"তুলনামূলক ধর্মতত্ব বিশারদ শায়খ আহমাদ দীদাত(রাহঃ) এবং ডা: জাকির নায়েক: তুলনামূলক চিত্র"
------------------------------------------
সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারি
আমরা জানি যে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত দক্ষিন আফ্রিকান ক্ষন জন্মা পুরুষ এবং তুলনামূলক ধর্মতত্বের (Comparative Religion) পথিকৃত শায়খ আহমদ হুসেন দীদাত (১৯১৮-২০০৫ ইং) সারাটি জীবন ধরে সারা পৃথিবীতে বিধর্মী ধর্মবিশারদদের সাথে বিতর্ক করে গেছেন। তিনি বড় বড় ইহুদী খ্রীষ্টান ধর্মযাজকদেরকে বহছে পরাজিত করেছেন এবং ইসলামের মুখকে সারা পৃথিবীতে উজ্জল করেছেন। পৃথিবীর সকল ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে তাঁর ছিল অগাধ জ্ঞান। তুলনামূলক ধর্মতত্ব বা Comparative Religion এ তিনি এক কিংবদন্তিতুল্য প্রবাদপুরুষ।
কিন্তু তাঁকে একবার একলোক লাইভ এক অনুষ্ঠানে একটি বিষয়ে ফতোয়া জিজ্ঞেস করেন। শায়খ আহমাদ দীদাত রাহঃ উত্তরে বলেন, "Brother, I am not a mufti. There are lots of Mufti in this world. Go and ask them about this issue. If you have any questions on comparative religion then you can ask me and i will give you the solution in shaaa Allah. I am not a specialist on Islamic law and Jurisprudence."
অর্থ্যাৎ "ভাই আমি কোন মুফতি নই। পৃথিবীতে অনেক মুফতি আছেন, আপনি তাদের কাছে যান এবং জিজ্ঞেস করেন এই সম্পর্কে। আপনার যদি তুলনামূলক ধর্মতত্ব সম্পর্কে কোন কিছু জানার থাকে তবে আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করুন আমি আপনাকে ইনশা আল্লাহ সমাধান দিব। আমি ইসলামিক আইন শাস্ত্র ফিকাহ বিশারদ নই।" (ইউটিউবে ভিডিও দেখুন)
উনাকে লাইভ একটি অনুষ্ঠানে এক আরব লোক একবার জিজ্ঞেস করেন, আপনি ঈদে মিলাদুন্নবী(ﷺ) উদযাপন করেন অথচ এটা বিদআত। আপনি এরকম কেন করেন?
তিনি জবাব দিলেন, আমি এটিকে জায়েজ মনে করি এবং পালন করি। আপনার যদি ইচ্ছা না হয় আপনি করবেন না। আমার ভাল লাগে আমি করি। তিনি কোন অবস্থায়ই ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) পালন করা নিয়ে কোন দলিল দেন নাই বা জায়েজ-নাজায়েজ নিয়ে কোন তর্কেই যান নাই। (ইউটিউবে ভিডিও দেখুন)
তিনি জীবনে কোনদিন ইসলামের কোন মতবাদের দিকে মানুষকে ডাকেন নি। সরাসরি বা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কোনদিন কাউকে বলেন নি সুফি হও , সুন্নী হও, শিয়া হও, সালাফি হও, আহলে হাদিস হও, মাজহাবী হও বা লা-মাজহাবী হও। তবে ব্যক্তিজীবনে তিনি হানাফি মাজহাবের অনুসরণে ইসলামী শরীয়ত মানতেন, আকিদাতে আশয়ারি মাতুরিদি অর্থ্যাৎ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকিদা অনুসরণ করতেন। যেকেউ তাঁর সম্পর্কে খোঁজ নিলেই তা জানতে পারবেন। উইকিপিডিয়াতে তাঁর জীবনি পড়লে সেখানেও পাবেন। (নিচে স্ক্রিনশট দেখুন)
তিনি কোনদিন বলেন নি এটি হালাল, এটি হারাম, এটি শিরক, এটি বিদআত, এটি জায়েজ, এটি নাজায়েজ। তাঁর হাতেও অনেক অমুসলিম মুসলমান হয়েছেন , কিন্তু তিনি কাউকে কোন মতবাদে দীক্ষিত করেন নি। শুধু ইসলামটাই দিয়েছেন।
