পবিত্র ইলম ও আকল


উপরোল্লেখিত দলীল প্রমাণ সমূহের আলোকে জানা গেলো যে, নবী করীম (ﷺ) এর প্রশংসনীয় আখলাক সুমহান, সর্বাধিক পূর্ণ ও কামেলে মুকাম্মল ছিলাে। আর এ মহান আখলাকের মূল, উৎস ও উৎপত্তিস্থল হলাে আকল। কেননা আকল থেকেই এলেম ও মারেফতের লতা-তন্তু অংকুরিত হয়। তা থেকেই সিদ্ধান্ত প্রদানের দৃঢ়তা, দবীরে, চিন্তা চেতনায় স্বাচ্ছন্দ, পরিণামে বিশুদ্ধতা, নফস কল্যাণ সমূহ, প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে কঠোর, সুন্দর শাসন ও প্রতিপালন, সৌন্দর্যের প্রচার প্রসার ও নিকৃষ্ট ও মন্দ স্বভাব চিরতরে পরিত্যাগ ইত্যাদি গুণ সমূহের উদ্ভব হয়।


আকলের হাকীকত কি? এ সম্পর্কে মতানৈক্য আছে। অভিধান গ্রন্থে এর সংজ্ঞা এভাবে প্রদান করা হয়েছে, বস্তু সমূহের ভালাে-মন্দ, উৎকর্য- অপকর্ষ, পূর্ণতা ও ত্রুটি ইত্যাদির মূল্যায়ন ক্ষমতাকে আকল বলা হয় । আবার এ সমস্ত মূল্যায়ন করা অনেক সময় শুধু আকলের দ্বারা সম্ভবপর হয় না। এলেম ও আকলের বিদ্যা ও বুদ্ধির) সমন্বিত ফলাফল দ্বারা এটা হাসিল হয়ে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আকল এমন এক শক্তি যা এলেমের উৎস, উৎপত্তিস্থল ও প্রস্রবন তুল্য। আকলের সংজ্ঞা এরূপ বলা হয়ে থাকে যে, মানুষের তৎপরতা ও অস্থিরতায় প্রশংসনীয় অবস্থার নাম আকল। হাঁটাও আকলের বৈশিষ্ট্য সমূহের অন্তর্ভূত।


উলামাগণ যে রকম বর্ণনা করেছেন, সে পরিপ্রেক্ষিতে আকলের সঠিক সংজ্ঞা হচ্ছে, আকল একটি রুহানী নূর যা দ্বারা এলমে জরুরী (স্বাভাবিক জ্ঞান) ও এলমে বদিহী (যুক্তিনির্ভর জ্ঞান) হাসিল হয়। মানব সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই আকলের আবির্ভাব ও অবস্থান সূচিত হয়। অতঃপর ক্রমে ক্রমে তা বাড়তে থাকে এবং পরিণত বয়সে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।


হুজুর আকরাম (ﷺ) এর আকল ও ইলমের পূর্ণতার স্তরে এমন ছিলাে যে, তিনি ব্যতীত অন্য কোনাে মানুষের পক্ষে সে স্তরে উপনীত হওয়া আদৌ ঋব নয়। আল্লাহতায়ালা তার উপর যে এলেম ও আকলের ফয়েয বর্ষণ করেছেন, তার কতিপয় এমন যে, সে সম্পর্কে চিন্তা করলে মানুষের চিন্তা জ্ঞান স্থবির হয়ে যায়। কেউ যদি হুজুর আকরাম (ﷺ) এর অবস্থা, তার প্রশংসনীয় গুণাবলী ও সৌন্দর্যময় কার্যাবলী অনুসন্ধান করে, তাহলে তার প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির উচ্চমান সম্পর্কে হয়তাে কিঞ্চিৎ আঁচ করতে পারবে। তার জামে কালাম, সুন্দর শামায়েল, দুর্লভ ও সুক্ষ্ম আচরণ সমূহ, রাষ্ট্রনৈতিক রক্ষণাবেক্ষণ, শরীয়তের বিধান প্রকাশ ও তার বর্ণনা, মর্যাদা মন্ডিত শিষ্টাচার সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা,সুন্দর চরিত্রের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ, আসমানী কিতাব ও সহিফা সম্পর্কিত জ্ঞান, অতীত জাতিসমূহের ইতিবৃত্ত, অতীত কাল সমূহের প্রকৃতি, তার কাহিনী ও ঘটনাবলীর বর্ণন— আরব বেদুইন হিংস্র হায়েনার ন্যায় ছিলে, যাদের স্বভাব চরিত্র, মূর্খতা, অজ্ঞতা, হিংস্রতা ও হতভাগ্যতায় পরিপূর্ণ ছিল, তাদেরকে তিনি কেমন করে সংশোধন করলেন। তাদের যুলুম অত্যাচার, পীড়া-যন্ত্রণাকে তিনি কেমন করে হাসিমুখে বরণ করে নিলেন। তিনি চরম নির্যাতনকালে ধৈর্যের পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। তদুপরি তাদেরকে এলেম, আমল ও সুন্দর আখলাকের মাধ্যমে সভ্যতার চরম শিখরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্যের পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। তারপর সেই আরব বেদুইনরা কেমন করে সে সৌভাগ্যের নীতিমালাকে নিজেদের জীবনের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। এক কালে তারা যে মহামানব কে অত্যাচারে জর্জরিত করে দিয়েছিল, সেই মহান রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পরবর্তী তারা বন্ধু-বান্ধব, সহচর- সহযোগীরা এমনি আপন পরিজন কে বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেন। এ সমস্ত বিষয়ে যদি কেউ অধ্যয়ন করে তাহলে সে হয়তাে অনুধাবন করতে সক্ষম হবে মহামানব, মহান রাসুল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) এর আকার কতটুকু পরিপূর্ণ ছিল। জানতে পারবে যে, মহানবী (ﷺ) এর ইলমের মর্যাদা ও স্তর কেমন ছিল।


