খেযাব সম্পর্কিত মাসআলার আলোচনা
দাঁড়ি বা চুলে খেযাব (কলপ) ব্যবহার করা সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতানৈক্য আছে। তবে অধিকাংশের মতে বিশেষ করে মুহাদ্দিসগণের মতে এটা মাকরুহ। কেননা, হুজুর পাক (ﷺ) এতাে বার্ধক্যে উপনীত হননি যাতে খেজাব ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। ইন্তেকালের সময় তার কেশরাজিতে এবং দাড়ি মোবারকে সতের বা আঠার খানা চুল সাদা হয়েছিলাে। তাও আবার যখন তিনি চুলে তেল ব্যবহার করে আঁচড়াতেন তখন সেই গুলো ঢাকা পড়ে যেতে। হযরত আনাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, মাথা ও দাড়ি মোবারকে মাত্র গুটিকয়েক চুল সাদা হয়েছিল, আমি ইচ্ছা করলে তা গণনা করতে পারতাম। তিনি আরও বলেন, হুজুর পাক (ﷺ) খোব ব্যবহার করেননি। হুজুর পাক (ﷺ) এর ঝরে পড়া চুল মােবারক যা হজরত আনাস (رضي الله عنه) এর নিকট রক্ষিত ছিল,তা খোঁজকৃত ছিলে বলে যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম বলেন, চুলগুলি আসলে খোঁজকৃত ছিলা না। বরং কোনোপ্রকার খুশবু দিয়ে সেগুলো সুগন্ধিযুক্ত করা হয়েছিল। বাহ্যিকভাবে দেখা যেতে, যেনাে খুব লাগানো হয়েছে। অথবা ও হতে পারে যা, পরবর্তীতে হযরত আনাস (رضي الله عنه) সে কেশ মােবারকগুলি খেযাব করে রেখে দিয়েছিলেন। হজরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছের বেলায়ও উক্ত সমাধানটি প্রযােজ্য। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাব বুখারী ও মুসলিম শরীফ থেকে হযরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) এর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে, তিনি হুজুর পাক (ﷺ) কে জরদ রঙ ব্যবহার করা অবস্থায় দেখেছেন। এ সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম বলেন, জরদ রঙ বলতে এখানে যাফরানকে বুঝানাে হয়েছে যা সুগন্ধির জন্য ব্যবহার করতেন। (লেখক বলেন) আমি হজরত শায়েখ আব্দুল ওয়াহাব মুত্তাকী (رضي الله عنه) থেকে এরূপ শুনেছি যে, উক্ত জরদ রঙ খেযাব ছিলে না। কেননা হুজুর পাক(ﷺ) এর কেশরাজি কৃষ্ণবর্ণ ছিলো। আর চুলের কৃষ্ণতা তা অন্য কোনো রঙ ধারণ করে না। কাজেই তিনি যে জরদ বর্ণ ব্যবহার করেছেন তা ছিলাে যাফরান, যা দিয়ে চুলকে অধিক পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করাই উদ্দেশ্য ছিলাে। অর্থাৎ তিনি যাফরান দিয়ে চুল ধৌত করে পরিষ্কার করেছেন। তবে যে কখানা দাড়ি সাদা ছিলাে তা অবশ্যই কৃষ্ণ বর্ণকে ধারণ করে নিয়েছে আর হুজুর পাক (ﷺ) খেযাব ব্যবহার বার্ধক্য কালে করেছেন। কাজেই এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনার অবকাশ রয়েছে। আর তিনি (আব্দুল ওয়াহাব মুত্তাকী) ইমাম নববী থেকে বর্ণনা করেছেন, হুজুর পাক (ﷺ) কখনো কখনো খেজাব ব্যবহার করতেন। তবে অধিকাংশ সময় চুল বা দাড়িকে স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দিতেন। কাজেই বর্ণনাকারীগণ তাকে যখন যে অবস্থায় দেখেছেন সেরূপই বর্ণনা করেছেন। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের বর্ণনাই সঠিক। তিনি আরও বলেছেন যে, এর ভাবার্থ নির্দিষ্ট। কেননা ইবনে ওমর (رضي الله عنه) এর হাদীছ বুখারী ও মুসলিম শরীফে উক্ত হয়েছে। সুতরাং তা পরিত্যাগ করা যেমন সম্ভব নয় তেমনি তার কোনো রূপক ব্যাখ্যা করাও সম্ভব নয়। যে কালে রমণীগণ তাদের অধিকাংশ চুল সাদা হয়ে যাওয়াকে অপছন্দ করে হুজুর পাক (ﷺ) এর বয়স ঐ সীমা পর্যন্ত পৌছার সম্ভাবনা থাকা সত্বেও উলামায়ে কেরাম এরূপ বলে থাকেন, কেউ যদি হুজুর আকরম (ﷺ) এর কোনােকিছুকে অপছন্দ করে সে কাফের।
হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়, তিনি বার্ধক্যের নিন্দাবাদ করেছেন। তিনি এরূপ বলেছেন আল্লাহতায়ালা হুজুর পাক (ﷺ) কে বার্ধক্য প্রদান করেননি। উলামায়ে কেরাম হজরত আনাস (رضي الله عنه) এর এই বর্ণনা সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন যে, হাদীছ শরীফে বর্ণনা এসেছে, 'বার্ধক্যের সম্মান ও নূরের প্রতীক। বার্ধক্যের প্রশংসা স্বয়ং নবীজির যবান মােবারক থেকেই পাওয়া যায়। এসম্পর্কে উলামা কেরাম বলেন হজরত আনাস (رضي الله عنه) হুজুর পাক (ﷺ) এর খোব ব্যবহারের ফলে তার বাহ্যিক অবস্থা পরিবর্তনে আধিক্য অবলোকন করেছেন। হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) এর পিতা হজরত আবু কুহাফা (رضي الله عنه) এর মাথা ও দাড়ির চুল সাদা হয়ে গেলে রসূল (ﷺ) তা দেখে অপছন্দ করলেন এবং বললেন, বার্ধক্যকে যৌবনে রূপান্তরিত করে নাও অর্থাৎ চুলগুলােকে কালাে বানিয়ে নাও। হজরত আনাস (رضي الله عنه) যখন বার্ধক্যকে অপছন্দ করা হয়েছে বলে জানালেন, তখন সম্ভবত তিনি এ সম্পর্কিত ভিন্ন মতের হাদীছ আর শ্রবণ করেননি অথবা এধারণাও করে থাকতে পারেন, ঐ হাদীছ এ হাদীছ দ্বারা মনসুখ হয়ে গিয়েছে। আর তাই, এর উপর হুকুম আরোপ করেছেন। এরূপ উক্তি রয়েছে মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাব।
হযরত শায়খ শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله) বলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, হুজুর আকরাম (ﷺ) শত্রুপক্ষের দৃষ্টিতে পুরোপুরি যৌবন, শক্তি, ক্ষমতা ও আতঙ্কের অধিকারী ছিলেন। কেননা দ্বীনের দৃঢ়তা অর্জনের জন্য এবং ইসলামের শান শওকত প্রকাশ করণার্থে উক্ত গুণাবলীর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে নবুওয়াতের যামানায় কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য আল্লাহতায়ালা হুজুর পাক (ﷺ) কে বার্ধক্য থেকে সংরক্ষিত করেছেন। কেননা বার্ধক্য হচ্ছে দুর্বলতা ও অক্ষমতার নিদর্শন। আর হুজুর পাক (ﷺ) যে সাহাবীগণকে খেজাব ব্যবহার করে নওজোয়ানদের সাথে সাদৃশ্য রাখার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন, তার কারণও এটাই ছিলাে। নবী করীম (ﷺ) এর জীবনে বার্ধক্যের আবির্ভাব ও বহিঃপ্রকাশ যা ঘটেছিল তা মূলত কয়েকখানা চুলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলে। আর এ-ও হয়েছিলো খওফে খোদা ও খাসিয়াতে ইলাহীর কারণে।
এ সম্পর্কে তিনি স্বয়ং ইরশাদ করেছেন, উহুদ, আল ওয়াকিয়াহ, আল মুরসালাত, আম্মা ইয়া তাসাআলুন ও ইযাশশামসু কুইয়িরাত সূরা সমূহ আমাকে বৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছে। আর তাঁর বার্ধক্য আবার এমনও ছিলাে না যে, যৌবনের আকৃতিতে ত্রুটির সৃষ্টি করে। বরং যৌবনের লাবণ্যের সাথে সাথে বার্ধক্যের মর্যাদা ও নূরও বিদ্যমান ছিল। যেমন হযরত ইব্রাহীম খলীল (عليه السلام) ও তদীয় পুত্র হজরত ইসহাক (عليه السلام) এর মধ্যে বয়সের পার্থক্য বুঝানাের জন্য আল্লাহ তায়ালা পিতার চুলের শুভ্রতা এনে দিলেন। এ দেখে তিনি আরজ করলেন, হে আমার প্রতিপালক এটা কি? আল্লাহতায়ালা বললেন, এটা হচ্ছে মর্যাদার প্রতীক। তখন তিনি বললেন, হে আমার প্রভু আমার মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করে দাও।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী]
© | সেনানী এপ্স |