বোরাকের আলোচনা


যমযমের পানি দ্বারা কলব ধৌত করার পর হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) শাদা বর্ণের একটি চতুষ্পদ বাহন আনলেন, যার নাম বোরাক। বোরাক খচ্চরের চেয়ে নীচু আর গাধার চেয়ে কিঞ্চিত উঁচু। সে পদবিক্ষেপ করতে পারে দৃষ্টির শেষসীমানায়।


নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আমাকে সওয়ার করানো হয়েছিলো এবং হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) আমাকে আকাশের উপর নিয়ে গিয়েছিলেন। হাদীছের বাহ্যিক অর্থ এরকম তিনি আসমান পর্যন্ত বোরাকের উপর ছিলেন। আর বোরাকটি যমীনের উপর যেমন চলছিলো শূন্যম-লেও চলছিলো তেমনই। এটাও স্বাভাবিকতার ঊর্ধ্বে, কেনোনা কোনো মানুষ বা জন্তু হাওয়ার উপর ভর করে চলতে পারে না। কিন্তু এসব যে আল্লাহ্তায়ালার কুদরত। আল্লাহ্তায়ালার কুদরত তো স্বাভাবিকতার সীমায় সীমিত নয়। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, বোরাকের দুটি পাখা, যার মাধ্যমে সে আকাশে ওড়ে। আবার কেউ কেউ বলেন, আরোহী বোরাকের উপরে ছিলেন মসজিদে আকসা পর্যন্ত। এরপর একখানা মেরাজ অর্থাৎ সোপান লাগানো হয়েছিলো, যার মাধ্যমে নবী করীম (ﷺ)কে উপরের দিকে ওঠানো হয়েছিলো। দু’টি বর্ণনার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান এরূপে হতে পারে, কোনো কোনো বর্ণনাকারী মেরাজের ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা করেননি, কেউ কেউ করেছেন। প্রথম বর্ণনাকারীরা মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণের বর্ণনা করেছেন স্পষ্টভাবে। কিন্তু এরপর আসমানে ভ্রমণের আলোচনা করেননি। আবার দ্বিতীয় বর্ণনাকারীগণ আসমানে আরোহণের বর্ণনা করেছেন। এখানে এরকমও হতে পারে যে, তখনকার ভ্রমণটি বেসওয়ারী অবস্থায় ছিলো। ওয়াল্লাহু আ’লাম।

 

