নামাযের ৭টি ফরয


 (১) তাকবীরে তাহরীমা, (২) কিয়াম করা, (৩) কিরাত পড়া, (৪) রুকূ করা (৫) সিজদা করা (৬) কা’দায়ে আখিরা বা শেষ বৈঠক, (৭) খুরুজে বিসুনইহি (সালামের মাধ্যমে নামায শেষ করা) । (গুনিয়াতুল মুসতামলা, ২৫৩ থেকে ২৮৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত) 


 (১) তাকবীরে তাহরীমা: মূলতঃ তাকবীরে তাহরীমা (অর্থাৎ প্রথম তাকবীর) নামাযের শর্তসমূহের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু নামাযের আভ্যন্তরিন কার্যাবলীর সাথে সম্পূর্ণরূপে সম্পৃক্ত, তাই সেটিকে নামাযের ফরয সমূহের মধ্যেও গণ্য করা হয়েছে। (গুনিয়াতুল মুসতামলা, ২৫৩ পৃষ্ঠা) (১) মুক্তাদী “তাকবীরে তাহরীমা” এর শব্দ “اَللهُ” ইমামের সাথে বললো, কিন্তু “اَكْبَرُ” ইমামের পূর্বে শেষ করে নিলো তবে তার নামায হবে না। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৬৮ পৃষ্ঠা) (২) ইমামকে রুকূতে পেল, আর সে তাকবীরে তাহরীমা বলতে বলতে রুকূতে গেলো অর্থাৎ তাকবীর এমন সময় শেষ হলো যে, হাত বাড়ালে হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছে যাবে, এমতাবস্থায় তার নামায হবে না। (খুলাসাতুল ফতোওয়া, ১ম খন্ড, ৮৩ পৃষ্ঠা) (অর্থাৎ এ সময় ইমামকে রুকূতে পাওয়া অবস্থায় নিয়মানুযায়ী প্রথমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমা বলে নিন এরপর اَللهُ اَكْبَرُ বলে রুকূ করুন। ইমামের সাথে যদি সামান্যতম মুহুর্তের জন্যও রুকূতে অংশগ্রহণ করতে পারেন তবে আপনার রাকাত মিলে গেলো আর যদি আপনি রুকূতে যাওয়ার পূর্বেই ইমাম সাহেব দাঁড়িয়ে যান তবে রাকাত পাওয়া হলো না। (৩) যে ব্যক্তি তাকবীর উচ্চারণে সক্ষম নয় যেমন-বোবা বা অন্য যে কোন কারণে যার বাকশক্তি বন্ধ হয়ে গেছে, তার জন্য মুখে তাকবীর উচ্চারণ করা আবশ্যক নয়, তার অন্তরের ইচ্ছাই যথেষ্ট। (তাবঈনুল হাকাইক, ১ম খন্ড, ১০৯ পৃষ্ঠা) (৪) اَللهُ শব্দকে اٰللهُ অর্থাৎ আলিফকে টেনে বা اَكْبَرُ কে اٰكْبَرُ অর্থাৎ আলিফকে টেনে অথবা اَكْبَرُ কে اَكْبَارُ অর্থাৎ ب কে টেনে পড়লো তবে নামায হবে না বরং যদি এগুলোর ভুল অর্থ জেনে বুঝে বলে তবে সে কাফির হয়ে যাবে। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ১৭৭ পৃষ্ঠা) নামাযীর সংখ্যা বেশি হওয়া অবস্থায় পিছনে আওয়াজ পৌঁছানোর জন্য যেসব মুকাব্বিরগণ তাকবীর বলে থাকেন, সেসব মুকাব্বিরদের অধিকাংশই জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে আজকাল اَكْبَرُ কে اَكْبَارُ অর্থাৎ ب কে দীর্ঘ টান দিয়ে বলতে শুনা যায়। এর ফলে তাদের নিজের নামাযও ভঙ্গ হয়ে যায় এবং তার আওয়াজ সে সব লোক নামাযের রুকন আদায় করে (অর্থাৎ কিয়াম থেকে রুকূতে যায়, রুকূ থেকে সিজদাতে যায় ইত্যাদি) তাদের নামাযও ভঙ্গ হয়ে যায়। এ জন্য না শিখে কখনো মুকাব্বির হওয়া উচিত নয়। (৫) প্রথম রাকাতের রুকূ পাওয়া গেলো, তাহলে ‘তাকবীরে ঊলা’বা প্রথম তাকবীরের সাওয়াব পেয়ে গেলো। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৬৯ পৃষ্ঠা) 


