স্নেহ, দয়া ও মেহেরবানী
হুজুর আকরাম (ﷺ) এর স্নেহ, দুয়া ও মেহেরবানী সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, আমি আপনাকে সমস্ত আলমের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি। আল্লাহতায়ালা আরও এরশাদ করেছেন, তোমাদের স্বজাতি থেকে তোমাদের জন্য এমন একজন রসূল আগমন করেছেন, তোমরা কষ্টে পতিত হয়ে যাবে এই চিন্তা তার কাছে অসহনীয়, তিনি তোমাদের কল্যাণের জন্য অত্যধিক আগ্রহী। মুমিনদের ব্যাপারে স্নেহশীল ও মেহেরবান ছিলেন।
شفقت
মেহেরবানিকে বলা হয়। হুজুর আকরাম (ﷺ) শফীক অর্থাৎ মেহেরবানীকারী বা দয়া প্রবন ছিলেন। 'এশফাক' শব্দের আভিধানিক অর্থ ভয় প্রদর্শন করা। শফকত শব্দেও এ অর্থ পাওয়া যায়। কেননা ‘মুশফিক ভয় করে থাকে, ক্ষতিকর কোন কিছু তাকে স্পর্শ করে না। কাজেই হুজুর আকরাম (ﷺ) এর প্রশংসায় শরীক বা মুশফিক শব্দ প্রয়ােগ না করে حريص 'হারীস' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেহেতু তিনি মানুষের সংশােধন ও পরিশুদ্ধি আসুক, এ ব্যাপারে লােভাতুর থাকতেন এবং সেজন্য মানুষকে উপদেশ প্রদান করতেন। نصوح 'নুসুহ' ও رافات 'রা'ফাত' অত্যধিক দয়া প্রবণতাকে বলা হয়। 'সাররাহ' নামক কিতাবে রহমত শব্দের অর্থ করা হয়েছে দান করা, দয়া করা আর ‘রাফাত' শব্দের অর্থ করা হয়েছে অত্যধিক দান ও মেহেরবানী করা।
হুজুর আকরাম (ﷺ) উম্মতের ব্যাপারে শরীয়ত ও তার বিধি বিধানর সহজসাধ্যতা ও লঘুত্বের দিকে লক্ষ্য রাখতে। কোন কোন আমল হুজুর আকরম (ﷺ) ইচ্ছা করেই মাঝে মধ্যে পরিহার করতেন, যাতে উক্ত আমল উম্মতের উপর ফরজ না হয়ে যায়। যেমন প্রত্যেক নামাজের পূর্বে মেসওয়াক করা, এশার নামাজের রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত দেরী কর, সওমে বেসাল (অনবরত রোজা রাখা) বা এজাতীয় আরও বিধান আছে যা তিনি ইচ্ছা করেই মাঝে মধ্যে পরিহার করতেন। হুজুর আকরম (ﷺ) আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করতেন, মানুষ যে তাকে গালি দেয়, লানত করে এগুলো যেন আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য রহমত, নৈকট্য ও কুফুরি থেকে পবিত্র হয়ে যাওয়ার ওসীলা বানিয়ে দেন। হুজুর আকরম (ﷺ) এর সম্মানিত স্বভাব এরকম ছিলাে যে, তিনি যখন জামাতে নামাজ আদায় করেন আর সে জামাতে যদি কোন শিশু সন্তানের মা হাজির থাকতাে, তবে শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলে তিনি নামাজ সংক্ষিপ্ত ভাবে শেষ করতেন। যাতে সন্তানের মা শিশুর কান্নার আওয়াযে উদ্বিগ্ন না হয়ে পড়ে। হুজুর পাক (ﷺ) মাঝে মাঝে এরকম বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন এমন কথা আমার কাছে না পৌছায় যা আমি পছন্দ করিনা। কেননা, আমি কামনা করি, আমার সীনা পাক সাফ থাকলে (সম্ভবতঃ উম্মতের দুঃখ কষ্টের কথা শুনতে তিনি পছন্দ করতেন না, তাতে তার অন্তঃকরণে আঘাত লাগে। তাই তিনি এরকম বলতেন)।
