স্বপ্নদোষ থেকে নিরাপদ থাকা
হুজুর আকরাম (ﷺ) এহতেশাম বা স্বপ্নদোষ থেকে নিরাপদ ছিলেন। সাইয়্যিদুনা হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে যে, কোনো নবীর কখনো স্বপ্নদোষ হয় না। কেননা স্বপ্নদোষ শয়তানের আছর থেকে হয়ে থাকে। হাদীস খানা তিবরানী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হুজুর আকরম (ﷺ) রমজান মাসে ফজরের সময় (অর্থাৎ সুবহে সাদিকের পূর্বে) এহতেলাম ব্যতীত জুনুবী হবেন। (স্ত্রী সহবাসের পর গোসল ওয়াজিব হলে সেই ব্যক্তি কে জুনুবী বলা হয়)। অতঃপর তিনি গোসল করে রোজা রাখতেন। হাদীস শরীফে 'এহতেলাম ব্যতীত কথাটির উল্লেখ থেকে এমন একটি ধারণা সৃষ্টি হয় যে, হুজুর পাক (ﷺ) এর শানে এহতেশাম হওয়ার সম্পর্ক লাগানাে ‘বৈধ'। অর্থাৎ তার দ্বারা হওয়া সম্ভব। নয়তাে এস্তেসনা করার অর্থ কি? এর উত্তর হচ্ছে এই যে, এস্তেসনার ভিত্তিটা জায়েয না হওয়ার উপর। আর যে কয়েদ' করা হয়েছে এটি হচ্ছে কয়েদে এত্তেফাকী'। অর্থাৎ এতেহলাম হওয়াটা সম্ভব এটা বুঝাচ্ছে। আর বর্ণনাটি হচ্ছে বাস্তবতার নিরিখে। অর্থাৎ হুজুর আকরাম (ﷺ) এর গােসল ছিল সহবাসের কারণে। এহতেলামের কারণে নয়। কেননা এহতেলাম তাই তার শানে প্রযোজ্য নয়। উপরােক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা যদি এরূপ না হয়, তবে তাে হাদীসের মমার্থ দাঁড়ায় এরকম, এহতেলাম এর সাথে যদি সহবাস জনিত জানাবাত হয় তবে গোসল ফরজ হবে না। বস্তুতঃ এটি হচ্ছে একটি ভ্রান্ত ধারণা। আল্লামা কুরতুবী (رحمة الله) বলেন, বিশুদ্ধ কথা এইযে, এহতেলাম হওয়া তাঁর সম্মানে বৈধই নয়। যেহেতু স্বপ্নদোষ হলাে শয়তানের কাজ। হুজুর আনওয়ার (ﷺ) তা থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিলেন। রোজা সংক্রান্ত হাদীসে আছে যে, এহতেলাম ব্যতীত কথাটির উল্লেখ হয়েছে তার মর্মার্থ হচ্ছে স্বপ্নে কিছু দেখা ব্যতীত নির্গত হওয়া। (তাও তার দ্বারা সংঘটিত হয় নি)। কেননা স্বপ্নদোষ কালে যা দেখানো হয়, তা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। কাজী আয়াজ (رحمة الله) উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় এ কথা বলেন, হুজুর (ﷺ) যে গোসল করেছিলেন তা সহবাসের পর কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গের সমাপ্তি টানা হচ্ছে সুদীর্ঘ একটি হাদীছ দ্বারা, যা আহলে বিয়ের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। হাদীস খানা সাইয়্যিদুনা ইমাম হাসান (رضي الله عنه) ও সাইয়্যেদুনা ইমাম হুসায়ন (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন। এতে হুজুর আকরাম (ﷺ) এর হুলিয়া মোবারক, তার চরিত্র ও অভ্যাস সমূহের বর্ণনা রয়েছে।
