লজ্জাশীলতা সম্পর্কে মাশায়েখগণের মাযহাব
হায়া বা লজ্জাশীলতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সম্পর্কে তরীকতের মাশায়েখ গণের কিছু বক্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য। হযরত যুনুন মিসরী কুদ্দিসা সিররুহু বলেন, তুমি যা কিছুই হকতায়ালা শানুহর কাছে প্রেরণ করে তাতে যেন অন্তরে ভয়াবহতার সাথে ভীতিপ্রদ অবস্থার আবির্ভাব ঘটে সেই অবস্থার নামই হায়া। তিনি আরও বলেন, আলহুব্বু ইয়ানতিকু ওয়াল হায়াউইয়াসকুতু ওয়াল খণওফু ইয়াকলুক অর্থাৎ প্রেম প্রেমিককে বাকশাল বানিয়ে দেয়। হায়া মানুষকে মহব্বত করে। আর ভয় ভীতি মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।
হযরত ইয়াহইয়া ইবন মু'আয রাযী (رحمة الله) বলেন, যে ব্যক্তি ইবাদতের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালাকে লজ্জা করে, আল্লাহ তায়ালা সে বান্দার গুনাহ প্রতি লজ্জা করেন। হায়া বা লজ্জাশীলতা সম্মান ও ভয় উভয়ের মিশ্রিত অবস্থায় আত্মপ্রকাশ করে। যেমন হুজুর আকরম (ﷺ) ঐ দলের প্রতি লজ্জা করলেন, যারা হযরত জয়নব (رضي الله عنه) এর বিয়ের ওলীমা উপস্থিত হয়েছিলেন। তারা উক্ত অনুষ্ঠানে দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু হুজুর পাক (ﷺ) লজ্জা করছিলেন এই ভেবে যে, তাদের কেমন করে উঠিয়ে দেবে। ঐ অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাযিল করে তাদেরকে স্থান ত্যাগ করার জন্য হুকুম দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা এই মর্মে এরশাদ করলেন, আহার সম্পন্ন হয়ে গেছে। সুতরাং তােমরা বেরিয়ে পড়ো।
আল্লাহতায়ালা আরও ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই তোমাদের দীর্ঘক্ষণ এভাবে বসে থাকা নবী (ﷺ) এর কষ্টের কারণ। অথচ নবী (ﷺ) লজ্জা করছেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সত্য প্রকাশ করতে কোনােরূপ লজ্জা করেন না। লজ্জা কখনও বন্দেগীর ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে। মাবুদের মহত্ব ও পূর্ণতার উপযোগী বন্দেগী না হওয়ার কারণে বান্দা তার প্রতিপালকের প্রতি লজ্জা করে থাকে।
আরেক প্রকারের লজ্জা আছে যা বান্দা নিজের প্রতি আরােপ করে থাকে (অর্থাৎ নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হয়)। এ ধরনের লজ্জা সম্মানিত এবং বুজুর্গ লোকদের মধ্যে প্রকাশিত হয়। এটা উপযুক্ত মর্তবা চেয়ে কম মর্তবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সম্ভুষ্ট হওয়ার মধ্যে নিহিত। কাজেই নিজেকে নিজের কাছে লজ্জাশীল বানানো উচিত। লজ্জার এ প্রকার গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, মানুষের মধ্যে দু'টি ভিন্ন ভিন্ন সত্তা বিদ্যমান। তার মধ্যে একটি নিন্দনীয় কাজ করলে অপরটি তার প্রতি লজ্জিত হয়। লজ্জার বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে এ প্রকারটি সবচেয়ে পূর্ণ এবং উন্নতমানের। মানুষ যখন স্বীয় সত্তার প্রতি লজ্জাশীল হয়ে যাবে, তখন অপরের প্রতি তাে আরও বেশী লজ্জাশীল হবে। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া গ্রন্থে এরকম উল্লেখ করা হয়েছে।
