দীদারে এলাহী


সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) যখন আল্লাহ্তায়ালার কুদরতের বড় বড় নিদর্শনাবলী দেখা শেষ করলেন, তখন তাঁর জন্য নৈকট্য, বিশেষত্ব ও হুজুরীর মুহূর্ত উপস্থিত হলো। শেষ সীমা পর্যন্ত উপনীত হতে হতে যাবতীয় বিচ্ছিন্নতার পরিসমাপ্তি ঘটলো। এখানে এসে তিনি হলেন সম্পূর্ণ একা। ফেরেশতা বা মানুষ কেউ তাঁর সাথে রইলো না। কিন্তু তখনও বিদ্যমান ছিলো সত্তর হাজার নূরানী পর্দা। পর্দাগুলো একে অপরের অনুরূপ নয়। 


বর্ণনায় এসেছে, একেক পর্দার পুরুত্ব ছিলো পাঁচশ বছরের রাস্তা। তখনও সেই বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করা বাকী। আল্লাহ্তায়ালার সাহায্যে তিনি সেই  পর্দাগুলোও অতিক্রম করলেন। এই মাকামে উপনীত হওয়ার পর এক বিশেষ ধরনের হয়রানী ও স্থবিরতা তাঁকে গ্রাস করলো। তিনি আল্লাহ্তায়ালার জালালাত ও আযমতই শুধু অনুভব করলেন। আওয়াজ হলো, ‘হে মোহাম্মদ থামো, তোমার প্রভুপালক এখন সালাত প্রেরণ করছেন।’ শব্দ শুনে তিনি অনুমান করলেন, এটা তো আবু বকরের কণ্ঠস্বরের মত মনে হচ্ছে। চিন্তা করলেন, আবু বকরের কন্ঠ কোত্থেকে এলো। পরিচিত কণ্ঠধ্বনি শুনে তিনি এক প্রকারের স্বস্তি অনুভব করলেন। এতে ভীতিপ্রদ অবস্থাটা চলে গেলো। এরপর আল্লাহ্ জাল্লা জালালুহুর পক্ষ থেকে বলা হলো, ‘হে সৃষ্টিকুল শ্রেষ্ঠ! হে আহমদ! হে মোহাম্মদ! নিকটবর্তী হও।’ নবী করীম (ﷺ) বলেন, অতঃপর আমার প্রভু আমাকে এতো কাছে নিয়ে নিলেন এবং আমি আমার প্রভুর এতো নিকটবর্তী হয়ে গেলাম যেমন আল্লাহ্তায়ালা এ ব্যাপারে এরশাদ করেছেন, ‘অতঃপর তিনি আল্লাহ্তায়ালার নিকটবর্তী হলেন এবং এতো কাছে চলে এলেন যে, ধনুকের দু মাথা বরাবর দূরত্ব অথবা এর চেয়েও কম।’ অতঃপর আল্লাহ্তায়ালা আমাকে কিছু প্রশ্ন করলেন। কিন্তু আমার এরকম চেতনা ছিলো না যে জবাব দেই। 


এরপর আল্লাহ্তায়ালা তাঁর কুদরতী দু’খানা হাত আমার দু’কাঁধের মাঝামাঝি সংস্থাপন করলেন। তাঁর হাতের কোনো রূপ ও আকার ছিলো না। আমি আল্লাহ্তায়ালার কুদরতী হাতের শীতলতা আমার বুকে স্পষ্ট অনুভব করলাম। এরপর পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সবকিছুর জ্ঞান আমাতে স্থিত হলো। নবী করীম (ﷺ) বলেন, আল্লাহ্তায়ালা আমাকে বিভিন্ন ধরনের এলেম শিক্ষা দিলেন। এক ধরনের এলেম এমন, যা কারও কাছে প্রকাশ করা যাবে না। এ ব্যাপারে আমার প্রতিশ্রুতিও নেয়া হয়েছিলো। কেনোনা এটি এমন একটি বিষয় যা কোনো সৃষ্টিই সহ্য করতে পারবে না। আরেক প্রকারের এলেম এমন ছিলো, যা মানুষের কাছে প্রকাশ করা না করার ব্যাপারে আমাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিলো। আর এক প্রকারের এলেম উম্মতের প্রত্যেকটি খাস ও আম ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য হুকুম দেয়া হয়েছে। এরপর রসুলেপাক (ﷺ) নিবেদন করলেন, হে আমার প্রভু! তোমার সকাশে উপস্থিত হওয়ার মুহূর্তে আমার মধ্যে অস্থিরতা এসে গিয়েছিলো। হঠাৎ ‘আপনার প্রভুপালক সালাত প্রেরণ করছেন’ একথা শুনতে পেলাম, যা আবু বকরের কণ্ঠস্বরের মতো মনে হয়েছে। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, এখানে আবু বকর কেমন করে এলো। আর আমার প্রভুপালক সালাত আদায় করবেন কেনো? তিনি তো কারো মুখাপেক্ষী নন। 


