বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী ও অবস্থা


বিধানগত হিশেবে নয়, বরং গুণ ও অবস্থারপরিপ্রেক্ষিতে, রসুলে আকরম (ﷺ) এর ওই বৈশিষ্ট্যনিচয় সংখ্যা ও হিসাবের আওতায় পড়ে না। বিশেষ করে ওই গুণাবলী ও অবস্থা যা বাতেনের সাথে সম্পৃক্ত। সেই রহস্যে পৌঁছতে কেউই সক্ষম নয়। তবে যাহেরী কিছু গুণা আলোচনার অন্তর্ভূত হয়েছে। কেননা এগুলোকে উলামায়ে কেরাম সংখ্যায় নিরূপণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এগুলো সবই মোজেজার পর্যায়ভুক্ত। মোজেজাগুলো আবার এমন যে, এরকম মোজেজা অন্য কোনো নবী কর্তৃক প্রকাশিত হয়নি। তাই সেগুলোকে মহত্বের ও আধিক্যের কারণে স্বতন্ত্র অধ্যায়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। 


রসুলে আকরম (ﷺ) এর সব চেয়ে উন্নত ও পরিপূর্ণ মর্যাদা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্তায়ালা তাঁর পবিত্র রূহকে সকল মাখলুকের রূহ সৃষ্টি করার পূর্বে সৃষ্টি করেছেন। তারপর সকল সৃষ্টির রূহ তাঁর রূহ থেকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি ওই সময়ও নবী ছিলেন, যখন আদম (عليه السلام) ছিলেন রূহ ও দেহের মাঝামাঝি। ইমাম তিরমিযী হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) এর মাধ্যমে এই বিবরণ দিয়েছেন। রূহের জগতে আম্বিয়া কেরামের পবিত্র রূহসমূহকে তাঁর রূহ থেকে ফয়েজ প্রদান করেছেন। রসুলেপাক (ﷺ) এর সূর্যতুল্য রূহ যতদিন অন্তরালে ছিলো ততদিন অন্যান্য আম্বিয়া কেরামের তারকাতুল্য রূহসমূহ উক্ত সূর্য থেকে আলোকপ্রাপ্ত হয়ে জাহেরী জগতে চমকিত ছিলো। তাঁর নবুওয়াতের সূর্য যখন উদিত হলো, প্রকাশ্যজগতে আত্মপ্রকাশ করলো, তখন উক্ত তারকাসমূহ হয়ে গেলো দ্যুতিহীন। যখন তারকারাজি উদিত হয়, তখন নভোম-ল তাদের রঙ রূপে চকমক করতে থাকে। কিন্তু প্রত্যুষে সূর্য যখন তার উজ্জ্বল কিরণ ছড়িয়ে আসে, তখন নক্ষত্রম-লী হয়ে পড়ে আলোহীন। হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন, রসুলে আকরম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, সৃষ্টি হিসেবে আমি নবীগণের পূর্বে আর জাহেরী জগতের আবির্ভাবে সকলের পরে। তাঁর এটিও একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে, তিনি রোজে আযলে ‘আলাসতু বিরব্বিকুম’ প্রশ্নের জবাবে সর্বপ্রথম ‘বালা’ (হাঁ) বলে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলেন। হাদীছ শরীফে এসেছে আদম, আলম, আলমের সৃষ্টি, সবকিছুর মূল কারণ হচ্ছে রসুলেপাক (ﷺ) এর সৃষ্টি। এটাও তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর পবিত্র নাম আরশের উপর, জান্নাতের দরওয়াজাসমূহে, সবস্থানে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, নবীগণের নিকট থেকে তাঁর ব্যাপারে এই মর্মে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে যে, তাঁরা যখনই আবির্ভূত হবেন, তখন আখেরী পয়গম্বর মোহাম্মদ (ﷺ) এর উপর ইমান আনবেন। এই অঙ্গীকার সম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালার এরশাদ হচ্ছে, ‘ওই সময়ের কথা স্মরণ করুন যখন আল্লাহ্তায়ালা সকল নবীর নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন।’ তাঁর বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে আরও একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে তাঁর মহিমান্বিত ব্যক্তিত্বের বিবরণ এবং সুসংবাদ রয়েছে। তাঁর বংশধারায় উপরের দিকে আদম (عليه السلام) পর্যন্ত তাঁর কারণেই কোনো ব্যভিচার সংঘটিত হয়নি। এসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা তাঁর বেলাদত শরীফের অধ্যায়ে আসবে ইনশাআল্লাহ্। আল্লাহ্তায়ালা প্রত্যেক যুগের শ্রেষ্ঠ সময়ে, শ্রেষ্ঠতম সম্প্রদায়ে এবং শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে তাঁর বংশক্রম জারী রেখেছেন। রসুল (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ্তায়ালা আদম সন্তানদের ভিতর বনী কেনানাকে অধিক মর্যাদা দিয়েছেন। বনী কেনানা থেকে কুরায়েশকে। কুরায়েশ থেকে বনী হাশেমকে এবং বনী হাশেম থেকে আমাকে বেশী মর্যাদা দিয়েছেন। সুতরাংরসুলেপাক (ﷺ) ধন্যদের ধন্য, উত্তমদের উত্তম এবং মনোনীতদের মনোনীত। তাঁর জন্মের সময় সকল মূর্তি মস্তকাবনত হয়ে পড়ে গিয়েছিলো। মাতৃগর্ভ থেকে খতনাকৃত, নাভী কাটা এবং পাক সাফ অবস্থায় তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেজদা করেছিলেন এবং সেই মুহূর্ত থেকেই তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকতো আকাশের দিকে। ভূমিষ্ঠকালে শাহাদাত আঙ্গুল ঊর্ধ্বমুখি ছিলো। ভূমিষ্ঠকালে মা জননী সাইয়্যেদা আমেনা (رضي الله عنه) দেখতে পেয়েছিলেন, একটি নূর উদ্ভাসিত হয়ে শামদেশের বালাখানা ও মহলসমূহকে আলোকিত করে দিচ্ছে। তাঁর দোলনা মোবারককে ফেরেশতারা দোলা দিয়েছিলেন। দোলনায় থেকে তিনি কথা বলেছেন। ইতিহাসবিদগণ বলেন, তখন চন্দ্র তাঁর সাথে কথোপকথন করতো। তিনি চাঁদকে যেদিকে ইশারা করতেন সেদিকেই সে হেলে যেতো। তাঁর বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে এটিও একটি যে, তিনি যখন রোদে চলাফেরা করতেন, তখন মেঘখ- তাঁকে ছায়া দিতো। এরকম ঘটনা সর্বদাই ঘটতো এমন নয়। কয়েকবার এরকম হয়েছিলো। বাল্যকালে যখন তিনি চাচা আবু তালেবের সঙ্গে সফরে গিয়েছিলেন, তখন বুহায়রা নামক পাদ্রী তাঁকে দেখামাত্র চিনে নিয়েছিলো। 


বক্ষ সম্প্রসারণ তাঁর বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্যতম। বক্ষ সম্প্রসারণ চার বার সংঘটিত হয়েছিলো। প্রথমবার- বাল্যবেলায়, যখন তিনি বনীসাআদ গোত্রে ছিলেন। দ্বিতীয়বার হয়েছিলো দশবৎসর বয়সে। তৃতীয়বার হয়েছিলো নবুওয়াতপ্রাপ্তির সময়। আর চতুর্থবার হয়েছিলো শবে মেরাজে। 


তাঁর বৈশিষ্ট্যাবলীর মধ্যে একটি- ওহীর প্রথম ঘটনায় হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং তাঁর পবিত্র সত্তার অভ্যন্তরে রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। উলামায়ে কেরাম এটাকেও তাঁর বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভূত বলেন। তাঁরা বলেন, তিনি ব্যতীত অন্য কোনো নবীর বেলায় এধরনের ঘটনা ঘটেনি। তাঁর বৈশিষ্ট্যাবলীর আর একটি- আল্লাহ্তায়ালা তাঁর পবিত্র দেহের অঙ্গসমূহের উল্লেখ করেছেন কোরআন মজীদে। তাঁর কলবে আতহারের উল্লেখ রয়েছে এই আয়াতে, ‘জিব্রাইল আমীন কোরআন নিয়ে আপনার কলবে অবতীর্ণ হয়।’ তাঁর যবান মোবারকের কথা রয়েছে এভাবে— ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআনকে আপনার রসনায় সহজ করে দিয়েছি’। 


আল্লাহ্পাক আরও বলেন, ‘তাঁর যবান স্বীয় প্রবৃত্তি অনুসারে বলেনি’- চক্ষু সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘তাঁর দৃষ্টি বক্র হয়নি, দৃষ্টিবিচ্যুত হয়নি।’ চেহারা মোবারকের কথা বলা হয়েছে ‘আপনার আকাশের দিকে মুখ তুলে বারবার তাকানোকে আমি দেখেছি।’ হাত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘আপনার হাতকে কাঁধের দিকে আবদ্ধ করে রাখবেন না।’ বক্ষ ও পৃষ্ঠদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘আমি কি আপনার বক্ষকে সম্প্রসারিত করিনি? আর যে গুরুভার আপনার পৃষ্ঠদেশকে ভেঙে ফেলার উপক্রম করেছিলো, তা কি আমি সরিয়ে দেইনি?’ 


