‘হাজির-নাজির’-বিষয়ক বিশ্বাস

মূল: আহলুস্ সুন্নাহ-ডট-কম (পাকিস্তান)

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসাইন

[[Bengali translation of www.ahlus-sunna.com‘s article “Haazir-Naazir”; translator: Admin]


بِسْمِ اللَّـهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ

সালাত-সালাম জানাই নবীকুল-শিরোমণি সাইয়্যেদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর আহলে বায়ত এবং আসহাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈনের প্রতি।

আহলুস্ সুন্নাত ওয়াল-জামাআত তথা সুন্নী মুসলিম সমাজের আক্বীদা-বিশ্বাস হলো প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) হাজির ও নাজির (অর্থাৎ, তাঁর রওযা শরীফে জীবিত এবং আমাদের সমস্ত কাজ লক্ষ্য করছেন; আল্লাহতা’লা প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তিনি একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে রূহানীভাবে উপস্থিত হতে পারেন)।

সালাফীদের মতো প্রতিপক্ষীয় গোষ্ঠী ভ্রান্তভাবে দাবি করে যে আমাদেরকে আল্লাহতা’লার হাজির-নাজির হওয়ার প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে, যদিও তা একটি মিথ্যে ছাড়া কিছু নয়। কেননা আল্লাহতা’লা স্থান-কাল-পাত্রের উর্ধ্বে; আর হাজির-নাজির স্থানের শর্তসাপেক্ষ। অধিকন্তু, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর হাজির-নাজির হওয়ার প্রতি এই আক্বীদা- বিশ্বাস রাখা শির্ক হতে পারে না, কেননা প্রথমতঃ হাজির-নাজির হওয়া আল্লাহতা’লার কোনো সিফাত/গুণ নয়। পক্ষান্তরে, দেওবন্দী/ক্বওমী ওহাবীরা ভ্রান্তভাবে বিশ্বাস করে যে আল্লাহ পাক হাজির-নাজির। অথচ এই গুণটি মাখলূক্ব তথা সৃষ্টিকুলের, খালেক্ব তথা স্রষ্টার নয়।

চলুন, আমরা ক্বুরআন মজীদ, সুন্নাহ ও চিরায়ত আলেম-উলামার বাণীসমৃদ্ধ প্রামাণিক দলিল দ্বারা সূচনা করি।


❏ আয়াত ১:


আল্লাহতা’লা তাঁর পাক কালামে ঘোষণা করেন:

يٰأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ إِنَّآ أَرْسَلْنَٰكَ شَٰهِداً وَمُبَشِّراً وَنَذِيراً ــ وَدَاعِياً إِلَى ٱللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجاً مُّنِيراً

অর্থ: হে অদৃশ্যের সংবাদদাতা (নবী)! নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি হাজির-নাজির করে, সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারীরূপে; এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর নির্দেশে আহ্বানকারী আর আলোকোজ্জ্বলকারী সূর্যরূপে। [আল-ক্বুরআন, ৩৩:৪৫-৪৬; নূরুল এরফান]


আল-ক্বুরআন স্পষ্টভাবে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে “শাহেদ” তথা সাক্ষী হিসেবে সম্বোধন করেছে; আর সাক্ষী স্রেফ ওই ব্যক্তি-ই হন যিনি (ঘটনাস্থলে) উপস্থিত থেকে চাক্ষুস (এবং শ্রুতি) সাক্ষ্য দেন। ক্বুরআন মজীদ তো অযৌক্তিক হতে পারে না এবং অনুপস্থিত জন, আর প্রত্যক্ষকারী নন এমন কাউকে সাক্ষী বলে সম্বোধন করতে পারে না। সালাফী ও দেওবন্দী গোষ্ঠী যদি মিথ্যে দাবি করে যে এই আয়াতটি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে কেবল তাঁর (প্রকাশ্য) জিন্দেগীর সময়কালেই ‘শাহেদ’ সম্বোধন করেছে, তাহলে আমরা অগ্রসর হয়ে আরো দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করবো।


❏ আয়াত ২:


আল-ক্বুরআনে ঘোষিত হয়েছে:

فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِن كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَىٰ هَـٰؤُلاۤءِ شَهِيداً ــ يَوْمَئِذٍ يَوَدُّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَعَصَوُاْ ٱلرَّسُولَ لَوْ تُسَوَّىٰ بِهِمُ ٱلأَرْضُ وَلاَ يَكْتُمُونَ ٱللَّهَ حَدِيثاً

অর্থ: তবে কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো? এবং হে মাহবূব! আপনাকে তাদের সবার ওপর সাক্ষী এবং পর্যবেক্ষণকারীরূপে উপস্থিত করবো? ওই দিন কামনা করবে ওই সব লোক, যারা কুফর করেছে এবং রাসূলের অবাধ্য হয়েছে – ‘আহা! যদি তাদেরকে মাটির মধ্যে ধ্বসিয়ে মিশিয়ে ফেলা হতো!’ এবং কোনো কথাই (তারা) আল্লাহ থেকে গোপন করতে পারবে না। [আল-ক্বুরআন, ৪:৪১-৪২; নূরুল এরফান]


এখানে আল-ক্বুরআন ব্যক্ত করছে সকল (পয়গম্বরবৃন্দের) উম্মতদের মধ্য হতে সাক্ষী তলব করার কথা; অতঃপর প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে তাদের ওপরে সাক্ষী হবার কথা। মহানবী (صلى الله عليه وسلم) যে হাজির ও নাজির, এই বিষয়ে ক্বুরআন মজীদে নিহিত একটা মহা-সাক্ষ্য এটা।


আপত্তি নং ১


কিছু লোক আপত্তি উত্থাপন করে যে, উম্মতে মুহাম্মদীকেও তো ‘শাহেদ’ বলা হয়েছে; তাহলে তাঁরাও কি হাজির-নাজির হয়ে যাবেন? কিন্তু এই সাদৃশ্য তুলে ধরতে গিয়ে তারা যে ভুলটি করে তা হলো, উম্মত শাহেদ/সাক্ষী হয়েছেন তাঁদের মাঝে রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’কে প্রেরণের কারণেই। অতএব, সব কিছুই আসলে নবী করীম (صلى الله عليه وسلم)’এর সাক্ষ্যের দিকে ফিরে যায়।


আপত্তি নং ২


কেউ কেউ আবার আপত্তি করে যে, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) শাহাদাহ/সাক্ষ্য দেবেন ক্বুরআন মজীদের ভিত্তিতে; মানে তিনি সঠিক কী ও ভ্রান্তি কী জেনেছেন যেহেতু আল-ক্বুরআনে তা উল্লেখিত হয়েছে। সুতরাং তিনি হাজির ও নাজির নন। এই আপত্তির জবাব হলো, ক্বুরআন মজীদে অবশ্যই সমস্ত জ্ঞান নিহিত রয়েছে; অতএব, তারা যা দাবি করছে, তাতেই খোদ রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর হাজির ও নাজির হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হচ্ছে। কেননা আল-ক্বুরআন তাঁরই প্রতি নাযেল হয়েছে এবং তিনি ওই ঐশীগ্রন্থটির সেরা আ’রিফ তথা জ্ঞানী হিসেবে সব কিছুই জানেন। দ্বিতীয়তঃ হাজির-নাজির মানে হলো রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) তাঁর রওযা পাকে (রূহানীভাবে) জীবিত, যেখান থেকে তিনি আমাদের সকল কাজ-কর্ম প্রত্যক্ষ করছেন, ঠিক যেমনটি নিম্নে আমাদের উদ্ধৃত সহীহ আহাদীসে প্রমাণিত হবে।


❏ হাদিস ১:


حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَاحِدِ بْنُ زِيَادٍ، حَدَّثَنَا الأَعْمَشُ، عَنْ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ يَجِيءُ نُوحٌ وَأُمَّتُهُ فَيَقُولُ اللَّهُ تَعَالَى هَلْ بَلَّغْتَ فَيَقُولُ نَعَمْ، أَىْ رَبِّ‏.‏ فَيَقُولُ لأُمَّتِهِ هَلْ بَلَّغَكُمْ فَيَقُولُونَ لاَ، مَا جَاءَنَا مِنْ نَبِيٍّ‏.‏ فَيَقُولُ لِنُوحٍ مَنْ يَشْهَدُ لَكَ فَيَقُولُ مُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم وَأُمَّتُهُ، فَنَشْهَدُ أَنَّهُ قَدْ بَلَّغَ، وَهْوَ قَوْلُهُ جَلَّ ذِكْرُهُ ‏{‏وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ‏}‏ وَالْوَسَطُ الْعَدْلُ ‏”‏‏.