 (২) কিয়াম করা বা দাঁড়ানো: (১) কিয়ামের নিম্নতম সীমা হচ্ছে যে, হাত বাড়ালে হাত যেন হাঁটু পর্যন্ত না পৌঁছে আর পূর্ণাঙ্গ কিয়াম হচ্ছে সোজা হয়ে দাঁড়ান। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ১৬৩ পৃষ্ঠা) (২) ততটুকু সময় পর্যন্ত কিয়াম করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত কিরাত পাঠ করা হবে। যতটুকু পরিমাণ কিরাত পড়া ফরয ততটুকু পরিমাণ দাঁড়ানোও ফরয। যতটুকু পরিমাণ ওয়াজীব ততটুকু পরিমাণ কিরাত ওয়াজীব এবং যতটুকু পরিমাণ কিরাত সুন্নাত ততটুকু পরিমাণ দাঁড়ান সুন্নাত। (প্রাগুক্ত) (৩) ফরয, বিতর, দুই ঈদ এবং ফযরের সুন্নাতে দাঁড়ানো ফরয। যদি সঠিক কারণ (ওজর) ব্যতীত কেউ এসব নামায বসে বসে আদায় করে, তবে তার নামায হবে না। (প্রাগুক্ত) (৪) দাঁড়াতে শুধু একটু কষ্টবোধ হওয়া কোন ওযরের মধ্যে পড়ে না বরং কিয়াম ঐ সময় রহিত হবে যখন মোটেই দাঁড়াতে পারে না অথবা সিজদা করতে পারে না অথবা দাঁড়ানোর ফলে বা সিজদা করার কারণে ক্ষতস্থান থেকে রক্ত প্রবাহিত হয় অথবা দাঁড়ানোর ফলে প্রস্রাবের ফোটা চলে আসে অথবা এক চতুর্থাংশ সতর খুলে যায় কিংবা কিরাত পড়তে যতক্ষণ সময় লাগে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে অক্ষম হয়। এমনি দাঁড়াতে পারে কিন্তু তাতে রোগ বৃদ্ধি পায় বা দেরীতে সুস্থ হয় বা অসহ্য কষ্ট অনুভব হয় তাহলে এ সকল অবস্থায় বসে পড়ার অনুমতি রয়েছে। (গুনিয়াতুল মুসতামলা, ২৫৮ পৃষ্ঠা) (৫) যদি লাঠি দ্বারা খাদিমের সাহায্যে বা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয় তবে এ অবস্থায়ও দাঁড়িয়ে নামায আদায় করা ফরয। (গুনিয়াতুল মুসতামলা, ২৫৮ পৃষ্ঠা) (৬) যদি শুধুমাত্র এতটুকু দাঁড়াতে পারে যে, কোন মতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমা বলতে পারবে তবে তার জন্য ফরয হচ্ছে দাঁড়িয়ে اَللهُ اَكْبَرُ বলা। এরপর যদি দাঁড়ানো সম্ভব না হয় তাহলে বসে বসে নামায আদায় করা। (গুনিয়াতুল মুসতামলা, ২৫৯ পৃষ্ঠা) (৭) সাবধান! কিছু লোক সামান্য