আল্লাহ্পাকের তরফ থেকে ঘোষণা এলো, অন্যের জন্য সালাত আদায় করা থেকে আমি অমুখাপেক্ষী। আমি আরও ঘোষণা দিচ্ছি যে ‘আমার পবিত্রতা, আমার রহমত আমার গযবের উপর অগ্রগামী। হে মোহাম্মদ! এই আয়াতখানা তেলাওয়াত করো ‘আল্লাহ্তায়ালা হচ্ছেন ওই সত্তা, যিনি আপনার উপর দরূদ পাঠ করেন এবং তাঁর ফেরেশতাবৃন্দও, বিশ্বাসীদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। আর তিনি মুমিনদের ব্যাপারে বড়ই দয়ালু।’ এখানে সালাত বা দরূদ যা আল্লাহ্তায়ালা তাঁর হাবীবের উপর প্রেরণ করেন, তার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর রহমত তাঁর উপর বর্ষিত হয়। 


তারপর হজরত আবু বকরের আওয়াজ শ্রবণ প্রসঙ্গের জওয়াব হচ্ছে, আল্লাহ্তায়ালা মেহেরবানি করে তাঁর হাবীবকে তাঁর প্রিয় সঙ্গী আবু বকরের কণ্ঠস্বরের অনুরূপ কন্ঠস্বর শুনিয়ে দিলেন, যাতে প্রিয় পরিচিতজনের গলার আওয়াজ শুনে অপরিচিত স্থানের বিস্ময় ও বিহবলতা কাটিয়ে তিনি স্বস্তি লাভ করতে পারেন এবং সত্তাস্থিত হন। ওই সময় আল্লাহ্তায়ালা নবী করীম (ﷺ) কে লক্ষ্য করে এরশাদ করলেন, হে মোহাম্মদ! আমি যখন তোমার ভাই মুসার সঙ্গে কালাম করতে চাইলাম, তখন তার মধ্যে সাংঘাতিক ভীতিসংকুলতা বিরাজ করছিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে মুসা, তোমার ডান হাতে ওটা কী? তখন মুসা তার নিজস্ব পরিচিত জিনিসটির কথা শুনে স্বস্থ হলো। তোমার ব্যাপারেও আমি চাইলাম যে, পরিচিতজনের কণ্ঠস্বর শুনে তুমি যেনো নিজের মধ্যে ফিরে আসো। 


তোমাকে মেরাজে আনবো এবং অপরিচিত স্থানে এসে তুমি বিহ্বল হবে, আমি জানতাম। তাই আগে থেকেই তোমার সঙ্গী আবু বকরের আকৃতি দিয়ে একজন ফেরেশতা বানিয়ে রেখেছি। আর সেই ফেরেশতাই কথা বলেছে। আমার অভিপ্রায় নয় যে, ভয়ভীতির কারণে তোমাকে প্রদত্ত জ্ঞান গ্রহণ করতে তুমি কুন্ঠিত হও। নবী করীম (ﷺ) বলেন, অতঃপর আল্লাহ্তায়ালা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, জিব্রাইল যে কথা আমার কাছে বলতে বলেছিলো, সেটি কী? আমি বললাম, হে বারী তায়ালা! তুমি তো সবই জানো। আল্লাহ্তায়ালা বললেন, আমি তার ফরিয়াদ মঞ্জুর করলাম। তার বাহুর শক্তি আরও বৃদ্ধি করে দেবো, যাতে করে সে তোমার উম্মতকে পুলসিরাত পার করে দিতে পারে। তবে শর্ত হলো, এটা তোমার ওই উম্মতের জন্য, যারা তোমাকে চায়, ভালবাসে এবং তোমার সংসর্গে থাকে। নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেন, এরপর আমার জন্য সবুজ বর্ণের রফরফ (গালিচা) বিছিয়ে দেয়া হলো, যার নূর সূর্যের আলোর চেয়ে প্রখর। সে নূরের ঝলকে আমার চোখে নূর চমকাতে লাগলো। আমাকে সেই রফরফে বসানো হলো। রফরফ রওয়ানা হলো। এক পর্যায়ে আমি আরশে আযীমে পৌঁছে গেলাম। 