নবী করীম (ﷺ) কে বহন করার জন্য বোরাক প্রেরণের মধ্যে হেকমত হচ্ছে, সাইয়্যেদ মাহবুবে রব্বুল আলামীন (ﷺ) এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন। যেমন কোনো বন্ধু তার বন্ধুকে বহন করে আনার জন্য ঘোড়া প্রেরণ করে থাকে। আবার এমনও দেখা যায়, বিশেষ ব্যক্তিকে আনার জন্য পাইক পেয়াদাও পাঠিয়ে দেয়া হয়। রাত্রিবেলায় মেরাজ সংঘটিত হওয়ার মধ্যেও হেকমত রয়েছে। রাতের মুহূর্তগুলো হচ্ছে একান্ত অভিসারের মুহূর্ত। অন্যান্যের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রেখে প্রেমিক তার প্রেমাষ্পদকে একান্ত নিভৃতে নিয়ে আসবে, এটাই তো প্রকৃত প্রেমের নিয়ম। ‘আল্লাহ্তায়ালার জন্য রয়েছে সর্বোচ্চ উপমা।’ খচ্চরের চেয়ে নীচু আর গাধার চেয়ে উঁচু ঘোড়ার আকৃতিবিশিষ্ট বোরাক পাঠানোর মধ্যে হেকমত এই যে, এই নিয়মের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার ইঙ্গিত আছে। হুবহু ঘোড়া পাঠানো হয়নি। কেনোনা ঘোড়া যুদ্ধবিগ্রহ ও ভীতিশংকুলতার প্রতীক। বোরাক ঘোড়ার আকৃতিতে ছিলো, কিন্তু ঘোড়ার মতো স্বাভাবিক গতিসম্পন্ন ছিলো না। তার গতি ছিলো অস্বাভাবিক, যা মোজেজা প্রকাশের উদ্দেশ্যেই তাকে দেয়া হয়েছিলো। শায়েখ আবদুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী বলেন, এর নাম ঘোড়াও নয়, খচ্চরও নয়। বোরাক আরবী শব্দ বারকুন থেকে এসেছে, যার অর্থ বিদ্যুৎ। তাই তার গতিও ছিলো বিদ্যুৎসম। কাযী আয়ায (رحمة الله) বলেন, তার নাম বোরাক হওয়ার যৌক্তিকতা হচ্ছে. বোরাকের গায়ে দু’টি রঙ ছিলো, যাকে বলা হয় শাতে বারকা অর্থাৎ চমকদার বকরী। এ শাতে বারকা ওই ধরনের বকরীকে বলা হয়, যার গায়ের পশম শাদা এবং কাল বর্ণের। মাওয়াহেবে লাদুুিন্নয়ার গ্রন্থকারের মত, বোরাক শব্দটি বারকুন বা বারীকুন শব্দ থেকে উৎপন্ন নাও হতে পারে। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, নবী করীম (ﷺ) যখন বোরাকের পাদানীতে কদম মোবারক রাখতে উদ্যত হলেন, তখন সে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে লাগলো। হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) বললেন, হে বোরাক! তোমার কি হয়েছে? তুমি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করছো কেনো? সরকারে দোআলম (ﷺ) এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ তো ইতোপূর্বে তোমার পিঠে চড়েননি। একথা শুনে বোরাক আগ্রহ প্রকাশ করলো এবং যমীনের উপর নতজানু হয়ে গেলো। রসুলে আকরম (ﷺ) তার পিঠে চড়লেন। এই বর্ণনা দ্বারা প্রমাণ হয় যে, আম্বিয়া কেরামের জন্যই বোরাক তৈরী হয়েছে। কেউ কেউ এরকমও বলেছেন, প্রত্যেক নবীর জন্যই আপন আপন মর্যাদা অনুসারে বিভিন্ন বোরাক ছিলো। বর্ণনা পাওয়া যায়, হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام) স্বীয় পুত্র হজরত ইসমাঈল (عليه السلام) এর সঙ্গে মুলাকাত করার জন্য বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে মক্কা মুকাররমায় এসেছিলেন বোরাকের পিঠে সওয়ার হয়ে। 


নবী করীম (ﷺ) যে বোরাকের পিঠে সওয়ার হয়েছিলেন, তার পিঠে ইতোপূর্বে আর কেউ সওয়ার হননি বিধায় সে বুঝতে না পেরে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিলো। কেউ কেউ আবার বোরাকের এহেন আচরণকে ঔদ্ধত্য বলেন না। তারা বলেন, বোরাক তখন আনন্দে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছিলো, যেমন পাহাড় কম্পনকালে নবী করীম (ﷺ) পাহাড়কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, হে পাহাড়! থামো। তোমার উপর নিশ্চয়ই নবী, সিদ্দীক এবং দু’জন শহীদ রয়েছেন।

 

বর্ণিত আছে, বোরাকের পাদানী ছিলো হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) এর হাতে। আর লাগাম ছিলে হজরত মিকাইল (عليه السلام) এর হাতে। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, ভ্রমণের সময় জিব্রাইল নবী করীম (ﷺ) এর পিছনে বসা ছিলেন। বর্ণনাদ্বয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান এভাবে হতে পারে যে, প্রথমে হয়তো জিব্রাইল পাদানী ধারণ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে পথিমধ্যে রসুলেপাক (ﷺ) মহব্বতের আতিশয্যে তাঁকে নিজের পিছনে বসিয়ে নিয়েছিলেন। সমাধান এরূপেও হতে পারে, প্রথমে তিনি নবী করীম (ﷺ) এর পিছনে বসা ছিলেন, পরে তাঁর সম্মান প্রদর্শনার্থে নেমে গিয়ে পাদানী ধরেছিলেন। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