কষ্টের (আঘাতের) কারণে ফরয নামায বসে আদায় করে, তারা যেন শরীয়াতের এ আদেশের প্রতি মনোযোগ দেয় যে, দাঁড়িয়ে আদায় করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও যত ওয়াক্ত নামায বসে বসে আদায় করা হয়েছে সবগুলো পুনরায় আদায় করে দেওয়া ফরয। অনুরূপভাবে এমনি দাঁড়াতে পারে না, তবে লাঠি বা দেয়াল কিংবা মানুষের সাহায্যে দাঁড়ানো সম্ভব ছিলো কিন্তু বসে বসে পড়েছে তাহলে তাদের নামাযও হয়নি। তা পুনরায় পড়ে নেয়া ফরয। (বাহারে শরীয়াত, ৩য় অংশ, ৬৪ পৃষ্ঠা) ইসলামী বোনদের জন্যও একই আদেশ। তারাও শরীয়াতের অনুমতি ব্যতীত বসে বসে নামায আদায় করতে পারবে না। অনেক মসজিদে বসে নামায আদায় করার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা রয়েছে। অনেক বৃদ্ধলোক দেখা গেছে এতে বসে ফরয নামায আদায় করে থাকে, অথচ তারা পায়ে হেঁটে মসজিদে এসেছে, নামাযের পর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাবার্তাও বলে, এমন সব বৃদ্ধ লোক যদি শরীয়াতের অনুমতি ব্যতীত বসে নামায আদায় করে থাকে তবে তাদের নামায হবে না। (৮) দাঁড়িয়ে নামায আদায় করার সামর্থ থাকা সত্ত্বেও নফল নামায বসে আদায় করতে পারবে, তবে দাঁড়িয়ে আদায় করা উত্তম। যেমনিভাবে- হযরত সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ ইবনে আমর رَضِیَ اللّٰہُ تَعَالٰی عَنْہُ থেকে বর্ণিত; রহমতে আলম, নূরে মুজাস্সাম, শাহে বনী আদম صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: “বসে নামায আদায়কারী দাঁড়িয়ে আদায়কারীর অর্ধেক (অর্থাৎ অর্ধেক সাওয়াব) (পাবে) । (সহীহ মুসলিম, ১ম খন্ড, ২৫৩ পৃষ্ঠা) অবশ্য অসুবিধার (অক্ষমতার) কারণে বসে পড়লে সাওয়াবে কম হবে না। বর্তমানে সাধারণভাবে দেখা যাচ্ছে, নফল নামায বসে পড়ার প্রথা চালু হয়ে গেছে। বাহ্যিকভাবে এটা বুঝা যাচ্ছে যে, হয়ত বসে নামায আদায় করাকে উত্তম মনে করছে। এমন অনুমান করা একেবারে ভুল। বিতরের পর যে দুই রাকাত নফল পড়া হয় উহারও একই হুকুম যে, দাঁড়িয়ে পড়াটা উত্তম। 


