পবিত্র বাহুদ্বয়
হুজুর আকরম (ﷺ) এর হস্ত মুবারকের বর্ণনায় শামায়েলে তিরমিযীতে এসেছে, পাঞ্জাদ্বয় লম্বা ছিল। زند 'জানদুন' যা বর্ণে যবর ও নূনে ছাকিন দিয়ে তার অর্থ হচ্ছে পাঞ্জা। আবার অভিধানে এর অর্থ করা হয়েছে এরকম -
الزند هوموصل الزراع والكف وهما زندان
‘আযযান্দুহুয়া মুসিলযযেরায়ে ওয়াল কাফফে ওয়াহুমা যান্দানে'। অর্থাৎ زند 'যান্দ’ হচ্ছে কবজি ও হাতের মিলনস্থল। এর দ্বিবচন হচ্ছে যান্দানে। হাতের পাঞ্জার দৈর্ঘ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয় নাই, যদিও তাঁর পাঞ্জা মুবারক লম্বা ছিলাে। এটা সম্ভব। অপর এক বর্ণনায় এসেছে - عبل الزراعين 'আবলুযযেরা দাইনে'। অন্য বর্ণনায় এসেছে عبل العضدين 'আবলুল আয দাইনে। এ দুটি বর্ণনারই অর্থ হচ্ছে তাঁর বাহু ও কব্জি মুবারক মােটা ছিলাে। সাররাহ নামক পুস্তকে 'যারায়ে' এর অর্থ করা হয়েছে হাতের তালু মাংশল ছিলাে। এক বিবরণে এসেছে, হাতের তালু প্রশস্ত ছিলাে। এ সকল বর্ণনার সারকথা হচ্ছে, হুজুর পাক (ﷺ) এর হস্ত মুবারক ভরপুর ও পূর্ণাঙ্গ ছিল - সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত ছিলো। আর এটি 'রাজবুররাহাত এর বর্ণনার অনুকূল। সাররাহ নামক পুস্তকে 'বিসতুন' শব্দের বা বর্ণে যের যোগে অর্থ হচ্ছে হাতের প্রশস্ততা। এক বর্ণনায় এসেছে, بشط 'বাসতুন এর পরিবর্তে সীন বর্ণকে আগে নিয়ে سبط الكفين 'সাবতুল কাফফাইনে'। তার অর্থ হচ্ছে হাতের তালু নরােম ছিলাে। এই সাবতুন শব্দটি আবার হুজুর পাক (ﷺ) এর চুলের বর্ণনায় ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ ছিলাে ঝুলন্ত নরােম চুল। যা جعد'যাআদ' রুক্ষ চুল এর বিপরীত। ঐ অর্থ হিসাবেই এখানে সাবতুল কাফফাইন (হাতের তালু নরােম)' ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন সুন্দর ও সামঞ্জস্যশীল দৈহিক গঠনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় মসৃণ ও সুন্দর শরীর। অভিধান গ্রন্থে سبط 'সাবতুন' শব্দের অর্থ করা হয়েছে প্রশস্ত। যেমন বলা হয় প্রশস্ত হাতবিশিষ্ট লােক, অর্থাৎ দানশীল। কেননা দানশীল ব্যক্তি প্রশস্ত হাতের অধিকারীই হয়ে থাকে ।এখানে রুক্ষতা ও কাঠিন্যের সমন্বয় কেমন করে হতে পারে? হ, কোমলতা ও স্থূলতার সাথে সমন্বয় ঘটতে পারে। যেমন, তার সমস্ত দেহ মুবারক নরােম, কোমল, মসৃণ, মাংশল ও সুদৃঢ় ছিলাে। ঠিক তেমনিই হাতের তালু মুবারকও নরােম ও মাংশল ছিলাে।
অবশ্য কোনাে কোনাে হজরত এরকম বলে থাকেন, হুজুর পাক (ﷺ) এর হস্ত মুবারকের নরম বা শক্ত হওয়ার বর্ণনার সময় ও অবস্থার উপর নির্ভরশীল ছিলাে। সুতরাং তিনি স্বীয় গৃহে বা যুদ্ধক্ষেত্রে যখন হাতে অস্ত্র তুলে নিবেন, বা কোন কাজ কর্মে নিয়োজিত হতেন তখন হাত শক্ত হয়ে যেতাে। আবার যখন তা ছেড়ে দিতেন তখন পূর্বের ন্যায় হাতে মৌলিক কোমলতা ও স্বাভাবিক তা ফিরে আসতে।