এরপর এমন এক বিশাল ব্যাপার আমার দৃষ্টিগোচর হলো, যার বর্ণনা দিতে রসনা অক্ষম। তারপর আরশ থেকে একফোঁটা পানি আমার নিকটবর্তী হলো এবং তা আমার মুখে পতিত হলো। আমি তার স্বাদ নিলাম। মনে হলো, এর চেয়ে মিষ্টি কিছু কেউ কোনোদিন আস্বাদন করেনি। এতে করে পূর্বাপর যাবতীয় খবর আমার জানা হয়ে গেলো এবং আমার কলব উজ্জ্বলতর হলো। আরশের নূর আমার চোখকে আচ্ছাদিত করলো। তখন সমস্তকিছুই অন্তরের চোখ দিয়ে দেখলাম। আর আমার পিছন দিকেও ওরকম দেখতে লাগলাম, যেমন সামনে দেখি। 

 

এখানে একটি বিষয় ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, উপরের বর্ণনাগুলোর মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত উঁচু স্তরের আলোচনা। এখানে পর্দা ছিলো মাখলুকের দিক থেকে। খালেক আল্লাহ্তায়ালার দিক থেকে নয়। কেনোনা আল্লাহ্তায়ালা তো পর্দাচ্ছাদিত হওয়া থেকে পবিত্র। এমন কোনো বস্তু নেই, যা আল্লাহ্তায়ালাকে ঢেকে ফেলতে পারে। পঞ্চ ইন্দ্রীয় দ্বারা ধারণ করা যায়, এমন জিনিসে পর্দা বেষ্টিত হওয়া সম্ভব। আল্লাহ্তায়ালা পর্দা দ্বারা আচ্ছাদিত হতে পারেন না। আল্লাহ্তায়ালা তাঁর আপন নাম, বৈশিষ্ট্য ও কর্মকা- দ্বারা আচ্ছাদিত। 


প্রত্যেক মাখলুকের জন্যই নূর ও যুলমাতের মাকাম রয়েছে। অনুভূতির এবং মারেফতের এক নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে। প্রত্যেক মুকাররবীন ফেরেশতা, যারা আল্লাহ্তায়ালার আরশের আশপাশে অবস্থান করেন, তারা সকলেই আল্লাহ্তায়ালার কিবরিয়া, জালালত, আযমত ও হায়াতের নূর দ্বারা আচ্ছাদিত। আল্লাহ্তায়ালার গুণাবলীই হেজাব বা পর্দা। আর ফেরেশতাগণ মাহজুব বা আচ্ছাদিত। এসকল ফেরেশতার মর্যাদাও ভিন্ন ভিন্ন। তাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট মাকাম ও পদমর্যাদা রয়েছে। এভাবে সমস্ত সৃষ্টিই স্রষ্টা থেকে মাহজুব বা আচ্ছাদিত। কোনো সৃষ্টি নেয়ামত দানকারীর নেয়ামত দর্শন দ্বারা আচ্ছাদিত। হালপ্রাপ্ত লোক বিভিন্ন হালের দর্শন দ্বারা আচ্ছাদিত। সরঞ্জাম গ্রহণকারী সরঞ্জাম দর্শনের দ্বারা আচ্ছাদিত। এভাবেই কেউ এলেম দ্বারা, কেউ বাসনা দ্বারা, কেউ আবার বুদ্ধি দ্বারা আচ্ছাদিত। কেউ আচ্ছাদিত বৈধ কামনা দ্বারা, কেউবা অবৈধ কামনা দ্বারা, কেউ কেউ আচ্ছাদিত গোনাহ্ ও অসুন্দরের পর্দা দ্বারা। কেউ আচ্ছাদিত সম্পদ, সন্তান অথবা অন্যান্য পার্থিব সরঞ্জাম দ্বারা। হে আল্লাহ্! তোমা থেকে আমাদেরকে আচ্ছাদিত কোরো না। দুনিয়াতেও না, আখেরাতেও না। 