যাত্রাপথে বাহন যখন খেজুর বাগানসমৃদ্ধ এলাকায় পৌঁছলো, তখন জিব্রাইল নবী করীম (ﷺ) কে বললেন, এখানে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে নিন। জায়গাটির নাম ইয়াছ্রিব। পরবর্তীতে এর নামকরণ করা হবে মদীনা মুনাওয়ারা। ভ্রমণপথে মাদায়েন এবং হজরত ঈসার জন্মস্থানে পৌঁছলে জিব্রাইল তাঁকে দু’ রাকাত নামাজ আদায় করার কথা জানালেন। এরপর রসুলেপাক (ﷺ) দেখতে পেলেন, এক পাশে এক বৃদ্ধা রমণী দাঁড়িয়ে আছে। তিনি (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, সে কে? বললেন, সামনে অগ্রসর হোন। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে রসুল (ﷺ) দেখতে পেলেন, একটি লোক তাঁকে ডাকছে। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ও কে? বললেন, সামনে চলুন। এরপর পথিমধ্যে একটি জামাত দেখতে পেলেন, যারা রসুলেপাক (ﷺ) কে সালাম প্রদান করছিলো। তাদের সালামের বাক্যগুলো ছিলো এইরূপ আসসালামু আলাইকুম ইয়া আউয়াল, আসসালামু আলাইকা ইয়া আখের, আসসালামু আলাইকা ইয়া হাশের। জিব্রাইল বললেন, সালামের জবাব প্রদান করে তাদেরকে ধন্য করুন। রসুলেপাক (ﷺ) তাদের সালামের জবাব দিলেন। এবার হজরত জিব্রাইল নবী করীম (ﷺ) এর প্রশ্নসমূহের জবাব দিলেন। বললেন, ওই বৃদ্ধা রমণীটি দুনিয়া। তার আয়ু বেশী দিন নেই। যেমন বৃদ্ধা রমণীর আয়ু যৎসামান্যই বাকী থাকে। যে লোকটি ডাক দিয়েছিলো, সে ইবলীস। তিনি যদি তার ডাকে সাড়া দিতেন, তাহলে তাঁর উম্মত দুনিয়াকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দিতো এবং শয়তান তাদেরকে গোনাহ্গার করে ফেলতো। আর ওই জামাত যাঁরা নবী করীম (ﷺ) কে সালাম প্রদান করেছিলেন, তাঁরা হলেন ইব্রাহীম, মুসা এবং ঈসা। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবী করীম (ﷺ) যখন নবী মুসার কবর শরীফের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি কবরের ভিতর নামাজ পড়ছিলেন। নবী করীম (ﷺ) এর আগমন বার্তা পেয়ে তিনি বলেছিলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রসুল। 


