আল্লাহ পাকের ভয় ও ইবাদতে কঠোরতা


হুজুর আকরাম (ﷺ) এর খওফ বা আল্লাহভীতি, হক তায়ালা শানুহুর আনুগত্য ও ইবাদত—এসব ছিলাে আল্লাহ তায়ালার এলেম ও মারেফত অনুসারে। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, এলেম এবং মারেফতের পরিমাণ অনুযায়ী আল্লাহ ভীতি এবং ইবাদতের যোগ্যতা লাভ হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমান, আল্লাহর বান্দাগণের মধ্যে তারাই আল্লাহতায়ালাকে ভয় করে যারা আলেম।


সহীহ বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে তাহলে তােমরা কম হাসতে এবং বেশি রােদন করতে।-তিরমিযী শরীফে এতােটুকু বেশী বলা হয়েছে, তােমরা যা কিছু দেখতে পাওনা আমি সে সবকিছু দেখে। তোমরা যা কিছু শুনতে পাইনি আমি সেসব শুনি। তিনি আরও বলেন, আকাশে এক বিশেষ ধরনের আওয়ায হয়ে থাকে, তাকে আতইয়াত বলা হয় —তাও আমি শুনতে পাই। ভার বেশী হয়ে যাওয়ার কারণে উট যে কষ্টকর আওয়ায করে, তাকে আতইয়াত বলা হয়। আকাশের ফেরেশতাগণের আধিক্যের কারণে সেখানে এক ধরনের আওয়াজ হয়ে থাকে। আয়াত দ্বারা সে আওয়াজকে বুঝানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আকাশে এমন চার আঙ্গুল পরিমাণ জায়গাও খালি নেই। যেখানে ফেরেশতাগণ কপাল রেখে যাতে বারীতায়ালাকে সেজদা করছে না।


অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন, আল্লাহর কসম! আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে তাহলে তােমরা খুব কম হাসতে এবং খুব বেশী ক্রন্দন করতে। আর স্ত্রীগণের সঙ্গে শয়ন করার আগ্রহ পরিত্যাগ করতে। যমীন ও তার উঁচু উঁচু টিলার দিকে বেরিয়ে পড়তে। রাস্তার দিকে বেরিয়ে পড়তে। রাস্তায় রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতে এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে আর্তনাদ করে ক্রন্দন করতে। তার কাছে ফরিয়াদ করতে। চিৎকার করে করে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করে। এর মমার্থ হচ্ছে এই যে, আমার এলেম থাকা সত্বেও ধৈর্যের মাধ্যমে সে ভার আমি বহন করছি। তোমরা জানলে কক্ষণও এই ভার বহন করতে পারতে না।হযরত আবু যর (رضي الله عنه) যিনি এই হাদীসের রাবী, তিনি বলেন, আমি (এই হাদীস শ্রবণ করার পর থেকে) সর্বদা কামনা করি, আমি যদি গাছ হতাম আর আমাকে কেটে ফেলা হবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সাহাবায়ে কেরাম একদিন আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনি কি পর্যবেক্ষণ করছেন? হুজুর (ﷺ) বললেন, বেহেশত ও দোযখ দেখছি।


কাজেই হুজুর পাক (ﷺ) এর যে আন্তরিক আল্লাহভীতি ছিলাে, আল্লাহ তায়ালার আজমত কে সর্বদা সত্তায় উপস্থিত থাকার মাধ্যমে। তার ইলমুল ইয়াকিন ও আইনুল ইয়াকিন যে শান বা অবস্থা ছিল অন্তরে, তাতাে অন্য কারও মধ্যে থাকতেই পারেনা। হাদীছ শরীফে এসেছে, হুজুর পাক (ﷺ) নামাজে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে যে, তার কদম মোবারক ফুলে যেতাে। এ অবস্থা দেখে সাহাবায়ে কেরাম আর করতেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ আপনি এতাে কষ্ট স্বীকার করছেন কেন? আল্লাহতায়ালা তাে আপনার অতীত ও ভবিষ্যতের যাবতীয় ত্রুটি বিচ্যুতি ক্ষমা করে দিয়েছেন। আপনিতাে ক্ষমাপ্রাপ্ত। তখন তিনি এরশাদ করতেন, আল্লাহ তায়ালা যে আমাকে ক্ষমাপ্রাপ্ত বানিয়েছেন, এই যে তার দয়া ও করম তার জন্য কি আমি শুকরিয়া আদায় করবােনা?


সাইয়্যেদা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, হুজুর আকরাম (ﷺ) এর যাবতীয় আমল স্থায়ী ছিল। হুজুর আকরাম (ﷺ) আমল করতে যেয়ে যে রকম কষ্ট স্বীকার করেছেন, তা সহ্য করার মতো আর কে আছে?


