বউ-শ্বাশুড়ির সমস্যা ঘনীভূত হওয়া: সাইকোঅ্যানালাইসিস-৪
-----
(আগের পর্ব থেকে চলছে)
৭.
হয়তো দু একটা জিনিস শাশুড়ি বলে দিলেন, দু একটা বকাঝকা ধমক দিলেন, বাপের বাড়ি ছেড়ে আসা মেয়েটা এক্কেবারে শামুকের মত গুটিয়ে গেল। তবু হয়তো সে কাজ করছে, করার চেষ্টা করছে দুপুরবেলা এসে দিনের পর দিন। ঝামেলা বাঁধল অন্যখানে:
শাশুড়ি ‘জন্মের’ পর থেকে যেখানে লবণের কৌটা রাখেন, এই ‘নবাবিনী’ মেয়ে তো সেখানে না রেখে অন্যখানে রেখেছে! তিনি তো হাজার খুঁজেও গরম মসলার কৌটা পাচ্ছেন না, এই মেয়ে এই ঢকে আলু কাটে কেন? এইভাবে পেঁয়াজ কাটলে না তরকারিতে রোয়া রোয়া রয়ে যাবে?
ঠিক এই সময়টায় শাশুড়ি টের পান,
এই মেয়ে এসে যা-ই কাজ করছিল না, তা তো ভালই ছিল। এখন তার পরিচিত দুনিয়ার সব যে ধ্বসে যাচ্ছে! তিনি ত্রিশ বছর ধরে যেখানে গুঁড়া হলুদ রাখেন সেখানে এখন তো পান না। যেভাবে মাছের টুকরা করেন, এ তো সেভাবে করে না! এর রান্না খেলে তো মনে হয় রাস্তার ধারের হোটেলে খেয়ে উঠলেন, নিজের বাসাকে তো নিজের বাসাই মনে হয় না!
এই মেয়ে তো কাজ করে আরো বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।
তিনি তার নিজের হাতে তিলে তিলে গড়া সংসারকে চিনতে পারছেন না, নিজের লবণের কৌটার মত সবচে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটাও জায়গামত পাচ্ছেন না আর লবণে পানি পানি হল কী করে? লবণ পানি পানি হয়ে গেলে ঘেন্না লাগে না এই মেয়ের? এর সমস্যা কী?
৮.
এবার শাশুড়ির মিশন চেঞ্জ।
তিনি এবার আর এই মেয়েকে কোন কাজে হাত দিতে দিবেন না। সে তাঁর ‘আজন্ম’ সংসারের চিত্র একেবারে বদলে দিচ্ছে!
সুতরাং তিনি আর রান্নাঘরে তাকে ঢুকতে দিবেন না।
কনে তো রান্নাঘরে ঢুকতে না পেরে কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, কারণ এইসব আগুনের আঁচে থেকে তার কোনদিনই অভ্যাস ছিল না, এবার সে একটু নিজের মত থাকতে পারবে। আবার অস্বস্তিও বোধ হয়, তিনি তো বরের মা। তিনি কাজ করছেন আমি করছি না...
৯.
এবার শাশুড়ির আপনজনদের কাছে রাক্ষসীর ‘রাক্ষসী’ পরিচয় তুলে ধরার পালা।
কারণ তিনি আগে কাজ করতেন যতজনের জন্য, এখন করেন আরো বেশি মানুষের জন্য। ছেলের বউতো যুক্ত হয়েছেই, ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে বউয়ের বাড়ির লোকজনও আসছে, আসছে বউয়ের বান্ধবীরাও বেড়াতে, আসছে ছেলের কলিগ বন্ধুরাও বেড়াতে- বিয়ের পরের দাওয়াত আরকী।
না তো করতেই পারেন না, এটা নিজের ফ্যামিলির সম্মানের বিষয়, নিজের ছেলের সম্মানের বিষয়। আবার এই কাজ করে তিনি তো কুলাতে পারেন না!
কিন্তু এই মেয়ের তো ভ্রুক্ষেপ নেই। এখনো না ঠিকমত কাজ করতে আসে, আর এলেও এমনভাবে কাজ করে যেন তাকে কাজ করতে না দেয়া হয়।
তিনি এতদিন নিজের স্বামী সন্তানের জন্য জীবন নষ্ট করেছেন, এখন এই বয়সে ছেলের বউ আর বেয়াই বেয়ানকে খাইয়ে মরবেন?
এই কষ্ট তিনি কার সাথে শেয়ার করবেন? নিজের মেয়েদের সাথে, কাজের মেয়ের সাথে, নিজের পাড়াপ্রতিবেশী মহিলাদের সাথে, নিজের বোনদের সাথে, জা-ননদদের সাথে। বলে মনকে হালকা করেন। যা সত্য তাই বলেন। মেয়ে তো কাজ করে না। নিজেরটাও করে না, নিজের স্বামীরটাও করে না। দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়। ইচ্ছা হল, একটু কাজ করতে এল, এমনভাবে রান্নাঘর উলটপালট করে দিবে যে আমার সাত জনমের শাস্তি হল। ভালমন্দ একটা কিছু বললে ভূতের মত মুখ করে থাকে। কেনরে, তুই কি ভূত বাড়ির মেয়ে নাকি? বাপমা কাজ তো শিখাতে পারেনি, ভূত হওয়া শিখিয়েছে?