এ সকল আয়াতে রসুলেপাক (ﷺ) এর দেহের বিভিন্ন অঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। এগুলো তাঁর প্রতি আল্লাহ্তায়ালার কামালে মহব্বতের এবং অধিক এনায়েতের প্রমাণ। তাঁর বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, আল্লাহ্তায়ালা স্বীয় নাম মাহমুদ থেকে তাঁর হাবীব (ﷺ) এর নাম আহমদ ও মোহাম্মদ নির্গত করেছেন। তাঁর পূর্বে অন্য কারও এরকম নাম রাখা হয়নি। 


কবি হাস্সান ইবনে ছাবেত (رضي الله عنه) বলেন ‘আল্লাহ্তায়ালা মোহাম্মদ এর নামকে নিজের নাম থেকে বের করেছেন। আরশের মালিক যিনি তাঁর নাম মাহমুদ আর ইনি হচ্ছেন মোহাম্মদ (ﷺ)। কেউ কেউ বলেন, এই কবিতা হজরত আবু তালিবের।


যেমন ইমাম বোখারী স্বীয় গ্রন্থ তারিখে সগীরে উল্লেখ করেছেন। তাঁর বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আল্লাহ্তায়ালা তাঁকে বেহেশতী আহার্য প্রদান করেছিলেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে সওমে বেসালের অধ্যায়ে ইনশাআল্লাহ্ । 


রসুলেপাক (ﷺ) সামনের দিকে যেমন দেখতে পেতেন, ঠিক তেমনি পিছনের দিকেও দেখতেন। দিনের আলোতে যেরকম দেখতেন রাতের অন্ধকারেও দেখতেন তেমনি। তিনি পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে গেলে পাথরে কদম মোবারকের ছাপ অঙ্কিত হতো। মাকামে ইব্রাহীমেও এরকম পরিলক্ষিত হয়। এই আলোচনা কোরআন মজীদেও রয়েছে। তাঁর দুই কনুই মোবারকের চিহ্ন মক্কার পাথরে আছে। তাঁর ঘোড়ার সমুনের চিহ্ন মদীনা মুনাওয়ারায় বনী মুআবিয়ার মসজিদে বিদ্যমান। তাঁর মুখের লালা লোনা পানিকে মিঠা পানিতে পরিণত করে দিতো এবং দুগ্ধপোষ্য শিশুর বেলায় দুধের প্রয়োজন মিটাতো। তাঁর বগল মোবারকের বর্ণ ছিলো শাদা ও লাল মিশ্রিত। সেখানে পশম গজাতো না। আবার সেস্থানের রঙ শরীরের রঙ থেকে আলাদা ছিলো না।বগল মোবারকে দুর্গন্ধও ছিলো না। 


এস্তেস্কার হাদীছে বর্ণিত আছে, তিনি দোয়ার সময় হাত এতটুকু ওঠাতেন যাতে বগল মোবারকের শুভ্রতা পরিলক্ষিত হতো। কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকেন, বগলের শুভ্রতা বুঝানোর জন্য এটা জরুরী নয় যে, সেখানে পশম থাকবে না। কেননা যে স্থান থেকে পশম উঠিয়ে ফেলা হয়, সে স্থান দেখতে শাদাই হয়ে থাকে। একথাও প্রমাণিত যে, রসুলেপাক (ﷺ) বগল মোবারকের পশম উঠিয়ে ফেলতেন। 


আব্দুল্লাহ ইবনে আকরম খাযাঈ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমি একবার রসুলেপাক (ﷺ) এর সঙ্গে নামাজ পড়েছি। সেজদার প্রাক্কালে তাঁর বগল মোবারকের দিকে আমার দৃষ্টি পড়েছিলো। হাদীছ শরীফে এসেছে ‘গুফরাতুন’। বাদামী রঙকে গুফরাহ বলা হয়। এ কথার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সেখানে পশমের চিহ্ন ছিলো। এরকম স্থানকেই ‘আগফার’ বলা হয়। পশমবিহীন স্থানকে আগফার বলা হয় না। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ায় এরকম বর্ণনা রয়েছে। 


যাই হোক, এক্ষেত্রে এরকম ধারণা রাখতে হবে যে, রসুলেপাক (ﷺ) এর বগল মোবারক থেকে কোনোরূপ দুর্গন্ধ নির্গত হতো না। বরং খুশবু বের হতো। বোখারী শরীফে একথাই আছে। তাঁর কণ্ঠস্বর এতো দূর দূরান্ত পর্যন্ত পৌঁছতো, যেখানে অন্য কারও আওয়াজ পৌঁছতো না। তাঁর চোখ নিদ্রিত হতো। কিন্তু অন্তর জেগে থাকতো। বোখারী।


নিদ্রাবস্থায় কেহ কথা বললে তিনি শুনতে পেতেন। হাদীছ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, নিদ্রার কারণে রসুলেপাক (ﷺ) এর অজুভঙ্গ হতো না। কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকেন, নিদ্রায় অজু ভঙ্গ না হওয়ার বিশেষত্বসকল নবীর বেলায় প্রযোজ্য।

 

এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে, লাইলাতুত্তারিছে সূর্য উদিত হওয়া সম্পর্কে তিনি কেনো জানতে পারলেন না- যার কারণে ফজরের নামাজ কাযা হয়ে গিয়েছিলো। উত্তরে এই বলা হয় যে,সূর্য উদিত হওয়া বা অস্ত যাওয়াকে অবলোকন করা চোখের কাজ। চোখ যেহেতু নিদ্রিত ছিলো, তাই তা জানতে না পারাটাই স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন- হৃদয় জাগ্রত থাকলেও জানতে পারেননি কেনো? এর কারণ হচ্ছে, অন্তরে ওহী হয়নি। আবার নামাজ ফওত হলে তা কাযা করার বিধান উম্মতের মধ্যে প্রচলিত করার উদ্দেশ্যও এতে ছিলো। এক্ষেত্রে অন্য কোনোও রহস্যও থাকতে পারে। আল্লাহ্তায়ালাই সর্বজ্ঞ। 


রসুলেপাক (ﷺ) কখনও শরীরে আড়মোড়া দিতেন না। এটি ইবনে আবী শায়বা ও ইমাম বোখারী তাঁর তারিখ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। হাই না তোলার ব্যাপারেও বর্ণনা আছে। অন্য কোনো নবীও শরীরে আড়মোড়া দিতেন না। হাইতোলা শয়তানের প্রভাবে হয়ে থাকে। কাজেই সাব্যস্ত হলো— এমন কাজ রসুলেপাক (ﷺ) দ্বারা সংঘটিত হতেই পারে না। 


রসুলেপাক (ﷺ) এর শরীর মোবারকে কখনও মাছি বসতো না এবং তাঁর পোশাক পরিচ্ছদে কখনও উকুন হতো না। কখনও তাঁর স্বপ্নদোষ হয়নি। অন্য কোনো নবীর বেলায়ও হয়নি। তিবরানী একথা বলেছেন। 


বর্ণিত আছে, স্বপ্নদোষ শয়তানের প্রভাবদুষ্ট কাজ। অবশ্য কোনো কোনো আলেম রসুলেপাক (ﷺ) থেকে এহতেলাম হওয়া জায়েয মনে করেন। কখনও কখনও মানসিক চাপেও এরকম হয়ে থাকে। শয়তানী স্বপ্ন থেকে নয়। তাঁর সীনা মোবারকের খুশবু মেশকের চেয়েও সুগন্ধিযুক্ত ছিলো।

 

যমীনের উপর রসুলেপাক (ﷺ) এর কোনো ছায়া পড়তো না। কেননা যমীন নাজাছাত (নাপাকি) ও কাছাফাত্ব (ঘনত্ব) এর স্থান। সূর্যের আলোতেও তাঁর ছায়া দেখা যেতো না। চেরাগের আলোতে তাঁর ছায়া হতো না, একথা বলা হয়নি। কাজেই বিষয়টি বড়ই বিস্ময়কর, সূক্ষ্ম ও দুর্লভ। 


রসুলেপাক (ﷺ) রাতের নামাজান্তে যে দোয়া পাঠ করতেন, কোনো কোনো মাশায়েখ তা ফজরের সুন্নত ও ফরজের মধ্যবর্তী সময়ে পাঠ করে থাকেন। তিনি (ﷺ) বলতেন, হে আল্লাহ্। আমার সমস্ত অঙ্গ ও সকল দিকে তুমি নূর প্রদান করো। উক্ত দোয়ার শেষাংশে রয়েছে ‘ ওয়াজআলনী নূরান’- হে আল্লাহ্ তুমি আমাকে নূর বানিয়ে দাও। রসুলেপাক (ﷺ) নূর ছিলেন। নূরের ছায়া হয় না।


তিনি যখন লম্বা লোকদের সঙ্গে হাঁটতেন, তখন সকলের চেয়ে তাঁকেই বেশী লম্বা দেখা যেতো। তাঁর পোশাক পরিচ্ছদে মাছি বসতো না। আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী এরকম বর্ণনা করেছেন। পোশাক পরিচ্ছদে যখন বসতো না, তখন দেহ মোবারকে মাছি বসারতো প্রশ্নই আসে না। মশা বা কীট-পতঙ্গ তাঁকে কখনও দংশন করেনি বা শরীরের রক্ত শোষণ করেনি। ছারপোকাও তাঁকে কোনোদিন কামড় দেয়নি। এসব উলামায়ে কেরামের বর্ণনা। তাঁর পবিত্র শরীরে কোনোদিন উকুন হয়নি— এটা বুঝানোই এ সকল বর্ণনার উদ্দেশ্য। 


কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, ‘কানা ইউফলী ছাউবাহু’- তিনি কাপড়ে উকুন তালাশ করতেন। এই বর্ণনা দ্বারা দেহে উকুন হওয়া বা উকুন তালাশ করা বুঝানো হয়নি। বরং এরদ্বারা পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দেওয়াই উদ্দেশ্য। তাঁর নবুওয়াতপ্রাপ্তির সময় দুষ্ট জ্বীন ও শয়তানদের আকাশ থেকে চুরি করে কিছু শ্রবণ করার প্রবণতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এরকম কুকর্ম থেকে আকাশকে হেফাজত করা হয়েছিলো। 


হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন, শয়তান আকাশসমূহে লুকিয়ে থাকতো না, বরং ওরা আকাশে ঢুকে পড়তো এবং চুরি করে ফেরেশতাদের কথাবার্তা ও সংবাদাদি শুনে আসতো। তারপর সেগুলো ওই যাদুকরদের কানে কানে বলতো, যাদের রূহ্ শয়তানের রূহের ন্যায় অপবিত্র। শয়তানের সাথে তাদের আত্মিক সম্পর্ক ছিলো। যাদুকরেরা শয়তানের কাছ থেকে কিছু শুনে তার সঙ্গে নিজেদের কিছু মিথ্যা মিশ্রিত করে মানুষকে শোনাতো। বিপরীত দিকে চিন্তা করলে দেখা যায়, আম্বিয়া কেরামের পবিত্র রূহ ফেরেশতাদের রূহের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলো। সে কারণে তাঁদের রূহ ছিলো সত্য সংবাদ অবতরণের মাধ্যম। রসুলেপাক (ﷺ) এর জন্মের পর শয়তানদের আকাশে আরোহণ করা থেকে রুখে দেয়া হয়। 