হুজুর আকরম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, লজ্জা মানুষকে কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছুই দান করে। অন্য এক বর্ণনায় আছে, লজ্জাশীলতা সর্বতঃরূপে কল্যাণ। হাদীছ শরীফে একটি ঘটনা এসেছে। এক ব্যক্তি তার ভাইকে সংকোচ না করার জন্য নসীহত করেছিলাম। ভাইটি লজ্জাশীলতার কারণে মানুষের কাছ থেকে প্রাপ্য চেয়ে নিতেও লজ্জা করতাে। এ পরিপ্রেক্ষিতে লােকটি তার ভাইকে উপদেশ দিতাে যে,হক আদায় করার ব্যাপারে লজ্জা করা উচিত নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে হুজুর পাক (ﷺ) লােকটিকে বলেছিলেন, তাকে ছেড়ে দাও, কেননা লজ্জাশীলতা ইমানের অঙ্গ।
মানুষের দোষ গােপন করা এবং এমন কাজ যা মানুষ নিজের জন্য পছন্দ করে না, তা কারো মধ্যে দৃষ্টিগোচর হলে সে ব্যাপারে গােপনীয়তা বজায় রাখা লজ্জাশীলতার নিদর্শন। হুজুর পাক (ﷺ) এ ব্যাপারে সর্বাধিক অগ্রণী ছিলেন।
এক বর্ণনায় হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে সংকলিত আছে—এক ব্যক্তি হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে এলে। তার চেহারার উপর হলুদ রঙের ন্যায় জাফরান লেপন করা ছিল। তা কোন মেয়েলোকের কাছ থেকে লেগে থাকবে হয়তাে। লােকটি লজ্জা পাবে ভেবে হুজুর পাক (ﷺ) তাকে কিছুই বললেন না। কেননা, হুজুর পাক (ﷺ) এর সম্মানিত স্বভাব এরকম ছিলাে যে, অপছন্দনীয় কিছু দেখলেও সে সম্পর্কে তিনি মুখের উপর কাউকে কিছু বলে দিলেন না। কাউকে কিছু বলা যদি নেহায়েত প্রয়োজন পড়ে এবং এ ব্যাপারে যদি তিনি বাধ্য হয়ে যেতেন, তখন ইশারা ইঙ্গিতে তাকে বুঝানাের চেষ্টা করতেন। লােকটি যখন হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছ থেকে বাইরে গেলে, তখন তিনি একজনকে বললেন, তাঁকে যেয়ে বলে চেহারার উপর থেকে যেনাে হলুদ রংগুলি ধুয়ে ফেলে। অন্য এক বিবরণে আছে, রাসূল (ﷺ) বলেছিলেন, "তাকে বলে দাও যে তার দেহ থেকে যেনাে কাপড় খুলে ফেলে। (সম্ভবতঃ কাপড়ে হলুদ রঙ মিশ্রিত হয়েছিলাে)। এঘটনায় একটি বিষয় পরিষ্কার থাকা উচিত যে, হুজুর পাক (ﷺ) এর উক্ত কথায় হলুদ রঙ বর্জন করা ওয়াজিব এবং উহা ব্যবহার করা হারাম - এ পরিপ্রেক্ষিতে ছিলাে না। (এক্ষেত্রে উৎকৃষ্টতা বর্জনের ইঙ্গিত ছিলাে)। যেহেতু হলুদ বর্ণ ব্যবহারের বৈধতা সম্পর্কে বিভিন্ন বিবরণ পাওয়া যায়।
হুজুর পাক (ﷺ) এর পবিত্র লজ্জাশােভিত অবস্থা এরকম ছিলাে যে, তিনি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে কারো চেহারার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না। যদি এমন কিছু দৃষ্টিগােচর হতাে যা তার পছন্দনীয় নয়, তখন এমন কথা বলতেন না যে, অমুক ব্যক্তি এমন বলে, বা এমন করে। বরং বলতেন, এ সম্প্রদায়ের কি অবস্থা হবে, যারা এমন কাজ করে বা এমন কথা বলে এবং এমনিভাবে বিরুদ্ধাচরণ করে। যারা করে বা যারা বলে বিশেষ করে তিনি তাদের নাম উচ্চারণ করেন না। তার সম্মানিত অভ্যাসে এজাতীয় উক্তি ছিল তার বক্তব্যের মূলনীতি স্বরূপ। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) থেকে সহীহ, হাদীস বর্ণিত আছে, হুযুর আকরাম (ﷺ) অশ্লীলভাষী ছিলেন না। তিনি কাউকে মন্দও বলতেন না। উচ্চস্বরে কোনাে কথাও বলতেন না। হাটে বাজারে যেয়ে কোনাে শােরগােলও করতেন না। মন্দ কাজের বদলা মন্দ দিয়ে শােধ করতেন না। বরং ক্ষমা ও বাৎসল্যই তার কাজের নীতি। তাওরাত কিতাবে হুজুর আকরাম (ﷺ) এর এরকম গুণাবলী সম্পর্কে সংবাদ প্রদান করেছে। এর সমর্থনে তাওরাত থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (رضي الله عنه) ও হজরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস (رضي الله عنه)।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী]
© | সেনানী এপ্স |