এখন শ্বাশুড়ি তো সবাইকে বলে নিজের মনও হালকা করলেন, আবার এই ‘রাক্ষসী-ডাইনি’ টার সামাজিক অবস্থানও নড়বড়ে করলেন। তা তো করতেই হবে। সে যে এই সংসারে ভিন্ন সরকারব্যবস্থা প্রচলন করতে নিয়েছিল, লবণের পাত্র ভিন্নদিকে রাখছিল- তিনি কি আর তা সইবেন? পেটের ছেলে যখন শত্রু হয়েছে, তখন তিনি কেন এই ‘রাক্ষসী’র হাতে নিজের গড়া সংসার অন্যরকম হয়ে যেতে দেখবেন? বরং সে যেন সংসারে নতুন সরকারব্যবস্থা পত্তন করতে না পারে, যেন নিজের ডালপালা ছড়িয়ে বসতে না পারে, সেই ব্যবস্থাই না তিনি করবেন। আর সংসারে ডালপালা বিছিয়ে প্রভাব তৈরি করতে না দেয়া মানে হল কাজের মেয়ের চোখে তাকে ছোট করে তোলা। কাজের মেয়ে যদি তাকে পাত্তা না দেয়, ননদ যদি তাকে পাত্তা না দেয়, পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন যদি তাকে খেলো মনে করে, তবেই না ‘রাক্ষসী’ একটু ঠান্ডা থাকবে।
১০.
কিন্তু ফল হল ভিন্ন।
ঘরের বৌ যাই কিছু কথা সহ্য করছিল, তার বাবা-মা বিষয়ে বলার পর আর সে তো সহ্য করবে না। তার বাবা মা তো এমন না। তার বাবা মা তাকে খাটিয়ে মারেনি বলে বাবা মায়ের এত দোষ?
সে তার বাবা মায়ের অপমানের কথা স্বামীকেই বলবে।
বলবে, কেমন করে তার শ্বাশুড়ি তাকে সিস্টেম করে রেখেছে।
কাজ করতে নিলে করতে দেয় না।
করতে না নিলে করে না বলে।
করতে নিলে এবং সফলভাবে কোন কাজ করলে বাবা মা কী শিখিয়েছে বাপ মা তুলে সেসবই বলে।
এ পর্যন্ত নাহয় সওয়া যায়।
তাই বলে কাজের মেয়েকে দিয়ে অসম্মান অপমান করাবে? কাজের মেয়েকে কিছু বললেই মুচকি মুচকি হাসে।
বলে, ‘আমি পারব না।’
বলে, ‘খালাম্মা নিষিদ করসে।’
পাড়া প্রতিবেশীরা, আত্মীয় স্বজনরা যারা বউ বলতে মাথায় তুলে রেখেছিল প্রথম দুই তিন মাস, তারা এখন খালি আকারে ইঙ্গিতে এসব বলে। চোখেমুখে রেসপেক্টও নাই, স্নেহও নাই।
সে কি বাবা মায়ের সংসার ছেড়ে আসেনি?এখন সে কোথায় যাবে, সবার চোখে তো তাকে খারাপ বানিয়ে ছাড়ল শ্বাশুড়ি। এখন সে কোথায় কোন্ সংসার করবে? তার যাবার জায়গা কোথায়?
সে বউ, সে তো আর বলতে পারে না, শ্বাশুড়ি মায়ের সমান, অপমান তো করতে পারে না, দু:খ করে স্বামীকে বলল। স্বামী যেন আবার মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার না করে।
১১.
এবার ছেলের চোখে মায়ের হিমালয়-সম ইমেজের চূড়ান্ত পতন।
এই নাকি মা! এর পায়ের তলায় বেহেস্ত? এমন বেহেস্তের কী দরকার?
এই প্রথম মায়ের সাথে গলা উঁচিয়ে চরম অভদ্র ভাষায় ছেলে কথা বলে ফেলল।
আর যায় কোথায়, মায়েরও ছেলের জন্য চক্ষুলজ্জাটা থাকলো না। পুরোটাই যাবে আবারো বউ ও তর বাপ-মায়ের উপর দিয়ে।
১২.
এইভাবে শীত-গ্রীষ্ম গড়াতে না গড়াতে সন্তানের মা হল বৌ।
এতদিন এখানে সে ছিল খড়কুটোর মত। এক স্বামী ছাড়া এই সংসারে তার কোন স্থায়িত্ব ছিল না। কোন পরিচয় ছিল না। কোন স্বীকৃতি ছিল না।
এইবার এখানে তাকে টলায় কে? রাণি তো সে নিজেও। প্রমাণ তো শ্বাশুড়ির আদরের নাতি বা নাতনি।
এবার বৌ সমানতালে জবাব দেয়া এবং সিস্টেম করা শুরু করল। সিস্টেম করা তো সে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন ননদ কাজের মেয়ে এবং চূড়ান্তে শ্বাশুড়ির কাছ থেকেই শিখেছে।
এখন তাকে কে টলায় দেখি!
১৩.
এই এক ধাক্কায় এক দুই দশক নরকে নরকে কেটে গেল। শ্বাশুড়ি বৃদ্ধা হলেন ‘কাজ করতে করতে’, বউ বৃদ্ধা হলেন ‘কাজ না করতে না করতে’, স্বামীর মাথার চুল পাকলো ‘সব দেখতে দেখতে’ এবং ঘরের সন্তান মেনে নিল, এটাই দুনিয়া। সুখ ফুখ নীতিকথা এগুলো ফালতু কথা।
আমরা কিন্তু এই নরকের বৃত্ত ভাঙতে পারি।