আহলে এলেমগণ বর্ণনা করেন, হজরত ঈসা (عليه السلام) এর আবির্ভাবের সময় শয়তানকে শুধু তিন আকাশ থেকে রোখা হয়েছিলো। আর রসুলে আকরম (ﷺ) এর  বেলাদতের বরকতে সকল আকাশ থেকেই শয়তানকে বিতাড়িত করা হয়েছিলো। 


শয়তান আকাশে আরোহণ করার চেষ্টা করলে আগুনের উল্কাপি- নিক্ষেপ করে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এ উল্কাপি- কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। উল্কাপি- নিক্ষিপ্ত হয়ে কোনো শয়তানকে জ্বালিয়ে দেয়, কারও চেহারা ঝলসে দেয়, কারও অঙ্গ নষ্ট করে দেয়, আবার কখনও আকল বিলুপ্ত করে দেয়। শয়তান সম্প্রদায়ের ভূত প্রেতেরা বন জঙ্গলে বা কোনো প্রান্তরে মানুষকে রাস্তা ভুলিয়ে দেয়। রসুলে আকরম (ﷺ) নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে এরকম ঘটতো না। তাঁর নবুওয়াতপ্রাপ্তির প্রারম্ভ থেকে এ ধরনের ঘটনা পরিদৃষ্ট হয় (এ থেকে মনে হয় তারা আকাশের দিকে আরোহণ করতে পারে না বলে বিক্ষুব্ধ হয়ে এধরনের অনিষ্টকর কার্যে লিপ্ত হয় -অনুবাদক)।


হজরত মুআম্মার (رحمة الله) বর্ণনা করেন, আমি ইমাম যুহরী (رحمة الله) কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জাহেল যুগেও কি আকাশ থেকে উলকা পতিত হতো! তিনি উত্তরে বলেছিলেন, হাঁ, তবে উল্কাপতনের তীব্রতা ও কঠোরতা বৃদ্ধি পেয়েছিলো রসুলে আকরম (ﷺ) এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির সময় থেকে। 


ইবনে কুতাইবা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, রসুলেপাক (ﷺ) এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বেও উল্কাপি- দ্বারা শয়তানদেরকে বিতাড়িত করা হতো বটে, তবে তাঁর আবির্ভাবের পর এব্যাপারে অধিক কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছিলো এবং আকাশের হেফাজত নিশ্চিত করা হয়েছিলো। কেউ কেউ বর্ণনা করেন, তারকা নিক্ষেপ করলে শয়তান সরে যেতো এবং পুনরায় যথাস্থানে ফিরে আসতো। 


ইমাম বগবী (رحمة الله) বর্ণনা করেন, রসুলে আকরম (ﷺ) এর বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে এটিও একটি বৈশিষ্ট্য- শবে মেরাজে তাঁকে নেয়ার জন্য বোরাক পাঠানো হয় তখন জীন ছাড়া। এতে করে বুঝা যায়, অন্য নবীদের জন্যও বোরাক ছিলো। বিভিন্ন বর্ণনার দ্বারা এরকমই প্রতীয়মান হয়। প্রশ্ন জাগে, রসুলেপাক (ﷺ) এর জন্য পাঠানো বোরাকই কি অন্য নবীদের নিকট আসতো? নাকি তাঁদের জন্য আপনাপন মর্যাদা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন বোরাক নির্ধারিত ছিলো। মেরাজের হাদীছে এসেছে ‘বোরাকটি যখন অবাধ্য আচরণ করছিলো, তখন জিব্রাইল (عليه السلام) বলেছিলেন, স্থির হও, রসুলেপাক (ﷺ) এর মতো কেউই তোমার পিঠে আরোহণ করেননি।’ এই হাদীছ দ্বারা প্রথম মতটিরই প্রমাণ পাওয়া যায়। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


রসুলেপাক (ﷺ) কে রাতারাতি মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসাতে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর সেখান থেকে মাকামে আ’লাতে পৌঁছানো হলো এবং আয়াতে কুবরা অর্থাৎ বড় বড় নিদর্শনাদি দেখানো হলো। তাঁর দৃষ্টিপাতকে বিভ্রম থেকে হেফাজত করা হলো। যেমন কোরআন মজীদে বলা হয়েছে ‘তাঁর দৃষ্টিপাতকে বিভ্রম থেকে হেফাজত করা হলো। আরো বলা হয়েছে ‘তাঁর দৃষ্টি বক্র হয়নি, ভ্রষ্ট হয়নি।’ তাঁর নিকট সকল নবীকে উপস্থিত করা হলো। তিনি তাঁদের এবং ফেরেশতাবৃন্দের সকলের ইমামতী করলেন। বেহেশতে তাঁকে ভ্রমণ করানো হলো এবং দোযখ দেখানো হলো। তাঁকে ওই মাকাম পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলো, যেখানে কারও জ্ঞান পৌঁছতে সক্ষম হয় না। তিনি স্বচক্ষে পরওয়ারদিগারে আলমের দীদার লাভ করলেন। হকতায়ালা তাঁর জন্যই আলাপন ও দর্শন নির্ধারণ করে রেখেছিলেন, যা কোনো ফেরেশতা, নবী বা ওলীর ভাগ্যে জোটেনি। 


তাঁর বৈশিষ্ট্যগুলোর এটিও একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে, তিনি যখন কোনো স্থানে যেতেন বা চল্লিশ কদম হাঁটতেন, তখন ফেরেশতাগণ তাঁর পিছে পিছে চলতো। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বলতেন, তোমরা আমার সামনে চলো। পিছনের দিক ফেরেশতাদের জন্য ছেড়ে দাও। ফেরেশতাগণ রসুলেপাক (ﷺ) এর সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করতো। যেমন বদর ও হুনায়নের যুদ্ধে হয়েছিলো। কোরআনে করীমে তার বর্ণনা রয়েছে। তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো, তাঁকে কিতাবে আযীম প্রদান করা হয়েছিলো। অথচ তিনি ছিলেন উম্মী নবী। তিনি কারও কাছ থেকে লেখা পড়া শিখেননি, কোনো বিদ্যালয়েও যাননি। এমনকি কোনো আলেমের সংস্পর্শেও আসেননি। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, উম্মিয়াত তাঁর পবিত্র সত্তাগত বৈশিষ্ট্য ছিলো। তিনি তো উলুহিয়াতের বিশেষ প্রকাশস্থল ছিলেন। তাই তিনি কারণ ও মাধ্যমের মুখাপেক্ষী হতে পারেন না। তাঁর এটিও একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য যে, তাঁর উপর অবতীর্ণ কিতাবকে বিকৃতি ও পরিবর্তন থেকে হেফাযত করা হয়েছে। এই কিতাবে পরিবর্তন আনয়ন ও একে রূপান্তরিত করার জন্য অনেক মুলহেদ ও যিন্দীক চেষ্টা করেছে, কিন্তু কেউ সফলকাম হতে পারেনি। কোনো একটি শব্দ বা বর্ণের রূপান্তর করতেও তারা সক্ষম হয়নি। 


যেমন আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘এই কোরআনে কোনো মিথ্যা আসতে পারে না। না সম্মুখ দিয়ে। না পশ্চাৎ দিয়ে। এটা প্রশংসিত মহাজ্ঞানীর পক্ষ থেকে অবতারিত।’ পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলোতে যা ছিলো, এই কিতাবে আযীমে তা একত্রে সন্নিবেশিত হয়েছে। এই কিতাবে পূর্ববর্তী জামানার খবরাদি, অতীতের উম্মতগণের অবস্থা এবং তাদের শরীয়ত ও বিধানের সমন্বয় ঘটেছে। আসমানী কিতাবের জ্ঞানধারী লোকদের মধ্যে দু একজন লোকের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় সমস্ত জিন্দেগী অতিবাহিত করবার পর তাদের অবস্থা সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত জ্ঞান পেয়েছেন। কোরআনে করীমের সংক্ষেপণ, এর পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি ও গুণাবলী সম্পর্কে মোজেজা অধ্যায়ে সমধিক আলোকপাত করা হবে ইনশাআল্লাহ্তায়ালা। 


উম্মতের কোনো ব্যক্তি কোরআনে করীম স্মৃতিবদ্ধ করার ইচ্ছা করলে আল্লাহ্তায়ালার তরফ থেকে তা তার জন্য সহজ করে দেয়া হয়। কিন্তু অন্যান্য উম্মতের ক্ষেত্রে দেখা যায়, গোটা উম্মত থেকে একজন লোকও তাদের কিতাব স্মৃতিস্থ করতে পারেনি। অনেক লোক তো দূরের কথা। অথচ কোরআন নাযিলের পর শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিবাহিত হয়েছে, এখনও শিশু, কিশোর ও নওজওয়ানেরা অতি সহজে কোরআন মজীদ হেফজ করে যাচ্ছে। সহজসাধ্য ও সহজবোধ্য করার জন্য, মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও বান্দার উপর দয়াপরবশতার কারণে আল্লাহ্পাক কোরআন মজীদ সাত লোগাতে নাযিল করেছেন। উক্ত সাত লোগাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে মেশকাত শরীফে। 


কোরআন মজীদ এক চিরস্থায়ী ও চিরন্তন মোজেজা। আল্লাহর কুদরতের এই নিদর্শন চিরকাল থাকবে। বেহেশতী বান্দাগণ বেহেশতে কোরআন মজীদ তেলাওয়াত করবেন এবং ওই তেলাওয়াতের মাধ্যমে বেহেশতের মধ্যে তাদের মর্যাদা উত্তরোত্তর উন্নত হতে থাকবে। হাদীছ শরীফে এসেছে, ‘আল্লাহ্তায়ালা বেহেশতীদেরকে বলবেন, কোরআন পাঠ করো এবং উন্নত মাকামে আরোহণ করো।’ আখেরাতের খবর ব্যতীত নবীগণের যাবতীয় মোজেজা শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোরআন এমন এক বিস্ময়কর মোজেজা, যার হেফাজত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ্তায়ালা নিজেই গ্রহণ করেছেন। 


আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ ফরমান ‘আমি কোরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর হেফাজত করবো।’ তওরাত ও ইঞ্জীলের হেফাজতের ভার ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো নবী ও আহবারগণের উপর। তাই বিকৃতি ও রূপান্তরের পথ প্রশস্ত হয়েছিলো। কোরআন মজীদ সংরক্ষিত থাকুক তা যখন আল্লাহ্পাক কামনা করলেন, তখন সাহাবা কেরামকে এই কাজে নিয়োজিত করলেন, যাতে এ প্রশ্নের অবকাশ না থাকে যে, আল্লাহ্তায়ালাই যদি কোরআন সংরক্ষণ করবেন, তাহলে আবার তার পা-ুলিপি সংরক্ষণ করার যৌক্তিকতা কী? কোনো কোনো শাফেয়ী মতাবলম্বী বলে থাকেন, উপরোক্ত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম কোরআনের প্রত্যেক সুরার প্রথমে যুক্ত করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য এই যে, বিসমিল্লাহ্ শরীফ কোরআনের প্রত্যেক সুরার প্রারম্ভে সংযুক্ত করাটা সাহাবীগণের ঐকমত্য দ্বারা নির্ধারিত। এক সুরা থেকে অপর সুরা পৃথক করার জন্য বিসমিল্লাহ্ শরীফ নাযিল হয়েছে। কতিপয় মুতাআখখেরীন কোরআন মজীদের সুরার নামসমূহ ও আয়াতের সংখ্যা গণনাকে জায়েয মনে করে থাকেন। বিসমিল্লাহ্ সংযোজন দ্বারা কোরআন মজীদে অতিরিক্ততা আরোপিত হয় না। এব্যাপারে সন্দেহের কিছুই নেই। 


কোরআন মজীদকে হেফাজত রাখার জন্য মানুষের কালাম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর এক কালাম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটিও কোরআনের অন্যতম অলৌকিকতা। সামান্যতম অতিরিক্ততা অথবা ন্যূনতা আনয়ন করা হলে অক্ষর ও প্রকাশভঙ্গিতে বাহ্যিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতো। তখন সুস্পষ্ট হয়ে যেতো যে, এটা কোরআনের বাক্য নয়। মানুষ যে কোরআন মজীদ সহজেই হেফজ করে নিতে পারে, এটাও তার হেফাজতের অন্যতম কারণ। শান শওকতওয়ালা বুজুর্গ ব্যক্তিও কোরআনে পাকের হরফ বা নূকতাকে কমবেশী করলে ছোট বড় সবাই নির্দ্বিধায় তাঁর ভুল ধরে ফেলে। 


হকতায়ালা সুরা ফাতেহা, আয়াতুল কুরসী, আমানার রসুলু অর্থাৎ সুরা বাকারার সর্বশেষ আয়াতগুলোকে রসুলে আকরম (ﷺ) এর জন্য বিশেষভাবে নির্ধারণ করেছেন। বলা হয়েছে, এগুলো আরশের নীচে রক্ষিত ধনভা-ার স্বরূপ। অন্য কোনো নবীকে এজাতীয় আয়াত প্রদান করা হয়নি। এক্ষেত্রে রসুলে আকরম (ﷺ) এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই ভা-ারসমূহের কুঞ্জি কেবল রসুলে আকরম (ﷺ) কেই প্রদান করা হয়েছে।


আরশের কুঞ্জি দান করা হয়েছে কথাটির বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ্তায়ালা পরবর্তীকালে সাহাবা কেরামের মাধ্যমে পারস্য ও রোম সাম্রাজ্য মুসলমানগণের অধিকারে এনে দিয়েছিলেন। আর তার বাতেনী তাৎপর্য হচ্ছে- খাযায়েন বা কুঞ্জির অর্থ জগতের জিনিস বা জাতসমূহ। আল্লাহ্তায়ালা সমস্ত রিযিক রসুলে আকরম (ﷺ) এর সম্মানিত হাতে সোপর্দ করে দিয়েছেন এবং জাহের বাতেনের যাবতীয় তরবিয়ত ও শক্তি তাঁকে দান করেছেন। যেমন গায়েবের কুঞ্জি রয়েছে এলমে এলাহীর পবিত্র কুদরতী হাতে। জাতী এলমে গায়েব তিনি ব্যতীত আর কেউ জানে না। ঠিক তেমনি রিযিক ও কিসমতের ভা-ার রসুলে আকরম (ﷺ) এর হস্তমোবারকে দান করেছেন। যেমন তিনি (ﷺ) এরশাদ করেছেন ‘আমি বণ্টনকারী আর দাতা হচ্ছেন আল্লাহআতায়ালা।’ 


রসুলেপাক (ﷺ) এর বিশেষত্বের মধ্যে আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, তিনি সমগ্র মানবতার জন্য প্রেরিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি রসুলূছ ছাক্বালাইন অর্থাৎ জ্বীন ও ইনসান সকলের রসুল। কোনো কোনো ফেরেশতারও তিনি রসুল। জগতের সকল অংশের ও অঙ্গের তিনি রসুল। তাই সকলে তাঁর রেসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করেছে। গাছ ও পাথর তাঁকে সালাম করেছে। এখানে একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়, হজরত নূহ (عليه السلام) এর সময়ে সংঘটিত মহাপ্লাবনের সময় যে ক’জন ইমানদার তাঁর কিশতীতে আরোহণ করে বেঁচে গিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁদের দ্বারাইতো পৃথিবী আবাদ করা হয়েছিলো। তাঁরা ব্যতীত অন্য মানুষতো পৃথিবীতে ছিলো না। পরবর্তী সমস্ত মানুষের নবী হলে হজরত নূহ (عليه السلام) হতে পারেন, রসুলেপাক (ﷺ) সমস্ত মানুষের জন্য কেমন করে নবী হলেন? 


এই প্রশ্নের উত্তরে শায়েখ ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) বলেন, হজরত নূহ (عليه السلام) এর সাধারণ রেসালত রসুলেপাক (ﷺ) এর আবির্ভাবের মধ্যে জড়িত ছিলো না। বরং প্লাবনের ঘটনা আপেক্ষিক হিসেবে ঘটে গিয়েছিলো। যার ফলে মানুষ ইমানদার পরিচয়ে সীমিত হয়ে বেঁচে গিয়েছিলো। আমাদের নবী (ﷺ) এর রেসালতের ব্যাপকতা মৌলিক আবির্ভাব হিসেবে ছিলো। বান্দা মিসকীন (শায়েখ মুহাককেক আব্দুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী) বলেন, রসুলে আকরম (ﷺ) সমগ্র মাখলুকাতের জন্য ব্যাপকতার ভিত্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন- একথার অর্থ, সমস্ত আলম- পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত; আরব ও আজম সকলেই তাঁর রেসালতের অধীন। 


যেমন হজরত জাবের (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছ- রসুলেপাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন, সকল নবীই বিশেষ বিশেষ কাওম বা সম্প্রদায়ের প্রতি আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু আমার আবির্ভাব আরব আজম সকলের জন্য। কোরআনে করীমে স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে ‘নিশ্চয়ই আমি নূহকে তার কাওমের কাছে প্রেরণ করেছি।’ এর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, নূহ (عليه السلام) কেবল তাঁর কাওমের নবী ছিলেন। কালীলা নামক একটি কাওম (নূহ (عليه السلام) এর কাওম) তো আর ‘কাফ্ফাতুন্নাস’ (মানবম-লী) হতে পারে না, যদিও প্লাবনের পর কেবল তাঁরাই বেঁচেছিলেন। 


শায়েখ ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) এর উত্তরের তাৎপর্য এটাই। এক্ষেত্রে অপর একটি প্রশ্নও উত্থাপন করা হয়ে থাকে, হজরত নূহ (عليه السلام) তৎকালীন ইমানদার ছাড়া অন্যদেরকে ধ্বংস করার জন্য বদদোয়া করেছিলেন। ইমানদারদেরকে রক্ষা করার জন্য কিশতীতে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁর বদ্দোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিলো। নবী করীম (ﷺ) যদি সমগ্র মানবজাতির জন্য নবী হয়ে এসে থাকেন, তাহলে অপর একজন নবী অর্থাৎ নূহ (عليه السلام) এর বদদোয়া এক্ষেত্রে কেমন করে কার্যকর হলো? 


উত্তর এই, আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘আমি কোনো কাওমের নিকট রসুল প্রেরণ না করা পর্যন্ত উক্ত কাওমকে শাস্তি প্রদান করি না।’ শাফাআত বিষয়ক হাদীছে এসেছে, তিনিই প্রথম নবী (প্লাবনের পর)। এর জবাবে বলা হয়েছে, সম্ভবতঃ হজরত নূহ (عليه السلام) এর দাওয়াতে তাওহীদ তাঁর উম্মতের কাছে আগেই পৌঁছে গিয়েছিলো। কেননা তাঁর আয়ু ছিলো দীর্ঘ। প্লাবনের পূর্বেই তাঁর বয়স হয়েছিলো সাড়ে নয়শত বৎসর। এ দীর্ঘ সময়ে তাঁর উম্মত তাওহীদের দাওয়াত পেয়েছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা শিরিক ছাড়েনি। তাই আযাবের উপযোগী হয়েছিলো। শায়েখ ইবনে ওয়াকীফ বলেন, কোনো কোনো নবীর উপর তাওহীদ আম ছিলো। আর শরীয়তের হুকুম আহকাম ছিলো আনুষংগিক। তাই দেখা যায় যে, অপর কাওমের সঙ্গে তাঁরা যুদ্ধ করেছেন কেবল শিরিক করার কারণে, যেমন হজরত সুলায়মান (عليه السلام)। 


