কুরআন অবতরণ সম্পর্কে সন্দেহ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে


আল্লাহতায়ালার এরশাদ, ‘আমি আপনার কাছে যা অবতীর্ণ করেছি, এ ব্যাপারে যদি আপনি কোন এরূপ সন্দেহ পোষণ করেন, তাহলে আপনার পূর্ববর্তী যারা কিতাব পাঠ করে, তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখুন। নিশ্চয়ই আপনার প্রভুর তরফ থেকে আপনার কাছে কে এসেছে। আর আপনি সন্দেহ পােষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। আর আপনি কক্ষণও হবেন না ঐ লােকদের অন্তর্ভূত, যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন। তাহলে তাে আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের দল ভুক্ত হয়ে যাবেন।'


উক্ত আয়াতে সম্বােধন করা হয়েছে কাকে? এখানে সম্বোধিত ব্যক্তিটি কে? হুজুর পাক (ﷺ) নাকি অন্য কেউ? এ নিয়ে মুফাসসেরীনে কেরামের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। যারা এরূপ বলেন যে, এই আয়াতে সম্বোধন করা হয়েছে হুজুর পাক (ﷺ) কে, তাদের মতবিরােধের প্রেক্ষিত তিনটি। (১) সম্বোধন যদিও হুজুর পাক (ﷺ) কে করা হয়েছে, তবে এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে উম্মতের দিকে। যেমন অন্য জায়গায় এরশাদ হয়েছে, যদি আপনি শিরক করেন, তবে অবশ্যই আপনার আমল বাতিল হয়ে যাবে'—আবার আল্লাহ তায়ালা হজরত ঈসা (عليه السلام) সম্পর্কে এরশাদ করেন, 

'তুমি কি বলেছেন মানুষকে যে, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাকে এবং আমার মাকে মাবুদ বানিয়ে নাও?”


ভাষার মধ্যে এরকম অনেক কথাই থাকে। যেমন, কোনাে বাদশাহ কোন কওমের কাছে গভর্নর নিয়োগ করেন এবং সে বাদশাহ এটা চান যে প্রজাবর্গের কাছে কোন নির্দেশ জারি করেন। তখন বাদশাহ সম্বোধন করলে জনগণকে সম্বোধন করে কিছু বলেন না। বরং তার নিয়োজিত গভর্নর কে তিনি সম্বোধন করে থাকেন। এবং বাদশাহ গভর্নর বলেন। যে, এরকম করে অথবা এরকম করো না। যদি এরকম করো তাহলে আমি এরূপ করবে অথবা যদি এরকম না করে তাহলে আমি এরূপ আচরণ করবো। বাহ্যত বাদশাহুতাে সম্বোধন করে থাকেন গভর্নরকে। কিন্তু বাদশাহর সম্বােধনের উদ্দেশ্য তাে থাকে দেশের প্রজাবর্গ। এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা তার নবীগণকে কোনো সম্বোধন করে থাকে, তা প্রকৃতপক্ষে সে নবীর উম্মতকে সম্বোধন করা হয়।


কুররা বলেন, আল্লাহ তায়ালা খুব ভালােই জানেন তাঁর রাসূল সন্দেহ পােষণকারী হতে পারেন না। আর এটা কেমন করেই বা হতে পারে যে, ওহীর নূরানিয়াত সত্বেও রসূল (ﷺ) সন্দেহের মধ্যে অবস্থান করবেন? ব্যাপারটা কিভাবে বুঝা সহজ হবে, কোন ব্যক্তি তার সন্তানকে বলল, তুমি যদি আমার সন্তান হও তাহলে আমার সঙ্গে ভালাে ব্যবহার করাে। অথবা কোন মনীব তার গোলামকে বললো যে, তুমি যদি আমার গােলাম হও তাহলে আমার আনুগত্য কর। এক্ষেত্রে পিতা ভালোভাবে জানে যে, সে তার পুত্র। আবার মনিব ভালোভাবে জানে যে, সে তার গােলাম। তা সত্ত্বেও সন্দেহযুক্ত বাক্য দ্বারা কথা বলে। প্রকৃতপক্ষে সেটিং এ ধরনের বাক্য কোন সন্দেহ নেই। এদারা পুত্রকে বা গোলামকে ধমকের ভাব দেখানাে হয়েছে।


(২) হক তায়ালা ভালোভাবে জানেন যে, হুজুর পাক (ﷺ) এর কোনােরূপ সন্দেহে নেই। তা সত্বেও সম্বোধনের ক্ষেত্রে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। এ ধরনের ইঙ্গিত সূচক বাক্য ব্যবহারের মাধ্যমে কেনায়ারvমাহাত্মকে তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম সম্বােধনের সম্বোধিত ব্যক্তি হুজুর পাক (ﷺ), আর দ্বিতীয় সম্বােধনের সম্বােধিত ব্যক্তি তিনি ব্যতীত অন্য কেউ। ফাফহাম।


