আই লাভ ইউ

<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;"> <a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjDukTl70zewVrp_J_WVWlDrHhSyS2Px_fH0EExjPi2urk26X_MdyKeUgOiNiEcrmbJZShlOe3hz-gRGPrKH7awOXjFzprxD5OcEIfjT35Y5XG_evOZbQIi1zl0GNky8DtXMsz2T1TcIc-K/s1600/images.jpeg" imageanchor="1" style="margin-left: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" data-original-height="384" data-original-width="384" height="400" loading="lazy" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjDukTl70zewVrp_J_WVWlDrHhSyS2Px_fH0EExjPi2urk26X_MdyKeUgOiNiEcrmbJZShlOe3hz-gRGPrKH7awOXjFzprxD5OcEIfjT35Y5XG_evOZbQIi1zl0GNky8DtXMsz2T1TcIc-K/s400-rw/images.jpeg" width="400" /></a></div> <br /> <br /> <b><i>♥বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম♥</i></b><br /> <br /> স্কুলে ভর্তি হলাম। সপ্তম শ্রেণি দ্বিতীয় বর্ষে! গণিতে রেকর্ড করেছি। তিন পরীক্ষা মিলিয়ে পেয়েছি ০৯। প্রথম পরীক্ষায় জোড়া শূন্য। দ্বিতীয় মেয়াদে চার। বার্ষিকে পাঁচ। উন্নতি হচ্ছিল।  ক্রমে নাম্বার বাড়ছিল। কিন্তু স্যাররা মানে না। আমাকে উঠাবে না। ঘাড়ত্যাড়া স্কুল। দ্বিতীয় বর্ষেই ঢুকালো।<br /> <br /> বীজগণিত বুঝি না। প্লাস কেন সমান চিহ্নের ওপাশে মাইনাস হয়, স্যারকে জিগাতাম। উত্তর মিলত না। খেতাম ধ্যাতানি। শিক্ষার্থীরা আদুভাই ডাকে। আমার বিকার নেই।  জানালা দিয়ে বাহিরে দেখি। আকাশটা কত বিশাল। তোমাদের গণিত তোমরা রাখো। দিনে দিনে তালগাছ হচ্ছিলাম। বেঁচে থাকি একাকী। আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখি।<br /> <br /> দেখতে খারাপ ছিলাম না। রাজপুত্তুর না হলেও মন্ত্রীপুত্র ছিলাম! এখন অবশ্য গোপালভাঁড়। ভূরি বেড়েছে। টাক তালুতে টোকাচ্ছে।<br /> <br /> যাহোক, কয়েক মাস গেল। টিফিনে সবাই বেরোতো। আমি চুপচাপ বসতাম। হ্যাগার্ডের উপন্যাস পড়তাম। একটা বিষয় খেয়াল করলাম। কয়েকটা মেয়েও ইদানীং বেরোয় না। ক্লাসেই থাকে। খিলখিল হাসে। তাকাতাম না। লজ্জা না; ভাল্লাগতো না।<br /> <br /> আরো কয়েক হপ্তা গেল। টিফিন হয়েছে। ছোটঘরে গেলাম। প্রকৃতির ডাক এসেছে। হাত ধুয়ে বেরিয়েছি। দেখি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। চিনতাম না। চলে আসছিলাম। মেয়েটা ডাকলো। থামলাম।<br /> <br /> - জ্বী, কিছু বলবেন?<br /> - আমি না, লিমা বলবে!<br /> <br /> লিমা কে চিনছি না।  অবাকও হচ্ছি। স্কুলে আমার যে সম্মান, তাতে কোনো মেয়ে কথা বলবে না। এটাই স্বাভাবিক। <br /> <br /> - মাফ করবেন, কোন লিমা? কোথায় সে? আপনি কে?