হযরত আউফ ইবন মালিক (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, এক রাত্রিতে আমি হুজুর পাক (ﷺ) এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি নিদ্রা থেকে জাগ্রত হলেন।

মিসওয়াক করার পর অজু করে নামাজে দন্ডায়মান হলেন। আমি তার সঙ্গে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। হুজুর (ﷺ) নামাজে সূরা বাকারা তেলাওয়াত শুরু করলেন। যেখানে রহমত সংক্রান্ত আয়াত পাঠ করলেন, সেখানেই হুজুর (ﷺ) আল্লাহ তায়ালার নিকট রহমতের আবেদন জানান। আর যখনই আযাব সংক্রান্ত কোনাে আয়াত পাঠ করলেন, তখনই তিনি সেখানে আল্লাহতায়ালার নিকট আযাব থেকে নিষ্কৃতি চাইলেন। অতঃপর যেমন দীর্ঘ সময় দন্ডায়মান অবস্থায় ছিলেন, ঐ রকম দীর্ঘ সময় রুকুতে কাটালেন। রুকু অবস্থায় তিনি এই দোয়া পড়লেন -


سبحان ذي الجبروت والعظمة والكبرياء-


এর পর রুকু থেকে সােজা হয়ে ঐ পরিমাণ দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন। সেখানেও এই দোয়া পাঠ করলেন। অতঃপর সেজদা করলেন। এখানেও তাই দোয়া পাঠ করলেন। অতঃপর দুই সিজদার মাঝে বসলেন। এখানে তাই রকম দোয়া পাঠ করলেন। এরপর বাকি অন্যান্য রাকাতে সূরা আল এমরান, সূরা নিসা ও সূরা মায়েদা তেলাওয়াত করলেন। আবার কখনও কখনো হুজুর পাক (ﷺ) দাঁড়ানো অবস্থায় একই আয়াত পাঠ করে করে সমস্ত রাত্রি কাটিয়ে দিতেন। এক বিবরণে এসেছে, সেই আয়াতটি হচ্ছে আপনি যদি তাদেরকে আযাব দেন তবুও তো তারা আপনারি বান্দা, আর যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। সুতরাং আপনি নিশ্চয়ই পরাক্রমশালী ও হেকমতের অধিকারী। নামাজে উপরােক্ত আয়াত তেলাওয়াত করার উদ্দেশ্য উম্মতের অবস্থা আল্লাহ রব্বল আলামীনের নিকট পেশ করা এবং তাদের জন্য মাগফেরাতের আবেদন করা। বর্ণিত আছে যে, হুজুর আকরম (ﷺ) যখন নামাজ আদায় করতেন, তখন তাঁর পেট মোবারকের ভিতর থেকে ফুটন্ত ডেক থেকে উত্থিত আওয়াযের মতো আওয়াজ বের হতে থাকে।


ইবন আবী হালা (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে আছে, হুজুর আকরম (ﷺ) এর এমন অবস্থা হতাে যে, অনবরত চিন্তা ও পর্যায়ক্রমিক মানসিক যন্ত্রণা চলতে থাকতাে। হুজুর পাক (ﷺ) বলেছেন, আমি আমার প্রতিপালকের কাছে দৈনিক সরবার ইস্তেগফার করে থাকি। অন্য এক বিবরণে আছে, একশ' বার। এরকম দুশ্চিন্তা ও এস্তেগফারnসবকিছুই ছিলাে তাঁর উম্মতের জন্য। এছাড়াও উলামায়ে কেরাম এর অন্যান্য কারণ উল্লেখ করেছেন, مرج البحرين ‘মারাজুল বাহরাইন' নামক পুস্তিকা যার বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে।


সাইয়্যেদুনা হযরত আলী মুর্তজা (رضي الله عنه) বলেন, আমি রাসূলে আকরাম (ﷺ) এর কাছে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে মিলনের তরীকা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তখন তিনি এরশাদ করলেন, আমার সম্মদের শিরােমণি হচ্ছে মারেফত। আমার দ্বীনের মূল হচ্ছে আকল। আর মহব্বত হচ্ছে তার ভিত্তি। শওক বা আত্মিক আগ্রহ হচ্ছে আমার বাহন। আল্লাহর জিকির আমার বন্ধু । ভালােবাসা আমার ভাণ্ডার। আর মানসিক চিন্তা-এ হচ্ছে আমার সাথী। এলেম আমার হাতিয়ার। ছবর আমার চাদর।রেযা বা সন্তুষ্টি হচ্ছে আমার গনীমত। ফকিরী হচ্ছে আমার অহংকার। যুহুদ বা অনাসক্তি আমার পেশা। একি হচ্ছে আমরা শক্তি। সত্যবাদিতা আমার প্রিয় বন্ধু। আনুগত্য আমার ভালােবাসা। জেহাদ আমার সৌন্দর্য। চোখের শীতলতা ও প্রশান্তি হচ্ছে নামাজ। আমার অন্তরের ফল হচ্ছে আল্লাহর জিকির ও উম্মতের চিন্তা। আমার শুক বা আত্মার আগ্রহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী] 


© | সেনানী এপ্স |

Top