ইমাম হাসান (رضي الله عنه) বলেন, আমি একদা আমার ফুফু হযরত হিন্দ বিনতে আবী হালাহ (رضي الله عنه) এর নিকট হুজুর আকরাম (ﷺ) এর হুলিয়া মুবারক সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। আর মনে মনে আমি এটাও কামনা করছিলাম যে, আমার সাথে যা সম্পৃক্ত সে সকল কথাগুলিও এই বর্ণনার মাধ্যমে এসে যাক। অর্থাৎ আমি মনে করলাম, হুজুর পাক (ﷺ) এর হুলিয়া মুবারকের আকৃতিগত মিল হয়তাে আমার মধ্যেও আছে। কেননা ইমাম হাসান (رضي الله عنه) এর আকৃতি হুজুর পাক (ﷺ) এর হুলিয়া মুবারকের সাথে এতাে বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ ছিলাে যে, তখন এমন একটি প্রচলন ছিলাে, কেউ যদি স্বপ্নযােগে হুজুর (ﷺ) কে দেখতাে তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হতাে, হুজুরকে কি রকম আকৃতিতে দেখেছেন। সে যদি বলে ইমাম হাসান (رضي الله عنه) এর মতাে, তখন বলা হতাে, সে ঠিকই দেখেছে। ইমাম হাসান (رضي الله عنه) এর প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দ বিনতে আবী হালা (رضي الله عنه) বললেন, হুজুর পাক (ﷺ) আযীম, বুযুর্গী ও শান শওকতময় দেহের অধিকারী ছিলেন। পূর্ণিমার চাঁদের কিরণের ন্যায় তার চেহারা মুবারক জ্যোতির্ময় ছিলাে। হযরত ইমাম হাসান (رضي الله عنه) বলেন, এরপর আমি আবার হিন্দ বিনতে আবী হালা (رضي الله عنه) কে বললাম, হুজুর পাক (ﷺ) এর কথা বলার ভঙ্গিমা কিরকম ছিলাে, কথা শেষে কিভাবে চুপ থাকতেন ও কীরকম বলিষ্ঠ ছিলাে? তাঁর বাক্যাবলী এ সম্পর্কে আমাকে বলুন। তিনি বললেন, হুজুর পাক (ﷺ) সর্বদাই ধ্যানমগ্ন এবং চিন্তাযুক্ত থাকতেন। বিনা প্রয়ােজনে কোনাে কথা বলতেন না। নীরবতা দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী থাকতাে। বাক্যের প্রকার ও সমাপ্তি মুখগহবরের কোণ থেকে হতাে। অর্থাৎ পরিপূর্ণ, সুস্পষ্ট ও বিশুদ্ধভাবে মুখের ভিতর থেকে শব্দ বের করে আনতেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ও অপূর্ণ কথা তিনি কখনও বলতেন না। তার বাক্যের বৈশিষ্ট্য ছিলাে জামেউল কালাম'। ভাবের গভীরতায় পরিপূর্ণ সংক্ষিপ্ত কথা। এমর্মে হাদীস শরীফে এরকম উক্ত হয়েছে, আমাকে জামেউল কালাম' প্রদান করা হয়েছে এবং বাক্যকে আমার জন্য সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। পরিচ্ছন্ন ও ঝরঝরে কথা বলতেন হযরত । তার কথার মধ্যে কোন কিছুর কমতিও থাকতাে না আবার অতিরিক্ত কিছু থাকতাে না। তিনি নরম স্বভাবের ও প্রফুল্ল মেজাজের ছিলেন। কর্কশ ও বদমেযাজী ছিলেন না। নেয়ামত সে যতাে অল্পই হােক না কেন তার সম্মান করতেন। কানে জিনিসের দোষ বর্ণনা করতেন না। খানা যে ধরনের হােকনা কেনাে গ্রহণ করতেন। কারও বা কোনাে কিছুর দোষ বর্ণনা করতেন না। মন্দ হলে তার প্রশংসাও করতেন না, যেমন চাটুকার লােকদের অভ্যাস। তার রাগত অবস্থার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেতােনা। যখন কেউ কোনাে অন্যায়ের ক্ষেত্রে সীমা লংঘন করে ফেলে তখন তিনি রাগান্বিত হতেন। কারও হক বা অধিকার সংক্রান্ত ব্যাপার হয়ে থাকলে তার বদলা তিনি নিয়েই ছাড়তেন। তবে তিনি নিজের হকের ব্যাপারে কখনও কারও প্রতি রাগ করতেন না এবং প্রতিশােধও গ্রহণ করতেন নাযদি সেটা দুনিয়াবী ব্যাপারে হয়ে থাকতাে। হুজুর পাক (ﷺ) কোনাে কিছুর প্রতি ইশারা করলে পুরা হাত দিয়েই করতেন। শুধুমাত্র হাতের আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতেন না। বিশ্ময় প্রকাশকালে হুজুর (ﷺ) স্বীয় হাত মুবারককে ঐ রকম আকৃতি করে বের করতেন, মানব সন্তান ভূমিষ্ঠকালে