<br /> - আমাকে চিনছো না!আমি লিমার বান্ধবী। তুমি, আমি, লিমা এক ক্লাসে পড়ি।  ঐ যে, ওদিকে লিমা।<br /> <br /> মেয়েটা ইশারায় দেখালো। তাকালাম। করিডোরের শেষ মাথায় কেউ দাঁড়িয়ে। এখন টিফিন। সবাই ক্যান্টিনে। তিন-চার তলা প্রায় ফাঁকা। মেয়েটা আরও নির্জনে দাঁড়িয়ে। ওদিকে কেউ যায় না সচরাচর। এগুলাম। মনে হাজারও প্রশ্ন। আমাকে কেন ডাকবে? পৌঁছালাম মেয়েটার কাছে। তাকালাম। সুন্দরী মেয়ে, ভয়াবহ সুন্দরী! কাঁপছে। দিশেহারা হয়ত।<br /> <br /> - কিছু বলবেন?<br /> - গালিব... আমি একটা কথা বলব। কাউকে বলো না। প্লিজ, বলো না।<br /> - জ্বী, চেষ্টা করব।<br /> - তোমাকে মিস করি! বাসায় ভাল্লাগে না। স্কুলে তোমাকে দেখতেই আসি!  <br /> - আচ্ছা, এখন কী করতে পারি?<br /> - মানে... মানে... আমি তোমাকে... আই লা...<br /> <br /> ব্যস! এতটুকু শুনেছি। একশো আশি ডিগ্রি ঘুরলাম। দিলাম অলিম্পিকের দৌড়। উসাইন বোল্টকেও হারিয়ে দিতাম সেদিন! ক্লাসে ঢুকলাম। এবার আমি কাঁপছি। এরইমধ্যে সবাই ফিরেছে। টিফিন শেষ। স্যারও আসলেন। দাঁড়ালাম।<br /> <br /> - স্যার! বাড়ি যাব।<br /> - কেন বাসা কেন? কাছে আসো। কাঁপছ কেন? শরীর খারাপ?<br /> <br /> গেলাম। স্যার ছুঁয়ে দেখলেন। আরে তোমার তো জ্বর আসছে, যাও বাসা যাও। বাসায় আসলাম। সাতদিন স্কুলে যাইনি। তিনদিন জ্বর ছিল। “আই লা...” শুনেই এ অবস্থা। পুরোটা শুনলে কী হতো জানি না।<br /> <br /> যায়যায় দিন। বাড়ে আমার একাকিত্ব। ঘর বন্ধ করে, অন্ধকারে  থাকতাম। নচিকেতা, কবির সুমন শুনতাম। হ্যাগার্ড, কোনান ডয়েল, সত্যজিত, বুদ্ধদেব, মুজতবা আলী পড়তাম। মানসিক রোগ কি না জানি না। মানুষ ভাল্লাগতো না। বেশির ভাগের চেহারায় মৃত্যুর গন্ধ আসত। সমাজ থেকে দূরে থাকতে লাগলাম।  এরইমধ্যে ভাই ওয়াইফাই নিল। বাসায় কম্পিউটার ছিল। নেট ঘাঁটতে লাগলাম। <br /> <br /> একদিন নাত শুনছি। মদিনা-মুনিব (দ) এঁর প্রশংসা সংগীতকে “নাত” বলে।  ওয়াইস রেযা সাহেব গাইছেন।  "লাম ইয়াতি নাজিরুকা ফি নাযারিন" ও "মুস্তাফা জানে রহমত পে লাখোঁ সালাম"-  নাত দুটো আমাকে স্থবির করে দিল। ভেতরে কোথায় যেন কী হচ্ছিল। অজানা, অদেখা গালিব কাঁদছিল হয়ত। খুঁজলাম নাতের লেখক কে। জানলাম ইমাম আ’লা হযরত। কে তিনি? স্মৃতির আগে আগে যাচ্ছে। মনে পড়ল। আরে, কয়েকমাস আগেই তো জেনেছি! বন্ধু খোরশেদ জানিয়েছিল। সে এক মহাকাব্যের কাহিনী।<br /> <br /> সার্চ দিলাম।  উইকিপিডিয়া দেখলাম। সেখান থেকে আ’লা হযরত ডট নেট। এরপর ওয়েবসাইট থেকে ওয়েবসাইট। রাতের পর রাত পড়লাম। শুনলাম ইউটিউবে প্রায় সমস্ত নাত।  