কুরাইশ বংশের লােকেরা হুজুর পাক (ﷺ) কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে লাগলে এবং সীমাহীন দুঃখ কষ্ট প্রদান করতে লাগলাে। এমতাবস্থায় হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) হাযির হয়ে বললেন, পাহাড় নিয়ন্ত্রণের দ্বায়িত্বে যে সমস্ত ফেরেশতা নিয়োজিত আছেন। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে হুকুম দিয়েছেন, মুহাম্মদ (ﷺ) যা হুকুম করেন, তা তোমরা বাস্তবায়িত করে।' তখন পাহাড়ের ফেরেশতাগণ বললেন, “হে মুহাম্মাদ (ﷺ), আপনি যা চান। আমাদেরকে আদেশ করুন। আপনি যদি চান তাহলে ‘আখবাশাইন' নামক পাহাড় দুটি এনে এদের উপর ফেলে দিয়ে এই এলাকাকে উলটপালট করে দেই।' আখবাশাইন মক্কা মুকাররমার দুটি পাহাড়ের নাম। এই দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে লোকালয় অবস্থিত।
হুজুর আকরাম (ﷺ) বললেন, না। আমি এটা চাই না যে, এরা ধ্বংস হয়ে যাক। আমি এ প্রত্যয় পােষণ করি, হয়তো ওদের বংশধর এর ভিতর থেকে এমন লোক বেরিয়ে আসবে, যারা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করলে। আল্লাহ তাআলার সঙ্গে শরীক করে না। এটা এক সুদীর্ঘ ঘটনার বর্ণনা পরবর্তীতে যথাস্থানে আসবে ইনশাআল্লাহ।
অন্য এক বর্ণনায় উল্লেখ আছে, হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) নবী করীম (ﷺ) এর কাছে আরয করলেন, আল্লাহতায়ালা আসমান যমীন ও পাহাড় পর্বতকে হুকুম প্রদান করেছেন, তারা যেনাে আপনার আনুগত্য করে, আপনি যা হুকুম করেন তারা তাই বাস্তবায়িত করে এবং আপনার দুশমনদেরকে যেনাে ধ্বংস করে দেয়। হুজুর পাক (ﷺ) বললেন, আমি ধৈর্য ধারণ করা পছন্দ করি। আর আমার উম্মতের উপর আযাব প্রদানে যেনাে বিলম্ব করা হয়, এটাই কামনা করি। হতে পারে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে হয়তো মাফ করে দিবেন। তওবা করার সুযোগ দিয়ে তাদের উপর রহমত নাযিল করবেন। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বলেন, আল্লাহতায়ালার তরফ থেকে যখনই হুজুর পাক (ﷺ) কে দু'টি পন্থা থেকে যে কোনাে একটি গ্রহণ করার জন্য স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, তখনই হুজুর (ﷺ) তার মধ্যে সহজতম পন্থা গ্রহণ করেছেন। অবশ্য এ কথার তাৎপর্য ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। তবে সুস্পষ্ট ও নিকটতর ব্যাখ্যা এই যে, হুজুর পাক (ﷺ) সহজতর আমলটি গ্রহণ করতেন উম্মতের জন্য। নিজের জন্য নয়। হযরত ইবন মাসউদ (رضي الله عنه) বলেন, হুজুর আকরম (ﷺ) ওয়ায, নসীহত ও উপদেশ প্রদানকালে আমাদের মনমেজাজের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। এর অর্থ এই যে, তিনি কখনও কখনও ওয়াজ নসীহতের কথা শুনাতেন। সর্বদাই করতেন না যাতে শ্রোতাদের মন বিগড়ে যায়।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী]
© | সেনানী এপ্স |