এটাই হচ্ছে একজন দায়ী আল ইসলামীর এক অনন্য গুণ। আমি যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই আমি সেই বিষয়ে কথা বলব না। আমি যদি সত্যিই ধর্মের প্রতি একনিষ্ঠ হই, বিনয়ী হই এবং ধর্মের প্রতি একাগ্রতা আমার ঠিক থাকে।
আসুন এবার তাঁরই অনুসারী ও ঘনিষ্ঠ ছাত্র দাবীদার বর্তমান যুগের আরেকজন তুলনামূলক ধর্মতত্ব বিশেষজ্ঞ , যিনি সব সময় দাবী করেন যে, শায়খ আহমাদ দীদাত আমার মেন্টর আমার গুরু, যিনি আসলে পেশায় চিকিৎসক, কিন্তু যিনি ইসলামের সর্ব বিষয়ে সকল সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন তার সম্পর্কে জানি। তার নাম ডা: জাকির নায়েক। তার প্রতিষ্ঠিত টিভি চ্যানেল "পিসটিভি"র প্রধান মেসেজ "মানবতার মুক্তির সমাধান"। আমরা সারা জীবন জেনেছি "সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে আল কুরআন"। কিন্তু উনার প্রতিষ্ঠিত একটি সামান্য টিভি চ্যানেলও নাকি মানবতার সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারে।
তিনি কোনদিন কোন মাদ্রাসাতে পড়েন নি। আরবী তিনি জানেন না (ইউটিউবে ভিডিও আছে তিনি বলছেন আমি আরবি জানি না, আমার ছেলে ফারেক নায়েক আরবি জানে)। ইংরেজী মাধ্যমে পড়ালেখা করেছেন। উর্দুটাও ঠিকমত বলতে পারেন না। নিজে নিজে পড়ালেখা করে তিনি সকল ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে ভাল জ্ঞান অর্জন করেছেন, এ কথা স্বীকার করতেই হবে। যাই হোক, একথা আমরা মানতে বাধ্য যে, তিনি তুলনামূলক ধর্মতত্বে একজন বিশেষজ্ঞ।
সে যাইহোক, উনাকে আমি প্রথম দেখি সেই ২০০০-০১ সালের দিকে পাকিস্তান ভিত্তিক ইসলামিক টিভি চ্যানেল Q-TV তে তুলনামূলক ধর্মতত্বের উপর লেকচার দিতেন। ভাল লাগত তার কথাবার্তা। বিধর্মী স্কলারদের সাথে রিলিজিয়াস হলি স্ক্রিপচারস থেকে এবং যুক্তি দিয়ে তিনি ভাল বিতর্ক করতেন। কিন্তু ২০০৮ সালে আল-আজহার পাশ করে মিশর থেকে দেশে ফিরে আসলাম এবং তার নিজের প্রতিষ্ঠিত টিভি চ্যানেলে পিসটিভিতে তাকে বক্তৃতা দিতে দেখলাম। তার প্রচুর অনুষ্ঠান দেখলাম, ৯ মাস যাবত প্রায় সব অনুষ্ঠান দেখলাম। এবার দেখলাম তিনি আর আগের সেই ডা: জাকির নায়েক নেই।
তার লেকচার শুধুমাত্র তুলনামূলক ধর্মতত্বের লেকচার ও বিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং তিনি ইসলামের এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি কথা বলেন না। দুনিয়ার সকল বিষয়ে তিনি ফতোয়া দিচ্ছেন। মানুষকে মাজহাব অনুসরন করতে নিষেধ করছেন। কোনটা বিদআত কোনটা শিরক আর কোনটা সুন্নাত তাও মানুষকে শেখাচ্ছেন। অবাক হলাম। পেশায় মূলত: চিকিৎসক, মুখস্থশক্তি খুবই ভাল হওয়ার কারনে ইংরেজীতে মুখস্থ করে করে তুলনামূলক ধর্মতত্বে লেকচার দেয়া এবং বিশেষজ্ঞ হওয়া লোক এখন শরিয়াতের সকল বিষয়ে ফতোয়া দিচ্ছেন।
