আয়াতে মীছাক
আয়াতে মীছাক হুজুর আকরম (ﷺ) এর চুড়ান্ত পর্যায়ের ফযীলত ও মর্যাদা প্রমাণকারী। আয়াতখানি একথাই প্রমাণ করে যে, তিনি সমস্ত নবীগণের সরদার। আর সমস্ত নবীগণই তার উম্মতের হুকুম রাখেন। আয়াতে মীছাকের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “হে বন্ধু! আপনি স্মরণ করুন ঐ সময়ের কথা, যখন আল্লাহতায়ালা সমস্ত নবীগণের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন এই মর্মে যে, আমি যখন তােমাদিগকে কিতাব ও হেকমত দান করবাে, অতঃপর তােমাদের নিকট এমন রসূল আগমন করবেন, যিনি তােমাদের নিকট যা আছে তাকে সত্যায়িত করেন। অবশ্যই তোমরা তখন তার উপর ঈমান আনবে এবং তার সাহায্য করবে। তখন আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছিলেন, 'তোমরা কি একথা স্বীকার করলে এবং এ বিষয়ে আমার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলে?' তারা বললেন, 'আমরা স্বীকার করলাম। আল্লাহতায়ালা বললেন, তােমরা সাক্ষী থেকো, আমিও তােমাদের সঙ্গে সাক্ষ্যদানকারীদের অন্তর্ভুত। অতঃপর যে ব্যক্তি ফিরে যাবে, তারাই হচ্ছে ফাছেক। এই আয়াতে কারীমার মাধ্যমে বুঝা যায় যে, হযরত আদম (عليه السلام) থেকে নবী করিম (ﷺ) পর্যন্ত যত নবী রাসূল পৃথিবীতে আগমন করেছেন, তাদের সকলের কাছ থেকেই আল্লাহতায়ালা অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন এ সম্পর্কে হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে সংবাদ প্রদান করা হয়েছে। বিখ্যাত তফসীরকারকগণের মত এটাই যে, আয়াতে কারীমে উল্লেখিত রাসূল' শব্দটি দ্বারা হুজুর আকরাম (ﷺ) এর পবিত্র সত্তা কে বুঝানো হয়েছে। পৃথিবীতে এমন কোন নবী আগমন করেছেন যার কাছে হুজুর আকরম (ﷺ) এর গুণাবলী সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়নি এবং গুণাবলী বর্ণনার পর তাঁর কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়নি। ঐ অঙ্গীকারে বলা ছিলাে যে, তুমি যখন শেষ নবীর যমানা পাবে, তখন অবশ্যই তার উপর ইমান আনবে। নবীগণের কাছ থেকে যখন উক্ত প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হলাে, তখন অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রমাণিত হয় যে, তাদের উম্মতগণ থেকেও উক্ত প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়েছে। যেহেতু আম্বিয়া কেরাম হলেন উম্মতের জন্য মূল এবং অনুকরণীয় ব্যক্তি। কাজেই আয়াতে কারীমায় সে মূলের আলােচনা করেই ক্ষান্ত করা হয়েছে। উম্মতের কথা উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন পড়ে নাই।
সাইয়্যেদুনা হজরত আলী ইবন আবী তালিব (رضي الله عنه) ও সাইয়্যেদুনা হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তায়ালা এমন কোন না নবীকে প্রেরণ করেননি, যাদের কাছ থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়নি যে, তােমরা যদি মােহাম্মদ (ﷺ) কে পাও তাহলে অবশ্যই তার উপর ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। কেউ কেউ এরকম বলেন যে, উক্ত আয়াতে কারীমার অর্থ শুধু উপরোক্ত মত অনুযায়ী