"জান্নাত-জাহান্নামঃ সুফি দৃষ্টিকোণ বনাম মোল্লাতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ"

-------------------------------------------




মাঝে মাঝে আমরা মাওলানা সাহেবদের কাছ থেকে জান্নাত জাহান্নামের এমন সব রগরগে বর্ণনা শুনি যে, রুচিশীল মানুষদের অন্তরে অনেক নেতিবাচক প্রশ্নের উদয় হয়। তাই বেহেশত ও দোজখ, দয়া করে এই কনসেপ্টটা মোল্লার দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে সুফিগণের দৃষ্টিকোণ থেকে জানার চেষ্টা করুন, ইন শা আল্লাহ আপনার সকল প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন। নারীবাদী (? এই নারীবাদী বা ফেমিনিস্ট নারীস্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দদের নিয়ে যদিও নিন্দুকেরা মজার একটি কথা বলেন। তাদের অনেকেই বলেন, "সব শেয়ালই মুরগীর স্বাধীনতা চায়। মুরগী যদি স্বাধীন না হয় তবে শেয়াল তার স্বার্থ চরিতার্থ করতে পারে না"। যাইহোক, নিন্দুকের কথায় আমরা কান না দিই 😀) অনেকে মানুষ প্রশ্ন তুলেন, "জান্নাতে পুরুষদের জন্য এত কিছুর ওয়াদা দেয়া হয়েছে, অথচ নারীদের জন্য সেই তুলনায় কিছু বলা হয়নি।" "এই দুনিয়াতে আমাদেরকে মদপান থেকে নিষেধ করা হয়েছে, অথচ জান্নাতে মদের নহরের ওয়াদা দেয়া হচ্ছে। এটা কেমন হয়ে গেলো না?" "অনন্ত জীবনের ওয়াদা দেয়া হয়েছে, মানুষ তো বোরিং ফিল করবে একসময়"। ইত্যাদি ইত্যাদি।



প্রিয় ভাই ও বোনেরা! বেহেশতের সবচাইতে বড় পুরস্কার হচ্ছে,  আল্লাহ পাকের দীদার, প্রিয় নবিজির ﷺ সঙ্গ, নবির আহলে বায়ত পরিবারবর্গ, খুলাফায়ে রাশিদিন, সাহাবাগণ, নেককার আওলিয়াগনের সোহবত তাঁদের সংস্পর্শ। এটা সবচাইতে বড় পুরস্কার।  এজন্য বুখারি মুসলিমের সহিহ হাদিসে বার বার এসেছে , "যার সাথে যার ভালবাসা তার সাথে তার হাশর নাশর।" তারপর কথা হচ্ছে, প্রত্যেক বেহেশত বাসীর উপর আল্লাহ রাজি থাকবেন, রাসুল ﷺ রাজি থাকবেন, সকল পূন্যবানগন রাজি খুশি সন্তুষ্ট থাকবেন। জান্নাতবাসীরাও রাজি থাকবেন আল্লাহ পাক ও সকল বেহেশতবাসীর ওপর। 

يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ

হে প্রশান্ত মন,

ارْجِعِي إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً

তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।

فَادْخُلِي فِي عِبَادِي

অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও।

وَادْخُلِي جَنَّتِي

এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। 
(আল কুরআন ৮৯ঃ ২৭-৩০)



সেখানে কারো কোন অভিযোগ থাকবে না, পুরুষেরও না, নারীরও না। রুহানি ও শারিরীক, মেটেরিয়াল ইম্মেটেরিয়াল সকল চাহিদা পরিপূর্ণ থাকবে, কোন দুঃখ, আফসোস, হতাশা, ক্লান্তি, একঘেয়েমি  কিছুই থাকবে না।



 পুরুষদেরকে তো আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেছেন, তাই না? তিনি জানেন এই জাতিটার জৈবিক চাহিদার লালসা অনেক বেশি। তাই এর লোভ দেখিয়েই তিনি এই পুরুষ জাতিকে একটু ট্রেকে রাখতে চেয়েছেন। এটা মহা প্রজ্ঞাময় আল্লাহর হিকমত। কোন নারীও অভিযোগ, হতাশা ও আফসোস, ইচ্ছা অপূরণ আছে বলার সুযোগ পাবে না। 



