মেরাজ থেকে প্রত্যাবর্তন
প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে নবী করীম (ﷺ) আল্লাহ্পাকের দরবারে নিবেদন করলেন, হে আমার প্রভুপালক! প্রত্যেক মুসাফিরের জন্য একটা বিদায়ী উপহার থাকে। সফর শেষে বাড়ি ফেরার সময় প্রত্যেকেই আপনজনদের জন্য কিছু না কিছু উপঢৌকন নিয়ে যায়। আমার উম্মতের জন্য এই সফরের উপহার কী?
আল্লাহ্তায়ালা বললেন, তাদের জীবদ্দশায় আমি তাদের জন্য, মৃত্যুর পরেও তাদের জন্য। কবরের মধ্যে এবং হাশরের ময়দানেও আমি তাদের কাছে থাকবো। সর্বাবস্থায় আমি তোমার উম্মতের সাহায্যকারী হবো।
অবশেষে নবী করীম (ﷺ) পৃথিবীতে ফিরে এলেন। তখন সকাল হয়েছে। তিনি এই ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করলেন। কিন্তু দুর্বল ইমানের অধিকারী কিছু লোক তাঁর কথায় অবিশ্বাস করে মুরতাদ (ধর্মত্যাগী ) হয়ে গেলো। কিছু মুশরিক দৌড়ে যেয়ে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) এর কাছে বললো, তোমার বন্ধুর খবর কিছু শুনেছো? সে কী সব কথা বলছে জানো? বলছে, ‘আজ রাতে আমাকে বাইতুলমুকাদ্দাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।’ হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) বললেন, সত্যিই কি তিনি এরকম বলেছেন? মুশরিকেরা বললো, হ্যাঁ। আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) বললেন, তিনি যা বলেন, তাতো ঠিকই বলেন, আমি তাঁর কথায় বিশ্বাস রাখি। মুশরিকেরা বললো, সে যে বলছে, আজ রাতে আমাকে বাইতুল মুকাদ্দাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো এবং সকালে আমি সেখান থেকে ফিরে এসেছি।একথাও কি বিশ্বাস করবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, যদি তিনি এরকমও বলেন যে, আমাকে রাতের বেলায় আকাশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো এবং সেখান থেকে আমি ফিরে এসেছি তাওতো আমি বিশ্বাস করবো। বাইতুল মুকাদ্দাসের কথা আর এমন কী? সেদিন থেকেই হজরত আবু বকর (رضي الله عنه) ‘সিদ্দীক’ উপাধিতে খ্যাত হয়ে গেলেন।
হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) নবী করীম (ﷺ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে আরয করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! আপনি এদের নিকট বাইতুল মুকাদ্দাসের আলামত বর্ণনা করবেন কি? তিনি বললেন, করবো। হজরত আবু বকর সিদ্দীক বললেন, তাহলে দয়া করে বলুন। আমি সেখানে গিয়েছি এবং বাইতুল মুকাদ্দাস স্বচক্ষে দেখেছি। নবী করীম (ﷺ) বাইতুল মুকাদ্দাসের আলামতসমূহ বর্ণনা করলেন। সবকিছু শুনে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচিছ, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রসুল। হজরত আবু বকর সিদ্দীকের আবেদন দ্বন্দ্ব-সন্দেহ বা অবিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ছিলো না। তিনি তো কাফেরদের মুখ থেকে মেরাজের ঘটনা শোনা মাত্রই বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন নবী করীম (ﷺ) এর এহেন ঘটনার সত্যতাকে আরও অধিক প্রকাশ করে দিতো।