 (বাহারে শরীয়াত, ৪র্থ খন্ড, ১৭ পৃষ্ঠা) 


 (৩) কিরাত: (১) কিরাত হলোসমস্ত অক্ষরসমূহ তার মাখরাজ (উচ্চারণের স্থান থেকে) আদায় করার নাম, যেন প্রত্যেক অক্ষর অন্য অক্ষর থেকে পৃথকভাবে বুঝা যায় ও উচ্চারণও বিশুদ্ধ হয়। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৬৯ পৃষ্ঠা) (২) নীরবে পড়ার ক্ষেত্রে এতটুকু আওয়াজে পড়া আবশ্যক যে, যেন নিজে শুনতে পায়। (গুনিয়াতুল মুসতামলা, ২৭১ পৃষ্ঠা) (৩) আর যদি অক্ষরগুলো বিশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করেছে, কিন্তু এত নিম্নস্বরে পড়েছে যে, নিজের কানেও শুনেনি অথচ এ সময় কোন অন্তরায় যেমন- হৈ চৈও ছিলো না, আবার কান ভারী (অর্থাৎ বধির) ও নয় তবে তার নামায হলো না। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৬৯ পৃষ্ঠা) (৪) যদিও নিজে শুনাটা জরুরী তবে এটার প্রতিও এতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক যে, নীরবে কিরাত পড়ার নামাযগুলোতে যেন কিরাতের আওয়াজ অন্যজনের কানে না পৌঁছে, অনুরূপভাবে তাসবীহ সমূহ আদায় কালেও এ বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। (৫) নামায ব্যতীত যেসব স্থানে কিছু বলা বা পড়াটা নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানেও এর দ্বারা এটা উদ্দেশ্য যে, কমপক্ষে এমন আওয়াজ হয় যেন নিজে শুনতে পায়। যেমন-তালাক দেয়া, গোলাম আযাদ করা অথবা জন্তু যাবেহ করার জন্য আল্লাহ্ তাআলার নাম নেয়া। এসব ক্ষেত্রে এতটুকু আওয়াজ আবশ্যক যেন নিজের কানে শুনতে পায়। (প্রাগুক্ত) দরূদ শরীফ ইত্যাদি ওযীফা সমূহ পড়ার ক্ষেত্রে কমপক্ষে এতটুকু আওয়াজ হওয়া উচিত যেন নিজে শুনতে পায়, তবেই পাঠ করা হিসেবে গণ্য হবে। (৬) শুধুমাত্র বড় এক আয়াত পাঠ করা ফরয নামাযের প্রথম দুই রাকাতে ফরয, আর বিতর, সুন্নাত ও নফলের প্রত্যেক রাকাতে ইমাম ও একাকী নামায আদায়কারী সকলের উপর ফরয। (তাহতাবীর পাদটিকা সম্বলিত মারাক্বিউল ফালাহ, ২২৬ পৃষ্ঠা) (৭) মুক্তাদির জন্য নামাযে কিরাত পড়া জায়েয নেই। না সূরায়ে ফাতিহা, না অন্য আয়াত, না নীরবে কিরাতের নামাযে, না উঁচু আওয়াজের কিরাতের নামাযে। ইমামের কিরাতই মুক্ততাদীর জন্য যথেষ্ট। (তাহতাবীর পাদটিকা সম্বলিত মারাকিউল ফালাহ, ২২৭ পৃষ্ঠা) (৮) ফরয নামাযের কোন রাকাতে কিরাত পড়লো না বা শুধু এক রাকাতে পড়লো তবে নামায ভঙ্গ হয়ে গেলো। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৬৯ পৃষ্ঠা) (৯) ফরয নামাযগুলোতে ধীরে ধীরে, তারাবীতে মধ্যম গতিতে ও রাতের নফল নামাযে তাড়াতাড়ি কিরাত পড়ার অনুমতি রয়েছে। তবে এমনভাবে পড়তে হবে যেন কিরাতের শব্দ সমূহ বুঝে আসে অর্থাৎ কমপক্ষে মদের (দীর্ঘ করে পড়ার) যতটুকু সীমা কারীগণ নির্ধারণ করেছেন ততটুকু যেন আদায় হয়, নতুবা হারাম হবে। কেননা তারতীল (অর্থাৎ থেমে থেমে) সহকারে কুরআন তিলাওয়াতের আদেশ রয়েছে। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, ১ম খন্ড, ৩৬৩ পৃষ্ঠা) বর্তমানে অধিকাংশ হাফিয সাহেবগণ এভাবে পড়ে থাকেন যে, মদ সমূহের আদায়তো দূরের কথা আয়াতের শেষের দু’একটি শব্দ যেমন-يَعْلَمُوْن , تَعْلَمُوْن ছাড়া বাকী কোন শব্দই বুঝা যায় না। এক্ষেত্রে অক্ষরসমূহের উচ্চারণ শুদ্ধ হয় না বরং দ্রুত পড়ার কারণে অক্ষরগুলো একটি অপরটির সঙ্গে সংমিশ্রণ হয়ে যায় আর এভাবে দ্রুত পড়ার কারণে গর্ববোধ করা হয় যে, অমূখ হাফিয সাহেব খুব তাড়াতাড়ি পড়ে থাকেন! অথচ এভাবে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা হারাম ও শক্ত হারাম। (বাহারে শরীয়াত, ৩য় খন্ড, ৮৬, ৮৭ পৃষ্ঠা) 