হাত যেরকম আকৃতির থাকে। কথাবার্তা বলার সময় ডান হাতের আঙ্গুল বাম হাতের তালুর উপর স্থাপন করতেন। হুজুর আকরম (ﷺ) এর এ সমুদয় অভ্যাসসমূহ আল্লাহ তাআলার নিকট বড়ই পছন্দনীয় ছিলাে। এ সমস্ত সম্মানিত স্বভাবগুলির ভিতরে নিঃসন্দেহে কোনাে না কোনাে সৃক্ষ্ম হেকমত নিহিত, যার ভেদ ও রহস্য সম্পর্কে অবহিত হতে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি অক্ষম হতে বাধ্য। আল্লাহপাকই ভাল জানেন।
তিনি যখন রাগান্বিত হতেন তখন চেহারা মুবারক ও পার্শ্ব সেদিক থেকে ফিরিয়ে নিতেন। আনন্দ ও উৎফুল্লতার সময় এবং যখন কোনাে কাম্য জিনিস পেয়ে যেতেন, তখন মুবারক চক্ষুদ্বয়কে বন্ধ করে দিতেন। অধিকাংশ সময় তিনি যখন হাসতেন তখন তাবাসসুম (মুচকি হাসতেন। মুচকি হাসির সময় হুজুর (ﷺ) এর স্বচ্ছ পরিষ্কার পবিত্র দস্তরাজি শ্বেতশুভ্র তুষারখন্ডের মতাে ঝকমক করতাে।
সাইয়্যেদুনা ইমাম হাসান (رضي الله عنه) বলেন, আমি উপরোক্ত হাদীস খানা হিন্দ বিনতি আবী হালা (رضي الله عنه) থেকে শােনার পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত তা আমার ভাই ইমাম হােসেন (رضي الله عنه) থেকে গােপন রাখি। পরবর্তীতে তা যখন আমার ভাইয়ের কাছে বর্ণনা করলাম, তখন বুঝতে পারলাম যে তিনি এ হাদীছ সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবহিত আছেন। শুধু তাই নয়, তিনি আমার পিতা সাইয়্যেদুনা আলী (কঃ) এর কাছে এই হাদিস সম্পর্কে বহুবার জিজ্ঞাসাবাদও করেছিলেন। হুজুর আকরম (ﷺ) এর গমনাগমন, আকৃতি প্রকৃতি উঠাবসা—সবকিছুই তিনি জেনে নিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে হজরত ইমাম হোসাইন বর্ণনা করেন, আমি আমার সম্মানিত পিতা আলী (رضي الله عنه) কে হুজুর আকরম (ﷺ) এর ঘরে প্রবেশ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম । বললাম, হুজুর আকরম (ﷺ) যখন ঘরে প্রবেশ করতেন, তখন তিনি কি করতেন? তিনি (হজরত আলী (رضي الله عنه) বললেন, হুজুর (ﷺ) যখন তাঁর পবিত্র গৃহাঙ্গনে প্রবেশ করতেন, তখন তাঁর সময়কে তিনটি ভাগে বিভক্ত করতেন। একভাগ আল্লাহর জন্য অর্থাৎ এক ভাগে ইবাদত করতেন। যদিও সর্বদা তিনি ইবাদতেই মশগুল থাকতেন। এখানে এ ইবাদতের অর্থ হচ্ছে বিশেষভাবে আল্লাহর ইবাদত করতেন। এই সময়ের মধ্যে পরিবার পরিজনের, নিজের এবং অন্য কারো হক অন্তর্ভূত থাকতাে না। দ্বিতীয় অংশ পরিবার পরিজনের জন্য রাখতেন। অর্থাৎ এসময় তাদের হক আদায় করতেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন, কোনাে অভাব অভিযােগ থাকলে তা পূরণ করতেন এবং তাদের সঙ্গে সহ অবস্থান করতেন। তাদেরকে সঙ্গ প্রদান করতেন। আর তৃতীয় অংশ নিজের জন্য রাখতেন। এ সময়ে তিনি নিজের পবিত্র শরীরের হক আদায় করতেন। অর্থাৎ বিশ্রাম গ্রহণ করতেন। নিদ্রা যেতেন বা এজাতীয় কাজ করতেন। অতঃপর এ অংশকেও দুভাগে ভাগ করতেন। একভাগ নিজের জন্য আরেকভাগ অন্যান্য মানুষের জন্য। এ অংশে তিনি অন্য লোকদের কে শরিক করে নিতেন। এ বন্টনের প্রকৃতি ছিল এরকম— হুজুর (ﷺ) তার খাছ খাছ সাহাবীগণকে সময় দিতেন। সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের কথা শুনতেন এবং