বৈশিষ্ট্য ও বন্ধুত্বের মর্যাদা প্রদান, সুসম্পর্ক ও সেবাশুশ্রূষা


হুজুর পাক (ﷺ) এর আখলাক ও বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে বন্ধুত্বের দাবী রক্ষা করার অঙ্গীকার করা, মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করা, রোগীর সেবা শুশ্রুষা করা এবং মন মেজাজ প্রতি লক্ষ্য রাখা অন্যতম। হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, যখন কোনাে বস্তু হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে হাদিয়া স্বরূপ আনা হতাে তখন তিনি বলতেন, অমুক মহিলার কাছে নিয়ে যাও। সে হজরত খাদিজা (رضي الله عنه) এর বান্ধবী। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, হযরত খাদিজা (رضي الله عنه) এর প্রতি আমার এতো ঈর্ষা হতে যে অন্য কারো প্রতি এরকম হতো না। কেননা হুজুর আকরম (ﷺ) তাকে খুব বেশী স্মরণ করতেন। হুজুর পাক (ﷺ) যদি একটি বকরি জবেহ করেন, তবে অবশ্যই তা থেকে হযরত খাদিজা (رضي الله عنه) এর বান্ধবীগণের জন্য কিছু অংশ পাঠিয়ে দিতেন। একদা হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে একজন মহিলা আগমন করলে হুজুর (ﷺ) তাকে দেখে আনন্দিত করলেন। তাকে যথেষ্ট সম্মান করলেন। মহিলা স্থান থেকে প্রস্থান করলেন হুজুর (সা) বললেন, এ মহিলা খাদিজা (رضي الله عنه) এর জীবদ্দশায় তার কাছে আসা যাওয়া করতেন। তিনি আরও বললেন, কারও বৈশিষ্ট্যকে সদাচরণের সাথে লালন করে যাওয়া ইমানের অংশ।


হুজুর আনওয়ার (ﷺ) রক্ত সম্পর্ক ও নিকটাত্মীয়দের হকের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করতেন এবং তাদেরকে সাহায্য করতেন। হুজুর পাক (ﷺ) এরকম বলতেন, অমুকের পিতার বংশ আমার বন্ধু নয়। কোনাে কোনাে হাদীছে এসেছে, তিনি এরকম বলতেন, আল্লাহতায়ালা এবং নেককার মুসলমান ব্যতীত আমার কোনো বন্ধু নেই। তবে হাঁ রক্ত সম্পর্ক অবশ্যই স্বীকার্য এবং এহেন রক্ত সম্পর্কের কারণে আমি তাদের প্রতি নরম ব্যবহার করে থাকি। এ কথার তাৎপর্য এই যে, হুজুর পাক (ﷺ) আত্মীয় স্বজনদের অস্বীকার করবেন না বটে, তবে তাদের চাইতে ঈমানদারগণকে বেশী গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলেন, আমি তাদের প্রতি কম অনুগ্রহ করে থাকি। যেমন কারও চেহারার উপর পানির ছিটা দিলে যেমন অল্প পানি চেহারার উপর পতিত হয়, সম্পর্কধারী আত্মীয়দেরকে আমি ঐ রকমই গুরুত্ব দিয়ে থাকি। হুজুর (ﷺ) এর এই উক্তি দ্বারা ইবনুল আবিল আসকে বুঝানো হয়েছে।


হুজুর আকরাম (ﷺ) উমামা বিনতে যয়নব (رضي الله عنه) কে কোলে উঠিয়ে নিতেন। হুজুর পাক (ﷺ) যখন নামাজ আদায় করতেন, তখন তিনি তাঁর কাঁধ মুবারকের উপর বসে থাকতেন। আবার যখন সেজদায় যেতেন তখন মাটিতে নেমে যেতেন। আবার যখন দণ্ডায়মান হতেন কাঁধে উঠে বসতেন। হুজুর পাক (ﷺ) এর এরকম অভ্যাস শিশুদের প্রতি তার অগাধ ভালােবাসা ও স্নেহবাৎসল্যের কারণে ছিলাে। হজরত উমামা (رضي الله عنه) যে হুজুর (ﷺ) এর কাঁধে উঠে বসতেন এবং যমীনে নেমে যেতেন, তা তিনি নিজেই করতেন। হুজুর (ﷺ) স্বহস্তে এরকম করতেন না। হুজুর (ﷺ) যখন দাঁড়াতেন তখন তিনি কাঁধে উঠে বসে যেতেন আবার যখন যমীনে সেজদায় লুটিয়ে পড়তেন তখন নীচে নেমে যেতেন। এখানে কেউ যেনাে এরকম মনে না করে যে, হুজুর (ﷺ) স্বহস্তে এগুলি করে নামাজে আমলে কাছীর করেছেন। অধিকন্তু উক্ত নামাজ ফরজ নামাজ ছিলােনা, বরং তা ছিলাে নফল নামাজ। ওয়াল্লাহু আ'লামু।