মানুষেরা আচ্ছাদিত থাকবে- এই ব্যাপারটি সম্পর্কে কোনো কোনো আরেফ বলেছেন- জেনে রাখতে হবে যে ‘তিনি নিকটবর্তী হলেন, অতঃপর আরও কাছে গেলেন’ এই আয়াতের ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘ধনুকের দু’মাথা বা তার চেয়েও অধিক নিকটবর্তী হলেন’ আয়াতখানা। মেরাজের হাদীছসমূহে এরকম ব্যাখ্যা রয়েছে। আর সুরা আন্ নজমে যে ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রসঙ্গ ভিন্ন। ওখানে নিকটবর্তী হওয়ার সম্পর্কটা হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) এর দিকে করা হয়েছে। সুরা আন্ নজমের আয়াতের পূর্বাপর সম্পর্ক দ্বারা সেটাই প্রমাণিত হয়। 


কোনো কোনো তাফসীরকার অবশ্য উক্ত আয়াতকেই রসুলেপাক (ﷺ) এর নৈকট্যের ব্যাপারে প্রমাণ হিসাবে গণ্য করেন, যেমন বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে। রবুবিয়াতের দরবারে আবদিয়াতের নেগাবানী হচ্ছে চূড়ান্ত সীমার আদব ও বুযুর্গী। কলবের প্রশান্তি, বাতেনী এতমিনান, সর্বোচ্চ সাহসিকতা- এসবই দৃষ্টি ও দর্শনের অনুকূলে। এ সবকিছুই রসুলেপাক (ﷺ) এর মধ্যে থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য নিদর্শনাবলী তাঁর সামনে প্রকাশিত হলো। তিনি কিন্তু কোনোকিছুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেননি। কোনো প্রকারের আকর্ষণও ব্যক্ত করেননি। এ মর্মে হক তায়ালা এরশাদ ফরমান, তাঁর দৃষ্টি বিচ্যুত হয়নি এবং অবাধ্যও হয়নি। বাদশাহের দরবারে কোনো বিশেষ ব্যক্তি যেমন, আল্লাহ্পাকের দরবারে তাঁর উপস্থিতি ছিলো তেমনই। সাইয়্যেদে বাশার (ﷺ) ছাড়া অন্য কারও ভাগ্যে এই অনুগ্রহ জোটেনি। 


মানুষের স্বভাব এই যে, উঁচু মর্যাদায় অবস্থান করলে সে মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং আরও অধিক মর্যাদার অভিলাষী হয়। তাই দেখা যায়, হজরত মুসা (عليه السلام) যখন আল্লাহ্পাকের দরবারে কথোপকথনের মর্যাদা লাভ করলেন, তখন দীদারে এলাহীর বাসনা প্রকাশ করলেন। এটা এক প্রকারের আনন্দ, যাতে মানুষ আপ্লুত হয়ে যায়। কেনোনা নৈকট্যের মাকামে আদবের প্রতি লক্ষ্য কমই থাকে। কিন্তু আমাদের নবী সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) যখন নৈকট্যের মাকামে পূর্ণ কৃতকার্য হলেন, তখন তার যাবতীয় হক পূর্ণভাবে আদায়ও করলেন। যে মাকামে তিনি উন্নীত হয়েছেন, সেখানেই শান্ত থেকেছেন। অতিরিক্ত আগ্রহ প্রকাশ করেননি। তাই তিনি স্বাভাবিকভাবে একে একে মর্যাদার সকল মনযিলগুলো অতিক্রম করেছেন। 


