বিবাহিত ছেলের মা: সাইকোঅ্যানালাইসিস-৩
-----
মায়েরাই ছেলেদের বিয়ে দিতে বেশি আগ্রহী থাকেন, এমনকি ছেলের চেয়েও বেশি, কারণ:
১. তিঁনি চান সংসারে তাঁর একান্ত আপন একজন সহযোগী আসুক। মানসিক।
২. কাজ করতে করতে তাঁর জীবন অতীষ্ট হয়ে গেছে, তাঁর কাজের ভাগও একজন এসে একটু নিক। তিঁনি অনেক ভার বহন করেছেন, এবার তাঁর কিছু কিছু হলেও অবসর দরকার।
৩. মায়েরা চান, ছেলের জীবনে আরো শৃঙ্খলা আসুক। নিশ্চিন্ততা আসুক।
৪. অন্তত ছেলের ব্যক্তিগত জীবনের কাজগুলো এবং ছেলের চলাফেরার সময়ের যে সহযোগিতাগুলো দরকার, সেগুলো গুছিয়ে যাক।
৫. তৃতীয় প্রজন্ম (নাতি-নাতনি)’র প্রতি তৃষ্ণা প্রবল এক বিষয়।
সাধারণত মায়েরাই ছেলের বউ পছন্দ করে নিয়ে আসেন। এমনকি, সাধারণত ছেলের পছন্দের কেউ থাকলে সে বিয়ের আগে ছেলের চেয়েও মায়ের বেশি পছন্দের হয়ে যায়।
কিন্তু বিয়ের পর তিনি এমন কিছু অবস্থার মুখোমুখি হন যেটা তিনি কখনো ভাবেননি:
১. লক্ষ্য করে তাকানো:
ছেলের কাছে মায়ের অবস্থান ছিল দেবপ্রতীম। মায়ের মুখের দিকে ছেলে তাকালে পূর্ণ চোখ মেলে তাকাতো। যখনি মা ঘরে ঢুকতেন, তখনি ছেলে মায়ের দিকে সারা দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে তাকাতো। এখন সে মায়ের দিকে খেয়াল করে তাকায়ও না।
ভেবে দেখুন তো, আপনারা আমরা সবাই এই কাজ করেছি কিনা বিয়ের পরপর? সর্বনাশটা ছেলেরা ওখানেই করেছে।
২. আর ওইযে আলগা ব্যক্তিত্ব্য!
ব্যক্তিত্ব্যের ঠেলায় বেশিরভাগ ছেলেই যাকে তাকে অবহেলা করে সেটা আবার স্পষ্ট করে বুঝিয়েও দেয়।
এই কাজটা প্রায় প্রত্যেক সন্তান তার মায়ের সাথে করে, কারণ উঠতে বসতে দেখা তো মায়ের সাথেই হচ্ছে।
ছেলে যখন মা’কে অসম্মান করে বসে, অপমানজনক কোন কথা বা আচরণ করে বসে, তখন মায়ের ভুবন টলে যায়। মা তখন রাতে ঘুমাতে পারেন না, দিনে ঠিকমত কাজ করতে পারেন না, কাজ করে শান্তি পান না, না পারেন সইতে, না পারেন কইতে।
৩. ফলাফল, মা তখন লক্ষ্য করা শুরু করেন ছেলে ও ছেলের নতুন বউয়ের আচরণ। এখন ছেলেকে তো আর সামনে পাওয়া যায় না সব সময়, পাওয়া যায় এই নতুন মেয়েটাকে। তার উপর, নিজের পেটের ছেলেকে তিনি আর কী রাগ করবেন, এই ছেলে কি কোনদিন এমন খারাপ ছিল? খারাপ না হল এই নতুন রাক্ষসী ঘরে আসার পর থেকে। হায়, নতুন রাক্ষসী যে এসবের কিছুই জানে না! সে খারাপ বানাবে কখন, পরিস্থিতির চাপে নিজের ছেলেই যে খোলসের ভিতরে ঢুকে গেছে এবং নানা ভুল বোঝাবুঝি পুষে যাচ্ছে মনে! আচরণ করছে সেই অনুযায়ী!
