কতিপয় নবী (আলাইহিমুস সালাম) এর বাল্যকালীন অবস্থা
কোন কোন নবীর আখলাকে কারিমা বহিঃপ্রকাশ বাল্যবেলার ঘটেছিল। তার যে নবুওয়াতের পদবীতে ভূষিত হবেন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলাে বাল্যকাল থেকেই। যেমন হযরত ইয়াহিয়া (عليه السلام) সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, 'আমি তাকে বাল্যকালেই হেকমত সমূহ প্রদান করেছেন।' হযরত ইয়াহিয়া (عليه السلام) সম্পর্কে এরকম বর্ণিত আছে যে, তার বয়স যখন দুই বা তিন বৎসর, তখন সমবয়সী ছেলেরা তাকে বললাে, আপনি আমাদের সঙ্গে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করেন না কেন? উত্তরে তিনি বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে খেলাধুলা করার জন্য সৃষ্টি করেননি। আয়াতে কারীমার তাফসীরে কথা বর্ণিত হয়েছে, হজরত ইয়াহইয়া (عليه السلام) এ সম্পর্কে তাসদীক (সত্য বলে স্বীকৃতি দেয়া) করেছিলেন, যখন তার বয়স ছিলাে তিন বৎসর। তিনি তাঁর সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন যে, তিনি (ঈসা আঃ) আল্লাহর কালেমা এবং রূহ। হযরত ঈসা (عليه السلام) দোলনায় থাকা অবস্থায় বলেছেন, “নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা, আমাকে আল্লাহতায়ালা কিতাব দান করেছেন এবং নবুওয়াত প্রদান করেছেন। হজরত সুলায়মান (عليه السلام) অন্যান্য শিশুদের মতাে যখন শৈশবকাল অতিক্রম করছিলেন, তখন তিনি ফতোয়া প্রদান করতেন। আল্লামা তিবরী (رحمة الله) বলেন, উন্নান রাজত্ব যখন তিনি পরিচালনা করতেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র বারো বৎসর। হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) সম্পর্কে কুরআনে মাজীদে বর্ণনা করা হয়েছে, “নিঃসন্দেহে ইব্রাহীম (عليه السلام) কে প্রথম থেকেই রুশদ অর্থাৎ জ্ঞানবুদ্ধির সঠিকতা প্রদান করেছিলাম। এ আয়াতের তফসীরে বলা হয়েছে, আমি তাকে বাল্যকালেই হেদায়েত প্রদান করেছিলাম। হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام) সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তার সময় ফেরেশতাগণকে তার কাছে পাঠানো হয়েছিল তাকে এই কথাটি জানিয়ে দেয়ার জন্য যে, আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন'অন্তর দিয়ে আমার পরিচয় অর্জন করাে এবং জিহ্বা দিয়ে আমার জিকির করে। তদুত্তরে হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام) বলেছিলেন, মন প্রাণ দিয়ে আমি কবুল করলাম। নমরুদ যখন তাকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছিল, তখন তার বয়স ছিল ষোল বৎসর। হযরত মুসা (عليه السلام) ও ফেরাউনের দাড়ি ধরে টান দিয়েছিলেন, তাই এরকম বয়সে হয়েছিলো। হযরত ইউসুফ (عليه السلام) কে যখন তার ভাইয়েরা কূপে নিক্ষেপ করেছিল, তখন আল্লাহ তায়ালা তার কাছে ওহী প্রেরণ করেছিলেন, তাও এ বয়সেই। আমাদের প্রিয় আকায়ে নামদার হজরত মােহাম্মদ মােস্তফা (ﷺ) তার জন্মের সময় দুখানা হাত ও মাথা মোবারক আকাশের দিকে উত্তোলন করে রেখেছেন। এটি তার একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। হুজুর পাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন, জাহেলী যুগের আচার অনুষ্ঠানের প্রতি জীবনে আমি দুই বারের বেশি আকর্ষণ বোধ করেন না। কিন্তু সে সময়েও আল্লাহতায়ালা আমাকে রক্ষা করেছেন। প্রথম জীবন থেকেই আমার অন্তরে মূর্তি পূজা এবং (অশ্লীল) কবিতা আবৃত্তির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছিল।
