যিঁনি সবার, আজ তাঁর দিবস: কেন তিঁনি?
-----গোলাম দস্তগীর লিসানী
[এই লেখাটা উদ্দীপক; এই একটাকে অনুসরণ করে অসংখ্য জট খুলে যাবে, পাওয়া যাবে অনেকগুলো ক্লু]
গাউসে পাক জিলানী (رحمه الله تعالي) কে নিয়ে লিখতে লজ্জা লাগে। লজ্জার চারটা কারণ:
১. তাঁর অনুসারী শুধু খাতা কলমে আমরা (অর্থাৎ আমার মত অভাজনেরা)। বাস্তব কর্মকান্ডে তো তাঁর ছায়াও নেই।
২. তিঁনি যে একান্তই আমাদের, আমার। যে একান্তই আমার, তাকে নিয়ে কিছু বলা বা লেখা লজ্জাশীলতার বিষয়।
৩. জগৎজুড়ে অসংখ্য মানুষ। অসংখ্য তাদের ইমাম। আমি আমার ইমামকে নিয়ে কিছু বললে সেটা কারো মনে অস্বস্তির কারণও তো হতে পারে!
৪. তাঁর বিশালত্ব এতই বেশি যে, সেটা কম করে লিখলেও বাড়িয়ে বলা হচ্ছে, এমন মনে হয়। যত কম করে, যত কেটেছেঁটে, যত মডেস্ট করেই লেখা হোক, তা বাড়াবাড়ি মনে হবে।
পৃথিবীতে গাউসে আযম জিলানী (رحمه الله تعالي)’র অনুসারীর সমান সংখ্যক অনুসারী কি কোন সূফি ধারায় আছে? নেই। সম্ভব না।
গাউসে আযম জিলানী (رحمه الله تعالي)’র খিলাফাতের ধারায় তো শুধু তরিক্বায়ে ক্বাদিরিয়া নয়। যদিও তরিকায়ে কাদিরিয়া সবচে বড় একক তরিকা। আরো অনেকগুলো তরিক্বা গাউসে পাক জিলানী (رحمه الله تعالي)’র অধস্তন পুরুষ থেকেই এসেছে। এসেছে তিনভাবে:
১. অনেক সূফি তরিক্বা এসেছে গাউসে পাক জিলানী (رحمه الله تعالي)’র বংশধরদের কাছ থেকে।
২. অনেক সূফি তরিক্বা এসেছে তাঁর খলিফাদের কাছ থেকে।
৩. অনেক তরিক্বা এসেছে এমন কিছু ব্যক্তির কাছ থেকে যারা না গাউসে পাক জিলানী (رحمه الله تعالي)’র বংশধর, না খলিফা। স্রেফ ভক্ত, স্রেফ রূহের জগতে নৈকট্যপ্রাপ্ত অনেকে গাউসে জিলানী (رحمه الله تعالي)’র ফয়েজ ও নিসবত থেকে তরিকাপ্রাপ্ত হয়েছেন।
খাজা গরীব নাওয়াজ (رحمه الله تعالي) গাউসে পাক জিলানী (رحمه الله تعالي)’র বংশধরও নন, মুরিদও নন, কিন্তু গাউসে পাক জিলানী (رحمه الله تعالي)’র ছায়াতলে। ইবনুর রিফায়ি (رحمه الله تعالي) তো সমসাময়িক। গাউসে পাক জিলানী (رحمه الله تعالي) বলেন, কাযা ইবনুর রিফায়ি কানা মিন্নি। ইমামুত তরিকত ইবনুর রিফায়ি (رحمه الله تعالي) আমারই অনুসারী। মুজাদ্দিদে আলফি সানি (رحمه الله تعالي) একদিক দিয়ে গাউসে পাক জিলানী (رحمه الله تعالي)’র তরিকার সাথে সম্পর্কিত নন। অন্যদিক দিয়ে তিনি গাউসে জিলানী (رحمه الله تعالي)’র তরিকার খলিফা, এমনকি তাঁর সম্মানিত পিতাও তরিকায়ে কাদিরিয়ার খলিফা। তিনি তো বিশেষ কিছু স্তর পেরুতে গাউসে জিলানি (رحمه الله تعالي)’র রুহি নৈকট্যের অবদান লিখে গেছেন।
তো,
যদি সরাসরি শুধু কাদিরিয়া তরিকার অনুসারীদের সংখ্যা বলি, তাতে সংখ্যা হবে সবচে বেশি।
আবার যদি গাউসে পাকের বংশধরদের মধ্য থেকে আসা অন্যান্য তরিকা বলি, সংখ্যা আরো অনেক বেশি বেড়ে যাবে।
এভাবে তাঁর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা রেখেছেন এবং রুহানীভাবে তাঁর দান পেয়েছেন কিন্তু বংশধরও নন, সিলসিলায় মুরিদও নন- এমন ইমামুত তরিকতদের মধ্যে এই মুহূর্তেই অন্তত তিন চারটি নাম মনে আসছে।
অনেক তরিকার ইমাম তাঁর সাধনাকালীন সময়ে গাউসে পাকের রুহানী সাহচর্য এবং সহায়তার কথা অকপটে বলেছেন। গাউসে পাক যে তাঁরও! গাউসে পাক যে সবার! যিঁনি আল্লাহ্’র, যিঁনি আল্লাহ্’র রাসূল দ.’র- তিঁনিই ই তো সবার! যিঁনি ইমামদের ইমাম হওয়ার আগের ইমাম, যিঁনি ইমামদের ইমাম হওয়ার আগের রুহী পথপ্রদর্শক- তিনিই তো সবার!