৪. তখনি তার চোখে পড়ে, নতুন বউ তো সকালে উঠে রান্নাঘরে কাজ করছে না। তিনি মা মানুষ, তিনি আজীবন অমানুষিক কষ্ট করে গেছেন, ঘরে বউ এসেছে- এখনো কি তিনি কষ্ট করে যাবেন?
আর অপরদিকে নতুন বউ তো প্রায় কখনোই ভোরে উঠে কাজ করতে পারবে না। কারণ, প্রথমত সে ভোরে উঠে অভ্যস্তই নয়, সে তার বাবার বাসায় ছিল আদরের কন্যা। দুদিন পর শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, তার আর ভোরে ওঠার দরকার কী। আর নববিবাহিত জীবনে ভোরে ওঠাও সম্ভব না।
৫. শাশুড়ির যে এক্সপেক্টেশন থাকে, যে বেসিকেরও বেসিক কাজগুলো নতুন বউ করবে বলে তিনি আশা করেন, সেগুলোর কোনটাই দেখতে পান না। তাঁর চোখে সংসারে কাজ আর কাজ, তার নতুন বউয়ের চোখে কোন কাজই পড়ে না।
কারণ,
ক. এর একটা কারণ নতুন বউ শ্বশুরবাড়িতে চলাফেরা করতেই অস্বস্তিবোধ করে।
খ. সে বাড়ি ছেড়ে এসেছে। এবং এ বাড়িকে নিজের বাড়ি করে নিতে চাচ্ছে। চিরদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে আসাটার যন্ত্রণা ও ব্যথা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। একটা নববিবাহিত মেয়ের এই যন্ত্রণা কাটিয়ে উঠতেই কমপক্ষে কয়েক মাস সময় লেগে যায়, এবং এই কয়েক মাসের মধ্যেই শাশুড়ির এক্সপেক্টেশনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।
গ. আসলে সে কখনোই সংসারে যে কাজগুলো আছে সেগুলো দায়িত্ব নিয়ে করতে অভ্যস্ত ছিল না। তাকে তার মা কখনোই সংসারের কাজের দায়িত্ববোধের ট্রেনিং দেয়নি এবং সাধারণত স্নেহময়ী মায়েরা তা করেনও না। ফলে, একটা মেয়ে বাবার বাড়িতে যেমন সব ঠিক চলতে দেখে এসেছে, এখানেও সব ঠিক চলতে দেখে তফাত টের পায় না। কিন্তু এই ঠিক চলাটা যে চলছে শাশুড়ির কষ্টের বিনিময়ে, এটা চোখে পড়তে অনেক সময় কেটে যায়।
৬. নতুন বউ ভোরে রান্নাঘরে ঢোকেনি, দুপুরের রান্নার জন্য ঢুকেছে।
মায়ের মনে রাগ। এখন এসেছে কাজ বাগাতে! আমি কাজ করি সেটা দেখাতে! অথচ সবচে কষ্ট ছিল ভোর থেকে দুপুরের আগের কাজটা! রান্না, রান্না প্রস্তুত, ঘর ঝাড়ু দেয়া, বিছানাপত্র ঝাড়া, বাসা থেকে বেরুতে থাকা প্রত্যেকের প্রত্যেকটা বিষয় নিশ্চিত করা। দুপুর তো বিশ্রামের সময়, আর এখন সে এসেছে কাজ দেখাতে!
ফলে শ্বাশুড়ি লক্ষ্য করা শুরু করেন তার কাজের দক্ষতা- যেহেতু আগে থেকেই রেগে আছেন, এবার তার চোখে পড়ে, মেয়ে তো তরকারিতে লবণও দিতে জানে না, চুলা কতটুকু জ্বালাতে হবে তার কিছুই জানে না, পানি কতটুকু দিতে হবে তাও জানে না, মাছ মাংসের ময়লাটা কী করে আলাদা করে রাখতে হয় তাও জানে না, এ জানে টা কী?
জানে না তো করবে টা কী?
‘কাজ করি,’ দেখাতে এসেছে এখানে?
সমস্যা ঘনীভূত হবে পরের ধাপগুলোতে...