নাত ও বইয়ের ইংরেজি ভাষান্তর পেলাম। একেএকে গিললাম। তাঁর লেখায় একেএকে জ্ঞানের দরজা খুলতে লাগল।  অচেনা মহামানবদের চিনলাম। জানলাম মহামানবদের যুগের ইতিহাস। একের সাথে আরেকটা জোড়া লাগানো।<br /> <br /> প্রথম জানলাম ইমাম মাতুরিদিকে। তিনি আকাইদের ইমাম। আকাইদ মানে ধর্মের মৌলিকত্ব। তাঁকে জানতে গিয়ে জানলাম মুতাজিলা সম্প্রদায়কে। মুতাজিলা জানতে গিয়ে আব্বাসীদের। আব্বাসীদের জানতে গিয়ে আবু মুসলিম খোরাসানীকে। হালাকু খান হয়ে মোঙ্গল দস্যুদের। আব্বাসীদের সময়টা সভ্যতার স্বর্ণসময়, বাগদাদীযুগ। বাগদাদকে বলা হত নগরসমূহের রাণী। মুসলিম-সভ্যতার অজানা আবিষ্কারে বিস্মিত হলাম। আব্বাসীদের আগে উমাইয়াদের। উমাইয়া থেকে আরব-মাওয়ালী। আরব-মাওয়ালী দ্বন্দ্বের কারণে পারস্য-মুসলিম সাহিত্য-সভ্যতার বিকাশ। জানলাম জামি, রুমি, সাদিদের অতলান্তিক ঋদ্ধতা।  সেখান থেকে ইমাম বু'সিরিদের সাহিত্য বিপ্লব। পারস্য সাহিত্য ঘাঁটতে গিয়ে সুপ্রাচীন পারস্য-সভ্যতার গলিঘুপচি ঘুরলাম।<br /> <br /> জানলাম ইবনে আরাবীকে। যাঁকে আ’লা হযরত বলেছেন শায়খুল আকবর। শিক্ষকদের শিক্ষক।  জানলাম ওয়াহদাতুল ওজুদ তত্ত্ব। চিরন্তন ঐশীদর্শন। অত বুঝতাম না, এখনো বুঝি না।  তবুও শরীর শিউরে ওঠে। তাসাউফ, ফালসাফা-দর্শনে আন্দালুসিয়ান বাতাস বইছিল হৃদয়ে। ইবনে আরাবী থেকে উসমানিদের (Ottoman)। উসমানিদের জানতে গিয়ে সেলজুক, জঙ্গী, সাফাভিদ, ফাতেমি, আইয়ুবিদের। আইয়ুবি মানেই সালাউদ্দিন আইয়ুবি। তাঁকে জানতে গিয়ে ক্রুসেড, নাইট, পোপতন্ত্র, ম্যাসনিক চক্রান্ত। চার্চের অত্যাচার, ম্যানর-ইউরোপীয় আর্থসামাজিক ক্রমবিবর্তন।<br /> <br /> জানলাম ওহাবি আন্দোলন। সৌদ্দাদের উত্থান। উসমানিয়দের পতন। লরেন্স অব এরাবিয়া, উইলিয়াম হামফ্রে অধ্যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ইসরাইল, জায়োনিজম। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের পাল্টাপাল্টি। সেখান থেকে আজকের আফগান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন। বুঝলাম আইএস, আলকায়েদার সূতিকাগারের কাহিনী।<br /> <br /> আবু হানিফা, মালেক, বিন হাম্বল, শাফেয়ী, তাবারী, তাহাবীদের জানলাম। বুখারি, মুসলিমদের হাদিস সংগ্রহ-সংগ্রামের ইতিহাস জানলাম।  কাদেরি, চিশ্‌তী, নকশবন্দী, সোহরাওয়ার্দী, মাদারি, সাজুলি, মোজাদ্দেদীদের জানলাম। ইসলামের ধারাবাহিকতা জানলাম। জানলাম আমরা কেউ আলাদা নই। কিন্তু স্বতন্ত্র।