আম্বিয়া কেরাম যেহেতু বরযখী জীবনে জীবন্ত, তাই তাঁরা সেখানে ইবাদতে রত থাকেন। যেমন বেহেশতী বান্দারা বেহেশতে প্রবেশের পরও ইবাদত করবেন। কিন্তু ইবাদতের নির্দেশ তাদের উপর থাকবে না। তারপর রসুলেপাক (ﷺ) নেক ও বদ লোকদের কাওম অতিক্রম করে গেলেন, যারা বরযখী ও মেছালী জগতে আপন আপন কৃতকর্মের পরিণাম ভোগ করছিলো। রসুলেপাক (ﷺ) তাদেরকে আযাববেষ্টিত অবস্থায় দেখতে পেলেন। এর বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এরপর রসুলেপাক (ﷺ) বাইতুল মুকাদ্দাছে পৌঁছলেন এবং মসজিদের দরজার বেষ্টনীতে বোরাককে বাঁধলেন। পরে ওই দরজার নাম রাখা হয়েছে বাবে মোহাম্মদ (ﷺ)। অতঃপর তিনি মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং দু’রাকাত নামাজ আদায় করলেন। দু’রাকাত নামাজ ছিলো তাহিয়াতুল মসজিদ। এখানে ফেরেশতাবৃন্দ একত্রিত হয়েছিলেন এবং হজরত আদম (عليه السلام) থেকে হজরত ঈসা (عليه السلام) পর্যন্ত রূহসমূহ আকৃতিসম্পন্ন হয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁরা আল্লাহ্তায়ালার হামদ ও ছানা পেশ করলেন এবং রসুলেপাক (ﷺ) এরও সালাত ও সালাম পেশ করলেন। সকলেই রসুলেপাক (ﷺ) এর শ্রেষ্ঠত্বেও স্বীকৃতি দিলেন। এরপর আযান হলো। একামতও হলো। সকলেই ইমামতীর জন্য রসুলেপাক (ﷺ) কে সামনে এগিয়ে দিলেন। রসুলেপাক (ﷺ) ইমামতী করলেন, আর আম্বিয়া কেরাম সকলেই তাঁর মুকতাদী হলেন। এই নামাজটি ফরজ না নফল, এ নিয়ে উলামায়ে কেরামের মতভেদ রয়েছে। ফরজ যদি হয়ে থাকে, তাহলে এটা কি এশার নামাজ ছিলো? নাকি ফজরের নামাজ ছিলো এ নিয়েও মতানৈক্য রয়েছে। হাদীছের পূর্বাপর ভাবধারায় প্রতীয়মান হয়, বাইতুল মুকাদ্দাছে তশরীফ নেয়ায় হয়েছিলো আসমানে আরোহণ করার পূর্বে। তাহলে বুঝা যায়, এটা এশার নামাজ। আর যারা বলেন, বাইতুল মুকাদ্দাছের ওই নামাজের জামাত হয়েছিলো মেরাজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তাঁদের বর্ণনানুসারে বুঝা যায় যে, ওই নামাজ ছিলো ফজরের নামাজ। কেউ কেউ আবার দ্বিতীয় বিবরণটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁদের মতে নবী করীম (ﷺ) যখন পূর্ণ কামালাত ও ফযীলত নিয়ে মেরাজ থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন, তখন আম্বিয়া কেরামের মধ্যে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে উক্ত নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।


বান্দা মিসকীন (শায়েখ আবদুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী) বলেন, আমার খেয়াল হয়েছিলো, বাইতুল মুকাদ্দাছে নামাজ আদায়কারীরা তো মেরাজে যাওয়া এবং প্রত্যাবর্তন করা, উভয় কালেই একত্রিত হতে পারেন। কিন্তু এলেমে হাদীছের আলেমগণের আলোচনা ছাড়া এ ব্যাপারে কলমধারণ করার মতো ধৃষ্টতা প্রদর্শনের সাহস পাচ্ছিলাম না। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে যখন বিভিন্ন বর্ণনা আমার দৃষ্টিগোচর হলো, তখন এলমে হাদীছ ও তাফসীরের বিশেষ প-িত শায়খে কাবীর ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছীরের একটি অভিমত আমার দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি উল্লেখ করেছেন, রসুলেপাক (ﷺ) মেরাজে যাওয়ার পথে এবং ফেরার পথে উভয় অবস্থাতেই আম্বিয়া কেরামকে নিয়ে নামাজ আদায় করেছেন। তিনি বলেছেন, উভয় অবস্থাতেই যে নামাজ আদায় করেছেন, তার প্রতি হাদীছের ইঙ্গিত রয়েছে। বিপরীত ইঙ্গিত নেই। ওয়ালহামদুলিল্লাহ্। 