অক্ষর সমূহ বিশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করা আবশ্যক


অধিকাংশ লোক ط ت, س ص ث, ا ء ع, ه ح, د ض, ذ ظ এ সমস্ত অক্ষর সমূহ উচ্চারণের কোন পার্থক্য করে না। স্মরণ রাখবেন! অক্ষর সমূহের উচ্চারণ পরিবর্তন হওয়ার কারণে যদি অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়, তবে নামায হবে না। (বাহারে শরীয়াত, ৩য় অংশ, ১০৮ পৃষ্ঠা) যেমন- যে ব্যক্তি سُبْحٰنَ رَبِّىَ الْعَظِيْم এ عَظِيْم কে عَزِيْم (ظ এর স্থানে ز) পড়ে দিলো, তবে তার নামায ভঙ্গ হয়ে গেলো। তাই, যে ব্যক্তি سُبْحٰنَ رَبِّىَ الْعَظِيْم শব্দটি শুদ্ধভাবে পড়তে পারে না সে যেন سُبْحٰنَ رَبِّىَ الْكَرِيْم পড়ে নেয়। (কানূনে শরীয়াত, ১ম অংশ, ১১৯ পৃষ্ঠা) 


সাবধান! সাবধান!! সাবধান!!!


যার বিশুদ্ধভাবে অক্ষরসমূহ উচ্চারিত হয় না, তার জন্য কিছুদিন অনুশীলন (বিশুদ্ধভাবে পাঠের প্রশিক্ষণ নেয়া) যথেষ্ট নয় বরং সেগুলো শিক্ষা করার জন্য যতদিন প্রয়োজন রাতদিন পূর্ণ প্রচেষ্টা চালানো আবশ্যক। যদি বিশুদ্ধভাবে পড়তে পারে এমন লোকের পিছনে নামায আদায় করা সম্ভব হয় তাহলে তাঁর পিছনে নামায আদায় করা ফরয। অথবা সে যেন নামাযে ঐ আয়াতগুলো পড়ে, যেগুলোর অক্ষরসমূহ সে বিশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে পারে। আর এ দুটো নিয়মে নামায আদায় করা সম্ভব না হলে প্রচেষ্টাকালীন সময়ে নিজের নামায হয়ে যাবে। আজকাল বহুলোক এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে যে, না তারা বিশুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে পারে, না শিখার জন্য চেষ্টা করছে। মনে রাখবেন, এভাবে তাদের নামায সমূহ বিনষ্ট হয়ে যায়। (বাহারে শরীয়াত, ৩য় অংশ, ১১৬ পৃষ্ঠা) যে ব্যক্তি রাতদিন চেষ্টা করছে কিন্তু শিখতে পারছে না, যেমন-কিছু লোক এমনই রয়েছে, যাদের মুখ থেকে বিশুদ্ধভাবে অক্ষরসমূহ উচ্চারিত হয় না;তাদের জন্য রাতদিন শিখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা আবশ্যক। প্রচেষ্টকালীন সময়ে তিনি মাযূর (অপারগ) হিসাবে গণ্য হবেন, তার নামায হয়ে যাবে কিন্তু সে কখনো বিশুদ্ধ তিলাওয়াতকারীদের ইমাম হতে পারবে না। হ্যাঁ, যেসব অক্ষরের উচ্চারণ তার বিশুদ্ধ নয়, অনুরূপভাবে সেসব অক্ষরের উচ্চারণ অন্যান্যদেরও বিশুদ্ধ নয়, প্রশিক্ষণকালীন সময়ে সে ঐ সমস্ত লোকের ইমামতি করতে পারবে। আর যদি নিজে চেষ্টাই না করে তাহলে তার নিজের নামাযই তো হচ্ছে না, সুতরাং তার পিছনে অন্যান্যদের নামায কিভাবে শুদ্ধ হবে? (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া, ৬ষ্ঠ খন্ড, ২৫৪ পৃষ্ঠা) 