আমরা যারা মাদ্রাসায় যৎসামান্য পড়ালেখা করেছি আমরা জানি যে, ফতোয়া দেয়ার জন্য কোরআন, হাদিস , উসূল, ফিকহ, উলুমুল কুরআন, উলুমুল হাদিস, তাফসীর, বালাগাত ও মানতিক, জরহ তাদীল, আরবী ভাষা ও ব্যকরন, শানে নুজুল, নাসিখ-মানসুখ, মক্কী -মাদানী, সীরাহ ও ইতিহাস ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে সম্যক ধারনা থাকা আবশ্যক। কিন্তু এই মানুষটা এসব বিষয়ে জানবে দূরে থাক কুরআন শরীফখানাও শুদ্ধভাবে পড়তে পারেন না এবং সবই ইংরেজীতে বলেন। তিনি এখন ইসলামের সকল হুকুম-আহকাম নিয়ে কথা বলছেন। আমভাবে তিনি ফতোয়া দিচ্ছেন।
তাও মধ্যমপন্থী কোন মতাদর্শ তিনি অনুসরন করছেন না, প্রচারও করছেন না। বরং তিনি সরাসরি হউক কিংবা ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে হোক সৌদী আরবের কট্টর উগ্রপন্থী ওয়াহাবী ও সালাফি -লা-মাজহাবী মতবাদ প্রচার করছেন জোরে শোরে। তিনি তার ইউটিউব ভিডিওতে অনেকবার দাবী করেছেন যে, আহলে হাদিস, সালাফী লা-মাজহাবীরাই ইসলামের সবচাইতে খাঁটি দল। হক্বের সবচাইতে নিকটবর্তী দল। (ইউটিউব ভিডিও দেখুন) যদিও তিনি নিজেকে আহলে হাদিস বা সালাফি বলতে নারাজ, নিজেকে বরং মুসলমান বলতে বেশি আগ্রহী।
কিন্তু নয়মাস যাবত তার পিসটিভি দেখে কোন একটা প্রোগ্রামে দশ মিনিটের জন্য এরকম একটা প্রোগ্রাম দেখলাম না যেখানে, আল্লাহর ভালোবাসা, প্রিয় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ভালোবাসা, উনার মর্যাদা, সম্মান, আল্লাহ পাক উনাকে কত ভালোবাসতেন, সাহাবাগন কিভাবে নবিজিকে ভালোবাসতেন, প্রিয় নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার পরিবার আহলে বায়তের ভালোবাসা, মর্যাদা, খুলাফায়ে রাশিদিন আম্মাজান আজওয়াজে মুতাহহারা গণের ভালোবাসা মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে ১০মিনিটের কোন অনুষ্ঠান দেখি নাই। মুহাব্বাত ভালোবাসা নামের জিনিসটার সাথে কী যেন শত্রুতা এই পিস টিভি নামক চ্যানেলটির৷
উল্টো সৌদী আরবের টাকায় কেনা রাজ-দরবারী মুফতীরা যেমন নবী বংশ হত্যাকারী ইয়াজিদ ইবনে মুআবিয়াকে খলিফাতুল মুসলিমিন বলে মান্য করে এবং রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলে তেমনি ডা: জাকির নায়েকও ইয়াজিদ এর নাম উচ্চারন করে রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু (May ALLAH BE pleased With Him) বলে। নাউজুবিল্লাহ মিন জালিক। (ইউটিউবে ভিডিও শোনুন)
এসব কিছু বিবেচনা করে, মনে প্রশ্ন জাগে ডা: জাকির নায়েকের টিভি চ্যানেল কার টাকায় চলে? পরিসংখ্যান বলে সারা পৃথিবীতে একটা টিভি চ্যানেল চালাতে বৎসরে তিন বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। পিসটিভিতে একটাও কোন প্রোডাক্টের এডভারটাইজিং করা হয় না। প্রশ্ন, এত টাকা কোথা থেকে আসে?
আরবের ওহাবী, সালাফি লা-মাজহাবীগন যদি এই টিভিকে স্পন্সর না করেন তবে পিসটিভি চলে কিভাবে? যৌত্তিক উত্তর চাই যদি কারো কাছে এর বিকল্প কোন যৌক্তিক উত্তর থাকে। এক সৌদী আরবই বছরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে তাদের সালাফি ও লা মাজহাবী মতবাদ সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ডা: জাকির নায়েকের পিসটিভি দিয়ে যদি তা হাসিল হয়ে যায় তবে আর অন্য কোন খাতে এই টাকা খরচ করার কি দরকার!