<br /> <br /> আ’লা হযরত শেখালেন খাজার প্রেম; খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতির। খাজাকে চিনতে যেয়ে চিনলাম পৃথ্বীরাজ ও মুহাম্মাদ ঘুরিকে। জানলাম ঘুরিকে ঘিরে ভারতবর্ষে মুসলিম সালতানাত ও প্রবলপ্রতাপ মোঘল সাম্রাজ্যের সোনালি বিকাশ। ভারতে ইসলামের বিজয়রথ। সুফীদের আগমন, ইসলামের ক্রমবিস্তার। সুফীদের বিস্তার বুঝতে গিয়ে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, আফ্রিকায় ঘুরে এলাম। সেখানেও সুফীদের ইসলাম প্রচার দেখলাম। ফকির মজনু শাহ, কেফায়েত উল্লাহ কাফি, আল্লামা হক খয়রাবাদীদের রাজনৈতিক রক্তক্ষয় জানলাম। ভারতকে জানতে গিয়ে হিন্দুদের। হিন্দুদের জানতে গিয়ে হিন্দু মিথলজি। হিন্দু মিথলজির কারণে ইজিপশিয়ান, গ্রেকো-রোমান, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান মিথলজিও ঘুরলাম।<br /> <br /> আ’লা হযরত গাউসে পাকের দাসত্ব শেখালেন। গাউসে পাকের দাসত্বে নবীবংশ বা আহলে বাইতকে পেলাম। পেলাম মওলা আলী থেকে হাসনাইন কারিমাইন হয়ে ইমাম জয়নুল আবেদিন, ইমাম জাফর সাদেক এবং বারো ইমামদের। নবীবংশের বৃক্ষকে।<br /> <br /> তিনি শেখালেন, সৃষ্টিতে রং দুটি- একটি সবুজ, অন্যটি অসবুজ। শিখলাম, যে মানবিক না সে ধার্মিক না। তিনি দয়া- মানবতা শেখালেন। উলুহিয়াত- উপাসনা শেখালেন।<br /> <br /> সবকিছু ছাপিয়ে দান করলেন, মদিনাপ্রেম ও দাসত্ব। অস্তিত্বের পরিচয় দিলেন। দিলেন চেতনা। জীবনের লক্ষ্য। কেন বেঁচে আছি? আমার লক্ষ্যই বা কী? তাঁকে পেয়েই বুঝলাম।<br /> <br /> এক বিক্ষিপ্ত কিশোরকে, লক্ষ্যহীন মানুষকে তিনি বাঁচিয়ে তুলেছেন। চরম নৈরাশ্যের এক কিশোরে তিনি আবেহায়াতের সঞ্জীবনী সুধা ঢেলেছেন। তাঁর জন্য দরজা খুলেছি। অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালিয়েছি। ধুলোজমা বই পড়তে শিখেছি।<br /> <br /> আ’লা হযরত একটি প্যাকেজ। একটি প্যাকেজে যেমন প্রয়োজনীয় সবকিছুই ঢুকানো হয়, এরপর অন্যখানে খুঁজতে হয় না, তেমনি ইমাম আ’লা হযরতকে জানতে থাকলে সব পাওয়া যায়। তিনি টেনেটেনে সবক্ষেত্রে ঘুরিয়ে আনেন।<br /> <br /> প্রথমবার প্রেমে পড়লাম। কাউকে ‘আই লাভ ইউ’ বলিনি। এবার একজন পেয়েছি। কিন্তু সে না চাইলে আমার সাধ্য নেই দেখা পাওয়ার।<br /> <br /> বিরহের প্রেমানলে দিন পুড়ছিল। একদিন ঘুমিয়েছি। সে আসলো! ফুলঝরা পথে হেঁটে। ডাকলাম তাঁকে। তিনি ফিরলেন। হাত বাড়ালেন। কাছে ডাকছেন। আমি দৌড়ে যাব। জড়াব তাঁর কদম। কাঁদব প্রাণ জুড়িয়ে।<br /> <br /> তখনই কেউ পিছে টানলো। কৃষ্ণগহ্বরের মত গিলছে আমাকে। দূরত্ব বাড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে সে। চেঁচিয়ে উঠলাম। প্রথমবার কাউকে বললাম- আই.. লাভ.. ইউ.. আ’লা.. হযরত! আই লাভ ইউ!