মুসলিম শরীফের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (ﷺ) বলেন, ওই সময় বাইতুল মুকাদ্দাসের বিস্তৃত আকার-আকৃতি আমার স্মৃতিপটে ছিলো না। তাই চিন্তিত ছিলাম। ইতোপূর্বে কখনও এরকম চিন্তায় পড়িনি। কিন্তু আল্লাহ্পাক বাইতুল মুকাদ্দাসকে আমার দৃষ্টির সামনে উপস্থিত করে দিলেন। তারা প্রশ্ন করেছিলো। আমি নির্দ্বিধায় উত্তর দিচ্ছিলাম। রসুলেপাক (ﷺ) এর সামনে বাইতুল মুকাদ্দাস উপস্থিত হওয়ার তাৎপর্য দু’রকম হতে পারে। হয় বাইতুল মুকাদ্দাসকে সরাসরি যমীন থেকে উঠিয়ে তাঁর সামনে নিয়ে আসা হয়েছিলো। যেমন বিলকিসের সিংহাসনেকে চোখের পলকের পূর্বেই হজরত সুলায়মান (عليه السلام) এর সামনে নিয়ে আসা হয়েছিলো অথবা রসুলেপাক (ﷺ) এর সামনে তার প্রতিকৃতি উপস্থিত করা হয়েছিলো। যেমন নামাজের মধ্যে বেহেশত ও দোযখের দৃশ্য বান্দাকে দেখানো হয়ে থাকে। উলামা কেরাম এরকম ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তাছাড়া আরেকটি ব্যাখ্যা এরকমও হতে পারে যে, নবী করীম (ﷺ) এবং বাইতুল মুকাদ্দাসের মধ্যবর্তী যাবতীয় পর্দা উঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো। ফলে তাঁর দৃষ্টির সামনে বাইতুল মুকাদ্দাসই উপস্থিত ছিলো। এ সম্পর্কে একটি বর্ণনা আছে, হজরত আকীল (رضي الله عنه) এর ঘরের পাশে বাইতুল মুকাদ্দাসকে আমার চোখের সামনে এনে দেয়া হয়েছিলো। আমি দেখছিলাম আর তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছিলাম। হজরত উম্মেহানী (رضي الله عنه) এর হাদীছে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, লোকেরা জিজ্ঞেস করেছিলো, বাইতুল মুকাদ্দাসের কয়টি দরজা, আমি তো তা গুণে দেখিনি। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার সামনে যা উদ্ভাসিত হয়েছিলো, তাই দেখে আমি তাদেরকে জবাব দিয়েছিলাম।
একটি ঘটনায় বর্ণিত আছে, রসুলেপাক (ﷺ) মেরাজের সফর থেকে ফেরার সময় কুরাইশদের একটি বণিকদলকে পথিমধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন। দলটি তাদের ব্যবসায়ের মাল নিয়ে আসছিলো। তাদের কাফেলায় একটি শাদা এবং একটি কালো বর্ণের উট ছিলো। তারা মাল নিয়ে উটের কাছে এলে একটি উট পালিয়ে গেলো। পরে উটটিকে ধরে নিয়ে আসা হলো। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, আমি তাদেরকে দেখে সালাম দিয়েছিলাম। তারা বলছিলো, মোহাম্মদের কণ্ঠস্বর মনে হচ্ছে। নবী করীম (ﷺ) প্রভাতের পূর্বেই ফিরে এলেন এবং এই ঘটনা কাওমের লোকদের কাছে বর্ণনা করলেন। বললেন, আমি তাদেরকে অমুক স্থানে দেখেছি।তাদের একটি উট হারিয়ে গিয়েছিলো, যাকে পরে অমুক ব্যক্তি ঘেরাও করে ধরে নিয়ে এসেছিলো। কাফেলার সামনে শাদা এবং কালো বর্ণের দু’টি উট ছিলো। তাদের পিঠের পালান ছিলো কালো রঙের। সেই কাফেলাটি অমুক দিন এখানে পৌঁছে যাবে।
লোকেরা নির্ধারিত দিনের অপেক্ষায় রইলো।অর্ধদিবস পর্যন্ত নানা ধরনের কথাবার্তা চলতে লাগলো। দিনের শেষদিকে কাফেলা এসে পড়লে রসুলেপাক (ﷺ) যা যা বলেছিলেন, তার হুবহু প্রমাণ মিললো। মেরাজ অস্বীকারকারী দুশমনদের মুখে তখন কথা নেই। এক বর্ণনায় এসেছে, রসুলেপাক (ﷺ) বলেছিলেন, কাফেলা বুধবারে এসে উপস্থিত হবে। সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থা। কাফেলা এলো না। তখন রসুলেপাক (ﷺ) দোয়া করলেন। দোয়ার বরকতে সূর্যাস্ত বিলম্বিত হলো। এমন সময় কাফেলা এসে উপস্থিত হলো।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]
© | সেনানী এপ্স |