অর্থ: হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) বলেন, “পয়গম্বর নূহ (عليه السلام)’কে পুনরুত্থান দিবসে ডাকা হবে এবং আল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘তুমি কি ঐশীবাণী পৌঁছে দিয়েছিলে?’ তিনি উত্তর দেবেন, ‘জি, হ্যাঁ।’ তাঁর উম্মতকে তখন প্রশ্ন করা হবে, ‘তিনি (নূহ) কি তোমাদের কাছে ঐশীবাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন?’ তারা উত্তর দেবে, ‘না, কোনো সতর্ককারী আমাদের কাছে আসেননি।’ এমতাবস্থায় আল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘তোমার সাক্ষী কে?’ তিনি তখন উত্তর দেবেন, ‘হযরত মুহাম্মদ (صلى الله عليه وسلم) ও তাঁর উম্মত।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানবৃন্দ সাক্ষ্য দেবেন যে পয়গম্বর নূহ (عليه السلام) ঐশীবাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন। আর এ-ই হলো আল্লাহতা’লার বাণী – ‏وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ‏ – ‘এবং কথা এই যে, আমি তোমাদেরকে সব উম্মতের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি (উম্মাতান ওয়াসাতান বা মর্যাদাবান জাতি হিসেবে) যাতে তোমরা মানবজাতির ব্যাপারে সাক্ষী হও [আল-ক্বুরআন, ২:১৪৩]।’ আল-ওয়াসাত-এর মানে আল-আদল তথা ন্যায়বান। [সহীহ বুখারী, ৬ষ্ঠ খণ্ড, বই নং ৬০, হাদীস নং ১৪]


❏ ব্যাখ্যা ১:


মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) এই পয়গম্বর নূহ (عليه السلام)-সম্পর্কিত হাদীসটি, যা’তে তাঁর পক্ষে সাক্ষী তলবের বর্ণনা বিদ্যমান, তা ব্যাখ্যাকালে বলেন:

فيقول محمد وأمته والمعنى أن أمته شهداء وهو مزك لهم وقدم في الذكر للتعظيم ولا يبعد أنه يشهد لنوح عليه الصلاة والسلام أيضا لأنه محل النصرة وقد قال تعالى وإذا أخذ الله ميثاق النبيين إلى قوله لتؤمنن به ولتنصرنه آل عمران فقال رسول الله فيجاء بكم وفيه تنبيه نبيه أنه حاضر ناظر في ذلك العرض الأكبر فيؤتى بالرسل وأولهم نوح ويؤتى بشهوده وهم هذه الأمة

অর্থ: [আর পয়গম্বর নূহ (عليه السلام) উত্তর দেবেন, ‘মুহাম্মদ (صلى الله عليه وسلم) ও তাঁর উম্মত’] এটা ব্যক্ত করে যে, তাঁর উম্মত সাক্ষী, আর তিনি তাঁদের (সত্যবাদিতার) ব্যাপারে সাক্ষী; তবে তাঁর নাম মোবারক প্রথমে উচ্চারিত হওয়াটা সম্মানার্থে ( للتعظيم)। এটা অসম্ভব (لا يبعد) নয় যে তিনি নিজেও পয়গম্বর নূহ (عليه السلام)’এর পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন, কেননা এর পরিপ্রেক্ষিত হচ্ছে সাহায্য করার, আর আল্লাহ পয়গম্বরবৃন্দের (আলাইহিমুস্ সালাম) কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, যখন তিনি বলেছিলেন – لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنصُرُنَّهُ – ‘তোমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে)।’ এই বিষয়ে লক্ষ্য করার মতো হুঁশিয়ারি আছে এ মর্মে যে, যখন আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামবৃন্দকে ও তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথমে পয়গম্বর নূহ (عليه السلام)’কে ডাকা হবে এবং তাঁদের পক্ষে সাক্ষী হিসেবে এই উম্মতে (মুহাম্মদী)’কে পেশ করা হবে, তখন রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) ওই চূড়ান্ত বিচারালয়ে উপস্থিত থাকবেন আর সাক্ষ্য দেবেন – وفيه تنبيه نبيه أنه حاضر ناظر في ذلك العرض الأكبر – [মিরক্বাত আল-মাফাতিহ শরহে আল-মিশক্বাত আল-মাসাবিহ, ১০ খণ্ড, ২১০ পৃষ্ঠা, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ কর্তৃক প্রকাশিত]


❏ ব্যাখ্যা ১:


মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) আরো ব্যাখ্যা করেন নিম্নবর্ণিত হাদীসটি: (গৃহে যখন কেউ উপস্থিত না থাকেন, তখন বলা উচিৎ – اَلسَّلَامُ عَلَي النَّبِيِّ وَرَحْمَةُ اللهِ – মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) এ প্রসঙ্গে বলেন:

اَيْ لِأَنَّ رُوْحَهُ عَلَيْهِ السَّلَامُ حَاضِرٌ فِيْ بُيُوْتِ الْمُسْلِمِينَ.

অর্থ: মানে হলো, তাঁর (মহানবী صلى الله عليه وسلم) রূহ মোবারক (পবিত্র আত্মা) সকল মুসলমানের ঘরে উপস্থিত থাকার কারণে (সালাম দেয়া জরুরি)। [শরহে শেফা, ২:১১৭]


❏ হাদিস ২:


حَدَّثَنَا عَيَّاشُ بْنُ الْوَلِيدِ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الأَعْلَى، حَدَّثَنَا سَعِيدٌ، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ـ رضى الله عنه ـ أَنَّهُ حَدَّثَهُمْ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏”‏ إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا وُضِعَ فِي قَبْرِهِ، وَتَوَلَّى عَنْهُ أَصْحَابُهُ، وَإِنَّهُ لَيَسْمَعُ قَرْعَ نِعَالِهِمْ، أَتَاهُ مَلَكَانِ فَيُقْعِدَانِهِ فَيَقُولاَنِ مَا كُنْتَ تَقُولُ فِي الرَّجُلِ لِمُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم‏.‏ فَأَمَّا الْمُؤْمِنُ فَيَقُولُ أَشْهَدُ أَنَّهُ عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ‏.‏ فَيُقَالُ لَهُ انْظُرْ إِلَى مَقْعَدِكَ مِنَ النَّارِ، قَدْ أَبْدَلَكَ اللَّهُ بِهِ مَقْعَدًا مِنَ الْجَنَّةِ، فَيَرَاهُمَا جَمِيعًا ‏”‏‏.‏


অর্থ: হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) বলেন: “আল্লাহর বান্দাকে যখন তার সমাধিতে শায়িত করা হয় এবং তার সাথীরা ফিরে যেতে থাকে, তখন সে এমন কী তাদের পায়ের শব্দও শুনতে পায়। দু জন ফেরেশতা তার কাছে আসেন এবং তাকে উঠিয়ে বসান; অতঃপর তাকে জিজ্ঞেস করেন – مَا كُنْتَ تَقُولُ فِي الرَّجُلِ – ‘তুমি এই ব্যক্তি (রাসূল صلى الله عليه وسلم) সম্পর্কে কী বলতে?’ ঈমানদার বান্দা তখন উত্তর দেবেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তিনি আল্লাহর হাবীব ও রাসূল।’ এমতাবস্থায় ফেরেশতা দু জন তাকে বলবেন, ‘দেখো, জাহান্নামে তোমার স্থান; আল্লাহ তা পরিবর্তন করে তোমাকে জান্নাতে একটি স্থান মঞ্জুর করেছেন।’ অতঃপর সে দুটো স্থান-ই দর্শন করবে….।” [সহীহ বুখারী, ২য় খণ্ড, বই নং ২৩, হাদীস নং ৪৫৬]