শায়েখ ইবনে কাছীর (رحمة الله) আরও বলেছেন, কেউ কেউ এরূপ বলে থাকেন, রসুলেপাক (ﷺ) আকাশে নামাজ কায়েম করেছিলেন। অথচ স্পষ্ট ও বহুবিদিত হাদীছসমূহের মাধ্যমে প্রমাণিত যে, তিনি বাইতুল মুকাদ্দাছে নামাজ কায়েম করেছিলেন এবং তা ফেরার পথে করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি এরূপ বলেননি যে, তিনি দু’খানেই বা উভয় অবস্থাতেই নামাজ কায়েম করেছিলেন। আর এটা যদি স্পষ্ট রেওয়ায়েত ও দেরায়েত দ্বারা প্রমাণিতই হয়ে থাকতো, তাহলে তিনি তা থেকে কেনোইবা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। ওয়াল্লাহু আ’লীম। 


নামাজান্তে রসুলেপাক (ﷺ) যখন মসজিদের বাইরে এলেন, তখন হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) তাঁর সামনে এক পেয়ালা দুধ এবং এক পেয়ালা শরাব পেশ করলেন। বললেন, দুটির মধ্যে যেটি আপনার পছন্দ হয়, গ্রহণ করুন। রসুলেপাক (ﷺ) দুধের পেয়ালাটি গ্রহণ করলেন। হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) বললেন, আপনি ফিতরত বা স্বাভাবিকতাকেই পছন্দ করলেন। এখানে ফিতরত অর্থ হচ্ছে ইসলাম এবং তার উপর দৃঢ়তা। 


মর্মার্থ এই যে, নবী করীম (ﷺ) ইসলামের শেআর ও তার দৃঢ়তাকেই পছন্দ করে নিলেন। দুধ ইসলামের আলামত এই জন্য যে, এটা পানকারীর জন্য সহজ ও সুপেয়। উন্নতমানের পানীয় দুধকে দ্বীন ও এলেমের প্রতীক মনে করা হয়। স্বপ্নে দুধ পান করার অর্থ হবে, এলেম ও দ্বীন দ্বারা ধন্য হওয়া। আলহামদুলিল্লাহ্! এই কিতাবের গ্রন্থকারও স্বপ্নে বিভিন্ন সময়ে দেখেছিলেন, তাঁর সামনে একটি নতুন পেয়ালা আনা হয়েছে, তা শাদা ও মিষ্টি দুধে পরিপূর্ণ। তিনি উক্ত পেয়ালা থেকে দুধ পান করেছেন। 


শরাবের অবস্থা এর বিপরীত। এটি উম্মুল খাবায়েছ অর্থাৎ যাবতীয় খবিছীপনার মূল। এটি মানুষের মধ্যে অন্যায় ও ফাসাদ সৃষ্টি করে। কেউ আবার বলেছেন, ফিতরতের অর্থ খিলকত বা গঠন। আর দেহ গঠনের মূল বস্তু হচ্ছে দুধ ও মাংশ। অস্থিমজ্জা ইত্যাদি বৃদ্ধির মূলও দুধ। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নবজাতক সন্তানের পেটে প্রবেশ করে দুধ। দুধ পেটে প্রবেশ করার পর পেটের নাড়ী ভূড়িকে প্রশস্ত করে। আর একথা সুপ্রসিদ্ধ যে, রসুলেপাক (ﷺ) এর নিকট দুধ খুবই প্রিয় ছিলো। আর শরাবের প্রতি তাঁর ছিলো ঘৃণা, যদিও সে সময় শরাব পান করা বৈধ ছিলো। মেরাজের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো মক্কা মুকাররমায়। আর শরাবের নিষিদ্ধতার বিধান নাযিল হয়েছিলো মদীনা মুনাওয়ারায়। যেহেতু পরিশেষে এটা এক সময় হারাম হবেই, যা আল্লাহ্পাকের এলেমে নির্দিষ্ট, তাই তার প্রতি রসুল (ﷺ) এর মনে আকর্ষণ সৃষ্টি হয়নি। জিব্রাইল (عليه السلام) তখন বললেন, আপনি ফিতরতকে পেয়েছেন। আবার কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, আপনি সঠিক রাস্তা গ্রহণ করেছেন। আপনার মাধ্যমেই আল্লাহ্তায়ালা এই সঠিক রাস্তা দেখিয়েছেন। এক বর্ণনায় এরকম এসেছে, জিব্রাইল (عليه السلام) তখন বলেছিলেন, আপনি যদি শরাব গ্রহণ করতেন, তাহলে আপনার উম্মত গোমরাহ হয়ে যেতো। ব্যাপকভাবে শরাব পানে অভ্যস্ত হতো। পরিণাম হতো বিবাদ আর বিসম্বাদ। 


হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এর হাদীছে আছে, নবী করীম (ﷺ) এর নিকট দুধ ও মধুর দু’টি পেয়ালা আনা হয়েছিলো। এক বর্ণনায় আছে, তিনটি পেয়ালা আনা হয়েছিলো। একটি দুধের, একটি পানির, আরেকটি শরাবের। এই বর্ণনায় মধুর উল্লেখ নেই। মোটকথা, নবী করীম (ﷺ) দুধের পেয়ালাটি গ্রহণ করেছিলেন। আর অন্যান্য পেয়ালার কথা যে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো পেশ করা হয়েছিলো সিদরাতুল মুন্তাহার কাছে, যার বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করেছেন হাফেজ ইবনে কাছির (رحمة الله)।


বর্ণিত আছে, ঐ সময় আম্বিয়া কেরাম আল্লাহ্তায়ালার হামদ ছানা পাঠ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام), হজরত মুসা (عليه السلام), হজরত দাউদ (عليه السلام), হজরত সুলায়মান (عليه السلام) এবং হজরত ঈসা (عليه السلام)ও ছিলেন। তাঁদের প্রশংসা এবং খোতবা ওই সমস্ত ফযীলত, কারামাত ও মোজেজাসমূহের বর্ণনাসম্বলিত ছিলো, যার মাধ্যমে আল্লাহ্তায়ালা তাঁদেরকে ধন্য করেছিলেন। আল্লাহ্তায়ালা শুকুর গুজারীর জন্য তাঁদের যবান মোবারক খুলে দিয়েছিলেন। এরপর সাইয়্যেদে আলম খাতেমুন্নাবিয়ীন (ﷺ) তাঁর যবান মোবারক খুললেন। বললেন, আপনারা সকলেই আল্লাহ্ রব্বুল ইযযতের হামদ ছানা পেশ করেছেন। এখন আমিও তাঁর হামদ ছানা পাঠ করছি। সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহ্তায়ালার জন্য যিনি আমাকে সমগ্র আলমের রহমত স্বরূপ, সকল মানুষের জন্য সুসংবাদ দানকারী এবং ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তিনি আমার উপর কোরআন নাযিল করেছেন, যার মধ্যে সবকিছুর স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। আমার উম্মতকে তিনি মধ্যম উম্মত বানিয়েছেন। মর্যাদার দিক দিয়ে তারাই প্রথম উম্মত আর আগমনের দিক দিয়ে সর্বশেষ। তিনি আমার বক্ষকে সম্প্রসারিত করে দিয়েছেন এবং আমার দায়িত্বের বোঝাকে সহনীয় করে দিয়েছেন। আমার নামের আলোচনা উন্নত করে দিয়েছেন। তিনি আমাকে নবুওয়াতের সিলসিলার উদ্বোধনকারী এবং সমাপ্তকারী বানিয়েছেন। 


নবী করীম (ﷺ) এর প্রশংসাবাণী শোনার পর হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام) আন্যান্য আম্বিয়া কেরামকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হলো যে, মোহাম্মদ আপনাদের সকলের চেয়ে উত্তম। এরপর জান্নাতুল ফেরদাউস থেকে একখানা সিঁড়ি আনা হলো, যার ডানে বামে ফেরেশতাবৃন্দ ছিলো। তিনি তার মাধ্যমে আকাশে আরোহণ করলেন। আকাশে পৌঁছে তিনি ওই নবীগণকে দেখতে পেলেন, যাঁদেরকে নিয়োজিত করা হয়েছিলো তাঁকে অভ্যর্থনার জন্য। বাইতুল মুকাদ্দাছে তাঁদেরকে প্রতিকৃতি স্বরূপ দেখানো হয়েছিলো এবং এখানেও সেরকমই করা হলো। তাঁরা এখানেও তাঁকে সালাম প্রদান করলেন। 