নয় বরং তার মর্ম এই, আল্লাহতায়ালা নবীগণ থেকে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা যেনাে আপন আপন উম্মতের কাছ থেকেও এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন, মুহাম্মদ (ﷺ) যখন আবির্ভূত হবেন, তখন তোমরা সকলেই তার উপর অবশ্যই ঈমান আনবে এবং সার্বিক ভাবে তার সাহায্য করবে। এমনিভাবে তাদের পরবর্তীতে যারা আসবে তাদের কাছে যেন তারা এমনি ধারাবাহিকভাবে অঙ্গীকার গ্রহণের কাজ চালিয়ে যায়।
এই অঙ্গীকার গ্রহণের প্রক্রিয়া হুজুর পাক (ﷺ) এর যমানায় আহলে কিতাবদের কাছ পর্যন্ত জারী হলাে। হুজুর পাক (ﷺ) যখন মদীনা মুনাওয়ারা আগমন করেন, তখন মদীনার ইহুদিরা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে লাগলাে। ঐ সময় তাদেরকে সেই পূর্বের অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য আল্লাহতায়ালা উক্ত আয়াতে কারীমা নাযিল করলেন, “আল্লাহ তায়ালা নবীগণের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতিও নিয়েছিলেন, তারা যেনাে আপন আপন উম্মত থেকে উক্তরূপ ওয়াদা গ্রহণ করেন।” অঙ্গীকার সম্পাদনের ক্ষেত্রে যারা এরূপ মত পােষণ করেন, তাঁদের স্বপক্ষে যুক্তি হলাে এই যে, হুজুর আকরাম (ﷺ) এর আবির্ভাবের পর আহলে কিতাবদের উপর তার ফরজ হয়ে গিয়েছিল তার উপর ঈমান আনা। অথচ হুজুর আকরাম (ﷺ) এর আবির্ভাবের পূর্বে আম্বিয়ায়ে কেরাম সকলেই এ দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গিয়েছিলেন।
সাইয়্যেদ যারা তাঁরা তাে কখনও মুকাল্লাফ হতে পারেন না। সুতরাং নবীগণের অনুসারী উম্মত যারা তাদের উপরই এই অঙ্গীকার গ্রহণের দায়িত্ব বর্তায়। আর উক্ত মতের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করছে এই আয়াতে করীমা-এহেন ওয়াদা অঙ্গীকার থেকে যারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে তারাই ফাছেক। -আর এ ফাছেক শব্দের ব্যবহারটা নবীগণের শানে হতে পারেনা। ফাসেক যদি হয় তবে সে হবে উম্মত। তার উত্তর এভাবেও প্রদান করা হয়েছে যে, আয়াতে ফাসিক হওয়া সম্পর্কে যা বলা হলাে, তা ফরযান বলা হয়েছে। কথাটির মর্ম এই, ধরে নেয়া হােক কোনাে নবী যদি জীবিত থাকে, না সে অবস্থায় মোহাম্মদ (ﷺ) এর আগমন ঘটে, তাকে তাকে অবশ্যই তার উপর ইমান আনতে হবে। কোনাে নবী বিদ্যমান থাকা অবস্থায় তার আবির্ভাব হওয়া সম্পর্কে কোনােরূপ সংবাদ প্রদান এখানে বুঝানাে হয়নি। এরকম বহু ব্যাপার রয়েছে যেখানে ফরযান' দিক অবলম্বন করা হয়েছে। যেমন কুরআনে পাকে এসেছে, 'ধরে নেয়া যাক আপনি যদি শিরক করেন, তাহলে আপনার আমল অবশ্যই বাতিল হয়ে যাবে।' 'ধরে নেয়া যাক আপনি যদি আমার উপর কোন বানোয়াট কথা বলেন।' ধরে নেয়া যাক কেউ যদি বলে নিশ্চয়ই আমি ইলাহ'—এ আয়াতগুলি ফরযান' (ধরে নেয়া যাক) এর উদাহরণ।
