু কীভাবে বানিয়ে ফেলল?
ফেলেছে, কারণ, প্রতিটা মানুষ সত্ত্বাগতভাবে আল্লাহ্’র সৃষ্ট সেই একই মানুষ। একজন মুসলিমের ভিতরে যে মেধা ও গুণ, একজন ‘কাফিরের’ ভিতরেও সেই মেধা ও গুণ। কারণ তা মানুষের গুণ। আর মানুষ সৃষ্টির সময় আল্লাহ্ বলেছিলেন, আমি পৃথিবীতে খলিফা সৃষ্টি করছি।
আল্লাহ্’র খলিফা-ক্যাটাগরির ক্ষমতা নিয়ে যারা এসেছে, তারা ‘মোমেন’ হোক বা ‘কাফের’, দৈহিক-মানসিক-বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা নিয়ে তো এসেছে, তাই না?
আল্লাহ্’র খলিফা আল্লাহ্’র সৃষ্টিতে হাত দিবে না তো দিবে কে?
ভাবুন,
এই সময়ে আমাদের পদক্ষেপগুলোর লেভেল কোথায় থাকার কথা, ধার্মিক হিসাবে আমরা কোথায় পদক্ষেপ নিচ্ছি? চিন্তা কোথায় থাকার কথা, চিন্তা কোথায় আছে? সক্রিয়তা কোথায় থাকার কথা, সক্রিয়তা কোথায় আছে!
আমরা, ধার্মিক ও বিশ্বাসীরা,
অলরেডি এক্সপায়ার্ড। তারচে বেশি এক্সপায়ার্ড আমাদের কান, কারণ সে শুনতেও পায়নি যে আমরা অলরেডি অগ্রহণযোগ্য আচরণ করে পুরো পৃথিবীর কাছে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে নিজেকে আল্লাহ্’র অপ্রতিনিধি হিসাবে, সম্পূর্ণ
অগ্রহণযোগ্য হিসাবে ইতোমধ্যে প্রমাণ করে বসে আছি।
(ব্যক্তিগত কথা: সূফিরা যদি বলে, সব আমি, সব আমার ভেতর, সব আমার সাথে মিশতে পারে, ওই বটগাছ আর ওই ঘাস আর ওই পাখি আর আমার মধ্যে আসলে কোন তফাত নেই- তখন কুফর হয়, আর বিজ্ঞানীরা প্র্যাক্টিক্যালি বানিয়ে বসে আছে তখন আমাদের জাতিসংঘ অবরোধ নাই!)
উত্থান হোক ছাইয়ের ভেতর থেকে,
বিজ্ঞানীরা লক্ষ লক্ষ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ম্যামথ ফিরিয়ে আনার যে চেষ্টা করছে, বাস্তবতা বলে, তারা সেটা পারবে।
তারা যদি সেটা পারে,
আমরাও ধর্মের মধ্যে আধ্যাতিকতা, সেবা, এবং সবচে বড় কথা, সময়োপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে রিজনেবল-প্র্যাক্টিক্যাল-গাইডিং লুক এনে প্রায় বিলুপ্ত ধর্ম-ম্যামথের একটা পুনর্জন্ম দিতে পারব।