বদরের বন্দীদের থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ
বদরের যুদ্ধবন্দীদের থেকে ফিদয়া বা মুক্তিপণ গ্রহণ করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, কোন নবীর জন্য এটা সমীচীন নয় যে, তারা কোন কাফেরকে জীবিত কয়েদ করবে, যতক্ষণ না জমিনে তাদের রক্ত প্রবাহিত করা হবে। তোমরা দুনিয়ার মাল চাও, অথচ আল্লাহ তায়ালা চান আখেরাত। আল্লাহতায়ালা পরাক্রমশালী, বিজ্ঞানময়। আর আল্লাহ তায়ালা যদি একটি কথা লিখে না রাখতেন, তাহলে তােমরা কাফেরদের থেকে যে মাল গ্রহণ করলে সে জন্য আল্লাহ তায়ালা তোমাদের কঠোর শাস্তি দান করতেন।
এই আয়াত খানা কে একদল লোক হুজুর পাক (ﷺ) এর উপর আল্লাহ তায়ালার তিরস্কার বলে সাব্যস্ত করে থাকে। ঘটনা হলো, হুজুর পাক (ﷺ) সাইয়্যেদুনা হযরত আবুবকর (رضي الله عنه) এর পরামর্শক্রমে বদরের বন্দীদের থেকে ফিদয়া বা মুক্তিপণ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। হযরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) এর পরামর্শ ছিলাে তাদেরকে কতল করার। কিন্তু হুজুর পাক (ﷺ) তা গ্রহণ করবেন না। এটা ছিলো তাদের নিজস্ব ইজতিহাদ। আর ইজতিহাদ ভুল প্রমাণিত হলেও শরীয়ত বিরুদ্ধে নয়। তবে ইজতেহাদী ভুল এর উপর কোন নবীর স্থির থাকা বৈধ নয়। উছুলে ফাঁকার মধ্যে এরকম বিধান রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে একটু বিস্তারিত আলোচনায় আসা যাক। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (رضي الله عنه) এর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহতায়ালা যখন বদরের যুদ্ধে কাফেরদের জন্য পরাজয় এনে দিলেন। কাফেরদের সত্তর জন মারা গেছে এবং সতুর জনকে বন্দি করা হলাে। তখন হুজুর আকরম (ﷺ) এ সমস্ত কয়েদীদের সম্পর্কে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) এবং হজরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) এর সঙ্গে পরামর্শ করলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) পরামর্শ দিলেন যে, কয়েদীরা তাে আমাদেরই চাচার সন্তান। ওরা আমাদের ভাই, আমাদের কাবিলার লোক। এদের সম্পর্কে আমার রায় এটাই যে, এদের থেকে ফিদয়া গ্রহণ করা হােক। তাতে আমাদের যে সম্পদ আমদানী হবে, তার মাধ্যমে আমরা অন্যত্র কাফেরদের মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে। আবার এদের ব্যাপারে আশা করা যায়, আল্লাহ পাক যদি হেদায়েত দান করেন, তাহলে একদিন তো এটা আমাদের সার্বিক শক্তির অংশবিশেষ হতে পারে। হযরত ওমর (رضي الله عنه) বলেন যে, রাসুল পাক (ﷺ) এরপর আমার মতামত চাইলেন। বললেন, ওমর ইবনুল খাত্তাব —সম্পর্কে তোমার মত কি? আমি আর করলাম, আল্লাহর কসম! আমার মত হজরত আবু বকরের মতের অনুরূপ নয়। আমার মত এই যে, এদেরকে হত্যা করা হােক। এবং এমর্মে আমি আরও বলতে চাই যে, অমুককে আমার হাতে তুলে দেয়া হােক, যেনাে স্বহস্তে আমি তাকে হত্যা করতে পারি। (তখন হযরত ওমর তার প্রিয়জনের প্রতি ইশারা করেছিলেন) আর হযরত আলীকে হুকুম করা হোক, সে যেন তার ভাই আকীলকে হত্যা করে ।হযরত হামযা (رضي الله عنه) কে হুকুম দেয়া হােক, তিনি যেনাে তার অমুক প্রিয়জনকে স্বহস্তে হত্যা করে। যাতে আল্লাহ আল্লামুল গয়ুব জেনে নিতে পারেন, আমাদের অন্তর কাফের মুশরিকদের ভালোবাসা-বন্ধুত্ব থেকে পবিত্র। কিন্তু হুজুর পাক (ﷺ) এর নিকট হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) এর অভিমত পছন্দ হলে এবং তিনি তাই গ্রহণ করলেন। তিনি তাদের মুক্তিপণ গ্রহণ করলেন।
হযরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) বলেন, দ্বিতীয় দিন যখন আমি হুজুর পাক (ﷺ) এর খেদমতে হাযির হলাম, তখন দেখলাম হুজুর পাক (ﷺ) এবং তাদের কাছে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) বসে আছেন। উভয়ই ক্রন্দনরত অবস্থায় আছেন। আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)। বলুন, কোন বস্তু আপনাদেরকে ক্রন্দন করালাে? কেননা যদি সম্ভব হয়, তাহলে আমিও আপনাদের সাথে কাঁদবাে। আর তা না হলে জোর করে হলেও ক্রন্দন করার চেষ্টা করবাে। তখন হুজুর পাক (ﷺ) বললেন, তোমাদের বন্ধুদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করার ব্যাপারে। তখন হুজুর পাক (ﷺ) নিকটস্থ একটি বৃক্ষের দিকে ইশারা করে বললেন যে, নিঃসন্দেহে ঐ বৃক্ষের চেয়েও কাছে এর আযাব রয়েছে। ঐ সময়ই আল্লাহপাক এই আয়াত নাযিল করলেন, কোনাে নবীর জন্য সমীচীন নয় যে, কোন কাফেরকে জীবন্ত অবস্থায় বন্দী করবে, যতক্ষণ না যমীনে তাদের রক্ত প্রবাহিত করা হয়। 'এছখান' এর অর্থ হচ্ছে। অতিরিক্ত করা, কোন জিনিসের মধ্যে আধিক্য করা। এই স্থানে তার অর্থ হবে হত্যা করা এবং যখম করা। ভাবার্থ এই যে, নবীর জন্য উচিত যখন তার কাছে কোনাে বন্দীকে আনা হয়, তখন তাকে হত্যা করে ফেলা। এবং এই হত্যার মধ্যে মুবালাগা বা আধিক্য করতে হবে, যাতে কুফুরী প্রতিষ্ঠিত না হয়ে যায় এবং ইসলাম প্রবল হয়।
তোমরা দুনিয়ার মাল মাত্রা চাও, অথচ আল্লাহ পাক চান আখেরাত' এই আয়াতের ভাবার্থ এই যে, তোমরা দুনিয়ার মাল ও গনিমত ইত্যাদির আকাঙক্ষা করবে। অথচ আল্লাহ পাক চাচ্ছেন আখেরাতের কামিয়াবী।এর মাধ্যমেই (হত্যার মাধ্যমে) দ্বীন ইসলামের শক্তি সূচিত হবে এবং আখেরাতে সওয়াব এর উপর ভিত্তি করেই প্রদান করা হবে।
আল্লাহ তায়ালা যদি পূর্বে একটি কথা না লিখে রাখেন, তাহলে হে মুসলমানগণ। তোমরা যে মুক্তিপণ হিসেবে কাফেরদের মাল গ্রহণ করেছে, এর জন্য তোমাদের আযাব প্রদান করা হবে। এই আয়াতের ভাবার্থ এই যে, আল্লাহ তায়ালার বিধান যদি এমন না হতে যে, ইজতিহাদের ভুলের কারণে কোনো রূপ ধরপাকড় নেই, তাহলে এই সময় তোমরা কাফেরদের নিকট থেকে যে সম্পদ গ্রহণ করেছে এজন্য তোমাদেরকে আযাব দেয়া হতাে। এক হাদীছে এ রকম বর্ণিত হয়েছে, এর জন্য যদি আযাব দেয়া হতাে, তাহলে কেবলমাত্র ওমর ছাড়া আর কেউ এ থেকে রেহাই পেতাে না।
এ পরিপ্রেক্ষিতেই ঐ দলের লােকগুলি বলে থাকে যে, হুজুর পাক (ﷺ) কে আযাব ও তিরস্কারের ধমক দেয়া হয়েছে এই আয়াতের মাধ্যমে। তাদের বক্তব্যের উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবের লিখক বলেন, এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হুজুর পাক (ﷺ) এর উপর কোন গুনাহ বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি।।
বরং আয়াতে ঐ জিনিসের বর্ণনা দেয়া হয়েছে যা অন্যান্য সমস্ত নবীগণের কাউকেই প্রদান করা হয়নি। বিশেষ করে হুজুর পাক (ﷺ) কেন প্রদান করা হয়েছে। হুজুর পাক (ﷺ) ব্যতীত অন্য কোন নবীর জন্য গনিমতের মাল বৈধ ছিলেনা। যেমন রাসূল পাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমার জন্য গনীমতসমূহ হালাল করে দেয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রে এ-ও বলা যেতে পারে যে, এ হুকুম হুজুর পাক (ﷺ) ছাড়া সমস্ত নবীগণের জন্য প্রযােজ্য। তবে হুজুর পাক (ﷺ) এর জন্য এটা বৈধ যে, তিনি তাদেরকে হত্যা না করে, তাদের কাছ থেকে ফিদয়া গ্রহণ করতে পারেন। আর ফিদিয়া গনিমতের একটা প্রকার। আয়াতের একাংশে বলা হয়েছে, তোমরা দুনিয়ার ধন সম্পদ গ্রহণ করতে চাও'—এ আয়াত সম্পর্কে কেউ কেউ লন যে, এদ্বারা নির্দেশ করা হয়েছে ঐ শ্রেণীর লোকদের যারা দুনিয়া কামনা করে এবং দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে দুনিয়াবী মাল ছামান সঞ্চয় করে। হুজুর আকরাম (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবীগণ এই আয়াতের লক্ষ্য নন। এমর্মে যেহাক (رحمة الله) বলেন যে, এ আয়াত তাে নাযিল হয়েছিল ঐ ঘটনার সময়, যখন বদরের যুদ্ধে মুশরেকরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছিলেন। তখন লোকেরা মাল ছামান কুড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং গনীমতের মাল সংগ্রহ করতে মশগুল হয়ে পড়েছিলেন। এই সময় মুশরেকদের সংগে যুদ্ধ করা থেকে তারা বিরত ছিলেন।
হযরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) তখন সংকটাপন্ন অবস্থা আঁচ করতে পেরে চিন্তা করলেন, হয়তাে মুশরেকরা মােড় পরিবর্তন করে পুনরায় মুসলিম বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়বে। যেহাক (رحمة الله) এর মত অনুযায়ী ঘটনা যদি এরকম হয়ে থাকে, তাহলে এই আয়াত তাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছিলাে বুঝতে হবে। আল্লাহ পাক বলেন, তােমাদের মধ্যে এমন কতিপয় লােক আছে, যারা দুনিয়া কামনা করে। আর এমন কিছু লােক এমনও আছে যারা কামনা করে আখেরাত। এ আয়াতের অর্থ সম্পর্কে মুফাসসিরীনে কেরামের মতভেদ রয়েছে। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এ আয়াতের অর্থ হবে এরকম “যদি পূর্বে লিখিত না থাকতাে যে, আমি কারও উপর আযাব প্রদান করবাে না। কিন্তু নিষিদ্ধতার পর তাে অবশ্যই আযাব প্রদান করবে।” এ কথায় বুঝা যায় যে, কয়েদিদের ব্যাপারটা কোন গুনাহের কাজ ছিলনা। কেননা তখনও নিষিদ্ধতা আরোপিত হয়নি।
কেউ কেউ আবার এরকম বলে থাকেন, এর অর্থ তোমাদের ঈমান যদি কুরআনের উপর না থাকতো, তবে গনিমতের (ফিদিয়া) ব্যাপারে তোমাদের আযাব প্রদান করা হতো। কুরআনের উপর ঈমান ছিলে বিধায় তােমরা আমার ক্ষমার যােগ্য হয়েছে। অথবা এর অর্থ এ-ও হতে পারে যে, লওহে মাহফুযে যদি লেখা না থাকতো যে, গনীমত সমূহ তোমাদের জন্য হালাল —এ জাতীয় অর্থ ও ব্যাখ্যা সবই গুনাহ ও নাফরমানীর বিরুদ্ধে। কেননা যে কাজ করা হালাল, তাতে কোন গুনাহ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ কারণেই আয়াতের শেষাংশে আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন, তােমাদের যে গনীমত হাসিল হয়, তা তােমরা হালাল ও পবিত্র হিসেবে ভক্ষণ করে। কেউ কেউ বলেন, রাসূল কারীম (ﷺ) এর সাহাবায়ে কেরামকে কতল ও ফিদইয়ার মধ্যে যে কোনােটি বেছে নেয়ার অধিকার দেয়া হয়েছিলাে। সাইয়্যেদুনা হযরত আলী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, রাসূল কারীম (ﷺ) এর কাছে হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) এসে বললেন, কয়েদীদের ব্যাপারে আপনার সাহাবীগণকে এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে। ইচ্ছা করলে তাদেরকে হত্যা করা যেতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে এই শর্তের উপর তাদের কাছে থেকে ফিদইয়া আদায় করে মুক্তি দেয়া যেতে পারে যে, আগামী বৎসর সাহাবী গণের মধ্য থেকে সত্ত্বর জনকে শহীদ করা হবে। তখন সাহাবায়ে কেরাম বললেন যে, আমরা ফিদইয়াটাই গ্রহণ করলাম। যাতে করে আমাদের মধ্য থেকে সত্তর জন শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করতে পারেন। পরে দেখা গেলাে, উহুদের যুদ্ধে সত্তর জন সাহাবী শাহাদত বরণ করেছিলেন। তারা তাে অনুমতি পাওয়ার পরই একাজ করেছেন; কাজেই গুনাহ হলে কোথায়? এখানে আবার কেউ কেউ এরকম বলেন যে, কতল ও ফিদইয়া দু’এর মধ্যে এখতিয়ার দেয়া হয়েছিল বটে, তবে কতল ও রক্ত প্রবাহিত করা ছিল উত্তম। সাহাবাগণ তা করেননি। এজন্য আয়াত দ্বারা তিরস্কার করা হয়েছে। তাই বলে এতে কোনো গুনাহ সাব্যস্ত হয়নি। আল্লাহ পাক ভালো জানেন।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]
© | সেনানী এপ্স |