এই অভিযাত্রার সবচেয়ে উঁচু মর্তবা হচ্ছে, দীদারে বারী তায়ালা। এই মাকামে আল্লাহ্তায়ালা তাঁর হাবীব (ﷺ)কে অধিষ্ঠিত করিয়েছেন। তাঁকে সুস্থির রেখেছেন। এটাই সর্বোচ্চ মর্যাদা। আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ ফরমান ‘তিনি যা দর্শন করলেন, তাঁর অন্তর সেগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেনি।’ দেখা এবং উপলব্ধি একটি অপরটির সহায়ক হয়েছে। দর্শন যা পেয়েছে চোখের দৃষ্টি তাকে ধারণ করেছে, আর চোখ যা দর্শন করেছে অন্তর তাকে অনুভব করেছে, বিশ্বাস করেছে। সবকিছুই সঠিকরূপে গৃহীত হয়েছে। এর মাধ্যমে রসুলেপাক (ﷺ) পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকলের উপর অগ্রাধিকার লাভ করেছেন। সেজন্যে সকল নবী তাঁর উপর গেবতা (সৌন্দর্যমন্ডিত ঈর্ষা) করতে লাগলেন। তিনি দুনিয়া এবং আখেরাতে সিরাতুল মুস্তাকীমের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেন। 


তাঁর এহেন প্রতিষ্ঠা লাভের ব্যাপারে আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কোরআন মজীদে কসম করে বললেন ‘হে সাইয়্যেদে আলম। প্রজ্ঞাপূর্ণ কোরআনের শপথ, নিশ্চয় তুমি পয়গম্বরগণের মধ্যে একজন, যে সিরাতুল মুস্তাকীমের উপর রয়েছেন।’ ‘এটা আল্লাহ্তায়ালার অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ্তায়ালা শ্রেষ্ঠ অনুগ্রহশীল।’ এর পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ ফরমান, ‘অতঃপর তিনি তাঁর হাবীবের কাছে ওহী প্রেরণ করলেন, ওহী শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। যতো প্রকারের এলেম, মারেফত, হাকীকত, সুসংবাদ, ইশারা, সংবাদ, নিদর্শন, কারামাত এবং কামালত আছে সব এই ‘ওহী’ শব্দটির গ-িতে আবদ্ধ।

 

উপরোল্লিাখিত সকল বিষয়ের আধিক্য এবং বিশালতা সবই এর ভিতরে রয়েছে। কেনোনা এখানে ‘ওহী’ বলে সেগুলোকে অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। পূর্ণ বিবরণ দেয়া হয়নি। কারণ এই যে, এর অন্তর্নিহিতভাব আল্লাহ্তায়ালা এবং তাঁর রসুল ছাড়া অন্য কেউ ধারণ করতে পারে না। অন্যেরা ততটুকুই জানতে পারে, যতটুকু রসুলেপাক (ﷺ) বর্ণনা করেছেন। কেউ আবার তাঁর পবিত্র রূহের দিকে মুতাওয়াজ্জাহ হয়ে বাতেনী এলকা হাসিল করতে সমর্থ হয়েছেন। আউলিয়া কেরাম যারা রসুলেপাক (ﷺ) এর পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগ্যতাকে ও আভিজাত্যকে অধিকার করে নিয়েছেন, কেবল তাঁরাই এই ধরনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের যৎকিঞ্চিৎ নিগুঢ়তা অর্জনে সফল হয়েছেন। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


অতঃপর রসুলেপাক (ﷺ) যখন আরশে আযীমে পৌঁছলেন, আরশ তখন তার জালালী বিস্তারকে সংকুচিত করে নিবেদন করলো, আপনিই তো সেই মোহাম্মদ, যাঁকে আল্লাহ্তায়ালা তাঁর আহাদিয়াতের জালাল দর্শন করিয়েছেন এবং তার সামাদিয়াতের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানিয়েছেন। 