আই লাভ ইউ

♥বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম♥ স্কুলে ভর্তি হলাম। সপ্তম শ্রেণি দ্বিতীয় বর্ষে! গণিতে রেকর্ড করেছি। তিন পরীক্ষা মিলিয়ে পেয়েছি ০৯। প্রথম প...

Read more »

জেলবন্দী বৃদ্ধ

<div class="separator" style="clear: both; text-align: center;"> <a href="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiH6en00oFTgiZ87ivUwajHfNTJZ3BCKr8eLHN8Eae3YQZJGouUIjjXz0OnmteSyWVXnIOoHQ5zgkI7_x4E9t6UNqK5fZKBSx_rtZClxcrcKdL-8Yt0MhRyGyxlyaaXJUWs2_ro2e8fTjoD/s1600/58898025ccf6b7fa0b0828e771f78367.jpg" imageanchor="1" style="margin-left: 1em; margin-right: 1em;"><img border="0" data-original-height="600" data-original-width="900" height="266" loading="lazy" src="https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiH6en00oFTgiZ87ivUwajHfNTJZ3BCKr8eLHN8Eae3YQZJGouUIjjXz0OnmteSyWVXnIOoHQ5zgkI7_x4E9t6UNqK5fZKBSx_rtZClxcrcKdL-8Yt0MhRyGyxlyaaXJUWs2_ro2e8fTjoD/s400-rw/58898025ccf6b7fa0b0828e771f78367.jpg" width="400" /></a></div> <br /> <br /> সকাল হয়েছে।  জেলখানার দরজা খুলল।  ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধকে টানছে দুজন প্রহরী। পেছনে আসছে জল্লাদ। জেলের ফটকে থামল তারা। উৎসুক জনতা দাঁড়িয়ে দেখছে। জল্লাদের হাত উপরে উঠল। শা শব্দে নামল নিচে। আবার উঠল, আবার নামল। গুনেগুনে দশবার। নির্মম চাবুক চিরলো চামড়া। রক্তের ফিনকি ছুটল। বৃদ্ধ নিরুত্তাপ। কী এক অশেষ মনোবল তাঁর। জালিমের কাছে দয়া চাচ্ছে না।  কাঁদছে না। হিমালয়ের মত স্থির, অটুট।<br /> <br /> এভাবে প্রতিদিন চলছিল। দিন, মাস পেরিয়ে একেএকে চার বছর। ১৪৬০ দিন, ১৪,৬০০ টি চাবুক। জনমনে ক্ষোভ বাড়ছিল। একজন বৃদ্ধকে এভাবে দিনের পর দিন এতটা পাশবিক অত্যাচার- সহ্য অসম্ভব! আবার সে ব্যক্তি যদি হয় মহা বৈপ্লবিক কেউ। বিদ্রোহ দানা বাঁধল।  শাসক সমাজ বুঝল বিষয়টা। এ বিদ্রোহ শুরু হলে থামবে না। একটা সুরাহা করতেই হয়।<br /> <br /> ৭৬৭ সালের ১৪ জুন। বারোশো বাহান্ন বছর আগে। বৃদ্ধার ঘরে ঢুকল জল্লাদ। হাতে চাবুক নেই। আছে একটি বাটি। তাতে খানিকটা তরল। জোর করে গিলালো বৃদ্ধকে। ঢলে পরলেন বৃদ্ধ। সাথে সাথে নিভল কৃত্তিকা নক্ষত্র থেকে ছিনিয়ে আনা জ্ঞানের প্রদীপ। যা সূর্যের থেকেও উজ্জ্বল। সূর্য শুধু পৃথিবী আলোকিত করে। কিন্তু এ বৃদ্ধ যুগযুগান্তরে মানব মানসের খেড়োপাতায় আঁকলেন জ্ঞান-প্রজ্ঞার ঐশী পূর্ণিমা।