হুজুর আকরম (ﷺ) এর ফযীলত, মর্যাদা ও অলৌকিকত্ব বুঝিনোর জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। এখানে কালামের ভিত্তি যখন ফরযান হিসাবে, তখন হক তায়ালার এরশাদ ফাসেক শব্দ প্রয়োগ করা সঠিক। অধিকন্তু আরেক ব্যাপার সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার রাখতে হবে যে, আল্লাহতায়ালা যখন নবীগণের প্রতিশ্রুতি নিলেন এবং হুকুম করলেন নবীকরীম (ﷺ) এর প্রতি ইমান আনতে ও তাকে সাহায্য করতে তা তাদের জীবদ্দশায়। জীবদ্দশায় কোন নবীর জন্য যা হুকুম সে হুকুম তারে সে নবীর উম্মতের জন্য বতরীকে আউলা প্রমাণিত হবে। অতএব এই আয়াতের সম্পর্ক হবে উম্মতের সঙ্গে। তবে অঙ্গীকার নবীগণ থেকে নেয়ার উদ্দেশ্য হলাে, তাতে গুরুত্ব ও দৃঢ়ত্ব বৃদ্ধি পাবে।
ইমাম সুবকী (رحمة الله) বলেন, আয়াতে মিছাক দিকে ইশারা করে যে, হুজুর আকরাম (ﷺ) এর নবুওয়াত সমস্ত নবীগণের জীবদ্দশায় তাদের সময় বিদ্যমান ছিল। কাজেই তার নবুওয়াত ও রিসালাত সাধারণভাবে আদম (عليه السلام) এর যমানা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মাখলুকের জন্য। সমস্ত নবীগণ ও তাদের উম্মতসমূহ সকলেই তাঁর উম্মত। হুজুর পাক (ﷺ) এরকম এরশাদ করেছেন যে, 'আমি সমস্ত মানবকুলের প্রতি প্রেরিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার এরশাদ এরকম, ‘আমি আপনাকে সমগ্র মানব জাতির প্রতি প্রেরণ করেছি।' সকল এরশাদ সমূহ একথাই প্রমাণ করে যে, তাঁর নবুওয়াত শুধু তাঁর জীবদ্দশা থেকে কিয়ামত পর্যন্ত এরূপ নয়, বরং তার পূর্বে যারা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাঁরাও তাঁর নবুওয়াতের অধীন।
এখন প্রশ্ন জাগে যে, তাহলে আউলিয়া কেরামগণ থেকে আল্লাহ তায়ালা কেননা অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। তার উত্তর এই, অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন এজন্য যে, তাদের মধ্যে তিনি যে সবচেয়ে মহান, সম্মানিত ও অগ্রগণ্য এই ব্যাপারটা তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। এবং তিনি যে তাদের সকলের নবী ও রাসূল তা বুঝানাের উদ্দেশ্যে। সুতরাং হে সত্যানুসন্ধিৎসুগণ! তোমরা ইনসাফের সাথে চিন্তা ফিকির করা, আল্লাহতায়ালার তাজিম ও তাকরীম নবী করীম (ﷺ) এর প্রতি কে মহান। গভীরভাবে ভাবলে এটা জানা সম্ভব হবে যে, তারা সকলেই বনী মােহাম্মদ (ﷺ)। আর তিনি হলেন নবীউল আম্বিয়া। এখান থেকেই এ তথ্য প্রকাশিত হয় যে, কিয়ামতের দিন আদম (عليه السلام) ও তার সমস্ত আওলাদ হুজুর আকরম (ﷺ) এর ঝান্ডার নীচে অবস্থান করবেন। যেমন তিনি এরশাদ ফরমান, আদম (عليه السلام) ও তারপর যাঁরা, তাঁরা সকলেই আমার পতাকাতলে অবস্থান করবেন। ধরে নেয়া যেতে পারে, যে, সমস্ত নবীগণ যদি হুজুর আকরাম (ﷺ) এর সঙ্গেই তার জীবদ্দশায় দুনিয়াতে আসবেন, তাহলে তারা সকলেই তার উপর ঈমান আনতেন এবং তাঁকে সাহায্য করতেন।
তাই নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, মুসা (عليه السلام) যদি জীবিত থাকতেন তাহলে আমার অনুসরণ ব্যতিরেকে তার কোনো উপায় থাকবে না। আর এই অনুসরণ ঐ মীছাক বা অঙ্গীকার অনুসারেই হতে যা তার নিকট থেকে গ্রহণ করা হয়েছিলাে। সুতরাং হজরত ঈসা (عليه السلام) আখেরী যামানায় হুজুর পাক (ﷺ) এর শরীয়তের উপর দুনিয়াতে তাশরীফ আনবেন করেছেন। অথচ তিনি যে স্বীয় নবুওয়াতের মূলক ইযযত কারামাতের উপরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন এবং তা থেকে সামান্যও ঘাটতি হবে না। অন্যান্য নবী গণের অবস্থা তদ্রুপ। তারা আপন আপন নবুওয়াত ও তাদের উম্মত থাকা সত্বেও হুজুর আকরম (ﷺ) এর উম্মত। সুতরাং হুজুর আকরম (ﷺ) এর নবুওয়াত অধিকতর ব্যাপক। অধিকতর সম্মিলিত এবং মহান। কথাটির তাৎপর্য গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। যেমন এ ধারণা সৃষ্টি না হয় যে, নবী করীম (ﷺ) এর কারণে অনান্য আম্বিয়া কেরামের নবুওয়াত ও রেসালত রহিত হয়ে গেছে। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া গ্রন্থ কার এরকম বলেছেন। যা কিছু বলা হলাে, তার চেয়ে অধিক তিনি এর তাহকীক ও তাফসীর মূলক আলোচনা করেছেন।
বান্দা মিসকীন অর্থাৎ শায়েখ মােহাককেক শাহ আব্দুল হক মােহান্দিছে দেহলভী (رحمة الله) বলেন, এটা স্পষ্ট হওয়া উচিত যে, প্রকাশ্য নিদর্শন দ্বারা সুস্পষ্টভাবে আম্বিয়ায়ে কেরাম থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, 'আমি যখন তােমাদেরকে কিতাব ও হেকমত দান করবাে। আমীরুল মুমিনীন সাইয়্যিদুনা আলী মর্তুজা (رضي الله عنه) এবং সাইয়্যিদুনা হযরত ইবন আব্বাস (رضي الله عنه) এর ব্যাখ্যা দ্বারা প্রকাশিত হয় যে, প্রতিশ্রুতি গ্রহণকালে যে আম্বিয়ায়ে কেরাম হুজুর আকরাম (ﷺ) এর উপর ঈমান আনবেন এবং তাকে সাহায্য করবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন, তার অর্থ তাঁর দ্বীনের অনুরূপ করা, প্রতিশ্রুতি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে রাখা অথবা সাহায্য করার ইচ্ছা পোষণ করা যা আলম অজুদে এসেছে। এরকম বহুলােক আছে যারা হুজুর আকরম (ﷺ) এর ওজুদে আনসারী বা জড়জগতের অস্তিত্বে আসার পূর্বেই তার উপর ঈমান এনেছিলেন। যেমন হযরত হাবীব নাজ্জার ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, পরবর্তী জামানার অনেক লােক হুজুর আকরম (ﷺ) এর ফাযায়েল, কামালাত এবং নবুওয়াতের সংবাদ পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন।
হুজুর আকরাম (ﷺ) যে আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং তাদের সকল উম্মতের নবী তার জন্য এ প্রমাণটিই যথেষ্ট যে, মেরাজ রজনীতে হুজুর আকরম (ﷺ) এবং তামাম আম্বিয়া কেরাম সকলেই একস্থানে সমবেত হয়েছিলেন। হুজুর পাক (ﷺ) তাদের ইমামতী করলেন এবং তারা সকলেই তার মুক্তাদী হয়েছিলেন। এই সময় তারা সকলেই তার উপর ইমান এনেছিলেন। যেহেতু আম্বিয়া কেরামের প্রকৃত জীবন ও পার্থিব জীবন উভয়ের সাথেই তারা সংশ্লিষ্ট । এতে উম্মতের ঐকমত্য রয়েছে। যদিও আম্বিয়ায়ে কেরাম তাদের আপন আপন উম্মতগণ থেকে আখেরী জামানার পয়গম্বর এর প্রতি ঈমান আনা এবং তাকে সাহায্য করার ব্যাপারে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন, এ অঙ্গীকারও কিন্তু ছিলাে হুজুর পাক (ﷺ) এর মহিমা ও আভিজাত্যের কারণে। তবে আল্লাহ তায়ালা যে নবীগণ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন তা ছিলাে অধিকতর সম্মানের এবং অধিকতর মহত্বের। ফফহাম ওয়া বিল্লাহিত্তাওফীক।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]
© | সেনানী এপ্স |