ইমাম ক্বসতলানী (رحمة الله) এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, “এটা বেসালপ্রাপ্ত জনের কাশফ (দিব্যদৃষ্টি) এ পর্যায়ে যে, তিনি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে দেখতে পান আর এটা মুসলমানদের জন্যে (আশীর্বাদপূর্ণ) সুখবর।” [ইরশাদ আল-সারী শরহে সহীহ আল-বুখারী, ৩য় খণ্ড, ৩৯০ পৃষ্ঠা]

এই হাদীসটি স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে হাজির/উপস্থিত হতে পারেন; কেননা দুনিয়াতে একই সময়ে অনেক মানুষ ইন্তেক্বাল করেন এবং রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) তাঁদের সবার সমাধিতে হাজির হন।


❏ হাদিস ৩:


عن ابن مسعود رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم حياتي خير لكم تحدثون ويحدث لكم ووفاتي خير لكم تعرض علي أعمالكم فما رأيت من خير حمدت الله عليه وما رأيت من شر استغفرت الله لكم

[উচ্চারণ: হায়া’তী খায়রুল্লাকুম তুহাদ্দিসূনা ওয়া ইউহাদ্দাসু লাকুম; ওয়া ওয়াফা’তী খায়রুল্লাকুম তু’রাদু আ’মা’লাকুম ‘আলাইয়া ফামা’ রায়াইতু মিন খায়রিন হামিদ-তু আল্লাহা ওয়া মা রায়াইতু মিন শার্রিন ইসতাগফার-তু আল্লাহা লাকুম]

অর্থ: হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) হতে, যিনি বলেন: “আমার (প্রকাশ্য) জিন্দেগী তোমাদের জন্যে মঙ্গলময়/কল্যাণকর, তোমরা তা বলবে এবং তোমাদেরকেও তা বলা হবে। আমার বেসাল শরীফ-ও তদনুরূপ। তোমাদের আমল (কর্ম) আমাকে দেখানো হবে; তাতে ভালো দেখলে আমি আল্লাহর প্রশংসা করবো। আর যদি মন্দ আমল দেখি, তাহলে আল্লাহর দরবারে তোমাদের পক্ষে ক্ষমা প্রার্থনা (তথা সুপারিশ) করবো।” [আল-বাযযার কৃত ‘মুসনাদ’, ৫:৩০৮-৯; হাদীস নং ১৯২৫]


❏ ইমাম হাফেয ইবনে হাজর আল-হায়সামী (رحمة الله) বলেন:

الحافظ الهيثمي في مجمع الزوائد (24/9) رجاله رجاله الصحيح

অর্থ: এ হাদীসের বর্ণনাকারীরা সবাই সহীহ। [মজমাউয্ যাওয়াইদ, ৯:২৪]


❏ ইমাম হাফেয জালালউদ্দীন সৈয়ূতী (رحمة الله) নিজ ‘খাসাইসুল কুবরা’ গ্রন্থে বলেন: “এর এসনাদ সহীহ।” [খাসাইসুল কুবরা, ২:২৮১]


❏ ইমাম সৈয়ূতী (رحمة الله) বলেন, এসনাদ বিশুদ্ধ। [সুয়ূতীঃ মানাহিল আল-সাফা’ (৩১ পৃষ্ঠা #৮)]


❏ আর ইমাম আল-ইরাক্বী (رحمة الله) বলেন:

وروى أبو بكر البزار في مسنده بإسناد جيد

অর্থাৎ, ইমাম আবূ বকর বাযযার (رحمة الله) এটা শক্তিশালী সনদে বর্ণনা করেন। [তারহুত্ তাসরিব, ৩:২৯৭]


❏ ইমাম ইবনে জাওযী (رحمة الله)-ও তাঁর লেখা চমৎকার ‘আল-ওয়াফা বি-আহওয়ালিল্ মুস্তফা (صلى الله عليه وسلم)’ গ্রন্থে এই হাদীসটি বর্ণনা করেন (৮২৬ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ১৫৬৪, দারুল কুতুবিল্ ইলমিয়াহ, বৈরুত, লেবানন হতে প্রকাশিত)। 

[নোট: বইয়ের সূচনায় জিরাহ ওয়া তা’দিল-বিষয়ে কট্টরপন্থী আলেম ইবনে জাওযী বলেন: ‘আমি এ বইয়ে সহীহ হাদীসের সাথে জাল বর্ণনা মিশ্রণ করিনি’]


❏ মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله عليه) যোগ করেন: “আল-হারিস্ ইবনে উসামা তাঁর ‘মুসনাদ’ কিতাবে বিশুদ্ধ সনদে এটা বর্ণনা করেন।” [শরহে শিফা, ১:১০২]


❏ শায়খ আবদুল্লাহ আল-তালিদী নিজ ‘তাহযীব আল-খাসাইস আল-কুবরা’ (৪৫৮-৪৫৯ পৃষ্ঠা #৬৯৪) পুস্তকে বলেন যে, ইমাম মুসলিম (رحمة الله عليه)’এর মাপকাঠি অনুযায়ী এই এসনাদ সহীহ


❏ আর শায়খ মাহমূদ মামদুহ তাঁর ‘রাফ’আল-মিনারা (১৫৬-১৬৯ পৃষ্ঠা) গ্রন্থে এর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে এটাকে সহীহ ঘোষণা করেন।


❏ আল-মানাবী (رحمة الله عليه)-ও এই হাদীসকে সহীহ ঘোষণা করেন। [ফায়দুল্ ক্বাদির, ৩:৪০১]


❏ এছাড়াও ইমাম ক্বসতলানী (رحمة الله عليه)’এর প্রণীত ‘আল-মাওয়াহিবুল্ লাদুন্নিয়্যা’ পুস্তকের ওপর করা আল-যুরক্বানী মালেকী (رحمة الله عليه)’এর ব্যাখ্যামূলক (শরাহ) কিতাবে তিনি তা-ই (সহিহ) ঘোষণা করেন; 


❏ অনুরূপ (সহিহ) আরো ঘোষণা করেন ইমাম শিহাবউদ্দীন খাফফাজী আপন ‘শরহে শিফা’ গ্রন্থে [১:১০২]।


এই হাদীসটি স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, আমাদের আমল/কর্ম প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) প্রত্যক্ষ করে থাকেন।


❏ আয়াত ৩:


ক্বুরআন মজীদে বিবৃত হয়:

أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ ٱلْفِيلِ

অর্থ: হে মাহবূব! আপনি কি দেখেন নি আপনার রব্ব ওই হস্তী আরোহী বাহিনীর কী অবস্থা করেছেন? [১০৫:১; নূরুল এরফান]


রাজা আবরাহা ও তার হস্তী বাহিনীর ঘটনা সংঘটনকালে মহানবী (صلى الله عليه وسلم) এই দুনিয়াতে যাহেরী/প্রকাশ্যভাবে ছিলেন না। ক্বুরআন মজীদে তাঁকে আল্লাহতা’লা স্পষ্ট জিজ্ঞেস করেন “আপনি কি দেখেন নি?” আর যেহেতু ক্বুরআন পাক অযৌক্তিক কথাবার্তা বলতে পারে না, সেহেতু এতে প্রমাণিত হয় যে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) হাজির-নাজির। এই দৃষ্টান্তকে সমর্থনকারী দলিল হিসেবে এখানে পেশ করা হয়েছে, যদিও অন্যান্য দলিল আরো শক্তিশালী।


❏ আয়াত ৪:


ক্বুরআন পাকে ঘোষিত হয়:

هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلأُمِّيِّينَ رَسُولاً مِّنْهُمْ يَتْلُواْ عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَابَ وَٱلْحِكْمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُّبِينٍ

অর্থ: তিনি, যিনি উম্মী লোকদের মধ্যে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল প্রেরণ করেন যেনো তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে (ঐশী) কিতাব ও হিকমতের জ্ঞান দান করেন আর নিশ্চয় নিশ্চয় তারা ইতিপূর্বে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে ছিলো। [৬২:২; নূরুল এরফান]


❏ আয়াত ৫:


পরবর্তী আয়াত-ই ব্যক্ত করে:

وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُواْ بِهِمْ وَهُوَ ٱلْعَزِيزُ ٱلْحَكِيمُ

অর্থ: এবং তাদেরই মধ্য থেকে অন্যান্যদেরকে পবিত্র করেন এবং জ্ঞান দান করেন তাদেরকে, যারা ওই পূর্ববর্তীদের সাথে মিলিত হয়নি; এবং তিনি-ই সম্মান ও প্রজ্ঞাময়। [৬২:৩]


যেহেতু ক্বুরআনে করীমের প্রতিটি কথা যুক্তিসঙ্গত হওয়ার ব্যাপারটি সন্দেহাতীত, সেহেতু এই আয়াতটিকে গভীর বিশ্লেষণ সহকারে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) কীভাবে ক্বুরআন তেলাওয়াত করেন, (পূর্ববর্তী প্রজন্ম ভিন্ন) অন্যান্যদেরকে পবিত্র করেন, পবিত্র কিতাব ও জ্ঞান-প্রজ্ঞা শিক্ষা দেন? কিছু গণ্ডমূর্খ তৎক্ষণাৎ বলবে – হ্যাঁ, তিনি মারা গিয়েছেন এবং তাই অন্যান্যদেরকে হেদায়াত দিতে আর সক্ষম নন (নাউযুবিল্লাহ)। এর জবাবে আমরা তাঁরই সুন্নাহ’র দিকে ফিরে তাকাবো। ওই সব লোকের প্রতি আমাদের প্রথম প্রশ্ন হলো: হাদীসশাস্ত্র, উসূলে ফেক্বাহ, তাফসীরশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থাবলী সংকলন করার আগে মানুষ কী করতেন? দ্বিতীয়তঃ পরবর্তীকালের মানুষ যদি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে আর নিজেদের পবিত্রকরণের জন্যে না পান, তাহলে তিনি কীভাবে রহমতুল্ লিল্ আলামীন তথা সমগ্র জগতের জন্যে প্রেরিত আল্লাহর করুণা হতে পারেন?

অধিকাংশ তাফসীরকারক উলামা এই আয়াতটিকে এটার যাহেরী/বাহ্যিক অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন, আর এটা-ই সঠিক পন্থা। মহিমান্বিত আল-ক্বুরআনের এই সহজ কিন্তু গভীর অর্থবোধক আয়াতে করীমা বুঝতে চলুন আমরা একটি প্রসিদ্ধ তাফসীর দেখি।


❏ তফসীর :


মুফাসসিরকুল শিরোমণি ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (رحمة الله) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:

قال ابن زيد، في قول الله عزّ وجلّ، { وَآخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُواْ بِهِمْ } قال: هؤلاء كلّ من كان بعد النبيّ صلى الله عليه وسلم إلى يوم القيامة، كلّ من دخل في الإسلام من العرب والعجم.

অর্থ: ইবনে যায়দ (رضي الله عنه) ‘এবং তাদেরই মধ্য থেকে অন্যান্যদেরকে পবিত্র করেন এবং জ্ঞান দান করেন তাদেরকে, যারা ওই পূর্ববর্তীদের সাথে মিলিত হয়নি’ মর্মে ক্বুরআনের আয়াতটি ব্যাখ্যাকালে বলেন, এটা সে সমস্ত মানুষকে উদ্দেশ্য করে, যাঁরা প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর বেসালপ্রাপ্তির পরে ক্বেয়ামত দিবস অবধি ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করবেন, আর এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন আরব ও অনারব জাতিগোষ্ঠী। [তাফসীরে তাবারী, ৭ম খণ্ড, ৮৩ পৃষ্ঠা; দারুল ফিকর, বৈরুত, লেবানন]


অতএব, এ বিষয়টি ক্বুরআনী নস্ তথা দলিল হতে প্রমাণিত হলো যে, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) মনোনীত পুণ্যাত্মা/আউলিয়াবৃন্দকে অদ্যাবধি নিরন্তর ক্বুরআন শিক্ষা দিয়ে চলেছেন এবং তাঁদেরকে পবিত্র করছেন। এই কারণেই অনেক আউলিয়া কেরাম (রহমতুল্লাহে আলাইহিম) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে পেরেছেন; যেমন – ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ূতী (رحمة الله) এবং অন্যান্যরা।


❏ আয়াত ৬:


ক্বুরআন মজীদে ঘোষিত হয়:

قُلْ يَتَوَفَّاكُم مَّلَكُ ٱلْمَوْتِ ٱلَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّكُمْ تُرْجَعُونَ

অর্থ: (হে রাসূল) বলুন, ‘তোমাদেরকে মৃত্যু প্রদান করে মৃত্যুর ফেরেশতা, যে তোমাদের জন্যে নিযুক্ত রয়েছে। অতঃপর আপন রব্বের দিকে (সবাই) ফিরে যাবে।’ [৩২:১১, নূরুল এরফান]

শত শত মানুষ একই সময়ে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে ইন্তেক্বাল করছেন, আর আজরাঈল ফেরেশতা (عليه السلام) তাঁদের সবার জান কবজ করছেন। যদি ওই ফেরেশতা হাজির-নাজির হতে পারেন, তাহলে ফেরেশতাদের চেয়ে বহু উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন নবী করীম (صلى الله عليه وسلم) তা পারবেন না কেন?


❏ তফসীর :


হাফেয ইবনে কাসীর এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:

الظاهر من هذه الآية أن ملك الموت شخص معين من ملائكة، كما هو المتبادر من حديث البراء المتقدم ذكره في سورة إبراهيم، وقد سمي في بعض الآثار بعزرائيل، وهو المشهور، قاله قتادة وغير واحد، وله أعوان، وهكذا ورد في الحديث: أن أعوانه ينتزعون الأرواح من سائر الجسد، حتى إذا بلغت الحلقوم، وتناولها ملك الموت، قال مجاهد: حويت له الأرض، فجعلت مثل الطست يتناول منها متى يشاء، ورواه زهير بن محمد عن النبي صلى الله عليه وسلم بنحوه مرسلاً، وقاله ابن عباس رضي الله عنهما.

وروى ابن أبي حاتم: حدثنا أبي، حدثنا يحيى بن أبي يحيى المقري، حدثنا عمر بن سمرة عن جعفر بن محمد قال: سمعت أبي يقول: نظر رسول الله صلى الله عليه وسلم إلى ملك الموت عند رأس رجل من الأنصار، فقال له النبي صلى الله عليه وسلم ” يا ملك الموت ارفق بصاحبي؛ فإنه مؤمن ” فقال ملك الموت: يا محمد طب نفساً، وقر عيناً، فإني بكل مؤمن رفيق، واعلم أن ما في الأرض بيت مدر ولا شعر في بر ولا بحر، إلا وأنا أتصفحهم في كل يوم خمس مرات، حتى إني أعرف بصغيرهم وكبيرهم منهم بأنفسهم، والله يا محمد لو أني أردت أن أقبض روح بعوضة، ما قدرت على ذلك حتى يكون الله هو الآمر بقبضها. قال جعفر: بلغني أنه إنما يتصفحهم عند مواقيت الصالة، فإذا حضرهم عند الموت، فإن كان ممن يحافظ على الصالة، دنا منه الملك، ودفع عنه الشيطان، ولقنه الملك لا إله إلا الله محمد رسول الله، في تلك الحال العظيمة. وقال عبد الرزاق: حدثنا محمد بن مسلم عن إبراهيم ابن ميسرة قال: سمعت مجاهداً يقول: ما على ظهر الأض من بيت شعر أو مدر، إلا وملك الموت يطوف، به كل يوم مرتين. وقال كعب الأحبار: والله ما من بيت فيه أحد من أهل الدنيا، إلا وملك الموت يقوم على بابه كل يوم سبع مرات، ينظر هل فيه أحد أمر أن يتوفاه؟