আল্লাহ্তায়ালা আমাকে (আকারের দিক থেকে) সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুক বানানোর পরও আমি চিন্তাক্লিষ্ট ছিলাম যে, কোন পথে কিভাবে আমি আপনার কাজে লাগতে পারি। মোহাম্মদ আমার সকাশে এলে আমি তাঁর সাথে কী আচরণ করবো, তাই ভেবে হয়রান পেরেশান ছিলাম। পরওয়ারদিগার আমাকে যখন সৃষ্টি করলেন, তখন আমি তাঁর হজরত ও জালালিয়াতের প্রভাবে কম্পমান ছিলাম। এরপর আমার পায়ায় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ লিখে দেয়া হলে তাঁর ভয়ে আমি আরও কাঁপতে লাগলাম। পরে মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ লেখা হলে আমার কম্পন থেমে গেলো। অস্থিরতা দূর হলো। আপনার পবিত্র নামের বরকত আমাতে উদ্ভাসিত হলো। এখন আমার উপর পতিত হলো আপনার শুভদৃষ্টি। কত বরকতের অধিকারীই না হলাম আমি। আপনি তো রসুল, সারা আলমের জন্য রহমত। আপনার রহমতের অংশ আমার জন্যও আছে। হে আল্লাহর হাবীব! আমার অংশটুকু এই যে, আপনি আমার সম্পর্কে নিরাপরাধের সাক্ষী ওই সকল মিথ্যা অপবাদকারীদের অপবাদ থেকে, যারা আমার সম্পর্কে বলে হক তায়ালাকে ধারণ করার মতো প্রশস্ততা আমার রয়েছে। তাঁর তো মেছাল (উদাহরণ) নেই। আমি তাঁকে কিভাবে বেষ্টন করতে পারি?


হে মোহাম্মদ! যে জাত পাকের কোনো আকার এবং ধরন নেই, যাঁর সিফত অসংখ্য ও অগণিত, তিনি কেমন করে আমার মুখাপেক্ষী হন? তিনি কিভাবে আমার উপর আরোহণ করতে পারেন। যেহেতু রহমান তাঁর নাম এবং এস্তেওয়া তাঁর সিফাত। তাঁর সিফত তো তাঁর জাতের সঙ্গে মিলিত। সুতরাং আমার সাথে তাঁর মিলিত হওয়া বা পৃথক হওয়া দু’টির একটিও তো হওয়া সম্ভব নয়। হে মোহাম্মদ! সেই জাত পাকের ইয্যত ও জালালের কসম, আমি মিলনের দিক দিয়ে তাঁর নিকটে, আর বিচ্ছেদের দিক দিয়ে তাঁর থেকে দূরে নই। তাঁকে বহন করার যোগ্যতা আমার নেই। তাঁকে ধারণ করার ক্ষমতাও আমার নেই। আল্লাহ্তায়ালা আমাকে স্বীয় অনুগ্রহে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাকে তাঁর আদল ইনসাফের দ্বারা যদি নিশ্চিহ্ন করে দেন, তাহলে আমি তো সেক্ষেত্রে নিছক তাঁর কুদরতের মাহমুল এবং মামুল মাত্র। 


এতদশ্রবণে নবী করীম (ﷺ) আরশকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি সরে যাও। আমি তোমা থেকে নির্লিপ্ত এবং অমুখাপেক্ষী। আমার পবিত্র মুহূর্তকে কলুষিত কোরো না। একাকীত্বকে দূষিত করো না। এরপর তিনি আরশের দিকে দৃষ্টি দিলেন। কিন্তু তার প্রতি আকৃষ্ট হলেন না। আরশের মধ্যে যা কিছু লিপিবদ্ধ ছিলো, তিনি তা পাঠ করলেন। তাঁর দিকে যা ওহী করলেন এর অন্যতম নিগুঢ়তা এই যে, তাঁর চক্ষু বিচ্যুত হয়নি এবং বিরুদ্ধাচরণও করেনি।


কাবা কাউসাইনে আও আদনা মাকামে উপস্থিত হয়ে নবী করিম (ﷺ) তাঁর উম্মতের অবস্থা আল্লাহ্তায়ারার কাছে পেশ করলেন। নিবেদন করলেন, হে আমার প্রভু! আপনি তো অনেক উম্মতকে আযাব দিয়েছেন। কাউকে পাথর বর্ষণ করেছেন, কাউকে মাটিতে প্রোথিত করেছেন, কারও চেহারা বিকৃত করে দিয়েছেন। আল্লাহ্তায়ালা বললেন, আমি তোমার উম্মতকে রহমত করবো, তাদের গোনাহ্কে নেকীতে রূপান্তরিত করে দেবো। যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে ‘লাব্বাইক’ বলবো। যে প্রার্থনা করবে তাকে দান করবো। আমার উপর যে নির্ভর করবে, আমি তাকে অভাবহীন করে দেবো। দুনিয়াতে আমি তাদের গোনাহসমূহ গোপন রাখবো, আর আখেরাতে তোমাকে তাদের শাফায়াতকারী নিযুক্ত করবো।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 




© | সেনানী এপ্স |

Top