আর জাহান্নামবাসী এই সকল কিছু থেকে বঞ্চিত থাকবে। তাদের জন্য সবচাইতে বড় শাস্তি হবে তারা আল্লাহ পাক, প্রিয় নবিজির ﷺ সঙ্গ, নবির আহলে বায়ত পরিবারবর্গ, খুলাফায়ে রাশিদিন, সাহাবাগণ, নেককার আওলিয়াগনের সোহবত তাঁদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবে। শারীরিক বিভিন্ন শাস্তি তো থাকবেই। 



কিন্তু আমাদের উলামায়ে কেরাম জান্নাত জাহান্নামের স্পিরিচুয়াল পুরস্কারের (ইম্মেটেরিয়াল পুরস্কারের) দিকটি বর্ণনা না করে,  শুধুমাত্র মেটেরিয়ালিস্টিক পুরস্কারের দিকগুলোর রগরগে বর্ণনা দেন। হুর, গেলমান, শরাবের নহর, দুধের নহর, মধুর নহর, সুমিষ্ট পানির নহর, আপেল আংগুর ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব বর্ণনা কুরআন হাদিসেই এসেছে। কিন্তু সকল গুরুত্ব এসবের উপরে দিয়ে দিলেই সমস্যা দাঁড়িয়ে যায়। 

এসব হচ্ছে শরীয়তি বা মোল্লাতান্ত্রিক ব্যাখ্যা। কিন্তু সুফিগণ জান্নাত জাহান্নামের এমন একটা স্পিরিচুয়াল ডাইমেনশন আমাদেরকে দেখান যা প্রশ্নের উর্ধ্বে। 



তাই  তো আমরা দেখি যে, বিখ্যাত সুফি ইমাম হাসান আল বাসরি রাহঃ বসরাতে দরস দিতেন। হজরতে রাবেয়া বসরি রাহঃ সেই দরসে নিয়মিত অংশ নিতেন পর্দার আড়ালে থেকে। নানান প্রশ্ন করতেন। আলোচনা হত দুজনের মাঝে দ্বীন ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে। একবার বেশ কিছুদিন ধরে হজরত রাবেয়া বসরি রাহঃ দরসে আসছেন না। তাঁর কী হলো জানার জন্য ইমাম হাসান বসরি রাহঃ রাবেয়া বসরি রাহঃর বাড়িতে গেলেন। গিয়ে দেখতে পেলেন তিনি খুব অসুস্থ। প্রচন্ড জ্বর। জিজ্ঞেস করলেন, "বিবি! এত জ্বর কী কারণে হঠাৎ করে?" হজরতে রাবেয়া বসরি রাহঃ জবাব দিলেন, "আমি কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করছিলাম। জান্নাতের নিয়ামতের বিবরণ পড়ে আমার  অন্তরে জান্নাতের প্রতি প্রচন্ড লোভ পয়দা হলো। সেসময় গায়েব থেকে আওয়াজ আসলো, " হে রাবেয়া! ভালোবাসার দাবি কর আল্লাহর, আর অন্তরে জান্নাতের লোভ? এ কেমন ভালোবাসা?"



এমনকী জ্বরের প্রকোপ বেড়ে যাওয়াতে তিনি এক হাতে পানি এবং অপর হাতে আগুন নিয়ে দৌড়াতে লাগলেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে হজরত রাবেয়া বসরি রাহঃ জবাব দেন, "আমি  আগুন দিয়ে জান্নাত জ্বালিয়ে দিতে চাই এবং পানি দিয়ে জাহান্নাম নিভিয়ে দিতে চাই। কারণ, অধিকাংশ মানুষ জান্নাতের লোভে এবং জাহান্নামের ভয়েই শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করে। আল্লাহর ভালোবাসা তাদের অন্তরে থাকে না।" আমাদের সমস্যাটা এখানেই। এই "ভালোবাসা" নামক মূল বিষয়টিতে আমরা জোর দিই না। এখানে এসেই মোল্লাতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা এবং সুফিগণের চিন্তাচেতনা আলাদা হয়ে যায়। 



আমরা সাধারণ মানুষ, তাই যখনই জান্নাতের বর্ণনা আমাদের সামনে আসবে তখনই জান্নাতের লোভ আমাদের অন্তরে পয়দা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রকৃত মুমিন হতে হলে আমাদেরকে আল্লাহর ভালোবাসা, প্রিয় নবিজির ﷺ ভালবাসা, নেককার পরহেজগারগণের ভালবাসার ওপরে জোর বেশি দিতে হবে। প্রেমপ্রীতির ওপর জোর বেশি দিই, বস্তুবাদের ওপর জোর কম দিই।
Top