মাদ্রাসাতুল মদীনা


প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা! আপনারা কিরাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে ভালভাবে ধারণা লাভ করেছেন। বাস্তবিকই ঐ সমস্ত মুসলমান বড়ই দূর্ভাগা যারা কুরআন শরীফ শুদ্ধভাবে পড়ার শিক্ষা গ্রহণ করে না। اَلْحَمْدُ لِلّٰہِ عَزَّوَجَلَّ তবলীগে কুরআন ও সুন্নাত প্রচারের বিশ্বব্যাপী অরাজনৈতিক সংগঠন “দা’ওয়াতে ইসলামী”র অগণিত মাদ্রাসা সমূহ “মাদ্রাসাতুল মদীনা” নামে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সেখানে মাদানী মুন্না ও মাদানী মুন্নীদের কুরআন শরীফ হিফ্য ও নাযারা বিনা পয়সায় শিক্ষা দেয়া হয়। তাছাড়া প্রাপ্ত বয়ষ্কদেরকে সাধারণত ইশার নামাযের পর হরফ সমূহ বিশুদ্ধ উচ্চারণের সাথে সাথে সুন্নাত সমূহের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। আহা! যদি কুরআনের শিক্ষা ঘরে ঘরে ব্যাপক হয়ে যেত। আহা! যদি ঐ সব ইসলামী ভাই যারা বিশুদ্ধভাবে কুরআন শরীফ পড়তে জানে তারা অন্যান্য ইসলামী ভাইদেরকে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করতো। 


ইসলামী বোনেরাও যদি এটা করত অর্থাৎ যারা বিশুদ্ধভাবে পড়তে পারে তারা অন্যান্য ইসলামী বোনদেরকে পড়াতো আর যারা জানে না তারা যদি তাদের কাছ থেকে শিখে নিত, তাহলে তো اِنْ شَآءَ اللّٰہ عَزَّوَجَلَّ এ প্রক্রিয়া চালু হয়ে গেলে আবারো চতুর্দিকে কুরআন শিক্ষার বাহার এসে যাবে এবং শিক্ষাদানকারী ও শিক্ষাগ্রহণকারী উভয়ের জন্য اِنْ شَآءَ اللّٰہ عَزَّوَجَلَّ সাওয়াবের ভান্ডার পড়ে যাবে।


ইয়েহী হে আরযু তা’লীমে কুরআ আম হো যায়ে, 

তিলাওয়াত শওক ছে করনা হামারা কাম হো যায়ে।


 (৪) রুকূ: এতটুকু ঝুঁকা যাতে হাত বাড়ালে হাত উভয় হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছে যায়, এটা রুকূর নিম্নতম পর্যায়। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ১৬৬ পৃষ্ঠা) আর পূর্ণাঙ্গ রুকূ হচ্ছে পিঠকে সমান করে সোজাসুজি বিছিয়ে দেয়া। (তাহতাবীর পাদটিকা, ২২৯ পৃষ্ঠা) 


মদীনার তাজেদার, রাসূলদের সরদার, হুযুর পুরনূর صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: “আল্লাহ্ তাআলা বান্দার ঐ নামাযের প্রতি দৃষ্টি দেন না, যাতে রুকূ ও সিজদা সমূহের মাঝখানে পিঠ সোজা করা হয় না।” (মুসনাদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ৩য় খন্ড, ৬১৭ পৃষ্ঠা, হাদীস-১০৮০৩) 