তার বিধিব্যবস্থা করে দিবেন। খাছ খাছ সাহাবীগণকে তার মোবারক মজলিসের ফায়দা প্রদান। করতেন। যাতে তাদের মাধ্যমে অন্যরা উপকৃত হতে পারে। মোটকথা, প্রথমে একবার খাছ সাহাবীগণকে কোন মাধ্যম ব্যতিরেকে সরাসরি ফায়দা প্রদান করতেন। এরপর সাধারণ লােকদেরকে উপলক্ষ্য করে পুনর্বার তাদেরকে ফায়দা প্রদান করতেন। এহেন ফায়দা প্রদান ও নসীহত করার ক্ষেত্রে হুজুর (ﷺ) কৃপণতা বশতঃ ঐ সমস্ত লোকদের থেকে কিছুই অবশিষ্ট রেখে দিলেন না, অবারিত ধারায় ফায়দা প্রদান করে যেতেন। লোকদের অবস্থা ও যােগ্যতা অনুসারে তিনি তাদেরকে অনুগ্রহ প্রদান করতেন।
হুজুর আকরম (ﷺ) এর পূতপবিত্র জীবন ও মহিমান্বিত স্বভাবের মধ্যে যে সমস্ত মহান জন নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তাদের বেলায় এবং আলেম ফাযেল ও পরিশােধিত ও সােহবতধন্য ব্যক্তিবর্গের বেলায় হুজুর (ﷺ) এর গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করার অনুমতি ছিল। উপরােক্ত গুণের অধিকারীগণের বেলায় হুজুর (ﷺ) তাঁর পবিত্র মজলিশে যােগদান করার ব্যাপারে বিশেষত্ব প্রদান করতেন। তাদের সম্মান ও মর্যাদা অনুসারে দ্বীনী কাজে তাদেরকে দায়িত্ব প্রদান করতেন। মােটকথা এই, যে ব্যক্তি হুজুর (ﷺ) এর মজলিশে বা দ্বীনদারীতে যতাে বেশী বিশেষত্ব ও স্বাতন্ত্র অধিকারী হতেন, তিনি ঐ পরিমাণে হুজুর আকরাম (ﷺ) এর দান এবং অনুগ্রহ অধিকতর উপযোগী হতেন। তিনি মানুষের অভাব পূরণ করা ও আসহাবগণের উদ্দেশ্য অর্জিত হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন এবং তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, তোমাদের মধ্যে যারা এ পবিত্র মজলিসে উপস্থিত আছে তাদের উপর কর্তব্য যাঁরা উপস্থিত নেই তাদের কাছে আমার বাণী পৌছে দেয়া। তিনি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আরও বলতেন, যারা আমার দরবারে উপস্থিত হয়ে আপন আপন প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করতে পারে না, তাদের পক্ষ থেকে সে সমস্ত প্রয়োজনের কথা আমার কাছে পৌছিয়ে দাও। তা তোমাদের উপর ফরজ।
হুজুর আকরাম (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, প্রয়োজন পূরণ করতে পারে এমন ব্যক্তির কাছে যদি কেউ নিজের প্রয়ােজনের কথা ব্যক্ত করতে না পারে তখন অপর কেউ যদি অক্ষম ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার প্রয়ােজনের কথাটা পাঠিয়ে দেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ পাক সেই ব্যক্তিকে কদমের দৃঢ়তা দান করবে। উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, হুজুর আকরম (ﷺ) ব্যক্তিগত প্রয়ােজন পেশ করার কথা উল্লেখ করেননি। হুজুর আকরাম (ﷺ) এর দরবারে এমন হাজত পেশ করা হবে দ্বীন ও দুনিয়া উভয় দিক দিয়েই যার প্রয়ােজন রয়েছে। এছাড়া তাঁর পবিত্র মজলিশে অন্য কোনাে প্রসঙ্গে আলােচনা হতাে না। বিশেষ করে অনর্থক কথাবার্তা হতােনা। মানুষ তার দরবারের এলেম, খায়ের ও বরকত থেকে ফয়েজ প্রাপ্ত হয়ে অন্য লোকের কাছে যেতেন এবং তাদের পথ প্রদর্শনের কাজে নিয়োজিত হলেন।
সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম হোসেন (رضي الله عنه) তার ওয়ালিদ সাহেব হজরত আলী মর্তুজা (رضي الله عنه) এর কাছে হুজুর আকরাম (ﷺ) এর বাইরে তশরীফ নেয়া এবং সাহাবাগণের সঙ্গে উপবেশনের ধরন কি রকম ছিলাে, এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। হজরত আলী (رضي الله عنه) বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বীয় জিহ্বা মুবারককে বন্ধ রাখতেন এবং তার হেফাযত করতেন। তবে যে সমস্ত কথায় মানুষের উপকার হবে তা তিনি ব্যক্তি করতেন। يفزن এই শব্দটি خزن থেকে উৎপত্তি, যার অর্থ ভাণ্ডারে মাল সংরক্ষণ করা। এ কথাটি অই দিকই ইঙ্গিত করছে যে, হুজুর আকরম (ﷺ) এর পবিত্র হৃদয় যা হাকীকত ও মারেফতে পরিপূর্ণ ছিলাে, তাঁর কুঞ্জি ছিলাে তাঁর পবিত্র রসনা। উম্মতের জন্য যা উপকারী ও কল্যাণকর সে সমস্ত বিষয়ে তিনি জবান মুবারক খুলতেন। অন্যথায় মুখ বন্ধ রাখতেন। তিনি উম্মতের মনােরঞ্জন করতেন এবং নিজের সাহচর্য থেকে যাতে দূরে সরে যায় তা থেকে উম্মতকে ক্ষমা করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে এ মহৎ কাজটি আল্লাহ তায়ালার কাজ। যেমন আল্লাহপাক এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা এতই মেহেরবান যে, তিনি তােমাদের অন্তঃকরণে প্রেম ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তিনি দুর্বল ঈমানদার লোকদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহ করতেন। এ শ্রেণীর লােকদেরকে পবিত্র কুরআনের ভাষায় মুআল্লাফাতুল কুলুব' বলা হয়। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সম্মানিত ব্যক্তিকে তিনি সম্মান করতেন। এ জাতীয় লোক সেখানকার জনসাধারণের জন্য হাকিম বা সরদার হিসাবে নিয়ােজিত করতেন। এভাবে তাদেরকে সামনে রেখে হুজুর (ﷺ) জনসাধারণ থেকে কিছুটা পরােক্ষে থাকতেন। ইসলামের দুশমন যারা তাদের সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট হুঁশিয়ার থাকতেন এবং তাদের আচরণের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। মুসলমানদের যাতে কোনােরূপ ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য তিনি সদাসচেতন দৃষ্টি রাখতেন। এটা অবশ্য তিনি করতেন 'আল্লাহ তায়ালা আপনাকে মানুষ থেকে হেফাযত করবেন আয়াত খানা নাযিল হওয়ার পূর্বে। অথবা সতর্ক দৃষ্টি রাখার মধ্যে এলেম ও হেকমত রয়েছে। এতে উম্মতকে শিক্ষা দেয়াই উদ্দেশ্য।
সাধারণ লোকদের থেকে যে হুজুর (ﷺ) পরােক্ষে থাকতেন, তা প্রকৃতপ্রস্তাবে হুজুরের আত্মমর্যাদা ও শানশওকত প্রতিষ্ঠিত রাখার দিকে ইঙ্গিত বহন করে। যাতে করে তারা ভয়ভীতিহীন ও উন্নাসিক হতে না পারে। এই যে তিনি সতর্কতার সাথে চলতেন, মানুষের মেলামেশা থেকে নিজকে কিঞ্চিত দূরে রাখতেন, এ স্বত্বেও আত্মার প্রশস্ততা এবং সদাচরণের যে স্বভাবগত অভ্যাস তার ছিলাে, তা তিনি কখনও বর্জন করতেন না। তিনি স্বীয় সাহাবী বা সাথীগণকে তাদের হাল অবস্থা জিজ্ঞেস করতেন, তাদের মনকে খুশী রাখার জন্য চেষ্টা করতেন। মানুষদের কাছ থেকে পারস্পরিক হালঅবস্থা জেনে নিতেন, যাতে করে কারও কোনাে সমস্যা না থাকে। সকলেই ভালাে অবস্থায় দিনযাপন করতে পারে