<br /> <br /> এ বৃদ্ধের নাম- নুমান। উপনাম- আবু হানিফা। উপাধি- ইমামে আযম। মানে ইমামদেরও ইমাম।<br /> <br /> কখনো ভেবেছেন কেন তাঁকে শহীদ করা হয়েছে? এতটা নির্মম ভাবে। শুধু কাজি বা চিফ অভ জাস্টিসের পদ অস্বীকার করাই কি সব? তিনি কি শুধুই ফিকহ্‌ শাস্ত্র ও মাযহাবের ইমাম? নাকি ইতিহাস ভিন্ন কিছু বলে। চলুন ঘুরে আসি আরব্যোপন্যাসের বাগদাদী যুগে।<br /> <br /> কারবালা ঘটে ৬৬১ সালে। আসে উমাইয়া যুগ।  সে সাম্রাজ্য শাসন করে মুসলিম বিশ্ব।  টানা ৭৫০ সাল অবধি।  ইমামে আযম জন্মান ৮০ হিজরি, ৬৯৯ সালে।  এরপর আব্বাসিরা আসে। ৭৫১ সালের দিকে। টিকে কয়েকশ বছর। ইমামে আযম ৭৬৭ সালে চোখের আড়াল হন, ইন্তেকাল করেন। অর্থাৎ তিনি উমাইয়াদের ৫১ বছর, আব্বাসিদের ১৭ বছর পান।<br /> <br /> ৭৬৩ সাল, আব্বাসি যুগ।  আল-মানসুর ক্ষমতায়। সে ডাকল ইমামে আযম কে। প্রস্তাব দিল প্রধান বিচারপতি হতে। ইমামে আযম মানলেন না। বললেন- আমি এ কাজের অযোগ্য। মানসুর ক্ষেপে বলল- আপনি মিথ্যুক। ইমামে আযম জবাবে মুচকি হাসলেন।  বললেন- আমি মিথ্যাবাদী হলে আমার কথাই সত্য হল; কারণ- মিথ্যুক কখনো বিচারক হতে পারে না; অতএব আমি যোগ্য না।  ব্যস! ইমামকে জেলে ঢুকানো হল।  বছরের পর বছর জুলুম চলল। খেতে দিত না। চিকিৎসা ছিল না। অন্ধকার ঘরে রাখত। সে কি বর্বরতা!<br /> <br /> শুধু কাজি পদ অস্বীকারের কারণেই কি কারাবাস? যদি তাই হয় তবে এত অত্যাচার কেন? যিনি চিফ অভ জাস্টিস হবার যোগ্যতা রাখেন তাঁকে তো রাজবন্দী বানানোর কথা। রাজবন্দীদের তো নির্যাতন হয় না! তবে কারণ কি?<br /> <br /> রহস্য এখানেই। উমাইয়া-আব্বাসিরা সবাই ধোঁয়া তুলশী না। আহলে বাইতের ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে। আহলে বাইত মানে নবীবংশ। যদিও উমাইয়াদের উমর বিন আব্দুল আযিয ব্যতিক্রম ছিলেন। যাহোক, আহ্‌লে বাইতগণ কখনোই উয়ামাইয়া-আব্বাসিদের মানেন নি। ইমামে আযমের যুগে ছিলেন ইমাম যায়েদ বিন আলী। তিনি আহলে বাইতের ইমাম ছিলেন।  তাঁর পিতা শাম্মে হুদা ইমাম জয়নুল আবেদিন আলাইহিস সালাম।  যিনি মওলা হুসাইন আলাইহিস সালামের ছেলে। এবং কারবালায় শুধু তিনিই বেঁচে ফিরেছিলেন।