হাদীছ শরীফের বর্ণনায় যে সব বিস্ময়কর ও সূক্ষ্ম হাল ও হেকায়েত এসেছে, তা এই যখন রসুলেপাক (ﷺ) ষষ্ঠ আকাশে পৌঁছে হজরত মুসা (عليه السلام)কে দেখতে পেলেন। সেখান থেকে যখন তাঁকে উপরের দিকে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করা হলো, তখন হজরত মুসা (عليه السلام) কাঁদতে লাগলেন। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলতে লাগলেন, এমন পয়গম্বর যাঁকে আমার পর দুনিয়াতে পাঠানো হলো, অথচ তাঁর উম্মত আমার উম্মতের পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। 


উলামা কেরাম বলেন, হজরত মুসা (عليه السلام) এর এহেন উক্তি প্রতিহিংসাজনিত ছিলো না। কেনোনা ওই জগতে তো কোনো মুমিনের অন্তঃকরণে হিংসার লেশমাত্র থাকবে না। আর একজন পয়গম্বরের বেলায় তো এ প্রশ্ন উঠতেই পারে না। আর তিনিও ছিলেন একজন উলুল আযম পয়গম্বর। আল্লাহ্পাক তাঁকে স্বীয় কালাম দ্বারা সম্মানিত করেছেন। বরং উক্ত উচ্চ মর্তবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে আফসোস করে তিনি উক্তরূপ বক্তব্য রেখেছেন। 


আফসোস করার আরেকটি কারণ এও হতে পারে যে, তাঁর উম্মতের মধ্যে এতোবেশী মতানৈক্য ও বিশৃঙ্খলা হয়েছিলো, যা তাঁর পুণ্যে স্বল্পতা এনেছিলো। কেনোনা, নবীর উম্মতেরা যে পরিমাণে নেক আমল করে, ঠিক সমপরিমাণ নেকী 

আল্লাহ্তায়ালা সেই নবীর আমলনামায় লিপিবদ্ধ করে দেন। সেই হিসেবে তিনি নেকীর স্বল্পতাদৃষ্টে উক্তরূপ খেদোক্তি করেছেন। আবার নবী করীম (ﷺ) এর অনুসরণকারী হবে অসংখ্য, হজরত মুসা (عليه السلام) এর অনুসারী তার তুলনায় অনেক কম। শায়েখ ইবনে হাজার (رحمة الله) ফতহুল বারী কিতাবে এরকমই আলোচনা করেছেন। 


ইবনে আবী জমরা (رحمة الله) যিনি মালেকী মাযহাবের একজন আরেফ ছিলেন, তিনি বলেন, আল্লাহ্তায়ালা প্রত্যেক নবীর অন্তরেই রহমত ও মেহেরবানি দান করেছেন। আর এই রহমত সৃষ্টি ও স্বভাবগত হিসেবেই তাদের মধ্যে থাকে। তাই কোনো কোনো বিষয়ে আমাদের নবী (ﷺ) কেও ক্রন্দন করতে দেখা গেছে। তা দেখে তাঁকে প্রশ্ন করা হতো, আপনি ক্রন্দন করেন কেনো? তিনি বলতেন, ক্রন্দন করা একটি রহমত। আর আল্লাহ্তায়ালা এই রহমতকারীর উপর রহমত নাযিল করে থাকেন। আম্বিয়া কেরাম আল্লাহ্তায়ালার দেয়া রহমতের পুরা অংশ লাভ করেছেন। তাই তাঁদের হৃদয়ের রহমত বা দয়ার্দ্রতা অন্যান্য লোকের দয়ার্দ্রতা থেকে অধিকতর পূর্ণ। এ পরিপ্রেক্ষিতে হজরত মুসা (عليه السلام) আপন উম্মতের প্রতি রহমত ও স্নেহপরায়ণতার জন্য ক্রন্দন করেছিলেন। নবী করীম (ﷺ) এর মেরাজে আগমনের সময় আল্লাহ্তায়ালার দেয়া সাধারণ ফযীলত ও মেহেরবানির সময়। কেনোনা এ সময় আল্লাহ্তায়ালা তাঁর হাবীব (ﷺ)কে গ্রহণ করবেন। তাঁর সাথে মিলন হবে। এ সময় তিনি আশাবাদী হয়েছিলেন যে, হয়তোবা আল্লাহ্তায়ালা এই বিশেষ মুহূর্তের খাতিরে তাঁর উম্মতের উপর দয়া করবেন। হজরত মুসা (عليه السلام) নবী করীম (ﷺ) এর শানে গোলাম শব্দ ব্যবহার করেছেন। গোলাম মানে অপেক্ষাকৃত কম বয়স এই অর্থে তিনি এ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। যেহেতু নবী করীম (ﷺ) এর দুনিয়ার বয়স অন্যান্য আম্বিয়া কেরামের তুলনায় অল্প ছিলো। পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক যুবকতুল্য শক্তি সামর্থ্যরে অধিকারী ব্যক্তিকে গোলাম বলা হয়। 