অর্থ: এই আয়াতের প্রকাশ্য মানে হলো ‘মালাক আল-মওত’ (ফেরেশতা আজরাঈল) সুনির্দিষ্টভাবে নিযুক্ত ফেরেশতা, যা জ্ঞাত হয়েছে সূরা ইবরাহীমের তাফসীর দ্বারা – যেখানে হযরত বারা’আ ইবনে আযিব (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত হাদীসটি প্রদর্শিত হয়েছে (২৭তম আয়াত)। কিছু আসা’র/বাণীতে তাঁর নাম আজরাঈল হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে এবং তা পরিচিতি পেয়েছে; এই হলো হযরত ক্বাতাদা (رضي الله عنه) এবং অন্যান্যদের দৃষ্টিভঙ্গি। ওই ফেরেশতার সহযোগীবৃন্দও আছেন। আহাদীসে উল্লেখিত আছে যে, তাঁর সহযোগীবৃন্দ সকল দেহ হতে রূহ/আত্মাকে বের করতে থাকেন যতোক্ষণ না সেগুলো গলায় পৌঁছে। অতঃপর মালাকুল মওত সেগুলো কবজ করেন। হযরত মুজাহিদ (رضي الله عنه) বলেন: “দুনিয়া তাঁর (আজরাঈল) জন্যে গুটিয়ে ফেলা হয় এবং তা একটি পাত্রের মতো হয়ে যায়, যেখান থেকে তিনি যাকে চান (কবজ করে) নেন।”

প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) একবার মালাকুল মওত’কে এক আনসার সাহাবী’র (মাথার) বালিশের ওপর বসে থাকতে দেখেন; তিনি তাঁকে বলেন: “ওহে মালাকুল মওত/মৃত্যুদূত! আমার সাথীর প্রতি নরম হোন, কেননা সে একজন ঈমানদার।” ফেরেশতা (عليه السلام) উত্তরে বলেন: “এয়া রাসূলাল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)! দুশ্চিন্তা করবেন না এবং আপনার নয়ন মোবারককে স্বস্তিতে রাখুন। কেননা আমি সকল ঈমানদারেরই প্রতি কোমল। আপনি জানেন, আমি জল ও স্থলে প্রত্যহ পাঁচবার উপস্থিত হই এবং প্রতিটি গৃহে ঘুরে বেড়াই; (সেখানে) প্রত্যেক তরুণ ও বৃদ্ধ বয়সী মানুষকে তারা নিজেরা নিজেদেরকে যতোটুকু চেনেন-জানেন, তার চেয়েও আমি বেশি চিনি-জানি। আল্লাহর নামে শপথ! আল্লাহতা’লার আদেশ ব্যতিরেকে আমি এমন কী একটি মশারও জান কবজ করার সামর্থ্য রাখি না।”

হযরত জা’ফর (رضي الله عنه) বলেন যে মৃত্যুর ফেরেশতা নামাযের ওয়াক্তে মানুষের খোঁজে থাকেন। যে ব্যক্তি নামাযে অভ্যস্ত হন, তাঁর ইন্তেক্বালের সময় ওই ফেরেশতা তাঁর সবচেয়ে কাছে থাকেন; অথচ শয়তান দূরে থাকে। সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ফেরেশতা তাঁকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ – এই কলেমা-বাক্যের তালক্বীন/শিক্ষা দেন। হযরত মুজাহিদ (رضي الله عنه) বলেন: “মালাকুল মওত দুনিয়ার সমস্ত এলাকা দু বার সফর করেন।” হযরত কা’আব আল-আহবার (رضي الله عنه) বলেন: “মৃত্যুর ফেরেশতা প্রতিটি (গৃহের) দরজায় দিনে সাত বার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন” – কারো জান কবজ করার হুকুম হয়েছে কি না তা দেখতে। [হাফেয ইবনে কাসীর কৃত ‘তাফসীর আল-ক্বুরআন আল-আযীম,’ সূরা সাজদাহ, ১১ আয়াত]


❏ আয়াত ৭:


আল-ক্বুরআনে ঘোষিত হয়:

يٰأَيُّهَا ٱلَّذِينَ آمَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَذَرُواْ مَا بَقِيَ مِنَ ٱلرِّبَٰواْ إِن كُنْتُمْ مُّؤْمِنِينَ ــ فَإِن لَّمْ تَفْعَلُواْ فَأْذَنُواْ بِحَرْبٍ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِ

অর্থ: হে ঈমানদারবর্গ! আল্লাহকে ভয় করো এবং ত্যাগ করো যা অবশিষ্ট রয়েছে সুদের (প্রথার), যদি মুসলমান হও। অতঃপর যদি তোমরা এই আজ্ঞানুরূপ না করো, তবে নিশ্চিত বিশ্বাস রেখো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে (তোমাদের) যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। [আল-ক্বুরআন, ২:২৭৮-২৭৯]

লোকেরা আজো সুদের কারবারে জড়িত। অতএব, মহানবী (صلى الله عليه وسلم) এখনো তাদের সাথে যুদ্ধরত।


❏ হাদিস ৪:


أخبرنا ابن المبارك، أخبرنا رجل من الأنصار عن المنهال بن عمرو أنه سمع سعيد بن المسيب يقول: ليس من يوم إلا تعرض فيه على النبي صلى الله عليه وسلم أمته غدوة وعشية، فيعرفهم بأسمائهم وأعمالهم، فلذلك يشهد عليهم، يقول الله تعالى: { فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِن كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَىٰ هَـٰؤُلاۤءِ شَهِيداً }

অর্থ: হযরত ইবনে মুবারক (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: জনৈক আনসার সাহাবী (رضي الله عنه) আমাদের কাছে বর্ণনা করেন হযরত আল-মিনহাল ইবনে আমর (رضي الله عنه) হতে এ মর্মে যে, তিনি (মিনহাল) শুনেছিলেন হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব (رضي الله عنه)’কে এ কথা বলতে: “এমন কোনো দিনই অতিক্রান্ত হয় না, যেদিন সকাল ও সন্ধ্যায় উম্মতে মুহাম্মদীকে মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’এর কাছে প্রদর্শন করা না হয়। তিনি তাঁদের নাম ও কাজ-কর্ম সম্পর্কে জানেন; যার দরুন তিনি তাঁদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবেন (শেষ বিচার দিবসে)। ঠিক যেমনটি আল্লাহতা’লা বলেছেন, তবে কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো, এবং হে মাহবূব, আপনাকে তাদের সবার ব্যাপারে সাক্ষী ও পর্যবেক্ষণকারীস্বরূপ উপস্থিত করবো?” [আল-ক্বুরআন, ৪:৪১]

এই রওয়ায়াত লিপিবদ্ধ আছে ইবনে আল-মুবারক (رضي الله عنه) হতে ‘আল-যুহদ’ পুস্তকে (৪২ পৃষ্ঠা); ইমাম ক্বুরতুবী কৃত ‘আল-তাযক্বিরা’ গ্রন্থে (১:৩৩৫); ইবনে হাজর আসক্বালানী প্রণীত ‘ফাতহুল বারী’ (৯:৯৯) কিতাবে এবং অন্যান্যদের বইপত্রেও।

এই দালিলিক প্রমাণটি এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে আমাদের পেশকৃত ৫ নং দলিলের সমর্থনে, যা’তে বিবৃত হয়েছিলো যে আমাদের সমস্ত কর্ম প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে তাঁর রওযা মোবারকে প্রদর্শন করা হয়।


ইমামগণের আকিদায় থেকে বর্ণনা করা হলঃ


❏ প্রমাণ ১:


মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) তাঁর রচিত ‘মিরক্বাত শরহে মিশক্বাত’ ও ‘শরহে শিফা’ গ্রন্থ দুটোতেই প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর হাজির-নাজির হওয়ার পক্ষে প্রামাণিক দলিল উপস্থাপন করেছেন।


❏ প্রমাণ ২:


হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله عليه) বলেন:

(” التحيات “) واحضر في قلبك النبي صلى الله عليه وسلم وشخصه الكريم وقل (” السالم عليك ايها النبي ورحمة الله وبركاته “)

অর্থ: নামাযের বৈঠকে ‘আত্ তাহিয়্যাতু’ পাঠ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: “তোমাদের অন্তরে বিশ্বাস করবে যে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) হাজির (উপস্থিত) আছেন; অতঃপর বলবে, ‘আস্ সালামু আলাইকা আইয়্যুহান্ নাবীউ’ (হে নবী, আপনার প্রতি সালাম)।” [এহইয়াও উলূমিদ্দীন, ১ম খণ্ড, পরিচ্ছেদ – ৩]

নামাযে সরাসরি মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’কে আহ্বান করা আপনাআপনি-ই একটি দালিলিক প্রমাণ এই মর্মে যে, তিনি এতে (প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে) সাক্ষী আছেন এবং (আমাদের সালাম) শুনছেন।


❏ প্রমাণ ৩:


ইমাম ক্বসতলানী (رحمة الله عليه) নিজের লিখিত চমৎকার ‘আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন:

“আমাদের উলামাবৃন্দ জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর (প্রকাশ্য) হায়াতে জিন্দেগী ও বেসাল শরীফের মধ্যে কোনো পার্থক্যই নেই; তিনি তাঁর উম্মতকে (অদ্যাবধি) দেখছেন এবং আমাদের কর্ম সম্পর্কেও ওয়াকেফহাল; বরঞ্চ আমাদের অন্তরে কী আছে, তাও তিনি জানেন, আর তাঁর কাছ থেকে কোনো কিছুই গোপন নেই। [আল-মাওয়াহিব, ২য় খণ্ড, ৩৮৭ পৃষ্ঠা; মওলানা শহিদুল্লাহ বাহাদুর কর্তৃক বাংলায় অনূদিত হয়েছে]


❏ প্রমাণ ৪:


ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ূতী (رحمة الله عليه) বলেন:

وحضور جنازة من مات من صالح أمته فإن هذه الأمور من جملة أشغاله في البرزخ كما وردت بذلك الأحاديث والآثار

অর্থ: এই উম্মতের পুণ্যাত্মাদের জানাযায় উপস্থিত হওয়াটা প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর কাজগুলোর একটা, যা তিনি বরযখ হতে করে থাকেন; আর এ ব্যাপারে অনেক আহাদীস ও আসা’র/বাণী উল্লেখিত হয়েছে। [আল-হাওয়ী লিল্ ফাতাওয়ী’, ২য় খণ্ড, ১৮৪-১৮৫ পৃষ্ঠা]


রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর দর্শন জাগ্রতাবস্থায় লাভ করার বিষয়েও ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ূতী (رحمة الله عليه) বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এখানে তা পেশ করা হলো:


تنوير الحلك في إمكان رؤية النبي والملك

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى. وبعد فقد كثر السؤال عن رؤية أرباب الأحوال للنبي صلى الله عليه وسلم في اليقظة و إن طائفة من أهل العصر ممن لا قدم لهم في العلم بالغوا في إنكار ذلك والتعجب منه وادعوا أنه مستحيل فألفت هذه الكراسة في ذلك وسميتها تنوير الحلك في إمكان رؤية النبي والملك ونبدأ بالحديث الصحيح الوارد في ذلك: أخرج البخاري ومسلم وأبو داود عن أبي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من رآني في المنام فسيراني في اليقظة ولا يتمثل الشيطان بي، وأخرج الطبراني مثله من حديث مالك بن عبد الله الخثعمي ومن حديث أبي بكرة، وأخرج الدارمي مثله من حديث أبي قتادة. قال العلماء اختلفوا في معنى قوله فسيراني في اليقظة فقيل معناه فسيراني في القيامة وتعقب بأنه بلا فائدة في هذا التخصيص لأن كل أمته يرونه يوم القيامة من رآه منهم ومن لم يره، وقيل المراد من آمن به في حياته ولم يره لكونه حينئذ غائبا عنه فيكون مبشرا له أنه لا بد أن يراه في اليقظة قبل موته، وقال قوم هو على ظاهره فمن رآه في النوم فلا بد أن يراه في اليقظة يعني بعيني رأسه وقيل بعين في قلبه حكاهما القاضي أبو بكر ابن العربي، وقال الإمام أبو محمد بن أبي جمرة في تعليقه على الأحاديث التي انتقاها من البخاري: هذا الحديث يدل على أنه من رآه صلى الله عليه وسلم في النوم فسيراه في اليقظة وهل هذا على عمومه في حياته وبعد مماته أو هذا كان في حياته وهل ذلك لكل من رآه مطلقا أو خاص بمن فيه الأهلية والاتباع لسنته عليه السلام اللفظ يعطى العموم ومن يدعي الخصوص فيه بغير مخصص منه صلى الله عليه وسلم فمتعسف قال وقد وقع من بعض الناس عدم التصديق بعمومه وقال على ما أعطاه عقله وكيف يكون من قد مات يراه الحي في عالم الشاهد قال وفي قول هذا القول من المحذور وجهان خطران أحدهما عدم التصديق لقول الصادق عليه السلام الذي لا ينطق عن الهوى والثاني الجهل بقدرة القادر وتعجيزها

অর্থ: আল্লাহর নামে আরম্ভ যিনি পরম দয়ালু, করূণাময়। সমস্ত প্রশংসা তাঁরই এবং সালাম জানাই তাঁর মনোনীত বান্দাবৃন্দের প্রতি। আধ্যাত্মিক হাল-বিশিষ্ট পুণ্যাত্মাবৃন্দের মাঝে জাগ্রতাবস্থায় মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’কে দেখার প্রশ্নটি (আজকাল সার্বিকভাবে) বৃদ্ধি পেয়েছে; আমাদের যুগের একটি দল, যাদের ধর্মীয় জ্ঞানে কোনো ভিত্তি-ই নেই, তারা তীব্রভাবে এটা অস্বীকার করে এবং এতে বিস্মিত হয়; তারা আরো দাবি করে এটা অসম্ভব (মুস্তাহীল) বিষয়।


এমতাবস্থায় আমি (ইমাম সৈয়ূতী) এসব পৃষ্ঠা লিখেছি এবং নাম দিয়েছি ‘তানউয়ীরুল হালাক ফী ইমকানে রুয়্যাত আন-নাবী’ই ওয়াল-মালাক।’ আমরা সূচনা করছি এই বিষয়ে বর্ণিত সহীহ হাদীস দ্বারা: সর্ব-ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ প্রমুখ (رحمة الله عليهم) বর্ণনা করেন হযরত আবূ হুরায়রাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত রাসূলে পাক (صلى الله عليه وسلم)’এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: “যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখলো, সে যেনো আমাকে জাগ্রতাবস্থায়ই (এয়াক্বাযা) দেখলো; (কেননা) শয়তান আমার চেহারা (রূপ/সুরত) ধারণ করতে পারে না।” 


