ভার সরিয়ে দেয়া


সন্দেহ দূর করার পরিপ্রেক্ষিতে আরেকখানা আয়াতে কারীমার প্রসঙ্গ নিয়ে আলােচনায় আসা যাক। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন আমি আপনার ভার সরিয়ে দিয়েছি, যে ভার আপনার পৃষ্ঠদেশকে ভেঙে ফেলছিলে।—আয়াতে কারীমার প্রতি বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায়, গােনাহের ভার যা কঠিন ছিলাে হুজুর পাক (ﷺ) এর উপর তা আল্লাহ্ সরিয়ে দিয়েছেন। এমনকি ফুকাহা, মুহাদ্দেছীন ও মুতাকাল্লেমীনগণের এক দল এরকম মত পােষণ করেন যে, আম্বিয়া কেরাম থেকে সগীরা গােনাহ প্রকাশ পাওয়া সম্ভব। তারা এ আয়াত দ্বারাই দলীল দিয়ে থাকেন। কুরআন ও হাদীছের যাহেরী শব্দ সমূহকে যদি আবশ্যিক হিসাবে ধরে নেয়া হয় এবং তাকে দলীল গ্রহণের উৎস হিসাবে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে এ শব্দ কেননা এরকম আরও বহু শব্দ পাওয়া যাবে, যেগুলিকে কবীরা গােনাহ জায়েজ হওয়ার দলিল রূপে দাঁড় করানো যাবে।


শুধু তাই নয়, আম্বিয়ায়ে কেরাম থেকে সগিরা ও কবীরা গুনাহ প্রকাশিত হওয়া জায়েয নয় বলে যে এজমা রয়েছে, তাও খন্ডন করা যাবে। কিন্তু এ মতকে কোনো মুসলমানই গ্রহণ করে না। সত্য কথা এই যে, জায়েয বলার পক্ষের যে দলটি যেসমস্ত আয়াত দ্বারা দলীল গ্রহণ করে থাকে, ঐ সমস্ত শব্দের অর্থের ব্যাপারে মুফাসিরগণের মতানৈক্য রয়েছে।


আবার তাদের সমস্ত সিদ্ধান্তের মধ্যে পরস্পর বিরােধী মত ও সম্ভাব্যতা বিদ্যমান রয়েছে। আর এ দলটি যে সকল মতকে আবশ্যিক করে থাকে। সালফে সালেহীনগণ তার প্রত্যেকটি বিপরীত মত পোষণ করেন। যেহেতু এদের মাযহাবের বিরুদ্ধে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরা যে মতের উপর একত্রিত হয়েছেন, সেগুলি মুহতামাল বা সম্ভাব্য এবং মুআব্বাল বা তাবীলকৃত। আর সলফে সালেহীনের সর্বসম্মতিক্রমে যে মতৈক্য সংগঠিত হয়েছে, তা এদের মতের বিপরীত। এদের দৃষ্টিগ্রাহ্য শব্দ পরিত্যাজ্য হবে। বাহ্যিকতা অবস্থায় উপরোক্ত বক্তব্য বর্জন এবং প্রকৃত বলের দিকে প্রত্যাবর্তন অপরিহার্য।


নিঃসন্দেহে উপরােল্লেখিত আয়াতে কারীমার তাফসীরের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। 

(১) এ প্রসঙ্গে কোনাে কোনাে তফসীরকার বলেন যে, আয়াতে কারীমায় যে বােঝা বা ডারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে হুজুর আকরম (ﷺ) এর উপর যে দায়িত্বের বােঝা ফেলে দেয়া হয়েছে, সে দ্বায়িত্বের পরিমাণের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা। আর সে বােঝা হালকা করা বা সরিয়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে আল্লাহপাক তাঁকে ছবর ও রেযা (ধৈর্য ও সন্তুষ্টি) দান করেছেন। তবে এক্ষেত্রে নবুওয়াতের বোঝা হালকা করা- এই ব্যাখ্যাটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।