কথিত আছে, আসমানী— যিনি আরবী ভাষায় ইমাম ছিলেন, তিনি যখন হুজুর পাক (ﷺ) এর হস্ত মুবারকের سبط الكفين 'সাবতুল কাফফাইন' এর ব্যাখ্যা করলেন ششن الكفين 'শাশনুন কাফ্ফাইন' অর্থাৎ হাত শক্ত ছিলাে। তখন তাকে বলা হলাে, হুজুর পাক (ﷺ) এর হস্ত মুবারক তাে নরম ও মোলায়েম ছিল বলে বর্ণনা এসেছে— আপনি তাকে কঠিন ও রুক্ষ বলে ব্যাখ্যা করলেন কেমন করে? একথা শুনে তিনি অঙ্গীকার করলেন, পরিপূর্ণ সাবধানতা ও সতর্কতা ব্যতীত তিনি আর হাদীছের ব্যাখ্যা করবেন না। আমাকে একজন পূর্ণ নিষ্ঠাবান ব্যক্তি ছিলেন। রসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে তিনি পরিপূর্ণ আদব ও ন্যায়নিষ্ঠতার প্রতি খেয়াল রাখবেন। একদা লোকেরা তাকে আমার অন্তরে কোনো কোনাে সময় পর্দা পড়ে' এই হাদীছের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করলেন। লােকেরা প্রশ্ন করলেন, পর্দা পড়া কি? এর হাকীকত কি? তিনি জবাব দিলেন, তোমরা যদি হুজুর আকরাম (ﷺ) এর মহা পবিত্র কলবের পর্দা সম্পর্কে প্রশ্ন না করে অন্য কারও কলবের পর্দা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে, তা হলে আমি বলতে পারতাম। এ মুহূর্তে আমার যা এলেম আছে, তা প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এর হাকিকত আল্লামাহুল গুয়ুব ছাড়া কারো জানা নেই।
হজরত আবু উবায়দা (رضي الله عنه) যে ব্যাখ্যা করেছেন তা নির্ভুল নয়। তিনি তার ব্যাখ্যা স্থূলতা ও সংকীর্ণতার সঙ্গে করেছেন।
শেফা গ্রন্থের প্রণেতা কাজী আয়াজ (رحمة الله) বলেন, উক্ত ব্যাখ্যাটি পুরুষদের জন্য প্রশংসনীয় বটে। তবে নারীদের জন্য নয়। হাতের কঠোরতা বা রুক্ষতা পুরুষ শ্রেণীর বেলায় প্রযোজ্য। কিন্তু নারীদের বেলায় এরূপ নয়। আর সে রুক্ষতা শব্দ নিয়ে হুজুর পাক (ﷺ) এর হাতের বর্ণনা দেওয়া সমীচীন হতে পারে না। তাই তাকে তিনি খন্ডন করেছেন। একথাটি ‘সায়েলুল আতরাফ (আঙ্গুলের অগ্রভাগ লম্বা) বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্যশীল হয়। অর্থ হচ্ছে হুজুর পাক (ﷺ) এর হাতের আঙ্গুলসমূহ লম্বা ও প্রবহমান ছিলাে। শেফা গ্রন্থে এসেছে, আঙ্গুলসমূহ লম্বা ছিলাে। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, شال الاطراف ‘শায়েল আতরাফ’ শীন বর্ণ যােগে। এটি شول 'শাউল' শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ হচ্ছে পাথর টানা, যমীন থেকে বোঝা উঠানো এবং উষ্ট্রীর ক্ষমতা অনুসারে বহন করা ইত্যাদি। আবার আরেক বর্ণনায় এসেছে, شين الطراف শায়েনুল আতরাফ লাম বর্ণকে নূর দ্বারা পরিবর্তন করে। যেমন জিবরীলকে জিবরীন পড়া। এই বর্ণনাটি প্রদান করেছেন ইবনুল আরী। আঙ্গুল সম্পর্কে এরূপ বিশেষণ প্রয়ােগ করা আঙ্গুলের খর্বতার পরিপন্থী। ششن 'শাশনুন' এর অর্থ পুরু ও মাংশল যার মধ্যে খর্বতা ও কাঠিন্য নেই। যদিও অভিধান গ্রন্থের মাধ্যমে এর অর্থ রুক্ষতা বা কাঠিন্য পাওয়া যায়। তার হস্ত মুবারকের গুণাবলী, নিদর্শন, বরকত ও মােজেজা সমূহের আধিক্য বর্ণনা করা লিখনীর ক্ষমতা বহির্ভূত। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে, একদা হুজুর পাক (ﷺ) হযরত জাবির ইবনে সামুরাহ (رضي الله عنه) এর গণ্ডদেশে তার পবিত্র হস্ত সঞ্চালন করলেন। তিনি তাঁর পবিত্র হস্ত মুবারক থেকে এমন শীতলতা ও সুবাস অনুভব করলেন যেননা হুজুর এই মাত্র আতর বিক্রেতার কৌটা থেকে তার হাত মুবারক বের করে এনেছেন। বায়হাকী ও তাবরানী শরীফে হজরত ওয়ায়েল ইবন হাজর (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করা হয়েছে, আমি যখনই হুজুর আকরাম (ﷺ) এর সাথে মুসাফাহা করি তখন তার হস্ত মুবারক স্পর্শ করার কারণে আমার হাত এতে সুরভিত হয়ে যেতে যে, সমস্ত দিন ভর আমার হাত থেকে ঘ্রাণ নিতে থাকতাম। হাত থেকে মেশক আম্বরের চেয়ে অধিক ঘ্রাণ বের হতাে।
হযরত ইয়াজিদ ইবনে আসওয়াদ বর্ণনা করেন, একদা হুজুর পাক (ﷺ) স্বীয় হস্তের মোবারক আমার হাতের মধ্যে রাখেন। তখন আমি তার হাতকে বরফের চেয়ে অধিক শীতল ও মেশকের চেয়ে অধিক সুবাসিত পেলাম। হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, একদা আমার অসুস্থতায় হুজুর পাক (ﷺ) আমাকে দেখতে এলেন। তিনি স্বীয় হাতখানা আমার কপালের উপর রাখলেন। এরপর আমার চেহারা, বক্ষ ও পেটের উপর স্বীয় পবিত্র হাতখানা বুলিয়ে দিলেন। এতে আমার অনুভব হলাে, এখন পর্যন্ত তার হাতের শীতলতা আমার কলিজা পর্যন্ত বিরাজ করছে। কাজেই হুজুর আকরম (ﷺ) এর পবিত্র দেহে যে সুগন্ধি ছিলাে, তা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তাঁর ঘাম ও পেশাব মুবারকের খােশবু সম্পর্কে বর্ণনা সামনে করা হবে।
এখন আসা যাক হুজুর পাক (ﷺ) এর হস্ত মুবাকের শীতলতা অনুভব কথার মর্মার্থ কি—এ প্রসঙ্গে। তার শরীর মোবারক তা স্বাস্থ্যসম্মত উষ্ণ ও ভারসাম্য সময় ছিলে। তাহলে উক্ত শীতলতা মানে কি? উক্ত শীতলতা থেকে ঐ শীতলতা উদ্দেশ্য নয় যা মেজাজ ও তবিয়তে শীতলতা কারণে হয়ে থাকে। যাতে দেহ থেকে শীতল ঘর্ম নির্গত হয় এবং তাকে স্পর্শ করতে মানুষ অপছন্দ করে থাকে। বরং উক্ত শীতলতার অর্থ হচ্ছে মেজাজের ভারসাম্যতা এবং তীব্র উত্তাপ দেহের মধ্যে বিরাজ না করা। কেননা তার হস্ত মুবারক স্পর্শ করাতে এক প্রকার আস্বাদ ও প্রশান্তি অর্জিত হতাে। যেমন হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস ও অন্যান্য হাদীছ দ্বারা জানা গেছে। (অতএব বুঝে নাও এবং সঠিক বুঝের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে তাওফীক চাও)।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী]
© | সেনানী এপ্স |