কেউ কেউ বলে থাকেন, সম্ভবত হজরত নূহ (عليه السلام) এর সময় অন্য নবীও পৃথিবীতে ছিলেন। আর তিনি জানতে পেরেছিলেন, লোকেরা ওই নবীর উপর ইমান আনছে না। তাই তিনি তাদের জন্য বদ্দোয়া করেছিলেন, চাই তারা তাঁর নিজের কাওমের লোক হোক বা অন্য কাওমের। এই উত্তরটি অবশ্য উৎকৃষ্ট তখনই, যখন এটা প্রমাণিত হবে যে, তাঁর সময়ে অন্য নবী আবির্ভূত হয়েছিলেন। কিন্তু এ ধরনের কোনো তথ্য কেবল অনুমান। প্রমাণের ক্ষেত্রে অনুমান গ্রাহ্য নয়। কেউ কেউ বলে থাকেন, আমাদের নবী (ﷺ) সকলের জন্য আম নবী- কথাটির তাৎপর্য হচ্ছে, কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর শরীয়ত বিদ্যমান থাকবে। এর মর্ম হচ্ছে, তিনি সকল মানুষের জন্য প্রেরিত। আর কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর শরীয়ত হুবহু বিদ্যমান থাকবে।


হজরত নূহ (عليه السلام) ও অন্য নবীগণের নবুওয়াত নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ছিলো, কেননা বিধান হচ্ছে, এক নবীর পর অন্য নবীর আবির্ভাব হলে পূর্বোক্ত শরীয়তের কিছু না কিছু অংশ রহিত করে দেয়া হয়ে থাকে। আর রসুলেপাক (ﷺ) এর সুউজ্জ্বল শরীয়ত কখনো রহিত হবে না। তিনি খাতেমুন্নাবিয়্যীন অর্থাৎ সর্বশেষ নবী। 


কোনো কোনো ইহুদী বলে, মোহাম্মদ (ﷺ) আরব জাহানের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাদের উক্তি ভ্রান্ত ও পরিত্যাজ্য। কোনো নবীর নবুওয়াত বা রসুলের রেসালতকে মানলে সেই নবী বা রসুলকেও সত্যবাদী বলে স্বীকার করতে হবে। কেননা রসুল কখনও মিথ্যাবাদী হন না। নবী করীম (ﷺ) দাবি করেছেন, ‘আমি সকল মানুষের জন্য নবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি।’ তাঁর দাবি সত্য। নিশ্চয় সত্য। 


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হলো, তাঁকে এক মাসের দূরত্বে রেখে দুশমনের ভয়ভীতি থেকে তাঁকে নিশ্চিন্ত করা হয়েছিলো। এক মাসের বলার কারণ হচ্ছে, রসুলেপাক (ﷺ) এর শহর আর দুশমনদের শহরের দূরত্ব এক মাসের অধিক রাস্তা ছিলো না। রসুলেপাক (ﷺ) এর এই বিশেষত্ব ছিলো সাধারণ হিসেবে। সৈন্যসামন্তহীন একাকী অবস্থাতেও তিনি ভয়ভীতি থেকে নিরাপদ থাকতেন। এই বিশেষত্ব অন্য কোনো নবীর ছিলো না। নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক ছিলো, বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁকে সাহায্য করা হয়েছিলো ফেরেশতাবৃন্দের মাধ্যমে। অন্য নবীর বেলায় এরকম হয়নি। এ সম্পর্কে বিভিন্ন যুদ্ধ, বিশেষ করে বদর যুদ্ধের অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হবে। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, গনিমতের মাল তাঁর জন্য এবং তাঁর উম্মতের জন্য হালাল করে দেয়া হয়েছে। তাঁর পূর্বে কোনো নবীর জন্য গনিমতের মাল হালাল ছিলো না। কোনো কোনো নবীর জন্য তো জেহাদ করারও অনুমতি ছিলো না, যাতে গনিমত লাভ হয়। কোনো কোনো নবীর জন্য জেহাদ করা অবশ্য হালাল ছিলো, কিন্তু গনিমতের মাল হালাল ছিলো না। তাঁরা গনিমতের মাল কোনো এক জায়গায় সঞ্চিত করতেন। আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে উক্ত মাল জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে যেতো। এটা ছিলো জিহাদ কবুল হওয়ার আলামত। কিন্তু এই উম্মতে মরহুমার জন্য গনিমতের মালকে হালাল করা হয়েছে। 


আহলে এলেমগণ বলেন, ওই সমস্ত জিনিস রসুলেপাক (ﷺ) কে দান করা হয়েছে, যা তাঁর উম্মতের বাসনা ও স্বভাবের অনুকূল। আকাঙ্খিত বস্তু লাভ আস্বাদ্য ব্যাপার। আকাঙ্খা পূরণার্থে যুদ্ধ ও শক্তি প্রয়োগ স্বাভাবিক। আর শ্রমলব্ধ বস্তু হাতছাড়া করতে চায় ক’জন?


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বগুলোর মধ্যে এটাও অন্যতম যে, তাঁর ও তাঁর উম্মতের জন্য সমস্ত ভূখ-কে সেজদার স্থান বানানো হয়েছে। তাই সকল জায়গায় নামাজ আদায় করা জায়েয। কোনো বিশেষ জায়গাকে সেজদার জন্য নির্ধারণ করা হয়নি। মাটিকে তাঁর উম্মতের জন্য পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম বানানো হয়েছে। পানি ব্যবহারের মাধ্যমে অজু গোসল করতে অক্ষম অবস্থায় মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করার বিধান করে দেয়া হয়েছে। অন্য কোনো শরীয়তে পানি ব্যবহার ব্যতীত পবিত্রতা অর্জনের উপায় ছিলো না। তেমনি অন্যান্য উম্মতের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া অন্য কোথাও নামাজ আদায় করা বৈধ ছিলো না। যেমন কানিছা বা গীর্জা, কালিছা বা প্যাগোডা ইত্যাদি। তাই উপাসনালয় থেকে দূরে বসবাসকারীরা হয়তো নামাজই আদায় করতো না। 


এই কিতাবের লেখক (শায়েখ আব্দুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী) বলেন, আমি মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া ছাড়া অন্য কোনো কিতাবে একথাটি পাইনি যে, হজরত ঈসা (عليه السلام) যমীনে চলাফেরা করতেন এবং যেস্থানে নামাজের ওয়াক্ত হতো সেস্থানেই নামাজ আদায় করে নিতেন। 


উপরের বক্তব্যটি মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ার গ্রন্থকার “দাউদী” এবং “ইবনুত্তিব ইয়ান” কিতাব থেকে সংকলন করেছেন। বোখারী শরীফের শরাহ ফতহুলবারীতে সাইয়্যেদুনা হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে হজরত জাবের (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে আছে, আম্বিয়া কেরামের মধ্য থেকে কোনো নবীই বায়তুলমুকাদ্দাসে না পৌঁছে নামাজ আদায় করতেন না। বর্ণিত বক্তব্যে কেবল নবীগণের কথা বলা হয়েছে। উম্মতের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। যাহোক, প্রসঙ্গটি মতানৈক্যমুক্ত থেকে মুক্ত নয়। ওয়াল্লাহু আ’লাম। কেউ কেউ বলে থাকেন, সমস্ত যমীন সেজদার স্থান এবং পাক হওয়া অন্য নবীর বেলায় ছিলো না। কেননা যমীন সেজদার স্থান হলেও পাক ছিলো না।

 

কেউ কেউ আবার এরকমও বলে থাকেন, একথার অর্থ হচ্ছে, যমীন যে পাক এ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ না হওয়া পর্যন্ত উক্ত জায়গায় সেজদা করা বৈধ ছিলো না। আর উম্মতে মোহাম্মদী (ﷺ) এর জন্য ওই যমীনই পাক যেখানে প্রকাশ্য নাপাকী নেই। 


মহানবী (ﷺ) এর এটাও একটি বিশেষত্ব যে, তাঁর মোজেজাসমূহ অন্যান্য আম্বিয়া কেরামের মোজেজা থেকে অধিক ছিলো। তাঁর উপর অবতীর্ণ সমগ্র কোরআন মজীদই মোজেজা। কোরআন মজীদের যে ক্ষুদ্রতম সূরা ‘ইন্না আ’ত্বইনাকাল কাউছার’ অথবা এ ধরনের ক্ষুদ্র অন্যান্য সূরা নিয়ে চিন্তা গবেষণা করা উচিত। তাহলে কোরআনের আলৌকিকত্বের পরিমাণ সম্পর্কে অনুধাবন করা যাবে। ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করা হবে মোজেজা অধ্যায়ের শেষাংশে।


নবী করীম (ﷺ) এর আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি খাতেমুল আম্বিয়া অর্থাৎ নবীগণের মধ্যে সর্বশেষ। তাঁর পর আর কোনো নবী আসবেন না। কোরআন মজীদে একথা স্পষ্ট উল্লেখ আছে। হাদীছ শরীফে উক্ত হয়েছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমার ও অন্যান্য নবীর অবস্থা ও উপমা এরকম— এক ব্যক্তি একটি মহল তৈরী করলো। নির্মাণের পর দেখা গেলো এক কোণে একটি ইট পরিমাণ জায়গা খালি। লোকেরা আনন্দ ও উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে উক্ত মহল পরিদর্শন করতে এলো। এর চারদিক ঘুরে ফিরে পর্যবেক্ষণ করলো এবং তাজ্জব হয়ে এক পর্যায়ে বললো, এই জায়গাটি খালি রাখা হলো কেনো? বুঝে নাও! আমি ওই ইট। আমি খাতেমুল আম্বিয়া। আমার আগমনের পর ওই ইমারতের নির্মাণ সমাপ্ত হয়েছে। অপূর্ণতা আর নেই। 

 

রসুলেপাক (ﷺ) আরও এরশাদ ফরমান, উত্তম চরিত্র ও সুন্দর কার‌্যাবলীর পরিপূর্ণতা বিধানার্থে আমি আবির্ভূত হয়েছি। এই হাদীছখানাও আম্বিয়া কেরামের মিশনের পরিসমাপ্তির ইঙ্গিত। সুতরাং তাঁর শরীয়ত হচ্ছে, চিরন্তন শরীয়ত যা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। আর এই শরীয়ত অন্যান্য আম্বিয়া কেরামের শরীয়তকে রহিত করেছে। কাজেই তাঁর উম্মত অন্যান্য উম্মতের চেয়ে উত্তম। তাঁর উম্মতের সংখ্যা অন্যান্য আম্বিয়া কেরামের উম্মতের চেয়ে অধিক। কোনো নবী তাঁকে পেলে তাঁর অনুসরণই করতেন।