কেননা নবুওয়াতের  আমাকে প্রতিষ্ঠিত করা, নবুওয়াতের মোজেজাত হেফাজত করা, তার হকসমূহ আদায় করা ইত্যাদির কারণে হুজুর পাক (ﷺ) এর পবিত্র পৃষ্ঠদেশ ভারাক্রান্ত ছিলে। তাই আল্লাহ তায়ালা তাকে সাহায্য সহায়তা করে তা তার জন্য লাঘব করে দিলেন। শরহে ছদর দান করে দাওয়াতে খালকের (সৃষ্টির প্রতি আহ্বান কার্যের) সাথে হুযুরে হক অর্থাৎ হকতায়ালার উপস্থিতিকে সমন্বিত করে দিয়ে সে বোেঝাকে তার জন্য সহজ করে দিলেন বা বােঝা সরিয়ে দিলেন। আর শরহে ছদর এমন একটি উন্নত স্তর যার পরিপূর্ণতা ও সম্পূর্ণতা কেবল হুজুর পাক (ﷺ) এর জন্যই খাছ ছিলাে। আর কারও তা নসীব হয়নি।


ক্ষমতাশালী কামেলা এবং আউলিয়ায়ে কেরাম যারা, তারা অবশ্যই তাদের আপন আপন যোগ্যতা ও অনুভূতি অনুসারে হুজুর আকরাম (ﷺ) এর আনুগত্যের বরকতে উক্ত মাকামের কিছু অংশ পেয়ে থাকেন। এজন্যই বলা হয় যে, সুফীগণ কায়েম ও স্থির। আর এ সুফীগণের ‘জমা' এর মধ্যে ‘ফরক' (ফরক বাদাল জমা) (একীভূতির পর পৃথক হয়ে যাওয়া) এসে কোনরূপ ক্ষতি সাধন করতে পারে না। এ মাকামে হাসিল হয় মাহজুব (পর্দাচ্ছাদিত) গণের মধ্যে। আর মাজজুবগণের মধ্যে এ অবস্থা পরিদৃষ্ট হয় না। কেননা তাদের বেলায় একীভূত অবস্থা প্রবল থাকে।


(২) কেউ কেউ বলেন , وزر 'বিযর' (বোঝা) দ্বারা ঐ সমস্ত পছন্দনীয় কার্যকলাপকে বুঝানো হয়েছে, যার মাধ্যমে কুরাইশরা হযরত ইব্রাহিম (عليه السلام) এর সুন্নতকে পরিবর্তন করে তাকে বিকৃত অবস্থায় পালন করতাে। অথচ সেগুলি হুজুর পাক (ﷺ) সহ্য করতে পারতেন না। তার কাছে এগুলি বড়ই দৃষ্টিকটু মনে হতাে, কিন্তু এগুলি প্রতিহত করার মতাে কোনােরূপ শক্তিও তখন তার ছিল না। এমনকি এক পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা তাকে আবির্ভূত করলেন, রেসালত দান করলেন, আমর (আদেশ) ও তওফীক (ক্ষমতা) ইত্যাদি দান করে তাঁকে শক্তিশালী বানালেন এবং এরশাদ করলেন, আপনি একনিষ্ঠভাবে মিল্লাতে ইব্রাহীমের অনুসরণ করুন। এরশাদে বারীতায়ালার মধ্যে যে اتبع ‘ইত্তাবি’ শব্দটি রয়েছে এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহতায়ালার তওফীক, সাহায্য ও শক্তি ইত্যাদির মধ্যে শরীয়ত জারি করা এবং আমার ও আহকামে ইলাহীকে বাস্তবায়িত করা। মিল্লাতে ইব্রাহীম বা সুন্নাতে ইব্রাহীম যে উল্লেখ করা হয়েছে বয়ানে ওয়াকে এর পরিপ্রেক্ষিতে।


(৩) কেউ কেউ বলেন যে, ذنب وزر বিযর ও যামব এর অর্থ হচ্ছে হুজুর পাক (ﷺ) এর ইসমত ও হেফাযত। এখানে একটি জিনিস লক্ষ্যণীয়। তা হচ্ছে বিযর ও যামব এর সিফত বা বিশেষণ স্বরূপ বলা হয়েছে, যা তার পৃষ্ঠদেশকে ভেঙে ফেলে। কাজেই এখানে وضع وزر 'ওয়াযয়ে বিযর' অর্থাৎ বােঝা দূর করে দেয়া এটাকেই মাজাযী বা রূপকভাবে বলা হয় ইসমত। ইসমত এর অর্থ হচ্ছে বিযর ও যামব (বােঝা ও গােনাহ) বিদ্যমান না থাকা। এরকমভাবে অন্য আয়াতে ইসমতের নাম রাখা হয়েছে مغفرات ذنوب  'মাগফেরাতে যনুব' (গােনাহ মাফ)। হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে, হুজুর পাক (ﷺ) নবুওয়াতের পূর্বে এক বিয়ের ওলীমা অনুষ্ঠানে একদিন উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে গান হচ্ছে। দফ এবং অন্যান্য বাজনা হচ্ছিলাে। সে সময় আল্লাহ তায়ালা তার উপর নিদ্রা প্রবলbকরে দিলেন। এভাবেই তিনি গান বাজনা শােনা থেকে মাহফুজ বা সুরক্ষিতbরয়ে গেলেন।