(৩) এক্ষেত্রে সন্দেহ থেকে অন্তরের সংকীর্ণতা বুঝতে হবে। এ ধর্ম অনুসারে আয়াতের তাৎপর্য এই যে, আপনি যদি কাফেরদের আচরণের কারণে সংকীর্ণতায় পতিত হন। কেউ যদি আপনাকে কাফেরদের যন্ত্রণা দান ও দুশমনী করা সম্পর্কে প্রশ্ন করে, তখন আপনি ধৈর্য ধারণ করবেন এবং পূর্ববর্তী যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নিন যে, পূর্ববর্তী নবীগণকে তাদের কওমের লোকেরা কি রকম যন্ত্রণা প্রদান করেছে। আর সে পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা কিরকম ধৈর্য ধারণ করেছেন। আর এটাও জেনে নিন যে, ঐ সমস্ত কাফেরদের পরিণামই বা কি রকম হয়েছে। আর নবীগণের উপর আল্লাহ তায়ালার সহায়তা কিভাবে হয়েছিলাে। আপনিতাে সন্দেহের মধ্যে নেই, তবুও ধরে নেয়া হােক আপনি যদি পূর্ববতী ঘটনাবলী যা কুরআন মজীদে বর্ণনা করা হয়েছে এ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে থাকেন,অথবা শয়তান যদি খেয়ালে কোন ত্রুটি ঢুকিয়ে দিয়ে থাকে, তাহলে আপনি পূর্ববর্তী যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে। এবং যারা পূর্ববর্তী কিতাব অধ্যয়ন করেছে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করেvজেনে নিতে পারেন। কেননা কুরআনে পাকে বর্ণিত ঘটনাবলী তাদের কাছেও সুসাব্যস্ত। আপনার কাছে ওহীর মাধ্যমে যে রকম বর্ণনা করা হয়েছে তাদের কিতাবে ঐ রকমই বিবৃত হয়েছে। এগুলো থেকে প্রকৃত অবস্থান যাচাই করা ও সাব্যস্ত করা হলাে আয়াত পাঠের উদ্দেশ্য। অধিকন্তু এই আয়াত দ্বারা এটা বুঝানােও উদ্দেশ্য যে, তাদের কিতাব সমূহে যা কিছু রয়েছে কুরআন মজীদ সেগুলিকে প্রত্যয়ন করতে কুণ্ঠিত নয়। সে সব সম্বন্ধে অবহিত করে দিয়ে আল্লাহপাক তার হাবীব (ﷺ) এর জ্ঞান ও বিশ্বাসকে স্পষ্ট করেছেন—এটাও এ আয়াতের উদ্দেশ্য। সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া সম্ভব এটা বোঝানো আয়াতের উদ্দেশ্য নয়। তাই তো এই আয়াতে কারীমা নাযিল হওয়ার সময় হুজুর পাক (ﷺ) বলেন, আমার সন্দেহ নেই। আর আমি জিজ্ঞেসও করবো না।


হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, আল্লাহর কসম চোখের পলক পরিমাণও রসূলে খােদা (ﷺ) এর সন্দেহ ছিলােনা। আর তাদের কারাে কাছে তিনি কিছু জিজ্ঞাসা করেননি।


বান্দা মিসকীন অর্থাৎ শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিছে দেহলভী (رحمة الله) বলেন, যাহেরী অর্থ এখানে গ্রহণ করা হয়নি, যা তাসদীক ও একিনের পরিপন্থী। বরং সন্দেহ বলতে মুমায়ানা ও মুশাহাদা পর বলবে যে এতমিনান বা প্রশান্তির আবির্ভাব হয়ে থাকে, তার পূর্বের অবস্থাকে বুঝানাে। হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হযরত ইব্রাহীম খলীল (عليه السلام) এর প্রশ্ন সংক্রান্ত যে হাদীছ সেখানে সাওয়ালের ক্ষেত্রে 'সন্দেহ শব্দ নেয়া হয়েছে। কেননা তিনি আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, প্রভু হে! তুমি মৃতকে কীভাবে জীবন দান করে আমাকে দেখাও, এক্ষেত্রে অত্যধিক বিনয় প্রকাশার্থে এবং হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) এর মর্যাদা অধিকার সমুন্নত করার উদ্দেশ্যে হুজুর পাক (ﷺ) বললেন, আমি তাকে তার চেয়ে সন্দেহ পোষণ করার অধিকতর দাবীদার।


হুজুর আকরম (ﷺ) সূরা সাব্বিহিসমি রব্বিকাল আ'লা তেলাওয়াত করাকে বেশী পছন্দ করতেন এ কারণে যে এ সূরায় রয়েছে, নিশ্চয় এ কুরআনের কথা রয়েছে পূর্ববর্তী সহীফা সমূহে, ইব্রাহীম (عليه السلام) ও মুসা (عليه السلام) এর সহিফা সমূহ।