 

মহানবী (ﷺ) এর আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে, আল্লাহ্তায়ালা তাঁকে রহমাতুল্লিল আলামীন করে প্রেরণ করেছেন। এক্ষেত্রে রহমতের অর্থ হেদায়েত ধরা হলে তাৎপর্য হবে, সকল মানুষের প্রতি তিনি প্রেরিত। সকল মানুষ হেদায়েত লাভ না করলেও। আর যদি রহমতের অর্থ হেদায়েত না নিয়ে ব্যাপকতর অর্থ গ্রহণ করা হয়, তখন তার তাৎপর্য হবে, তাঁর মহিমান্বিত অস্তিত্বের ওসীলায় সকল সৃষ্টি অস্তিত্ব পেয়েছে। তাঁর (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, আল্লাহ্তায়ালা সকল আম্বিয়া কেরামকে নাম ধরে সম্বোধন করেছেন। যেমন ইয়া আদম, ইয়া নূহ, ইয়া ইব্রাহীম, ইয়া দাউদ, ইয়া যাকারিয়্যা, ইয়া ঈসা, ইয়া ইয়াহ্ইয়া ইত্যাদি। কিন্তু রসুলে আকরম (ﷺ) কে আল্লাহ্পাক এভাবে ডাকেননি। বরং বলেছেন, ইয়া আইয়্যুহান্নাবিয়্যু, ইয়া আইয়্যুহার রসুলু, ইয়া আয়ি্যুহাল মুয্যাম্মিল এবং ইয়া আইয়্য্যুহাল মুদ্দাছ্ছির।

 

শেষোক্ত নাম দুটিতে মহব্বত ও স্নেপরায়ণতার আভাষ পাওয়া যায়। এ ধরনের সম্বোধনের আস্বাদ অনুভব করতে পারেন কেবল প্রেমিকেরাই। মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, কোনো উম্মতের জন্য তাঁর নাম ধরে ডাকা হারাম। যেমন- লোকেরা একে অপরকে ডেকে থাকে, আল্লাহ্তায়ালা এধরনের আহবান করতে বারণ করেছেন। ঘোষণা দিয়েছেন ‘তোমরা একে অপরকে যেমন আহ্বান করো, সেরকমভাবে তাঁকে (ﷺ) আহ্বান কোরো না।’ বরং তাঁকে আহ্বান করতে হলে তাঁর কোনো গুণবাচক নামের দ্বারা আহবান করতে হবে। যেমন- ইয়া হাবীবাল্লাহ্, ইয়া রসুলাল্লাহ্, ইয়া নাবিয়াল্লাহ্ ইত্যাদি। ডাক দেয়ার সময় আদব, সম্মান, বিনয় ও আজেযী এনকেছারীর সঙ্গে অনুচ্চ স্বরে ডাক দিতে হবে। 


উপরোক্ত আয়াতে কারীমার তাফসীরে হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হজরত ছাবেত ইবনে কায়েস (رضي الله عنه) সম্পর্কে কানে কম শোনা এবং উচ্চস্বরে কথা বলার অভিযোগ ছিলো। উল্লিখিত আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হলে তিনি ঘরে আবদ্ধ হয়ে রইলেন। নবী করীম (ﷺ) এর কোনো মজলিশে তিনি আর যেতেন না। 


একদিন সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী? ছাবেত কেনো আসে না? তিনি তাঁকে ডেকে এনে অনুপস্থিতির কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ্! আমি উচ্চস্বরে কথা বলি, আর এ সম্পর্কে আয়াতে কারীমা নাযিল হয়েছে। আমার আশংকা হয়, না জানি আমার আমল বাতিল হয়ে যায়। রসুল করীম (ﷺ) বললেন, তুমি তো ওই আয়াতে কারীমার উদ্দিষ্ট ব্যক্তি নও। আর আমার সাহাবীগণের কেউই সেরকম নয়। 


রসুলে আকরম (ﷺ) তাঁর আদব দেখে খুশি হয়ে বললেন, তোমার জীবনের দিনগুলো উত্তম এবং উত্তম অবস্থাতেই তুমি দুনিয়া থেকে প্রস্থান করবে। রসুলেপাক (ﷺ) তাঁকে জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়ে দিলেন। পরবর্তীতে তিনি ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে আরও অধিক আলোচনা এই কিতাবের শেষাংশে আসবে ইনশাআল্লাহ্তায়ালা। উচ্চস্বরে তাঁকে ডাক দেয়া শুধু অবৈধ ছিলো তাই নয়, তাঁর হুজরা শরীফের বাইরে থেকেও তাঁকে ডাক দেয়া অবৈধ ছিলো। এক্ষেত্রে আদব হচ্ছে, চুপচাপ অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ না তিনি স্বেচ্ছায় বাইরে আসেন। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক এই যে, হকতায়ালা শানুহু কোরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে তাঁর হাবীব (ﷺ) এর জীবনের, তাঁর শহরের এবং তাঁর জামানার কসম করেছেন। রসুলেপাক (ﷺ) এর আরেকটি বিশেষত্ব, আল্লাহ্তায়ালা ওহীর সমস্ত প্রকারের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে কালাম করেছেন। এর বিস্তারিত বর্ণনা মাবআছ অধ্যায়ে আসবে ইনশাআল্লাহ্। 


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের মধ্যে এটিও একটি অন্যতম বিশেষত্ব যে, রসুলেপাক (ﷺ) এর নিকট হজরত ইস্রাফীল (عليه السلام) এসেছিলেন। তিনি ইতোপূর্বে অন্য কোনো নবীর কাছে আসেননি। ইমাম তিবরানী হজরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) এর মাধ্যমে বর্ণনা করেন- রাসুলপাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমার নিকট ইস্রাফীল এসেছিলেন। আর কোনো নবীর কাছে তিনি আসেননি এবং এর পরেও কারও কাছে আসবেন না। একবার ইস্রাফীল (عليه السلام) এসে নবী করীম (ﷺ) এর কাছে আরয করলেন, আপনার প্রভুপালক বলে পাঠিয়েছেন, আপনি নবী এবং বান্দা হওয়া পছন্দ করেন, নাকি নবী এবং বাদশাহ্ হওয়া পছন্দ করেন। আমি জিব্রাইলের কাছে জানতে চাইলাম, কোনটা পছন্দ করবো? তিনি বললেন, আপনি বিনয়কে গ্রহণ করুন। বান্দা হওয়াকে পছন্দ করুন। 


নবী করীম (ﷺ) বললেন, আমি যদি নবী এবং বাদশাহ হওয়া পছন্দ করতাম তাহলে স্বর্ণের পাহাড় আমার অনুবর্তী হতো। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে এরকম বর্ণনা করা হয়েছে যে, হজরত ইস্রাফীল (عليه السلام) নবী করীম (ﷺ) এর নিকট একবার দু’বার আগমন করেননি, বরং তিনি নবী করীম (ﷺ) এর মজলিশে সর্বদাই উপস্থিত থাকতেন। 


‘সুফরাতুস্ সাআদাত’ কিতাবের লেখক বলেন, রসুলে আকরম (ﷺ) এর বয়স যখন সাত বৎসর তখন তাঁর দাদা হজরত আবদুল মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর 

লালনপালনের দায়িত্ব এসে পড়ে হজরত আবু তালিবের উপর। তখন আল্লাহ্তায়ালা হজরত ইস্রাফীল (عليه السلام) কে হুকুম করেন, তিনি যেনো সর্বদাই রসুলেপাক (ﷺ) এর খেদমতে হাজির থাকেন। এরপর থেকে নবী করীম (ﷺ) এর বয়স এগারো বৎসর হওয়া পর্যন্ত হজরত ইস্রাফীল (عليه السلام) তাঁর সঙ্গেই থাকতেন। 


তাঁর বয়স যখন এগারো বৎসর পূর্ণ হলো, হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) এর নিকট ফরমান হলো, রসুলেপাক (ﷺ) এর খেদমতে থাকো। নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, তিনি আদম (عليه السلام) এর সন্তানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। ইমাম মুসলিম হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) এর মাধ্যমে বর্ণনা করেন- নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি বনী আদমের সরদার হবো।’ কিয়ামতের দিন বনী আদমের সরদার হলে দুনিয়াতে তো হবেনই। কেননা সেস্থান ও সময় তো তাঁর নেতৃত্ব, ইজ্জত-সম্মান বহিঃপ্রকাশেরই স্থান। সেখানে তিনি ব্যতীত অন্য কারও তো নিশ্বাস ফেলার অবকাশ থাকবে না। ‘মালিকি ইয়াওমিদ্দীন’ এর তাফসীরের সূক্ষ্মতা সেদিকেই ইঙ্গিত করে। 


ইমাম তিরমিযী হজরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) এর মাধ্যমে বর্ণনা করেন, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি সকল বনী আদমের সরদার হবো, একথা অহংকারপ্রসূত নয়। আমার হাতেই সেদিন আল্লাহর বন্দনার পতাকা থাকবে। এটা দম্ভোক্তি নয়। হাদীছখানার তাৎপর্য এই যে, রসুলেপাক (ﷺ) আল্লাহ্তায়ালার অনেক প্রশংসা করবেন, যা আর কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহ্তায়ালার মারেফত জ্ঞান তাঁর যতটুকু ছিলো, ততটুকু আর কারও ছিলো না। আর ওই নেয়ামতের অধিকারী তিনি যতটুকু হয়েছিলেন, সেরকম আর কেউ হতে পারেননি। হামদ এর অর্থ মাহমুদিয়াতও হতে পারে। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন তাঁর যত প্রশস্তি ও প্রশংসা করা হবে এরূপ আর অন্য কারও হবে না। সেইদিন তাঁরই দিন। সেইদিনের মহিমা তাঁরই মহিমা। নবী করীম (ﷺ) এর বক্তব্যে ‘দম্ভোক্তি নয়’ কথাটি রয়েছে। এর ভাবার্থ হচ্ছে, উপর্যুক্ত বিশেষত্ব আমার অর্জিত বিশেষত্ব নয়। বরং এটা মহান আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের ফজল ও মেহেরবানি। অতএব কৃতিত্বজাত অহংকার থেকে আমার উক্তি মুক্ত। 