(৪) কেউ কেউ বলেন যে ‘বির' এর অর্থ হচ্ছে হুজুর পাক (ﷺ) এর চিন্তা ফিকির এবং শরীয়ত অন্বেষণের জন্য অস্থিরতার বোঝা। এই ভারত ও বোঝা তার উপর ছিলাম। অবশেষে আল্লাহ তায়ালার শরীয়ত তার কাছে প্রকাশিত হলাে এবং হকতায়ালা শরীয়ত বর্ণনা করে দিলেন। তার পবিত্র পিঠ থেকে সে বােঝা এভাবে আল্লাহপাক সরিয়ে নিলেন।


(৫) কেউ কেউ বলেন যে, এতে উদ্দেশ্য হচ্ছে, শরীয়তের আদেশ সমূহকে সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে আসামি ও সহজসাধ্যতা প্রদান করা, যা হুজুর পাক (ﷺ) থেকে কামনা করা হয়েছিল। আর হেফজ বা স্মৃতিতেbসংরক্ষণ করাটা একটা বােঝা তুল্য এবং কঠিন কাজ। যা বহন করাটা স্বভাবতই কঠিন। এমনকি তা পৃষ্ঠকে ভেঙে ফেলার মতো কষ্টসাধ্য।


(৬) কেউ কেউ মনে করেন, হুজুর পাক (ﷺ) এর নবুওয়াতের পর যে কার্যাবলীকে হারাম করে দেয়া হয়েছিল, ঐগুলিকে তিনি নবুয়তের পূর্বেbবোঝা তুল্য অনুভব করেন এবং অন্তর থেকে সেগুলো অত্যন্ত কঠিন মনে করতেন। নবুওয়াতের পর হক তায়ালা সেগুলো বোঝা তার উপর থেকে সরিয়ে দিলেন। এমন ছােট ছােট কাজ যা নবুওয়াতের পূর্বে ঐ কামের কাছে বৈধ বলে পরিগণিত হতো, কিন্তু নবুওয়াতের পর তার বৈধতাকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি বরং সেগুলিকে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বােঝা সরিয়ে দেয়ার অর্থ, ঐ সমস্ত কাজ।


(৭) একদল আলেম এই মতের দিকে গিয়েছেন এবং তাদের এই মতটা কতইনা চমৎকার যে, বােঝা মানে উম্মতের গােনাহের বােঝা যা রসূলে পাক (ﷺ) এর পবিত্র হৃদয়ে বােঝাতুল্য ছিলাে। সুতরাং উক্ত বােঝা সরিয়ে দেয়ার মানে হচ্ছে আল্লাহতায়ালা তাদের গােনাহের কারণে এ পৃথিবীতে তাদেরকে আযাব ও গযব থেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ করে দিলেন। এমর্মেbযেমন আল্লাহ তায়ালা ঘােষণা দিলেন, আল্লাহ তায়ালা এমন নন যে, আপনি উম্মতের মধ্যে অবস্থান করছেন এমতাবস্থায় তিনি তাদেরকে আযাব প্রদান করবেন।এটাতাে হচ্ছে দুনিয়াতে তাদেরকে আযাব না দেয়ার সম্পর্কে ঘােষণা। আর আখেরাতে তাদের ব্যাপারে শাফাআত কবুল করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা করেছেন। যেমন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, অচিরেই আপনার প্রভু আপনাকে এতাে বেশী প্রদান করবেন যে, আপনি তখন খুশি হয়ে যাবেন।'—আল্লাহতায়ালা আরও এরশাদ ফরমান ‘আপনার কারণে আল্লাহ তায়ালা (উম্মতের) পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহ মাফ করে দেবেন। উপরােক্ত মতটির সপক্ষে উত্তম ও প্রসিদ্ধ প্রমাণ হচ্ছে এই আয়াতে কারীমা। অবশ্য এই উলামায়ে কেরাম এর আরও বিভিন্ন রকম ভাবার্থ উপস্থাপন করে থাকেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে এই অধ্যায়ের আয়াতে কুরআনে ও হাদীসের আলোকে রাসূল (ﷺ) এর মর্যাদা নামক অনুচ্ছেদে।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 


© | সেনানী এপ্স |

Top