এবং একে অপরের প্রতি সদাচরণ করে। হুজুর (ﷺ) ভালাে কাজের জন্য সাহাবীগণকে উৎসাহ দিতেন, শক্তি যােগাতেন এবং প্রয়ােজনমতাে সাহায্য সহযােগিতা প্রদান করতেন। আর কাজ যদি যথাযথ না হতাে তবে তা সংশােধন করে দিতেন এবং মন্দ কাজের নিন্দা করতেন এবং তা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দিতেন। তাঁর মহিমান্বিত স্বভাবই ছিলে এরপর যে, তিনি ভালাে কিছু দেখলে তার প্রশংসা করতেন এবং মন্দের নিন্দা করতেন। মন্দ কাজ যে কেউ করুক, তাকে তিনি ভৎসনা করতেন। এতে কেউ কোনাে ক্ষতি করতে পারে এরকম মনে রেখে করতেন না। যে যতা বড়াে শক্তিধর এবং বাহ্যিক মর্যাদার অধিকারী লোক হােক না কেন তাকে বিন্দু পরিমাণ ভয় করতেন না।
হুজুর আকরম (ﷺ) যে একজন থেকে অন্যজনের সংবাদ সংগ্রহ করতেন, তা কিন্তু গুপ্তচর মূলক প্রবণতার অন্তর্ভুত ছিলােনা। কেননা গুপ্তচরবৃত্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে কারও গােপন দোষ অন্যের নিকট প্রকাশ করে দেয়া। হুজুর আকরম (ﷺ) যে একজনের দ্বারা অপরজনের অবস্থা জেনে নিতেন, তা ছিলাে প্রকাশ্য অবস্থা। কারও গােপন কোনাে দোষ নয়। তাও তিনি প্রতিপালন ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে করতেন। তিনি সবক্ষেত্রেই ভারসাম্য রক্ষাকারী ছিলেন। অর্থাৎ তার যাবতীয় মহান কর্মধারা, সম্মানিত গুণাবলী— এ সবকিছু ভারসাম্যময় ও স্বাতন্ত্রশােভিত ছিলাে। তাঁর কাজের মধ্যে কখনও নিম্নগতি আবার কখনও উর্ধগতি হতো না। কাজের অবস্থা বিভিন্নতায় কখনও অতিরিক্ততা আবার কখনও স্বল্পতা ইত্যাদি অবস্থার সৃষ্টি হতো না। তিনি কখনো উম্মতের সৌজন্য, শালীনতা ও আদ্রতা শিক্ষা দিতে উদাসীন হতো না। সর্বদা তাদের পরিচালনা, পথ প্রদর্শন ও যত্ন নেয়ার ব্যাপারে মশগুল থাকতেন। তারা উত্তম আমল থেকে কখনও গাফেল হয়ে যায় কিনা এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন। উম্মতের উপর ফরজ হয়ে যায় কিনা এ আশংকায় কঠিন কোনাে ইবাদত চাপিয়ে দিতেন না অথবা সর্বদাই করার জন্য বলতেন না। হুজুর (ﷺ) সর্বাবস্থায় সব কাজের জন্য প্রস্তুত থাকার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করতেন। যেমন সমরাস্ত্র এবং যুদ্ধের আসবাবপত্র প্রস্তুত রাখতে উৎসাহ দিতেন। শুধু তাই নয়, এগুলির সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা যা প্রয়ােজন তার ব্যবস্থা করতেন। হক বা অধিকার সংক্রান্ত ব্যাপারে কোনরূপ কার্পণ্য করেন না এবং এসব ব্যাপারে অতিরঞ্জিত কিছু করতেন না। সর্বদাই হক প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রতিষ্ঠিত রাখার মাধ্যমে নিয়োজিত থাকেন। তাঁর দরবারে নৈকট্যপ্রাপ্ত গণ এবং সাহেব গ্রহণকারী হযরত গুণ সকলেই ছিলেন সৎকর্মশীল। এ মহান দরবারে অধিকতর মর্যাদাবান এবং নৈকট্য লাভকারী তারাই হবেন, যারা ছিলেন আপামর মানুষের জন্য অধিকতর কল্যাণকামী।