এটা তো গেল প্রাতিষ্ঠানিক সূফি ইমাম হিসাবে তাঁর উচ্চতার কথা। এবার আসা যাক তাঁর অবদানে:
পৃথিবীতে এমন একজন মুসলিমও নেই, যে এবং যার পূর্বপুরুষরা গাউসে পাক জিলানী (رحمه الله تعالي)’র প্রশিক্ষণ, আত্মত্যাগ ও শিক্ষার উপকার পায়নি।
বাংলাদেশের রাজশাহী থেকে নোয়াখালী, সুদূর জাভা (ইন্দো-মালয়) অঞ্চল থেকে শুরু করে আফ্রিকার গহীন বন- সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমন সব ইসলাম প্রচারক সূফির মাযার, যাঁরা সেসব অঞ্চলে একেবারে আদি ইসলাম প্রচারক হিসাবে এসেছিলেন। যাঁদের হাতে ওই অঞ্চলগুলোর মানুষ প্রথম মুসলিম হয়েছিল।
একটা বিরাট সংখ্যা গাউসে পাকের সরাসরি বংশধর।
কেউ কেউ তো ছেলে ও নাতি।
আবার সারা পৃথিবীতে যত জায়গায় ইসলাম আজকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই সমস্ত জায়গায় দেখা যাবে গাউসে পাক জিলানী (رحمه الله تعالي)’র খলিফা ও মুরিদরা একেবারে প্রথম দিকেই গিয়েছিলেন।
অঞ্চলের পর অঞ্চল, কোটি কোটি মুসলিম হয়েছে গাউসে জিলানীর অনুসারীদের হাত ধরেই। সিলেটের হজরত শাহ জালাল (رحمه الله تعالي) কে? কে মুন্সিগঞ্জের শাইখ আদম আশ্ শহীদ?
৭০০ বছর মুসলিম জাহানের মাথায় রোদ ঝড় বৃষ্টিতে বিশাল ছাতা হয়ে থাকা তুর্কি খিলাফাত কার রুহি নৈকট্য থেকে শুরু হয়েছিল? শাইখ মুহিউদ্দিন আল আরাবী (رحمه الله تعالي)’র? কে মুহিউদ্দিন আল আরাবী? পৃথিবীর যতজন মুসলিম তুর্কি খিলাফাতের অবদান ভোগ করেছে, প্রত্যেকে গাউসে জিলানির প্রতি সরাসরি ঋণী।
কে সালাহউদ্দিন আইউবি? পৃথিবীর যতজন মুসলিমের ঈমান টিকে আছে ক্রুসেডে আইউবির বিজয়ের সৌজন্যে, তাদের প্রত্যেকে গাউসে জিলানির প্রতি ঋণী।
খাজা মুঈন (رحمه الله تعالي) এসেছিলেন বলে না আমরা শিরক থেকে মুক্ত হয়েছি! মুজাদ্দিদে আলফি সানি (رحمه الله تعالي) এসেছিলেন বলে না আজকে আমরা ‘দ্বীনে এলাহি’র বদলে মুসলিম। ইমাম আলা হযরত (رحمه الله تعالي) এসেছিলেন বলে না আজকে আমরা ডিজিটাল তাসাউউফের বদলে, হাইপার ওয়াহাবিয়াতের বদলে আদি তাসাউউফ ধরে রাখতে পেরেছি!
একবার শুধু ভাবুন তো- কত মাল্টি ডাইমেনশনে গাউসে জিলানীর অধস্তন ও অনুরক্তরা তার রুহি সংশ্লিষ্টতার কারণে আমাদের কত্ত আলাদা আলাদা যুগে রক্ষা করেছেন!