 (৫) সিজদা: (১) নবী করীম, রউফুর রহীম صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم ইরশাদ করেন: “আমাকে হুকুম করা হয়েছে সাতটি হাঁড় দ্বারা সিজদা করার জন্য। ঐ সাতটি হাড় হলো মুখ (কপাল) ও উভয় হাত, উভয় হাঁটু এবং উভয় পায়ের পাঞ্জা আরও হুকুম হয়েছে যে, কাপড় ও চুল যেন সংকুচিত না করি।” (সহীহ মুসলিম, ১ম খন্ড, ১৯৩ পৃষ্ঠা) (২) প্রত্যেক রাকাতে দুইবার সিজদা করা ফরয। (দুররে মুখতার, রদ্দুল মুহতার, ২য় খন্ড, ১৬৭ পৃষ্ঠা) (৩) সিজদাতে কপাল জমিনের উপর ভালভাবে স্থাপন করা আবশ্যক। ভালভাবে স্থাপনের অর্থ হচ্ছে; জমিনের কাঠিন্যতা ভালভাবে অনুভূত হওয়া। যদি কেউ এভাবে সিজদা করে যে, কপাল ভালভাবে জমিনে স্থাপিত হয়নি তাহলে তার সিজদা হয়নি। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৭০ পৃষ্ঠা) (৪) কেউ কোন নরম বস্তু যেমন ঘাস (বাগানের সতেজ ঘাস) , তুলা অথবা কার্পেট (CARPET) ইত্যাদির উপর সিজদা করলো, যদি এমতাবস্থায় কপাল ভালভাবে স্থাপিত হয় অর্থাৎ কপালকে এতটুকু চাপ দিলো যে, এরপর আর চাপা যায় না, তাহলে তার সিজদা হয়ে যাবে, অন্যথায় হবে না। (তাবঈনুল হাকাইক, ১ম খন্ড, ১১৭ পৃষ্ঠা) (৫) বর্তমানে মসজিদ সমূহে কার্পেট (CARPET) বিছানোর প্রচলন হয়ে গেছে। (বরং কোন কোন জায়গায় কার্পেটের নিচে ফোমও বিছিয়ে দেয়া হয়) কার্পেটের উপর সিজদা করার সময় এ বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে, কপাল যেন ভালভাবে স্থাপিত হয় নতুবা নামায হবে না। (নাকের ডগা নয় বরং) নাকের হাঁড় পর্যন্ত ভালভাবে চেপে না লাগালে নামায মাকরূহে তাহরীমী হবে, নামায পুনরায় আদায় করা ওয়াজীব হয়ে যাবে। (বাহারে শরীয়াত, ৩য় অংশ, পৃষ্ঠা ৭১ হতে সংকলিত) (৬) স্প্রীং এর গদির উপর কপাল ভালভাবে বসে না। কাজেই এর উপর নামাযও হবে না। (প্রাগুক্ত) 


কার্পেটের ক্ষতি সমূহ


কার্পেটে একেতো সিজদা করতে কষ্ট হয়, তদুপরি সঠিকভাবে এটাকে পরিস্কারও করা যায় না। তাই এতে ধূলাবালি ইত্যাদি জমে যায় এবং বিভিন্ন রোগ জীবাণু সৃষ্টি হয়। সিজদাতে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে রোগ জীবাণু ও কার্পেটের পশম নাকের ভিতরে প্রবেশ করে, কার্পেটের পশম ফুসফুসে গিয়ে একবার লেগে গেলে আল্লাহ্র পানাহ!ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক সময় বাচ্চারা কার্পেটে বমি বা প্রস্রাব করে দেয়, বিড়ালও ময়লাযুক্ত করে ফেলে, ইঁদুর আর টিকটিকি মল ত্যাগ করে। এসব কারণে কার্পেট অপবিত্র হয়ে গেলে সাধারণত দেখা যায় এটা পবিত্র করার কষ্টও কেউ করে না। আহ্! যদি কার্পেট বিছানোর প্রথাই বন্ধ হয়ে যেত। 