সাইয়্যিদুনা হযরত ইমাম হোসাইন (رضي الله عنه) বলেন, আমি আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা সাইয়্যেদুনা হজরত আলী মুর্তজা (رضي الله عنه) কে হুজুর আকরম (ﷺ) এর দরবারের নিয়ম কানুন ও আদব সম্মান কি রকম ছিলাে, এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম । হুজুর আকরম (ﷺ) এর সঙ্গে তাঁর সাহচর্য কি রকম ছিল এ সম্পর্কে আমি আমার ওয়ালিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলাম । তিনি জবাব দিলেন, হুজুর আকরম (ﷺ) উঠতে বসতে এমনকি সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালার জিকিরে রত থাকতেন। যখন কোন মজলিসে যোগদান করতেন, যেখানে জায়গা পেতেন সেখানেই বসে যেতেন। কোনাে উচু আসন বা বিশেষ কোনাে স্থানে বসার ইচ্ছা পােষণ করতেন না। নিজের বসার জন্য বিশেষ কোনাে জায়গা নির্ধারিত করে রাখতেন না। তিনি উম্মতকেও এরূপ শিক্ষা প্রদান করতেন।
উঁচু আসন বা বিশেষ স্থানের আকাংখা করতে নিষেধ করতেন। হুজুর আকরম (ﷺ) স্বীয় অনুগ্রহ, আত্মিক মনযােগ ও লক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে মজলিশের সকলকে ধন্য করতেন। কেন এরকম মনে করার অবকাশ পেতে যে, অমুক ব্যক্তি হয়তাে তুলনামূলক ভাবে রাসূল (ﷺ) এর নিকট অধিকতর সম্মানিত, অধিকতর নৈকট্যপ্রাপ্ত বা তার সাহচর্যে অধিকতর ধন্য। তিনি মানুষ যােগ্যতা ও অবস্থা অনুসারে গুরত্ব প্রদান করতেন। কোনাে লােক যে কোনাে প্রয়োজনে হুজুর আকরম (ﷺ) এর কাছে আসার পর প্রয়ােজন মিটে গেলেও চলে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিতেন না বরং স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। এমন কি তারা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে উঠে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি তাদেরকে রেখে কোথাও বের হবেন না। কেউ যদি তার কাছে কোনাে কিছু চাইতে বা কোনাে প্রয়ােজন নিয়ে উপস্থিত হতাে, তিনি তাদেরকে মানা করতেন না বা ফিরিয়ে দিতেন না। বরং প্রয়ােজন পূরণ করে দিতেন। আর ঐ সময় প্রয়োজন মিটানোর মতো কোনো কিছু যদি না থাকতাে, তাহলে সুন্দর আচরণের মাধ্যমে তার মন জয় করার পর মিষ্টি কথা বলে তাকে বিদায় করতেন। এরকম মহিমান্বিত স্বভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করা হবে হুজুর আকরম (ﷺ) এর আখলাক অধ্যায়ের দানশীলতা ও মহানুভবতা অধ্যায়ে। তিনি সমগ্র মানুষের জন্য পিতৃতুল্য ছিলেন। অধিকারের দিক দিয়ে সকলেই তার নিকট সমান ছিল। তার মজলিশ ছিলাে বিদ্যা, সহিষ্ণুতা, লজ্জাশীলতা, ধৈর্য ও বিশ্বস্ততার মজলিশ। উক্ত মহতী মজলিশে উচ্চস্বরে কোনাে আওয়াজ হতােনা। অবৈধ ও অশালীন কোনাে কথাবার্তাও হতো না।
মজলিশে অংশগ্রহণকারীগণের ভিতরে কখনো কারো দ্বারা কোন অশোভন তৎপরতা ঘটে গেলে তিনি তা প্রকাশ করতেন না। মোটকথা, মানবীয় স্বভাব প্রসূত কোনোরূপ অশোভন কাজ যদি কারো দ্বারা সম্পাদিত হয়ে যেতো তাহলে সে ব্যাপারে গোপনীয়তা বজায় রাখা হতো। মজলিসের সকল সদস্য পরস্পর মুয়াফিক ওসমান ছিলেন। বড়রা ছোটদের প্রতি স্নেহশীল থাকতেন। আর বড়দেরকে ছোটরা সম্মান করতেন। দরিদ্র অভাবের প্রতি সকলেই আত্মত্যাগী ছিলেন। অসহায় ও মুসাফিরদের প্রতি সকলেই ছিলেন যত্নবান।
صلى الله عليه وسلم ورضي الله تعالى عنهم
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী]
© | সেনানী এপ্স |