আবার উপরোক্ত হাদীছের মর্ম এও হতে পারে যে, আওলাদে আদমের সরদারীর যে সম্পর্ক আমার প্রতি হয়েছে, তাতে অহংকারের কিছু নেই। আল্লাহ্তায়ালার অনুগ্রহে নির্ভরশীল হয়ে অহংকার করা যায়। যেমন কোনো কোনো আহলে এলেম নবী করীম (ﷺ) এর বেলায়েতকে তাঁর নবুওয়াতের উপর মর্যাদা দিয়ে থাকেন। কোনো কোনো আহলে কালাম এই হাদীছের অর্থ এরকম করে থাকেন যে, আমার অহংকার তো প্রকৃতপক্ষে সেই একক সত্তায় লয়প্রাপ্তিতে নিহিত। অস্তিত্বের নিদর্শন ও সৃষ্টির বেষ্টনীর মধ্যে নয়। তাই বুঝি তার ব্যাপকবিদিত কথাটি এরকম, আলফাকরু ফাকরী’- দারিদ্রই আমার অহংকার। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


তিনি সমগ্র আওলাদে আদমের সরদার। সমস্ত মাখলুকাতের সরদার। আল্লাহ্তায়ালার নিকট তিনি সমস্ত আম্বিয়া মুরসালীন, মালায়েকায়ে মুকাররাবীন, সমস্ত যমীন ও আসমানওয়ালাদের চাইতে অধিকতর সম্মানিত ও মর্যাদাশালী। 


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক, আল্লাহ্তায়ালা তাঁকে এবং তাঁর ওসীলায় পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীগণের গোনাহ্ মাফ করে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কোরআন মজীদে ঘোষণা করেছেন, মা তাকাদ্দামা মিন যাম্বিকা ওয়া মা তাআখ্খারা। শায়েখ ইযযুদ্দীন আব্দুস সালাম (رحمة الله) বলেন, এটা রসুলেপাক (ﷺ) এরই একমাত্র বৈশিষ্ট্য যে, আল্লাহ্তায়ালা দুনিয়াতেই তাঁকে ক্ষমার সুসংবাদ শুনিয়েছেন। তবে তিনি একথা বলেননি যে, অন্য নবীদেরকে এরকম সুসংবাদ দেয়া হয়নি। কিন্তু এতটুকুতো জানা যায়, অন্য সকল নবী কিয়ামতের দিন নাফসী নাফসী বলবেন। 


সারকথা, এই সকল নবী যদিও ক্ষমাপ্রাপ্ত এবং নবীগণ আখেরাতের শাস্তিথেকে মুক্ত, তবুও তাঁদের ক্ষমা সম্পর্কিত মর্যাদার ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ঘোষণা আসেনি। কিয়ামত দিবসে নবী করীম (ﷺ) কে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেয়া হবে। তিনি নিজের চিন্তা ভাবনা থেকে নিঃশংক বলেই উম্মতের চিন্তায় মনোনিবেশ করবেন। উম্মতের জন্য শাফাআত, তাদের গোনাহ্ মাফ করানো এবং তাদের মর্যাদা উচ্চ করার জন্য তিনি অবিরত চেষ্টা করতে থাকবেন। তাঁর বিশেষত্বের আরেকটি দিক এই, তাঁর কারীন অর্থাৎ হামযাদ শয়তান ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। অর্থাৎ তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো। কথাটির বিস্তারিত আলোচনা আছে হজরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) এর হাদীছে। বলা হয়েছে, রসুলেপাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য মুআক্কেল নিযুক্ত করা হয়েছে। সকলের জন্যই একজন জ্বীন আর একজন ফেরেশতাকে সাথী করে দেয়া হয়েছে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসুলাল্লাহ্! আপনার বেলায়ও কি তাই? তিনি বললেন, হাঁ। কিন্তু আল্লাহ্তায়ালা তার উপর আমাকে সাহায্য করেছেন; তাই সে ইসলাম গ্রহণ করেছে। সে এখন কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছুতে প্ররোচিত করে না। কেউ কেউ বলে থাকেন, শয়তানের ইসলাম গ্রহণ করা মানে অধীন হয়ে যাওয়া। তবে এব্যাপারে অধিকাংশের মত, প্রকৃতই মুসলমান হয়ে যাওয়া। 


নবী করীম (ﷺ) এর আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, তাঁর জন্য কোনো অন্যায় বৈধ নয়। মাওয়াদী ও হেজাজী ‘মুখতাসার রাউযা’ নামক কিতাবে একথা উল্লেখ করেছেন। এক সম্প্রদায় এরকমও বলে থাকেন,ভুলও তাঁর জন্য অবৈধ। শরহে মুসলিমে ইমাম নববী থেকে উক্ত মত সম্পর্কে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ার গ্রন্থকারও মতানৈক্য উল্লেখ ব্যতিরেকে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ওই সকল বাণী যা তবলীগ, শরীয়ত ও ওহীর সাথে সম্পৃক্ত, সেগুলোর ক্ষেত্রে ভুল ভ্রান্তি না হওয়াকে বুঝানো হয়েছে এবং এর উপর এজমা সংঘটিত হয়েছে। তবে খবর বা বিজ্ঞপ্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁর ভুল ভ্রান্তিহয়েছিলো কিনা, এ সম্পর্কে কেউ কেউ মতানৈক্য করে থাকেন। তাঁরা এ সকল ক্ষেত্রে নবী করীম (ﷺ) থেকে ভুল ভ্রান্তি হওয়াকে জায়েয মনে করেছেন। তবে তাদের মতটি দুর্বল। কেননা বাস্তববিরোধী সংবাদ মিথ্যা এবং দোষণীয়। এ ব্যাপারে রসুলেপাক (ﷺ) এর ইজ্জতের প্রসঙ্গকে পাক সাফ মনে করা ওয়াজিব। একথা সন্দেহাতীতভাবে জানা আছে যে, সাহাবা কেরামের স্বভাব ছিলো, তাঁরা রসুলে আকরম (ﷺ) এর সকল কথাতেই নির্ভর করতেন। তা যে কোনো ব্যাপারে বা যে কোনো বিষয়েই হোক না কেনো। এটাই প্রখ্যাত আলেমগণের মত। নামাজে রসুলেপাক (ﷺ) এর ভুল হয়েছিলো। এই ভুলের ব্যাপারে ধারণা রাখতে হবে যে, এর মাধ্যমে শরীয়তের বিধান জারী করাই ছিলো উদ্দেশ্য। রসুলেপাক (ﷺ) এর মানবীয় অংশ এবং প্রাকৃতিক বিধানকে বিদ্যমান রাখা হয়েছিলো। তাঁর বিভিন্ন অঙ্গের কাজ এবং অঙ্গ সঞ্চালন এসব কিছু সৃষ্টি জগতের সাথেই সম্পর্কযুক্ত ছিলো। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


এখন আসা যাক ভুলের সূত্র প্রসঙ্গে। বুদ্ধিবাদিতার ভুল- যেমন বদরবন্দীদের কাছ থেকে ফিদইয়া গ্রহণের ব্যাপারটি। এক্ষেত্রে দেখা গেছে, রসুলেপাক (ﷺ) কে উক্ত বিবেচনাপ্রসূত ভুলের উপর বিদ্যমান রাখা হয়নি। বরং এ সম্পর্কে তাঁকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সমস্ত বিবেচনাপ্রসূত ভুলের ব্যাপারে একই বিধান। এখন রইলো সন্দেহের ব্যাপার। সন্দেহের বাতিক তাঁর পবিত্র জীবদ্দশায় কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। যেমন নামাজে এরকম সন্দেহের সৃষ্টি হওয়া যে, দু’রাকাত নামাজ পড়লেন, না তিন রাকাত। এধরনের সন্দেহ তাঁর ছিলোই না। তিনি এরশাদ করেছেন, সংশয় সন্দেহ আনে শয়তান। 


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি স্তর হচ্ছে, মৃতব্যক্তিকে কবরে তাঁর (ﷺ) সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। যেমন বলা হবে, ওই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার মতামত কী, যিনি তোমাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন। নবী করীম (ﷺ) সম্পর্কে প্রশ্ন করার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীছ থেকে বুঝা যায়, কবরে অন্য কোনো উম্মতকে তাদের নবী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোনো কোনো আলেম বলে থাকেন, কবরের প্রশ্নোত্তর উম্মতে মোহাম্মদী (ﷺ) এর একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। কেননা, আল্লাহ্তায়ালা তাদেরকে আলমে বরযখে গোনাহ্ থেকে পাকসাফ করে আলমে আখেরাতে উপস্থিত করবেন। নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, আল্লাহর নামে কসম করার সময় রসুলেপাক (ﷺ) এর নামেও কসম করা জায়েয। তবে অন্য কারো নামে কসম করা জায়েয নয়। যেমন, ফেরেশতার নামে বা নবীগণের নামে কসম করা অবৈধ। শায়েখ ইযযুদ্দীন ইবনে আব্দুস সালাম বলেন এ বৈধতাটি রসুলেপাক (ﷺ) এর জন্য অপরিহার্য। অন্য কেউ তাঁর মতো নয়। কথাটি মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়াতে আছে। 


মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, তাঁর পুতপবিত্রা স্ত্রীগণকে উম্মতের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘তাঁর (ﷺ) স্ত্রীগণ উম্মতের মা।’ তাঁদের এহেন মর্যাদা রসুলেপাক (ﷺ) এর মর্যাদার কারণেই। তাঁরা জান্নাতেও তাঁর স্ত্রী হিসেবে বসবাস করবেন। 


আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কালামে ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের জন্য এটা সমীচীন নয় যে, তোমরা আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দিবে, আর এটাও সমীচীন নয় যে, তাঁর প্রস্থানের পর তাঁর স্ত্রীগণকে বিবাহ করবে।’ 