ইমাম তাবারানী (رحمة الله عليه) ইমাম মালিক ইবনে আব্দিল্লাহ (رحمة الله عليه) হতে বর্ণিত অনুরূপ একটি হাদীস উদ্ধৃত করেন, যিনি তা গ্রহণ করেছিলেন (সাহাবী) হযরত আবূ বাকরা হতে (رضي الله عنه); ইমাম দারিমী (رحمة الله عليه)-ও হযরত আবূ ক্বাতাদাহ (رضي الله عنه)’এর বর্ণিত একটি অনুরূপ হাদীস উদ্ধৃত করেন। উলামামণ্ডলী বলেছেন: ‘সে যেনো আমাকে জাগ্রতাবস্থায় (এয়াক্বাযা) দেখলো’ – এ কথাটির ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন এর অর্থ: ‘সে আমাকে শেষ বিচার দিবসে দেখবে।’ তবে এই মতটি সমালোচিত হয়েছে অনর্থক হিসেবে; কেননা এখানে তাখসিস তথা খাস/সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, নতুবা ক্বেয়ামত দিবসে তাঁকে সবাই দেখবেন – যাঁরা ইতোমধ্যে তাঁকে দেখেছেন এবং যাঁরা দেখেননি সবাই। এ কথাও বলা হয়েছে যে এর অর্থ: ‘যাঁরা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছেন তাঁরই (যাহেরী) জীবদ্দশায় কিন্তু উপস্থিত না হওয়ার কারণে তাঁকে দেখতে পারেননি, তাঁদেরই প্রতি এখানে খোশ-খবরী দেয়া হয়েছে যে তাঁরা বেসালপ্রাপ্ত হবার আগে তাঁকে দেখতে পাবেন।’

উলামাদের একটি দল অবশ্য বলেন যে, এর অর্থ আক্ষরিক এবং যে ব্যক্তি স্বপ্নে প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)‘কে দেখেন, তিনি নিশ্চিতভাবে জাগ্রতাবস্থায়ই তাঁকে দেখে থাকেন। অর্থাৎ, তাঁর জাগ্রত চোখ দ্বারা তিনি দেখেন, যদিও (উলামাদের) কেউ কেউ বলেছেন তাঁর অন্তর্চক্ষুকে (এখানে) উদ্দেশ্য করা হয়েছে। 


এই দুটোই বর্ণনা করেছেন ক্বাজী আবূ বকর ইবনে আল-আরবী (رحمة الله عليه)। ইমাম আবূ মুহাম্মদ ইবনে আবী জামরা (رحمة الله عليه) বুখারী শরীফের ওপর কৃত তাঁর ব্যাখ্যায় বলেন: “এই হাদীসটি প্রমাণ করে, 

যে ব্যক্তি তাঁকে স্বপ্নে দেখেন, তিনি অবশ্যই জাগ্রতাবস্থায় দেখেন। (বিতর্ক হচ্ছে) এই বাক্যটি কি তাঁর (প্রকাশ্য) জিন্দেগী ও বেসাল শরীফ-পরবতী সময়কাল উভয়েরই ক্ষেত্রে আম (সার্বিক)-ভাবে প্রযোজ্য? নাকি শুধু (প্রকাশ্য) জিন্দেগীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? এছাড়া, এটা কি যাঁরা তাঁকে দেখেছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? নাকি এটা স্রেফ মহিমান্বিত পুণ্যাত্মা ও সুন্নাতে রাসূল (صلى الله عليه وسلم)-এর সযত্ন অনুসারীদের বেলায়ই খাস? (ব্যবহৃত) এই শব্দটি আম বলে দৃশ্যমান হয়; আর তাই যারা মহানবী (صلى الله عليه وسلم) কর্তৃক খাস না করা সত্ত্বেও এটাকে সুনির্দিষ্ট বলে দাবি করে, তারা সীমালঙ্ঘনকারী (মুত’আসসাফ)।” ইমাম আবূ মুহাম্মদ ইবনে আবী জামরা (رحمة الله عليه) আরো বলেন, “কিছু লোক আম বিষয়টিকে অবিশ্বাস করে নিজেদের মস্তিষ্কের খেয়াল অনুযায়ী দাবি করছে: ‘জীবিত ব্যক্তি এই চর্মচক্ষে দর্শনের দুনিয়ায় বেসালপ্রাপ্তদের দেখতে সক্ষম হবেন কীভাবে’?” অতঃপর হযরত ইমাম (رحمة الله عليه) উত্তর দেন: “এই আপত্তি উত্থাপন দুটো বিপজ্জনক সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে; প্রথমতঃ সত্যবাদী রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) যিনি নিজের আকাঙ্ক্ষা হতে (তথা মনগড়া) কথা বলেন না, তাঁর সহীহ হাদীসকে অস্বীকার; আর দ্বিতীয়তঃ সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার ক্ষমতা সম্পর্কে অজ্ঞতা (প্রকাশ)।” 

[আল-হাওয়ী লিল-ফাতাওয়ী, ২য় খণ্ড, ৪৩৭-৪৩৮ পৃষ্ঠা, মাকতাবা আল-আসরীয়্যা, বৈরুত, লেবানন কর্তৃক প্রকাশিত] {বঙ্গানুবাদকের নোট: আমাদের এ যুগেও ওহাবী/মওদূদী/আহলে হাদীস তথা লা-মাযহাবীদের দেখলে হযরত ইমামের কথার সত্যতা উপলব্ধি করতে পারি আমরা}


❏ প্রমাণ ৫:


শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহেলভী (رحمة الله عليه) যাঁকে চিরায়ত সালাফী/আহলে হাদীস পণ্ডিতবর্গ এবং দেওবন্দী আলেমবর্গও শ্রদ্ধা করে, তিনি বলেন:

যদি বলা হয়, আল্লাহতা’লা তাঁর রাসূল (صلى الله عليه وسلم)’কে এমন ক্ষমতা দিয়েছেন যার দরুন তিনি যেখানে চান সেখানেই যেতে পারেন – হোক তা আত্মিকভাবে অথবা শারীরিকভাবে – তাহলে এ কথা বলা সঠিক; তবে তাঁর রওযা মোবারকের সাথে সংশ্লিষ্টতা বহাল থাকবে। [মাদারিজ আল-নবুওয়াত, ‘হায়াত আল-আম্বিয়া’ পরিচ্ছেদ, ২য় খণ্ড, ৪৫০ পৃষ্ঠা]


❏ প্রমাণ ৬:


দেওবন্দী আলেম-উলামার মধ্যে কর্তৃত্বশীল পণ্ডিত আনওয়ার শাহ কাশমিরী বলে: আমার দৃষ্টিতে, প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষে ‘জাগ্রতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’কে দেখা সম্ভব’, যাঁদেরকে আল্লাহতা’লা তা দ্বারা আশীর্বাদধন্য করেছেন। এ কথা হাফেয জালালউদ্দীন সৈয়ূতী (رحمة الله عليه) উল্লেখ করেছেন এই মর্মে যে, তিনি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’কে ২২ বার দেখেছিলেন এবং কিছু হাদীসের বিশুদ্ধতা (সহীহ হওয়া) সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেসও করেছিলেন। আর যখন তিনি (রাসূলুল্লাহ صلى الله عليه وسلم) সেগুলোকে সহীহ বলেন, তখন হাফেয সৈয়ূতী (رحمة الله عليه)-ও সেগুলোকে সহীহ বলে ঘোষণা করেন। শায়খ শাযালী (رحمة الله) তাঁকে (ইমাম সৈয়ূতীকে) ওই সময়কার শাসক (হাকিমে ওয়াক্বত্)’এর উপস্থিতিতে শায়খ শাযালীর নিজের জন্যে সুপারিশ করার আবেদন জানান। কিন্তু ইমাম সৈয়ূতী (رحمة الله عليه) তা নাকচ করে বলেন: “আমি যদি হাকিমের দরবারে যাই তাহলে আমি প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর যেয়ারত হতে মাহরূম/বঞ্চিত হবো, আর এটা উম্মতের জন্যে একটা বড় ক্ষতি হবে” 

[বঙ্গানুবাদকের নোট: তাঁর মতো হক্কানী আলেম-উলামার ও দরবারি মৌ-লোভীদের মধ্যকার পার্থক্য লক্ষ্য করুন; তারা হলে ছুটে যেতো। কিন্তু সূফীবাদী উলামা এটাকে এড়িয়ে চলতেন]। 


❏ প্রমাণ ৭:


ইমাম শার’আনী (رحمة الله عليه) ‘জাগ্রতাবস্থায়’ মহানবী (صلى الله عليه وسلم)’কে দেখেছিলেন এবং তিনি তাঁর কাছ থেকে সহীহ বুখারী শরীফ শিক্ষাগ্রহণ করেন; আর এতে তাঁর আট জন শিষ্যও অংশগ্রহণ করেন, যাঁদের একজন ছিলেন হানাফী মাযহাবের আলেম। অতএব, জাগ্রতাবস্থায় প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর দর্শন লাভ করা সপ্রমাণিত এবং এটাকে প্রত্যাখ্যান করা গণ্ডমূর্খদের (জাহেলীনের) কাজ। [ফায়যুল বারী, শরহে সহীহ আল-বুখারী, ১ম খণ্ড, ২০৪ পৃষ্ঠা, মাতবুআ মাজলিসে ইলমে হিন্দ কর্তৃক প্রকাশিত, ১৩৫৭ হিজরী]

এ রকম আরো অনেক আলেম-উলামার ভাষ্য প্রদর্শন করা যাবে, তবে আশা করি ওপরের উদ্ধৃতিগুলোই যথেষ্ট হবে।

পথভ্রষ্ট ক্বুরআন ব্যাখ্যাকারী, পারভেযী ও অনুরূপ লোকেরা ছাড়া সকল মুসলমানই এই বাস্তবতা স্বীকার করেন যে, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم) ইসরা ওয়াল মিরা’জে গমন করেছিলেন স্বশরীর ও রূহ/আত্মা সহ। তিনি মসজিদে আক্বসায় সমস্ত আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম)’এর ইমাম হিসেবে নামায পরিচালনাও করেন; অতঃপর তাঁদের সাথে আসমানে সাক্ষাতও করেন। এই মেরা’জ রাতে উর্ধ্বগমন প্রমাণ করে যে, আম্বিয়া (আলাইহিমুস সালাম)’বৃন্দ তাঁদের মাযারে অবস্থান করতে পারেন, যেমন সহীহ মুসলিমের হাদীস অনুযায়ী পয়গম্বর মূসা (عليه السلام) নিজ মাযারে নামায পড়েছিলেন, আবার মসজিদে আক্বসায় উপস্থিতও হতে পারেন, আর আসমানেও অবস্থান করতে পারেন। সালাফী/আহলে হাদীস গোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় হাফেয ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যাহ রূহ/আত্মা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে রূহের বিশাল ক্ষমতা ও সামর্থ্য সম্পর্কে লিখেছে, যা সালাফী বা দেওবন্দীদের কাছে আক্বীদাগত এ বিষয়টি বুঝতে সহজ করবে।


❏ প্রমাণ ৮:


ইবনে ক্বাইয়্যেম বলে:

وإنما يغلط أكثر الناس في هذا الموضع حيث يعتقد أن الروح من جنس ما يعهد من الأجسام التي إذا شغلت مكاناً لم يمكن أن تكون في غيره، وهذا غلط محض، بل الروح تكون فوق السماوات في أعلى عليين، وترد إلى القبر، فترد السلام، وتعلم بالمسلِّم، وهي في مكانها هناك، وروح رسول الله صلى الله عليه وسلم في الرفيق الأعلى دائماً، ويردها الله سبحانه إلى القبر، فترد السلام على من سلم عليه، وتسمع كلامه، وقد رأى رسول الله صلى الله عليه وسلم موسى قائماً يصلي في قبره، ورآه في السماء السادسة، والسابعة، فإما أن تكون سريعة الحركة والانتقال كلمح البصر، وإما أن يكون المتصل منها بالقبر وفنائه بمنزلة شعاع الشمس، وحرمها في السماء،

অর্থ: অনেকের মাঝে এই বিষয়ে ভুল ধারণা বিদ্যমান এবং তারা মনে করে যে, “রূহ/আত্মা (একই সাথে) ২টি স্থানে উপস্থিত থাকতে পারেন না।” কিন্তু এ ধারণাটি “নিছক ভ্রান্তি”; কেননা রূহ আসমানের ওপরে ইল্লিয়ীনে অবস্থান করা সত্ত্বেও “আপন মাযারে আগমন করেন এবং সালাম প্রদানকারীর সালামের প্রত্যুত্তর দেন, আর যেয়ারতে আগত ব্যক্তিকে চিনতেও পারেন।” এর প্রমাণ জানা যায় এ বাস্তবতা হতে যে, প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর রূহ মোবারক অবস্থান করছেন রফিক্ব আল-আ’লা নামের স্থানে, অথচ একই সময়ে তিনি “তাঁর রওযা পাকে” মানুষের সালামের প্রত্যুত্তর দিচ্ছেন। একইভাবে, রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم) পয়গম্বর মূসা (عليه السلام)’কে তাঁর মাযারে নামাযরত দেখেন এবং এরপর ৬ষ্ঠ বা ৭তম আসমানেও দেখতে পান। অতএব, (পুণ্যাত্মাদের) রূহ “অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ভ্রমণ করেন এমনই এক পর্যায়ে, যার দরুন তিনি সহস্র বছরের দূরত্ব চোখের এক পলকেই অতিক্রম করতে পারেন।” কিংবা “মাযার ও তার পরিবেশের সাথে সংশ্লিষ্ট বা যুক্ত থাকেন।” এর উদাহরণ হলো, সূর্য আকাশে বিরাজমান, কিন্তু নিজ কিরণ-রস্মি দ্বারা পৃথিবীর সাথেও যুক্ত। [ইবনে ক্বাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা কৃত ‘কিতাবুর রূহ’, ১৫তম অধ্যায়]


পরিশেষে আমরা একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের অবতারণা করবো, আর তা বাইবেল থেকে। আমরা সচরাচর জাকির নায়েকের মতো ওহাবীদের দেখা পাই, যারা বাইবেলের ইউহোন্না/যোহন ভাববাদীর পুস্তক ১৪:১৬ হতে উদ্ধৃতি দেয়, যেখানে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (صلى الله عليه وسلم)’এর আগমনীবার্তা বিদ্যমান। জাকির নায়েক ও ওহাবীরা সর্বদা ওই সব বাইবেলীয় পংক্তি ভুলভাবে উদ্ধৃত করে থাকে; আর খৃষ্টান আত্মপক্ষ সমর্থনকারীরা পংক্তির পটভূমি দেখে পাল্টা জবাব দিলে ওহাবীরা সব সময়ই উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। জাকির নায়েক ও ওহাবীরা বেশির ভাগ সময় যা গোপন করে, তা ওই একই পংক্তি – যেটা ‘সাহায্যকারীর’ কথা বলে, যিনি ‘তোমাদের কাছে চিরকাল থাকবেন।’ চলুন, পুরো পংক্তিটুকুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি:


ইউহোন্না ১৪:১৬ বিবৃত করে: “আমি (পয়গম্বর ঈসা আলাইহিস্ সালাম) পিতার (মানে খোদার) নিকট চাইবো, আর তিনি তোমাদের কাছে চিরকাল থাকবার জন্যে আর একজন সাহায্যকারী পাঠিয়ে দেবেন।” [বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ১৯৮০ সংস্করণ]


আমাদের ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাস যথাযথ হলে এবং আমরা প্রিয়নবী (صلى الله عليه وسلم)’এর হাজির-নাজির হওয়ার বিষয়টিতে বিশ্বাস করলেই কেবল আমরা খৃষ্টানদের প্রতি যথাযথ জবাব দিতে সক্ষম হবো।

এই বলে আমরা এ লেখাটির ইতি টানবো। আল্লাহতা’লা সালাফী ও দেওবন্দীদের হেদায়াত দিন। আমাদের ওয়েবসাইটে বিরাজমান ‘হায়াতে আম্বিয়া (عليه السلام)’ শীর্ষক লেখাটিও আপনারা দেখতে পারেন, যদি ‘আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দ তাঁদের মাযার-রওযায় জীবিত’ মর্মে মৌলিক সুন্নী আক্বীদা-বিশ্বাসে সালাফীরা বিভ্রান্তিতে পতিত হয়।

*সমাপ্ত*

Top