আজকে আমাদের ঈমান টিকে আছে, তার পেছনে কত্ত আলাদা আলাদা যুগে কত্ত আলাদা আলাদা মহান ব্যক্তির সরাসরি অবদান! আর সেই মহিম ব্যক্তিগুলো কত্ত আশ্চর্যভাবে গাউসে পাকের রুহি গাইডেন্সের মাধ্যমে এগিয়েছেন!
মুসলিম হয়েছি, সেটাও গাউসে পাকের বংশধর ও খলিফাদের চেষ্টায়।
৭০০ বছর খিলাফাত পেয়েছি সেটাও তাঁর প্রশিক্ষিতদের সরাসরি অবদান।
দ্বীনে এলাহি হইনি, সেটাও তাঁর সাথে সম্পর্কযুক্ত মাওলা শাইখ আহমাদ আল সিরহিন্দির অবদান।
ওহাবি শিয়া বা ডিজিটাল সূফিপন্থী বা দেহবাদী রসবাদী সূফিপন্থী কোনটাই হইনি সেটাও তাঁর মুরিদ আলা হযরতের অবদান।
ক্রুসেডের ধাক্কায় মক্কা মদীনা পৌছে যেতো ইউরোপীয়রা, মুসলিম আছি সেটাও তার মুরিদদের নিয়ে গঠিত আইউবী বাহিনীর অবদান।
যুগে যুগে মুসলিম সালতানাতগুলো, যেমন ভারতের মুঘল সালতানাত থেকে শুরু করে তাতার (মোঙ্গল) সালতানাত পর্যন্ত গাইডেন্সও তারই অবদান।
আজো সূফি পাচ্ছি, আজো আমরা মাদ্রাসা পাচ্ছি, আলিম পাচ্ছি, খানকাহ পাচ্ছি, দরগাহ পাচ্ছি, আল্লাহ্’র ওয়ালীদের সামনাসামনি পাচ্ছি- এরা প্রায় প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গাউসে জিলানীর অবদানের সাথে যুক্ত।
আজো গহীন আফ্রিকার একেকটা গ্রামে যান। যান জাভা অঞ্চলের দুর্গম অনুন্নত বিভিন্ন বনের বসতিতে। সেখানে তারা মুসলিম হয়েছে কার দ্বারা, জিগ্যেস করেন। কে সবচে বড় ওয়ালী, জিগ্যেস করেন।
একবার ভাবুন তো,
ঠিক কয়টা ডাইমেনশনে এক গাউসে আযম জিলানী (رحمه الله تعالي)’র অবদান আল্লাহ্’র রহমতে আমাদের বাঁচিয়েছে?
তিনি যদি গাউসে আযম পদবীধারী না হবেন, তো কে হবে? তিনি যদি সকল ওয়ালীর শ্রেষ্ঠ না হবেন, তো কে হবে?
তাঁর মর্যাদাকে চাইলে আমরা ডিজিটালাইজ করেও মাপতে পারি। রাসূল দ. বলেছেন, যে যাকে ভালর পথ দেখায়, সে ওই সমস্ত ভালর মর্যাদা পায়। সমান সওয়াব পায়।
ভাবুন তো, পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে গত ৮০০ বছর কত শত কোটি মুসলিম আছে এবং ছিল এবং থাকবে? ইরাক, আফগান, তুরস্ক, ইন্দো, মালয়, চীন, মঙ্গোলিয়া এবং সমগ্র আফ্রিকায় কত মুসলিম ছিল আছে এবং থাকবে? এরা প্রায় প্রত্যেকে মুসলিম হয়েছে গাউসে জিলানীর খলিফা এবং বংশধরদের দ্বারা। যারা আগের প্রচারে মুসলিম হয়েছে, তারা ইসলামে টিকে ছিল এই খলিফা এবং বংশধরদের আসার মাধ্যমে। খোদ আরবেও টিকে থাকার বিষয়টা এমনি।
এই প্রত্যেকটা মানুষের প্রতিটা সিজদা, প্রতিটা রোযা, প্রতিটা নি:শ্বাসে আল্লাহ্ ডাক এর টোটাল সওয়াব ভাবুন তো। টোটাল যোগফলটা যুক্ত হবে গাউসে জিলানীর অ্যাকাউন্টে। যে যাকে পথ দেখায়, সে তার সব সৎ কাজের সমান সওয়াব পায়।
এবার গাউসে জিলানী (رحمه الله تعالي)’র নেকি হিসাব করুন তো!
গাউসে পাক জিলানীর বড়ত্বের, মহত্বের, বিশালত্বের, তাঁর মর্যাদা এবং পদবির পরিচয় কীসে?
তাঁর প্রভাবে। তাঁর টোটাল অবদানে। তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া নেকিতে।
বৃক্ষ, তোমার নাম কী?
ফলে পরিচয়।