হুজুর আনওয়ার (ﷺ) এর দুধ বোন হযরত শীমা (رضي الله عنه)। তিনি হুজুর পাক (ﷺ) এর দুধ মাতা হযরত হালিমা সাদিয়া (رضي الله عنه) এর সঙ্গে একত্রে হুজুর পাক (ﷺ) এর খেদমত ও লালন পালনের কাজ করতেন। হজরত শীমা (رضي الله عنه) কে ইবনুল আছীর মহিলা সাহাবীগণের মধ্যে শামিল করেছেন। হাওয়াযেন গােত্রের বান্দীদের সংগে তিনিও হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে আনীত হয়েছিলেন। তিনি হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে নিজের পরিচয় প্রদান করলে হুজুর (ﷺ) তাঁর জন্য নিজের চাদর বিছিয়ে দিয়েছিলেন। হুজুর (ﷺ) তাকে বললেন, আপনি যদি আমাদের এখানে থাকতে চান তাহলে বলুন। সম্মান মর্যাদার সাথে আপনাকে এখানে রাখা হবে। ধনদৌলতও প্রদান করা হবে। আর যদি নিজ গােত্রে ফিরে যেতে চান তাহলে যেতে পারেন। তিনি আপন গােত্রে ফিরে যাওয়াকে  পছন্দ করলেন। তাই হুজুর আকরম (ﷺ) সাজ সরঞ্জাম সহকারে তাঁকে সসম্মানে তাঁর গােত্রের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।


আবু তোফায়েল (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমি একদা বাল্যকালে হুজুর পাক (ﷺ) কে দেখলাম, একজন মহিলা তার কাছে আগমন করলেন। তিনি উক্ত মহিলাদের জন্য স্বীয় চাদর খানা বিছিয়ে দিলেন। মহিলাটি উক্ত চাদরের উপর উপবেশন করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম মহিলাটি কে? সাহাবাগণ বললেন, ইনি সেই মহিয়সী রমণী, যিনি হুজুর আকরম (ﷺ) কে দুধ পান করিয়েছিলেন। প্রকাশ থাকে যে, মহিলা ছিলেন হযরত হালিমা সাদিয়া (رضي الله عنه)। ইবন আব্দুল বার 'এস্তিআব নামক গ্রন্থে লিখেছেন, তিনি হালীমা (رضي الله عنه) ই ছিলেন। উলামায় কেরাম অবশ্য এ সম্পর্কে বলে থাকেন যে, হুজুর পাক (ﷺ) কে সর্বমােট আটজন মহিলা দুধপান করিয়েছিলেন। তিনি হয়তাে তাদের মধ্যে একজন হবেন। আল্লাহপাক ভালাে জানেন। আমর ইবন সায়েব বর্ণনা করেন, হুজুর আকরম (ﷺ) একবার কোনাে কন্থানে তাশরীফ আনয়ন করলেন। সেখানে হুজুর (ﷺ) এর দুধপিতা এলেন। তিনি তাঁর জন্য স্বীয় চাদর মুবারক বিছিয়ে দিলেন। তিনি তার উপর বসলেন। অতঃপর তাঁর দুধমাতা এলে তাঁকেও চাদরের এক প্রান্তে বসিয়ে দিলেন। এরপর তার দুধ ভাই এসে পড়লে হুজুর (ﷺ) তাঁকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং কাছে এনে সামনে বসিয়ে দিলেন। 


হুজুর (ﷺ) সৌহার্দ স্বরূপ আবু লাহাবের বান্দী ছাওবিয়ার জন্য খানা ওপােশাক পরিচ্ছদ প্রেরণ করতেন। কেননা, তিনিও হুজুর পাক (ﷺ) কে দুধ পান করিয়েছিলেন। ছাওবিয়া মৃত্যুবরণ করলে হুজুর (ﷺ) লোকদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ছাওবিয়ার কোনাে নিকটাত্মীয় আছে কি? লােকেরা জবাব দিয়েছিলাে, না তার কেউ নেই।


হযরত খাদীজাতুল কুবরা (رضي الله عنه) এর হাদীসে উল্লেখ আছে-তিনি হুজুর আকরম (ﷺ) কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, হে রাসূল (ﷺ)! আপনি শুভ সংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহর কসম! আল্লাহতায়ালা আপনাকে কক্ষণও লাঞ্ছিত করবেন না। কারণ আপনি তাে মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন, আপনি এতীমের- অনাথদের দায়িত্ব বহন করেন, অসহায়দের জন্য কামাই রােজগার করে দেন, মেহমানদারী করেন, সত্যের জন্য বিপদের ক্ষেত্রে আপনি সাহায্য করে থাকেন।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী] 


© | সেনানী এপ্স |

Top