নাপাক কার্পেট পাক করার পদ্ধতি


কার্পেটের নাপাক অংশটি একবার ধৌত করে ঝুলিয়ে দিন। এতটুকু সময় পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখুন, যেন পানির ফোটা পড়া বন্ধ হয়ে যায়। অতপর পুনরায় ধৌত করে ঝুলিয়ে রাখুন যতক্ষণ পর্যন্ত পানি ঝরা বন্ধ হয়ে না যায়। অতপর পুনরায় একইভাবে ধুয়ে ঝুলিয়ে রাখুন যতক্ষণ পর্যন্ত পানি ঝরা পূর্বের মত বন্ধ হয়ে না যায়। তবেই কার্পেট পাক হয়ে যাবে। চাটাই, চামড়ার জুতো এবং মাটির থালা ইত্যাদি যে গুলোতে পাতলা নাপাক পানি শোষণ হয়ে যায় সে গুলোও একই পদ্ধতিতে পাক করে নিন। (এমন হালকা পাতলা কাপড় যা নিংড়ানো হলে ফেটে যাওয়ার আশংখা রয়েছে, তাও এই নিয়মে পাক করে নিতে পারেন।) নাপাক কার্পেট বা কাপড় ইত্যাদি যদি প্রবাহিত পানিতে (যেমন, সাগর, নদী অথবা পাইপ বা বদনা ইত্যাদি জলপাত্রের নালীর প্রবাহিত পানির নিচে) এতটুকু সময় পর্যন্ত রেখে দেয় যে, মনে প্রবল ধারণা জন্মে যে, পানি নাপাকীকে বয়ে নিয়ে গেছে, তাহলেও পাক হয়ে যাবে। কার্পেটে বাচ্চা প্রস্রাব করে দিলে, ঐ জায়গায় শুধু পানির ছিটা দিলে তা পাক হবে না। স্মরণ রাখবেন! একদিনের ছেলে শিশু বা মেয়ে শিশুর প্রস্রাবও নাপাক। (বিস্তারিত জানার জন্য বাহারে শরীয়াত ২য় অংশ অধ্যয়ন করুন) 


 (৬) কা’দায়ে আখিরা (বা শেষ বৈঠক) : অর্থাৎ নামাযের রাকাত সমূহ পূর্ণ করার পর সম্পূর্ণ তাশাহহুদ অর্থাৎ (আততাহিয়াত)  পর্যন্ত পড়তে যত সময় লাগে এতক্ষণ পর্যন্ত বসা ফরয। (আলমগিরী, ১ম খন্ড, ৭০ পৃষ্ঠা) চার রাকাত বিশিষ্ট ফরয নামাযে চতুর্থ রাকআতের পর কেউ ভুলে কা’দা করলো না, তাহলে পঞ্চম রাকাতের সিজদা না করা পর্যন্ত এ সময়ের মধ্যে যখনই মনে পড়বে তৎক্ষণাৎ বসে যাবে আর যদি পঞ্চম রাকাতের সিজদা করে ফেলে অথবা ফজরের নামাযে দ্বিতীয় রাকাতে বসলো না তৃতীয় রাকাতের সিজদা করে নিলো কিংবা মাগরিবে তৃতীয় রাকাতে না বসে চতুর্থ রাকাতের সিজদা করে নিলো, তবে এসব অবস্থায় ফরয বাতিল হয়ে যাবে। মাগরিব ব্যতীত অন্যান্য নামাযে আরো এক রাকাত মিলিয়ে নামায শেষ করবেন। (গুনিয়াতুল মুসতামলা, ২৮৪ পৃষ্ঠা) 


 (৭) খুরুজে বিসুনইহী: অর্থাৎ কা’দায়ে আখিরাহ এরপর সালাম বা কথাবার্তা ইত্যাদি এমন কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে করা যা নামায ভঙ্গ করে দেয়। তবে সালাম ব্যতীত অন্য কোন কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে করে নামায শেষ করলে ঐ নামায পুনরায় আদায় করে দেয়া ওয়াজীব। আর যদি অনিচ্ছাকৃত ভাবে এ ধরণের কোন কাজ করা হয় তবে নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে। (গুনিয়াতুল মুসতামলা, ২৮৬ পৃষ্ঠা) 


Top