বৃক্ষরোপণের ফজিলতঃ
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
إِنَّ اللهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوَى يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَمُخْرِجُ الْمَيِّتِ مِنَ الْحَيِّ ذَلِكُمُ اللهُ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ... وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ نَبَاتَ كُلِّ شَيْءٍ فَأَخْرَجْنَا مِنْهُ خَضِرًا نُخْرِجُ مِنْهُ حَبًّا مُّتَرَاكِبًا وَّمِنَ النَّخْلِ مِنْ طَلْعِهَا قِنْوَانٌ دَانِيَةٌ وَّجَنَّاتٍ مِّنْ أَعْنَابٍ وَّالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُشْتَبِهًا وَّغَيْرَ مُتَشَابِهٍ انْظُرُوا إِلٰى ثَمَرِه إِذَا أَثْمَرَ وَيَنْعِه إِنَّ فِي ذٰلِكُمْ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يُّؤْمِنُوْنَ.
‘নিশ্চয় আল্লাহ শস্যবীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী। তিনি প্রাণহীন বস্তু হতে প্রাণবান বস্তু নির্গত করেন এবং তিনিই প্রাণবান বস্তু হতে নিষ্প্রাণ বস্তুর নির্গতকারী। হে মানুষ! তিনিই আল্লাহ। সুতরাং তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করে কোন্ অজ্ঞাত দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?...আর তিনিই ঐ সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, তারপর আমি তা দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদের চারা উদগত করেছি, তারপর তা থেকে সবুজ গাছপালা জন্মিয়েছি, যা থেকে আমি থরে থরে বিন্যস্ত শস্যদানা উৎপন্ন করি এবং খেজুর গাছের চুম্রি থেকে (ফল-ভারে) ঝুলন্ত কাঁদি নির্গত করি এবং আমি আঙ্গুর বাগান উদগত করেছি এবং যায়তুন ও আনারও। তার একটি অন্যটির সদৃশ ও বিসদৃশও। যখন সে বৃক্ষ ফল দেয়, তখন তার ফলের প্রতি ও তার পাকার অবস্থার প্রতি গভীরভাবে লক্ষ কর। এসবের মধ্যে সেই সকল লোকের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা ঈমান আনে।’ [সূরা আনআম (৬) : ৯৫, ৯৯]
قُلِ الْحَمْدُ لِلهِ وَسَلامٌ عَلٰى عِبادِه الَّذِينَ اصْطَفٰى آللهُ خَيْرٌ أَمَّا يُشْرِكُونَ ، أَمَّنْ خَلَقَ السَّمٰواتِ وَالْأَرْضَ وَأَنْزَلَ لَكُمْ مِنَ السَّماءِ مَاءً فَأَنْبَتْنَا بِه حَدائِقَ ذاتَ بَهْجَةٍ، مَا كانَ لَكُمْ أَنْ تُنْبِتُوْا شَجَرَهَا أَإِلٰهٌ مَّعَ اللهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ يَّعْدِلُوْنَ.
‘বল, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই এবং সালাম তাঁর সেই বান্দাদের প্রতি যাদেরকে তিনি মনোনীত করেছেন। বল তো, আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, নাকি যাদেরকে তারা আল্লাহর প্রভুত্বে অংশীদার বানিয়েছে তারা? তবে কে তিনি যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন? তারপর আমি সে পানি দ্বারা উদগত করেছি মনোরম উদ্যানরাজি। তার বৃক্ষরাজি উদগত করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না...।’ [সূরা নামল (২৭) : ৫৯-৬০]
এ আয়াতের শেষে বান্দাকে আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, বান্দা! এ বৃক্ষরাজি উদগত করার ক্ষমতা তোমার নেই। এ আমি উদগত করি। এ আমার দান। সুতরাং আমারই শুকরিয়া আদায় কর।
বৃক্ষরোপণকারীর জন্য সদকায়ে জারিয়াঃ
❏ হাদিস ১ :
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন,
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا، أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا، فَيَأْكُلُ مِنْهُ طَيْرٌ أَوْ إِنْسَانٌ أَوْ بَهِيمَةٌ، إِلَّا كَانَ لَهُ بِه صَدَقَةٌ.