কেউ রসূলে আকরাম (ﷺ) এর জীবনের বিভিন্ন অবস্থা আদ্যোপান্ত অধ্যয়ন করলে দেখতে পাবে আল্লাহতায়ালা তাকে কি পরিমাণ জ্ঞান প্রদান করেছেন। বুঝতে পারবে আল্লাহ তায়ালার ফয়েজের প্রবাহ কি রকম জারি ছিলাম তার উপর। অতীত ও ভবিষ্যতের এলেম সমূহ ও বহুবিধ গুপ্ত রহস্য সম্পর্কে অবলীলাক্রমে তার যে অবগতি ছিলো, তাতে নির্দ্বিধায় ও নিঃসন্দেহে নবুওয়াতের এলেম সম্পর্কে ধারণা লাভ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ফরমান, “আপনি জানেন না আল্লাহতায়ালা সে সবই আপনাকে জানিয়ে দিয়েছেন। অনন্তর আপনার উপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ মহান।'


হযরত ওহাব ইবনে মুনাবি তাবেয়ী হাদিস শাস্ত্রের সনদে নির্ভরশীল এক মহান ব্যক্তিত্ব, মহাসত্যবাদী আল্লামা, হাদীছ শাস্ত্রের বিশেষ পণ্ডিত ও প্রণেতা ছিলেন। তিনি বলেন, উলামায়ে মুতাকাদ্দিমীন একাত্তর খানা কিতাব অধ্যয়ন করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ঐ সমস্ত কিতাবে আমি দেখেছি যে, হক সুবাহানাহু তায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি লগ্ন থেকে লয় প্রাপ্তি পর্যন্ত সকল মানবমন্ডলীকে যে পরিমাণ আকল ও জ্ঞান প্রদান করেছেন এবং করবেন, সকলকে যদি একত্রিত করা হয়, তাহলে এ সমষ্টিভূত জ্ঞান হুজুর আকরম (ﷺ) এর আকল মুবারকের একপার্শ্বতুল্য হবে। সারা জাহান যদি মরুভূমিতে পরিণত হয়, তাহলে সে মরুভূমির বালুকারাশির সমতুল্য হবে হুজুর পাক (ﷺ) এর এলেম ও আকল। যার একখানা বালুকণা তুল্য হবে সমস্ত জাহানের এলেম ও আকল। আবু নাঈম (رحمة الله) তাঁর ‘হুলিয়া' নামক কিতাবে এবং ইবনুল আসাফির তার ইতিহাস গ্রন্থে এ কথা উল্লেখ করেছেন।


‘আওয়ারেফুল মাআরেফ' গ্রন্থে কোন কোন আলেম থেকে এরূপ উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়েছে যে, সমস্ত আকলের একশত ভাগের নিরানব্বই ভাগ আকল হুজুর পাক (ﷺ) কে প্রদান করা হয়েছে, আর একভাগ প্রদান করা হয়েছে সমস্ত মুসলমানকে। বান্দা মিসকীন শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله) এর মত এই যে, সমস্ত সকলকে এক হাজার ভাগ করে নয়শ নিরানব্বই ভাগই হুজুর পাক (ﷺ) কে প্রদান করা হয়েছে, আর একভাগ বাকি সমস্ত মানবকুলকে প্রদান করা হয়েছে, যদি এরূপ বলা হয় তবুও তা যথাযথ হবে। সামান্যও অত্যুক্তি হবেনা। যেহেতু হুজুর পাক (ﷺ) এর অসীম কামালাত ছিলে বলে প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই তার এলেম ও আকলের আধিক্য সম্পর্কে অতিরিক্ত যা কিছুই বলা হবে, তা-ই যথাযথ হবে। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালার এরশাদ এরকম, “আমি আপনাকে কাউছার বা সীমাহীন কল্যাণ দান করেছি।'


নবী করীম (ﷺ) এর মহান আখলাক সমূহের মধ্যে বাহ্যিকভাবে যেগুলো মানুষের দৃষ্টিগোচর হতো সে সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা হয়েছে। এ মর্মে যে সব উদ্ধৃতি পেশ করা হবে তার অধিকাংশ সংগ্রহ করা হয়েছে 'আশ শিফা', 'মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া' 'রওযাতুল আযান ও মাদারিজুন্নবুওয়াত প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী] 


© | সেনানী এপ্স |

Top