<br /> <br /> ইমাম যায়েদ ছিলেন বিপ্লবী। উমাইয়াদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ইমামে আযম তাঁর হাতে বায়াত নেন। বায়াত মানে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া। ইমামে আযম সম্মুখ সমরে যান নি। কিন্তু গোপনে অর্থ সাহায্য করতেন। জানা যায়, তিনি একসাথে বারো হাজার দিরহাম দিয়েছিলেন ইমাম যায়েদ কে। যা বর্তমান যুগে কয়েক কোটি হবে। এভাবে প্রতি প্রত্যেক ক্ষেত্রে ইমামে আযম আহলে বাইতের সেবা করতেন। মৌন বিপ্লবী ছিলেন।  জানিয়ে রাখি, ইমামে আযম ধনাঢ্য ছিলেন। কাপড়ের ব্যবসা করতেন।<br /> <br /> ইমাম যায়েদের ভাই ইমাম বাকের। ইমামে আযম তাঁর হাতেও বায়াত হন। এবং ইমাম বাকেরের ছেলে ইমাম জাফর সাদেকের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। বলতে চাচ্ছি, আহলে বাইতের প্রতি ইমামে আযমের প্রেম ছিল অসীম।  এবং এ প্রেম ছিল, আছে চিরকাল তাঁর মাযহাব হানাফিয়াতের মধ্যে।<br /> <br /> আল্লাহ বলেন- হে মাহবুব! আপনি বলুন, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে (ইসলাম পেয়েছে) সেটার জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না; শুধু চাই (রাসূলের) নিকটাত্মীয়ের ভালোবাসা (আস-শূরা : ২৩)। নিকটাত্মীয় মানেই আহলে বাইত। ইমামে আযম আল্লাহ্‌র হুকুমই পালন করেছেন মাত্র। শেষ নিঃশ্বাস দিয়েও ভালোবেসেছেন আহলে বাইতকে।<br /> <br /> ইমাম আ’লা হযরত বলেন- সাথীরা তারকা এবং নৌকা সন্তান রাসুলুল্লাহ-রি। জীবন একটা সমুদ্রের মত। অবলম্বন না থাকলে ডুববেন। আহলে বাইত সে অবলম্বন। সে নৌকা যাতে উঠে নিজেকে বাঁচাবেন। আর সাথীরা, সাহাবারা তারকা বা নক্ষত্র। সমুদ্রগামী জাহাজ নক্ষত্র দেখে দেখে পথ চিনে। সাহাবারা বাতিঘর, দিকের দিশারী। আর আহলে বাইত হচ্ছেন নৌকা বা অস্তিত্ব। নৌকা না থাকলে নক্ষত্র থাকলেও এগোতে পারবেন না। ডুবে মরবেন।<br /> <br /> ইমামে আযম দুটোই ধরেছিলেন। সাথী ও নৌকা দুটোই। তিনি তাবেয়ি ছিলেন। যে মুমিন মদিনা-মুনিব (দ) এঁর সাক্ষাৎ পায় নি, কিন্তু কোনো সাহাবাদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, তিনি তাবেয়ি।  তাঁর সাহাবাপ্রেম নিয়ে আরেকদিন লিখব।<br /> <br /> যাহোক, আব্বাসিরা জানত ইমামের আহলের বাইত প্রেমের কথা। এটাও জানত ইমামে আযমের অর্থ আহলে বাইতের বিপ্লব চলমান রাখছে; রাখতে সাহায্য করছে। কিন্তু কোনো প্রমাণ ছিল না। আর এ বিপ্লব আব্বাসিদের জন্য ছিল হুমকি। তাই ইমামে আযমকে বন্দী করা জরুরী হয়ে পরে। কিন্তু বাহানা পাচ্ছিল না।