যখন কোনো মুসলিম গাছ লাগায়, অথবা কোনো ফসল বোনে, আর মানুষ, পাখি বা পশু তা থেকে খায়, এটা রোপণকারীর জন্য সদাকা হিসেবে গণ্য হয়।
(সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩২০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৫৩)
❏ হাদিস ২ :
আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, যদি কোনো মুসলিম বৃক্ষ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে, মানুষ কিংবা চতুষ্পদ প্রাণী খায়, তাহলে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে। [বোখারি ২৩২০; মুসলিম ৪০৫৫]
❏ হাদিস ৩ :
আরেক বর্ণনায় এসেছে “কিয়ামত পর্যন্ত (অর্থাৎ যতদিন গাছটি বেঁচে থাকবে বা তা থেকে উপকার গ্রহণ করা হবে) সে গাছ তার জন্য সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে গণ্য হবে।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৫২)
❏ হাদিস ৪ :
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا إِلَّا كَانَ مَا أُكِلَ مِنْهُ لَهُ صَدَقَة، وَمَا سُرِقَ مِنْهُ لَهُ صَدَقَةٌ، وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ مِنْهُ فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ، وَمَا أَكَلَتِ الطَّيْرُ فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ، وَلَا يَرْزَؤُهُ أَحَدٌ إِلَّا كَانَ لَهُ صَدَقَةٌ.
মুসলিম যখন কোনো গাছ রোপণ করে, তো এর যে ফল খাওয়া হবে এটা তার জন্য সদাকা হিসেবে গণ্য হবে। এ থেকে যা চুরি যাবে তাও সদাকা হিসেবে গণ্য হবে। হিংস্র প্রাণীও যদি তা থেকে খায় তাও সদাকা হবে। পাখি খেলে সদাকা হবে। (এমন কি) যে কেউ যে কোনোভাবে এ থেকে (উপকার) গ্রহণ করবে তা সদাকা হিসেবে গণ্য হবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৫২)
❏ হাদিস ৫ :
মহানবী (ﷺ) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বৃক্ষরোপণ করে তা ফলদার হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্যা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি ফল যা নষ্ট হয়, তার বিনিময়ে আল্লাহপাক তাকে সদকার নেকি দেবেন’ [মুসনদে আহমদ: ১৬৭০২]।
❏ হাদিস ৬ :
مَا مِنْ رَجُلٍ يَغْرِسُ غَرْسًا إِلَّا كَتَبَ اللهُ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ قَدْرَ مَا يَخْرُجُ مِنْ ثَمَرِ ذَلِكَ الْغِرَاس.
কোনো ব্যক্তি যখন গাছ লাগায়, তো এ গাছে যত ফল হবে, তার আমলনামায় এ ফল পরিমাণ সওয়াব লেখা হবে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৫২০)
❏ হাদিস ৭ :
عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ، أَنَّ رَجُلًا، مَرَّ بِهِ وَهُوَ يَغْرِسُ غَرْسًا بِدِمَشْقَ فَقَالَ لَهُ : أَتَفْعَلُ هَذَا وَأَنْتَ صَاحِبُ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَقَالَ : لَا تَعْجَلْ عَلَيَّ سَمِعْتُ، رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: " مَنْ غَرَسَ غَرْسًا لَمْ يَأْكُلْ مِنْهُ آدَمِيٌّ، وَلَا خَلْقٌ مِنْ خَلْقِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ إِلَّا كَانَ لَهُ صَدَقَةً.
হযরত আবু দারদা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি গাছ লাগাচ্ছিলেন, এমন সময় তার পাশ দিয়ে এক ব্যক্তি যাচ্ছিলো। তাঁকে গাছ লাগাতে দেখে লোকটি বলে উঠলো, আপনি রাসূলের সাহাবী হয়ে গাছ লাগাচ্ছেন! তখন আবু দারদা (رضي الله عنه) তাকে বললেন, একটু শুনে যাও; আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)কে বলতে শুনেছি, যখন কেউ গাছ লাগায়, আর তা থেকে কোনো মানুষ বা কোনো প্রাণী খায়, এটা তার জন্য সদাকা হিসেবে গণ্য হয়। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৭৫০৬)
❏ হাদিস ৮ :
আরেক বর্ণনায় আবু দারদা (رضي الله عنه)-এরই একটি ঘটনা এভাবে এসেছে, (যা শরহুস সুন্নাহয় বাগাভী রাহ. আরেক বর্ণনার অধীনে পেশ করেছেন)
আবু দারদা (رضي الله عنه) একটি ফলগাছ লাগাচ্ছিলেন, এক ব্যক্তি তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। সে বলল, আপনি তো অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে, আপনি কেন এ গাছ লাগাচ্ছেন? এ গাছে ফল হতে হতে তো অনেক বছর লেগে যায়। তখন উত্তরে তিনি বললেন, এতে কী সমস্য? এর ফল অন্য মানুষ খাবে কিন্তু আমি তো এর সওয়াব পেয়ে যাবো। (শরহুস সুন্নাহ, বাগাভী, বর্ণনা ১৬৫২-এর অধীনে)
❏ হাদিস ৯ :
নবীজী (ﷺ) ইরশাদ করেন,
إِنْ قَامَتْ عَلَى أَحَدِكُمُ الْقِيَامَةُ، وَفِي يَدِهِ فَسِيلَةٌ فَلْيَغْرِسْهَا.
যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগ মুহূর্তেও তোমাদের কারো হাতে একটি চারাগাছ থাকে, তাহলে সে যেন তা রোপণ করে দেয়।
(মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৯০২; আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৪৭৯)
বিনা প্রয়োজনে বৃক্ষ নিধনের শাস্তিঃ
❏ হাদিস ১০ :
প্রিয় নবী মুহাম্মদ (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবে’ (আবু দাউদ: ৫২৪১)।
❏ হাদিস ১১ :
অপর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,
مَنْ قَطَعَ سِدْرَةً صَوَّبَ اللَّهُ رَأْسَهُ فِي النَّارِ.
যে ব্যক্তি কোনো বড়ই গাছ কাটবে আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
❏ হাদিস ১২ :
আবু দাউদ রাহ.-কে এ হাদীসের অর্থ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন,
এ হাদীসের বক্তব্যটি সংক্ষিপ্ত। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যে ব্যক্তি অকারণে বা না-হকভাবে মরুভূমির কোনো বড়ই গাছ কাটবে, যেখানে পথিক বা কোনো প্রাণী ছায়াগ্রহণ করে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২৩৯)
তবে কেউ কেউ বলেন, এ হাদীস হরম অঞ্চলের বড়ই গাছ কাটার সাথে সম্পৃক্ত। তো যাইহোক অকারণে গাছকাটা যে নিজেদের ক্ষতি ও সওয়াব থেকে মাহরূমি উপরের আলোচনায় আশা করি তা স্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং আমরা বেশি বেশি গাছ লাগাব, অকারণে গাছ কাটব না।
তবে কোনো গাছ এমন স্থানে অবস্থিত হয় যার জন্য মানুষের চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটে, ঘর-বাড়ির ক্ষতি হয় এবং মানুষের দরকারে কাটার প্রয়োজন হয়, তাহলে গাছ কাটতে কোনো নিষেধ নেই।
❏ হাদিস ১৩ :
আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘আমি এক ব্যক্তিকে দেখেছি জান্নাতে সে ওই গাছের ছায়ায় চলাচল করছে যা সে রাস্তার মোড় থেকে কেটেছিল, যা মানুষকে কষ্ট দিত (মুসলিম: ৫৮৩৭)।
জান্নাতে পুরষ্কারঃ
❏ হাদিস ১৪ :
নবীজী (ﷺ) এর প্রিয় সাহাবী গাছ লাগাচ্ছিলেন, তিঁনি তাঁকে প্রতিদানও বলে দিয়েছেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ بِهِ وَهُوَ يَغْرِسُ غَرْسًا، فَقَالَ : يَا أَبَا هُرَيْرَةَ، مَا الَّذِي تَغْرِسُ؟ قُلْتُ : غِرَاسًا لِي، قَالَ : أَلَا أَدُلُّكَ عَلَى غِرَاسٍ خَيْرٍ لَكَ مِنْ هَذَا؟ قَالَ: بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ : " قُلْ : سُبْحَانَ اللَّهِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ، يُغْرَسْ لَكَ بِكُلِّ وَاحِدَةٍ شَجَرَةٌ فِي الْجَنَّةِ "
হযরত আবু হুরাইরা (رضي الله عنه) একদিন গাছ লাগাচ্ছিলেন। এমন সময় নবীজী পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, আবু হুরাইরা! কী লাগাচ্ছো? তিনি বললেন, একটি চারা রোপণ করছি। নবীজী বললেন, আমি কি তোমাকে এর চেয়ে উত্তম রোপণের কথা বলে দেব? আবু হুরায়রা বললেন, আল্লাহর রাসূল! অবশ্যই বলুন। তখন নবীজী (ﷺ) বললেন, বল,
سُبْحَانَ اللَّهِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ، وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ.
এর প্রতিটির বিনিময়ে জান্নাতে তোমার জন্য একটি করে গাছ লাগানো হবে।
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৮০৭)