দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি


হুজুর আকরম (ﷺ) এর স্বভাবে যুদ্ধ বা দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তির পূর্ণতার বিবরণ বিভিন্ন হাদিসে পরিপূর্ণভাবে এসেছে। দুনিয়ার প্রতি লােভ থেকে তিনি সার্বিকভাবে মুক্ত ছিলেন। অথচ পূর্ণ চাকচিক্যের সাথে দুনিয়াকে তার সামনে পেশ করা হয়েছিল। তিনি সেগুলির প্রতি ভ্রক্ষেপ করেননি। একের পর এক যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। প্রচুর গনীমতের মাল এসেছে। কিন্তু দেখা গেল হুজুর আকরাম (ﷺ) যখন দুনিয়া থেকে পর্দা করলেন, তখন তার সম্পদ বলতে ছিলাে একটি মাত্র যেরা যা কোনাে এক ইহুদীর কাছে রক্ষিত ছিলাে। ইন্তেকালের পর তা বিক্রি করে পরিবার পরিজনের খােরাকীর জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিলাে। তিনি আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করতেন, হে আল্লাহ আমার বংশধরের জন্য জীবনধারণযােগ্য রিযিকের ব্যবস্থা করে। হুজুর পাক (ﷺ) এর ওফাতের পূর্ব পর্যন্ত উক্ত যেরাখানা ইহুদীর কাছ থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে এটাই প্রমাণিত হবে যে, যুছদ বা দুনিয়ার প্রতি তার পরিপূর্ণ অনাসক্তি ছিলাে। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, নবী করীম (ﷺ) জীবনে কখনও এক সাথে তিন দিন উদর পূর্তি করে আহার করেন নি। অন্য এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, একাধারে দুদিন কখনও যবের রুটি দেখেননি। অথচ তিনি যদি কামনা করতেন, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে এতাে পর্যাপ্ত পরিমাণ রিযিক দান করতেন, যা মানুষেরা কল্পনাও করতে পারে না। অন্য এক হাদীসে আছে, হুজুর আকরম (ﷺ) এর পরিবার পরিজন কখনও উদরপূর্তি করে গমের রুটি খেতে পারতেন না।এমনি অবস্থা বিরাজিত ছেলে তার ওফাত পর্যন্ত।


হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, হুজুর পাক (ﷺ) না রেখে গেছেন কোনাে দীনার দেরহাম না কোনাে উট-বকরী। আমর ইবন হারেছ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, হুজুর আকরম (ﷺ) মীরাছ হিসাবে হাতিয়ার, ঘোড়া ও যীনপুশ ব্যতীত আর কিছুই রেখে যাননি। সেগুলিকেও বাইতুল মালে দান করে দিয়েছিলেন। সাইয়্যেদা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, হুজুর আকরম (ﷺ) যখন দুনিয়া থেকে প্রস্থান করলেন, তখন তার গৃহে আধা কিলো যাব ব্যতীত খাবার যোগ্য অন্য কিছু ছিলাে না। সেই আধা কিলো যাব ঘরের এক কোণে তাকের উপর রক্ষিত ছিল। হুজুর পাক (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয়েছিলাে, আমি যদি চাই তাহলে মক্কার ওয়াদি পাহাড় কে আমার জন্য স্বর্ণে রূপান্তরিত করে দেয়া হবে। আমি তখন আরয করলাম, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এতটুকু দান করুন যাতে আমি একদিন উপবাস করে পরের দিন আহার করতে পারি। আর যেদিন উপবাস থাকি সেদিন যেনাে আপনার দরবারে রোনাজারি করতে পারি, আপনার কাছে প্রার্থনা করতে পারি, আর যেদিন আহার করতে পারি সেদিন যেন আপনার শুকরিয়া আদায় করতে পারি। আপনার প্রশংসা ও গুণ-গান করতে পারি।


অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে, একদা হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) হুজুর পাক (ﷺ) এর খেদমতে হাযির হয়ে বললেন, আল্লাহতায়ালা আপনাকে সালাম জানিয়ে এরশাদ করেছেন, আপনি চাইলে পাহাড় সমূহকে স্বর্ণ রূপান্তরিত করে দেবেন। আর আপনি যেস্থানে তশরীফ নিয়ে যাবেন পাহাড়গুলিও আপনার সঙ্গে সঙ্গে যাবে। হুজুর পাক (ﷺ) ক্ষণিক মাথা নীচু করে চুপ থেকে বললেন, ওহে জিব্রাইল! দুনিয়া ঐ ব্যক্তির ঘর, যার কোনাে ঘর নেই। দুনিয়া ঐ লোকের সম্পদ যার কোন সম্পদ নেই। আর দুনিয়াকে ঐ ব্যক্তিই জমা করতে পারে যার কোন জ্ঞান নেই।-জিব্রাইল (عليه السلام) বললেন, হে হাবিবে খোদা! আল্লাহ তায়ালা আপনাকে সুদৃঢ় বাক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন।


সাইয়েদা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমরা হুজুর আকরম (ﷺ) এর পরিবার পরিজন। আমাদের অবস্থা এই যে, দীর্ঘ একমাস পর্যন্ত আমাদের ঘরে (খাদ্য পাকানাের জন্য) কোনাে আগুন জ্বলতাে না। খেজুর ও পানি ছাড়া ঐ সময় আমাদের কোনাে খাবার থাকতাে না। হযরত আব্দুর রহমান ইবন আউফ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, একদা হুজুর পাক (ﷺ) এর নিকট একটি বড় পাত্র ভর্তি খানা আনা হলাে। তিনি তা দেখে ক্রন্দন করে বলতে লাগলেন, ধ্বংস! রসূলে খােদা (ﷺ) এবং তাঁর স্ত্রীগণ যবের রুটি দিয়েও তাে কখনও উদরপূর্তি করে আহার করেন নি। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, রসূলে খােদা (ﷺ) এবং তার পবিত্র স্ত্রীগণ একাধারে কয়েক রাত ধরে অনাহারে থাকবে। ঐ সময় তাদের ঘরে খাবার থাকতাে না।


হযরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, হুজুর আকরম (ﷺ) কখনও টেবিলে বা প্লেটে আহার করেন নি এবং তার জন্য পাতলা চাপাতি রুটি তৈয়ার করা হেনা। খুব মোটাতাজা বকরীর গোশত তার সামনে কখনও দেখা যেতােনা। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, হুজুর পাক (ﷺ) খানাপিনা করে পরিতৃপ্ত হয়ে যেতেন এরকম হতো না। আর এ ব্যাপারে কারও কাছে তিনি অভিযােগও করতেন না। হুজুর পাক (ﷺ)-এর নিকট ধনাঢ্যতার তুলনায় দারিদ্র্য অধিকতর পছন্দনীয় ছিলাে। তিনি দারিদ্রের মধ্যেই দিনাতিপাত করতেন। রাত্রিবেলায় সমস্ত রাত্রি পেট মুবারকের উপর ক্ষুধা মালিশ করতেন। ক্ষুধা মালিশ করা এটি একটি রূপক কথা, যার অর্থ ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর থাকা। রাত্রিবেলা এ অবস্থায় থাকার কারণে তিনি যে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকেন —তা নয়। অথচ তিনি যদি পরওয়ার দিগারের কাছে চাইতেন, তাহলে পৃথিবীর সমস্ত ধন ভাণ্ডার, সমস্ত ফলফলাদি লাভ করতেন। হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) বলেন, হুজুর পাক (ﷺ) এর এমন অবস্থা দেখে মহব্বতের তাড়নায় আমার কান্না এসে যাবে। আমি তার এমন অবস্থা দেখে কখনো কখনো আমার হাত দিয়ে তার পেট মুবারক মালিশ করে দিতাম। ক্ষুধায় কাতর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলতাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার জন্য আমার জান কুরবান হোক। আপনার খানাপিনা জন্য এবং শরীরে শক্তি সঞ্চারের জন্য যতটুকু দরকার, ততটুকু যদি আপনি দুনিয়া থেকে গ্রহণ করতেন! 

—একথা শুনে হুজুর পাক (ﷺ) এরশাদ করলেন, হে আয়েশা! দুনিয়া দিয়ে আমি কি করবো? আমার ভ্রাতৃ বর্গ যারা উলুল আযম পয়গম্বর ছিলেন, তারা তো এর চেয়ে বেশি কষ্ট ও বিপদে ধৈর্য ধারণ করে গেছেন। এমনকি তারা সে অবস্থায় থেকে নিজেদের অবস্থান অতিক্রম করে চলে গেছে। আপন প্রতিপালক হক তায়ালার কাছে পৌছে গেছেন। সে অবস্থায় তাদের প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তনকে হক তায়ালা অনেক মূল্য দিয়েছেন। তাদের অনেক সওয়াব দানে ধন্য করেছেন। তাঁদের সেই অবস্থাবলীর দিকে লক্ষ্য করে আমি যখন আমার নিজের দিকে তাকাই, তখন লজ্জিত হয়ে পড়ি। চিন্তা করি, আমি কি এরূপ জীবন যাপন করবাে, যা আগামী কালই আমার কাছ থেকে পৃথক করে দেয়া হবে? কাজেই আমার কাছে আমার ভাইগণের দলের অন্তর্ভুত হওয়ার চাইতে অধিকতর প্রিয় আর কিছুই নেই ! সাইয়্যেদা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, এ ঘটনার পর হুজুর পাক (ﷺ) এক মাসের অধিক এ দুনিয়াতে অবস্থান করেন নি।


সাইয়্যেদা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) আরে বর্ণনা করেন, হুজুর আকরম (ﷺ) এর স্বতন্ত্র কোনাে বিছানা ছিলাে না। শুধু এমন একটি বিছানা ছিলে যাতে তুলার পরিবর্তে খেজুর গাছের ছাল ভর্তি ছিলে। হযরত হাফসা (رضي الله عنه) বলেন, হুজুর আকরম (ﷺ) এর পবিত্র ঘরে দু'খানা সুতির বিছানা (কম্বল) ছিলাে। যা দু' ভাঁজ করে বিছানাে হতাে। তিনি তাতে আরাম করতেন। এক রাত্রিতে আমি তা চার ভাজ করে বিছিয়ে দিলাম যাতে বিছানা একটু নরম হয়। পরদিন সকালে হুজুর (ﷺ) বললেন, আজ রাতে তুমি আমার জন্য কি বিছিয়ে দিয়েছিলে? আমি বললাম, যা দৈনিক বিছানায় হয়, তাই বিছিয়ে দিয়েছিলাম। তবে আজ রাতে আমি বিছানাটি চার ভাঁজ করেছিলাম। তখন হুজুর আকরাম (ﷺ) বললেন, পূর্ব অবস্থা ভালো। কেননা নরম বিছানা আমার রাতের নামাজ আদায়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। তার পবিত্র অভ্যাস এমন ছিলাে যে, তিনি কখনও তক্তার উপর শুয়ে আরাম করতেন। আবার কখনও খেজুরের চাটাই এর উপর শয়ন করতেন। তাঁর দেহ মোবারক চাটাই এর দাগ পড়ে যেতাে।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী] 


© | সেনানী এপ্স |

Top