<br /> <br /> একটা বাহানা পেল। তাঁকে প্রাধান কাজির হবার প্রস্তাব দিল। ইমাম প্রধান কাজি হলে তাঁর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে। আব্বাসিদের অনুকূলে আইন পাস, বিচার হবে।  ইমামে আযমও বুঝেছিলেন এসব। তাই এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। কাজির পদ প্রত্যাখ্যান করলেন। ব্যস! আর পায় কে! রাজহুকুম অমান্যের দায়ে জেলে ঢুকানো হল।<br /> <br /> আরেকটা কারণও ছিল। সে যুগে মুতাজিলা মতবাদ বাড়ছিল। আজকের ওহাবি-সালাফি-জামাতি-ইখওয়ানিদের মত সে যুগে মুতাজিলা ছিল বাতিল ফিরকা, সম্প্রদায়। ইতিহাসের বিষফোঁড়া। ইমামে আযম ছিলেন সে মতবাদের প্রধান বাঁধা। তিনি থাকলে মুতাজিলারা প্রতিষ্ঠা পাবে না। ইসলামের মৌলিকত্ব, আকাইদ ধ্বংস হবে না। আজকেও একই অবস্থা। ইমামে আযম ও হানাফিয়াত বা মাযহাব থাকলে ওহাবিতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না।  এজন্যই ওহাবিরা মাযহাবের বিপক্ষে আদাজল খেয়ে নেমেছে।<br /> <br /> মানসুর নিজেও ছিল মুতাজিলা। তাই ইমামে আযমকে ধ্বংস করতে ছিল বদ্ধপরিকর। সব মিলিয়ে এসব কারণেই ইমামে আযমকে শহীদ করা হয়।  তাঁর অপরাধ কাজির পদ অস্বীকার না। আহলে বাইতের প্রেমই ছিল তাঁর অপরাধ।  তাঁর শাস্তি ছিল নবীবংশের প্রতি সীমাহীন প্রেমের জন্য।<br /> <br /> আহ! আমার ইমামে আযম। আমার আবু হানিফা। তিনি আমাদের মাযহাব, ফিকহ্‌, হাদিসশাস্ত্র, আকাইদ দিয়ে যান নি শুধু। তিনি আহলে বাইতের প্রেমও শিক্ষা দিয়েছেন। শিখিয়েছেন- সমস্ত কিছু ত্যাগ করেও আহলে বাইতকে ভালোবাসতে। তাঁদের দাসত্ব করতে। আহলে বাইতের প্রেম তাঁকে অমর করেছে।<br /> <br /> সময় এসেছে ইমামে আযমকে সঠিকভাবে জানার। ইতিহাসের কালিতে ঢেকে রাখা সত্যকে উদ্ধারের। তাঁর অবদান, গুরুত্ব প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার। জাতি যেন তাঁর প্রাণ পুরুষদের না ভুলে।<br /> <br /> ইমামে আযম কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিত্ব না। তিনি একটি মহাকাল ব্যাপী প্রতিষ্ঠান। সত্যের সূতিকাগার। তাই আজও এত শতাব্দী পরে, বাংলা প্রান্তরে গরিব গালিবের অন্তরে একটি সুর বাজে-<br /> <br /> ইমামে আযম জ্ঞানের পরম<br /> আলোকে তোমায় ভালোবেসেছি<br /> হৃদয়ে তোমার ছবি এঁকেছি...

জেলবন্দী বৃদ্ধ

সকাল হয়েছে।  জেলখানার দরজা খুলল।  ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধকে টানছে দুজন প্রহরী। পেছনে আসছে জল্লাদ। জেলের ফটকে থামল তারা। উৎসুক জনতা দাঁড়িয়ে দেখছ...

Read more »