ফতহুল বারী কিতাবে আছে, হজরত মুসা (عليه السلام) গোলাম শব্দ বলে ইঙ্গিত করেছেন, রব্বুল ইয্যতের ফজল, করম এবং নেয়ামত যে নবী করীম (ﷺ) এর প্রতি স্থায়ী শক্তিমত্তা সৃষ্টি করেছে সেদিকে। এই শক্তিমত্তা পরবর্তী জীবনেও পরিদৃষ্ট হয়েছে। তিনি পরিপূর্ণ বার্ধক্যে উপনীত হওয়া সত্ত্বেও শক্তির খর্বতা, দুর্বলতা, অলসতা, কোনো কিছুই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ঘটনা এমনও ঘটেছে যে, হিজরতের পর মদীনা মুনাওয়ারার লোকেরা তাঁকে নওজোয়ান বলতো। অথচ হজরত আবুবকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) কে বলতো শায়েখ বা বৃদ্ধ। বস্তুত রসুলেপাক (ﷺ) এর বয়স আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) এর চেয়ে বেশী ছিলো। বান্দা মিসকীন (শায়েখ আবদুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী) বলেন, নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র মস্তকের কয়েকখানা চুল শাদা হওয়া ছাড়া তাঁর দেহ মোবারকে বার্ধক্যের কোনো আলামতই প্রকাশ পায়নি। কারণ, কেউ যেনো তাঁকে দুর্বল এবং বৃদ্ধ ভাবতে না 

পারে।

 

নবী করীম (ﷺ) এর প্রতি হজরত মুসা (عليه السلام) এর কোনো প্রতিহিংসা যে ছিলো না তার প্রমাণ হচ্ছে, তাঁর উম্মতের প্রতি হজরত মুসা  (عليه السلام) এর দয়া ও হেমমতা। তাঁর ওসীলায় উম্মতে মোহাম্মদীর প্রতি নামাজের হুকুম পঞ্চাশ ওয়াক্ত থেকে পাঁচ ওয়াক্তে নেমে আসে। উলামা কেরাম বলেন, এ উম্মতের প্রতি তাঁর øেহপরায়ণ হওয়ার কারণ এই যে, তাওরাত কিতাবে তিনি এই উম্মতের মর্যাদা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পাঠ করেছিলেন এবং এতে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, আল্লাহ্তায়ালা যেনো এই উম্মতকে তাঁর উম্মত বানিয়ে দেন। আল্লাহ্তায়ালা জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই উম্মত তো তাঁর হাবীব (ﷺ) এর জন্য নির্ধারিত। তিনি যেনো এাই আকাক্সক্ষা পরিত্যাগ করেন। তখন হজরত মুসা নিবেদন করেছিলেন, হে আল্লাহ্তায়ালা! তাহলে তুমি আমাকে সেই নবীর উম্মত বানিয়ে দাও। 


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 




© | সেনানী এপ্স |

Top