বাল্যকাল থেকে আউলিয়া কেরামকে আখলাকে হাসানার বৈশিষ্ট্য প্রদান করা হয়েছে। এরপর রেসালত ও নবুওয়াতের কার্যাবলী দিয়ে তাদেরকে সুদৃঢ় করে দেয়া হয়েছে এবং অনবরত প্রভুর তরফ থেকে পবিত্র সুবাস এসে তাদেরকে সুবাসিত করেছে। এমনকি চূড়ান্ত পর্যায়ের উন্নত মর্যাদা এবং কামালিয়াত শেষ স্তর লাভ করে যারা অকৃতকার্য হয়েছেন। এসবই তারা লাভ করেছিলেন মেহনত, রিয়াযত ও কঠোর সাধনা ব্যতিরেকে। যেমন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, যখন আকল পূর্নতায় পৌছে দৃঢ়তা অর্জন করলাে, তখন আমি এলেম ও হেকমত দান করলাম।
নবী রাসূলগণের উপরোক্ত গুণাবলীর অংশবিশেষ কোন কোন ওলীরও হাসিল হয়ে থাকে। তবে তাঁদের সমস্ত গুণাবলী অর্জন করা ওলীগণের পক্ষে সম্ভব নয়। আর ইসমত (গােনাহ থেকে নিরাপত্তা) তা কেবল নবী রসূলগণের জন্যই খাছ।
বিভিন্ন গুণাবলী যাবতীয় আখলাক ও খাসলত, সিফাতে জামালী ও জালালী ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে হুজুর আকরাম (ﷺ) এর পবিত্র ব্যক্তিত্ব এতাে উন্নত, উত্তম, পূর্ণাঙ্গ, সুন্দর, সুদর্শনীয়, উজ্জ্বল ও সদৃঢ় ছিলাে যে, তা ছিলে সীমার অতীত, সংখ্যার উর্ধে ও ধারণ ক্ষমতার বাইরে। পরিপূর্ণতার কুদরতের ভাণ্ডার ও সম্ভাব্যতার স্তর বলতে যা অনুমিত হয়, ঐ সমুদয়েরও উপস্থিতি তার মধ্যে ছিল। সমস্ত আম্বিয়া মুরসালীন ছিলেন চন্দ্র তুল্য আর তিনি ছিলেন সেই চন্দ্রের উপর কিরণ সঞ্চারণকারী সূর্য। তারা সকলেই ছিলেন হুজুর আকরাম (ﷺ) এর নূর জামালের প্রতিবিম্বের আধার।বস্তুত আল্লাহতায়ালার জন্যই সমস্ত সৌন্দর্য। ইমাম বুসিরী (رحمة الله) কি সুন্দর বলেছেনঃ
সমস্ত আম্বিয়া মুরসালীন যে সকল মোজেজা সহকারে দুনিয়াতে এসেছেন এসব কিছুই তাঁদের কাছে এসেছে হুজুর আকরম (ﷺ) এর নূরে জামাল থেকে। বস্তুতঃ তারা সকলেই ছিলেন হুজুর আকরম (ﷺ) এর নূরে জামালের প্রতিবিম্বরূপ। নিঃসন্দেহে তিনিই হলেন ফযীলতের সূর্য। আর অন্যান্য নবীগণ হলেন নক্ষত্রতুল্য। আর নক্ষত্রের আলোর বহিঃপ্রকাশ তাে ঘটে তখনই যখন সূর্য থাকে অনুপস্থিত। হুজুর পাক (ﷺ) সাগর তুল্য। সাগরের সীমাহীন জলরাশি থেকে অন্যেরা যেনাে অঞ্জলি পেতে কিছু আহরণ করে নিচ্ছেন। অথবা তিনি হলেন মুষলধারার বৃষ্টি যা থেকে কেউ এক চুমুক গ্রহণ করে কণ্ঠনালী সিক্ত করে নিচ্ছে।
হুজুর আকরাম (ﷺ) এর সত্তায় আল্লাহ তায়ালা যে মর্যাদাময় আখলাক ও প্রশংসনীয় গুণাবলীর সমাহার ঘটিয়েছে, তার আধিক্য, দৃঢ়তা ও মহত্বের প্রশংসা কুরআনে কারীমে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, আপনার উপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ সুমহান।' হুজুর পাক (ﷺ) স্বয়ং এরশাদ করেছেন, উত্তম আমলের পরিপূর্ণতা বিধানের জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি। অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী পূর্ণতা দেয়ার উদ্দেশ্যে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে।' আয়াতে কারীমা ও হাদীছের বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয়, হুজুর পাক ( ﷺ) এর পবিত্র সত্তায় সকল সৌন্দর্য ও উত্তম আখলাক সন্নিবেশিত ছিল। আর কেনই বা এরকম হবে না? তার শিক্ষক যে ছিলেন স্বয়ং রাব্বুল ইজ্জত, যিনি সমস্ত ইলমের উৎস।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী]
© | সেনানী এপ্স |