আর দাজ্জাল সম্পর্কে হযরত তামীম দারী (رضي الله عنه) যে তথ্য দিয়েছে তা ঐ এরশাদেরই অনুকূল যা হুজুর পাক (ﷺ) সাহাবায়ে কেরামকে জানিয়েছেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে ডেকে দাজ্জালের কাহিনী বর্ণনা করেছিলেন। তাও অই অর্থেই, মােজেযা প্রকাশিত হওয়ার পর যে হুজুর (ﷺ) বলেছিলেন, সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আমি আল্লাহর রসূল।-তাও উপরােক্ত তাবীল অনুসারেই বুঝে নিতে হবে। যারা বলে থাকেন যে لؤن اشركت ‘লাইন আশরাকতা' আয়াতে হুজুর পাক (ﷺ) কে সম্বােধন করা হয়নি। বরং প্রত্যেক শ্রোতাই এখানে সম্বাধিত। ঠিক ঐ রকমই فان كنت فى شك 'ফাইন কুনতা ফি শাককিন' আয়াতে সম্বোধন করা হয়েছে শ্রোতাদের কে। রাসূল করীম (ﷺ) কে নয়।


কথাটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা এরকম রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সময়ে তিন শ্রেণীর লােক ছিলাে। 

(১) মুসাদ্দেকীন

(২) মুকাযযেবীন ও 

(৩) মুনাফেকীন অথবা মুতাওয়াফফেকীন। তৃতীয় প্রকারের ব্যক্তিরাই হুজুর পাক (ﷺ) এর কার্যকলাপের প্রতি সন্দেহ পোষণ করতে। এজন্য আল্লাহ তায়ালা ক্রিয়ার একবচনের রূপ যা ‘আমি’ বোঝানোর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় তা দ্বারা সম্বােধন করলেন। এবং বললেন হে মুতাওয়াফুফেক অর্থাৎ সন্দেহে নিপতিত! তুমি যদি সন্দেহের বেড়াজালে আটকে পড়ে থাকো আমার নবী মুহাম্মদ (ﷺ) কে প্রেরণ করা সম্পর্কে অথবা তার আনীত দ্বীন সম্পর্কে, তাহলে আহলে কিতাব কে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারে। তাহলে তার নবুওয়াত সম্পর্কে রাস্তা পেয়ে যাবে এবং উম্মতের কল্যাণার্থে যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রমাণ পেয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালা তাে এব্যাপারে বলেছেন, আমি তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট নূর প্রেরণ করেছি।


হকতায়ালা যখন তাদের জন্য ঐ সমস্ত বস্তুর আলােচনা করলেন, যা তাদের সন্দেহ দূর করে দেয়, তখন রাসূল করীম (ﷺ) তাদেরকে এই মর্মে ভয় প্রদর্শন করলেন যে, যখন সত্য সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়ে যায় তখনও যদি তোমরা উপরোক্ত সন্দেহের মধ্যে পড়ে থাকে, তবে দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ মুকাযযেবীন এর অন্তর্ভুত হয়ে যাবে। সুতরাং সে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করলেন, এখন আর তোমরা ঐ সমস্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত হায়েনা, যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের দল ভুক্ত হয়ে পড়বে।' আল্লাহ তায়ালা আরও এরশাদ করেন, “আমি তাদের কিতাব দিয়েছি, তারা ভালো করেই জানে যে, এটা আপনার প্রভুর তরফ থেকে অবতীর্ণ । কাজেই আপনি সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।' মর্মার্থ এই যে, আহলে কিতাবরা জানে, আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে নবী ও রাসূলগণের আগমন করে থাকে এবং তাদের উপর কিতাব অবতীর্ণ হয়। অথবা উপরােক্ত আয়াতের মর্মার্থ এরকম হতে পারে। এখানে এই বাক্যে উহ্য আছে “হে মোহাম্মদ (ﷺ) যারা মিথ্যা অপবাদ দেয়, আপনি তাদেরকে বলুন, কক্ষণও তােমরা সন্দেহপােষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। সুতরাং এখানে রাসূল (ﷺ) কে সম্বােধন করেন নি, বরং কাফেরদের সম্বােধন করার জন্য রাসূল (ﷺ)কে উপলক্ষ্য করেছেন। সম্বোধন যে রসূলের প্রতি নয় তার সহায়ক একটি দলীল রয়েছে এই আয়াতে, হে রসূল (ﷺ)। আপনি বলে দিন যে, হে মানব মন্ডলী! তোমরা যদি আমার দ্বীনের ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে থাকো ---- ।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 


© | সেনানী এপ্স |

Top