রওজাতুল আহবাব কিতাবে আছে, তালহা ইবনে আব্দুল্লাহ বলেছিলেন, রসুলেপাক (ﷺ) দুনিয়া থেকে পর্দা করলে, আমি হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) কে বিয়ের প্রস্তাব দেবো। তখনই উপরোক্ত আয়াত নাযিল হয়। কোনো কোনো কিতাবে এসেছে, বদবখত ইয়াযীদ হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর প্রতি লোভ করেছিলো, তখন মুমিনগণ উপরোক্ত আয়াতে কারীমা শুনিয়ে তাকে একাজ থেকে বিরত করেছিলেন। 


আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের বিয়ে হারাম হওয়া সম্পর্কিত বিধান ওই বিবিগণের বেলায় যাঁদেরকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছিলো যে, তাঁরা ইচ্ছা করলে দুনিয়া ও তার চাকচিক্য গ্রহণ করতে পারেন। অথবা ইচ্ছা করলে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলকে গ্রহণ করতে পারেন। এরপর যারা দুনিয়া চেয়েছিলেন, তাঁরা রসুলেপাক (ﷺ) থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন।তাদেরকে বিয়ে করা হালাল হওয়া সম্পর্কে মতানৈক্য রয়েছে।


ইমামুল হারামাইন এবং ইমাম গাযযালী (رحمة الله) তাঁদের হালাল হওয়ার ব্যাপারে মত পোষণ করেছেন। কিন্তু যে বিবিগণ রসুলেপাক (ﷺ) এর ওফাত পর্যন্ত জীবিত ছিলেন তাঁরা চিরকালের জন্য অন্যের জন্য হারাম। 


এখন তাঁদেরকে দেখা উম্মতের জন্য হালাল কিনা- সে সম্পর্কে দু’টি মত রয়েছে। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ মতটি হচ্ছে, তাঁদেরকে দেখাও নিষিদ্ধ। মা কথাটির তাৎপর্য হচ্ছে, তাঁদেরকে ইয্যত-সম্মান করা এবং বিয়ে হারাম হওয়া। তাঁদের সঙ্গে নির্জনে অবস্থান, তাঁদের থেকে মীরাছ গ্রহণ- এরকম অর্থে নয়। যেমন কেউ যদি বলে, রসুলেপাক (ﷺ) এর কন্যাগণ তো মুসলমানদের জন্য ভগ্নি তুল্য, এটা ঠিক নয়। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে এরকম উদ্ধৃত হয়েছে। 


মোটকথা, আযওয়াজে মুতাহ্হারাতগণ উম্মতের জন্য হারাম হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, নবী করীম (ﷺ) এর রওজা শরীফে জীবিত থাকা। উলামায়ে কেরাম বলেন, স্বামীর মৃত্যুর কারণে স্ত্রীগণের যে ইদ্দত পালনের নিয়ম, আযওয়াজে মুতাহ্হারাতগণের বেলায় তা ছিলো না। যাদেরকে রসুলেপাক (ﷺ) এখতিয়ার দিয়ে দিয়েছিলেন এবং অঙ্গের শুভ্রতা দেখে যাঁদেরকে তিনি পৃথক করে দিয়েছিলেন, তাঁদের ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে। তন্মধ্যে একটি মত হচ্ছে, তাঁরাও উম্মতের জন্য হারাম। 


ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) দৃঢ়তার সাথে এই মতের উপর রয়েছেন। আর এক মত অনুসারে তাঁরা হারাম নয়। ইমামুল হারামাইন বলেন, তাঁরা যদি নবী করীম (ﷺ) এর সঙ্গে বাসর যাপন করে থাকেন, তাহলে হারাম। একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, আশাআছ ইবনে কায়েস হজরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) এর জামানায় রসুলেপাক (ﷺ) এর জনৈক পরিত্যক্তা বিবিকে বিয়ে করেছিলেন। এতে হজরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে সঙ্গেছার করতে চেয়েছিলেন। পরে যখন তিনি জানতে পেরেছিলেন, উক্ত বিবির সঙ্গে নবী করীম (ﷺ) এর বাসরযাপন হয়নি, তখন সঙ্গেছার করা থেকে বিরত হয়েছিলেন। 


বাসর যাপন করার পর নবী করীম (ﷺ) যে সকল বাঁদীকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে উম্মতের বিয়ে বৈধ হওয়া সম্পর্কে তিনটি মত রয়েছে। তন্মধ্যে তৃতীয় মতটি হচ্ছে, তাঁরাও উম্মতের জন্য হারাম হবেন, যদি তাঁদের পৃথক হওয়াটা নবী করীম (ﷺ) এর ওফাতের কারণে হয়ে থাকে। যেমন হজরত মারিয়া কিবতিয়া (رضي الله عنه), যিনি নবী করীম (ﷺ) এর সাহেবজাদা হজরত ইব্রাহীমের জননী ছিলেন। আর যদি কোনো বাঁদীকে নবী করীম (ﷺ) তাঁর জীবদ্দশায় বিক্রি করে দিয়ে যেয়ে থাকেন, তিনি উম্মতের জন্য হারাম হবেন না। 


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক এই ছিলো যে, পর্দার আয়াত নাযিল হওয়ার পর তাঁর আযওয়াজে মুতাহ্হারাতগণের দেহ মোবারক দেখাও হারাম হয়ে গিয়েছিলো, যদিও তা বোরকা বা চাদরে আচ্ছাদিত থাকতো। কোনো প্রয়োজনে যথা সাক্ষী ইত্যাদির কারণে চেহারা মোবারক বা হাত খোলাও হারাম ছিলো। যদিও এক্ষেত্রে অন্য মেয়েদের জন্য এরূপ করা জায়েয। 


কাযীখানের মধ্যে এরকম ফতওয়া প্রদান করা হয়েছে। তিনি স্বীয় গ্রন্থ ফতওয়ায়ে কাযীখানে উল্লেখ করেছেন, উম্মাহাতুল মুমিনীনের চেহারা এবং হাতের পর্দাও ফরজ ছিলো। এতে কোনো মতভেদ নেই। সাক্ষী দেয়ার ক্ষেত্রেও মুখ ও হাত খোলা বৈধ ছিলো না। তবে হাঁ, প্রাকৃতিক প্রয়োজনে জায়েয ছিলো। মুআত্তা গ্রন্থে এই হাদীছ দ্বারা উপরোক্ত বিধানের দলীল নেয়া হয়েছে। 


হাদীছখানা হচ্ছে এই, হজরত হাফসা বিনতে ওমর (رضي الله عنه) এর ওফাত হলে মেয়েরা তাঁর দেহ মোবারককে আচ্ছাদিত করে ফেলেছিলেন, যেনো কেউ তাঁর দেহ মোবারক দেখতে না পারে। হজরত যয়নব বিনতে জাহাশ (رضي الله عنه) হজরত হাফসা (رضي الله عنه) এর লাশ মোবারকের উপর কাপড় দিয়ে গম্বুজের মত তৈরী করে দিয়েছিলেন, যেনো দেহের গঠনও অনুমান করা না যায়। 


মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ার গ্রন্থকার শায়েখ ইবনে হাজার আসকালানী থেকে বর্ণনা করেছেন, ফতওয়ায়ে কাযীখানে যা বলা হয়েছে তা যে ফরজ, এ সম্পর্কে কোনো দলীল নেই। একথা সুসাব্যস্ত যে, আযওয়াজে মুতাহ্হারাতগণ হজ ও তাওয়াফের জন্য বাইরে আসতেন এবং সাহাবী ও তাবেয়ীগণ তাঁদের কাছ থেকে হাদীছ শুনতেন। তবে তাঁদের দেহ মোবারক কাপড় দ্বারা আচ্ছাদিত থাকতো। তবে শারীরিক কাঠামোকেও তাঁরা লুকিয়ে রাখতেন, এরকম হতো না। উম্মাহাতুল মুমিনীনের পর্দার অর্থ দেহ কাঠামো যাহের না করা, যদিও তা কাপড় দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে। একথা সর্বজনবিদিত এবং সুসাব্যস্ত। তবে এক্ষেত্রে শায়েখ ইবনে হাজার (رحمة الله) এর কথার অর্থ কী? ওইরূপ পর্দা ফরজ নয়, এটা বুঝানোই কি তাঁর উদ্দেশ্য? তাঁর বর্ণনার প্রকাশ্য অর্থ দ্বারা এরকমই বুঝা যায়। নাকি- এরূপ পর্দা প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে হবে, এরূপ বুঝানোই ছিলো উদ্দেশ্য? অথচ তাঁদের হজ ও তওয়াফের সময় দেহকাঠামো দৃষ্টিগোচর হয়েছে, এরূপ প্রমাণও পাওয়া যায়। 


হাদীছ শরীফে এসেছে, হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন, আমরা হজ পালনকালে রাস্তায় অন্য মেয়েদের সঙ্গে চলার সময় চেহারার সম্মুখ থেকে পর্দা উঠিয়ে দিতাম। আবার কোনো পুরুষ মানুষ সামনে পৌঁছে যাবে মনে হলে চেহারার উপর পর্দা ফেলে দিতাম। অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়, উম্মুল মুমিনীন হজরত সুফিয়া (رضي الله عنه) দুর্বলতায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে ভীড়ের মধ্যে তওয়াফ করতে পারছিলেন না, তখন রসুলেপাক (ﷺ) তাঁকে মানুষেরপিছনে থেকে তওয়াফ করার জন্য বলেছিলেন। সকল বর্ণনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, পর্দার ভিতরে থাকলেও তাঁদের দেহ কাঠামো আন্দাজ করা যেতো না, এরকম ছিলো না।


এখন একটি প্রশ্ন থেকে যায়, উম্মুল মুমিনীনগণ যখন হাদীছ শোনাতেন, তখন তাঁদের অবস্থা কী ছিলো? এর উত্তর হচ্ছে যে, এটাতো সম্ভব যে, তাঁরা পর্দার ভিতরে থেকেই হাদীছ বর্ণনা করতেন। হজরত আব্দুল ওয়াহেদ ইবনে আয়মন তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, একবার আমি হাদীছ শ্রবণার্থে উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর কাছে গেলাম। তখন তাঁর শরীরে কিতয়ী উড়না ছিলো। এই বর্ণনার প্রকাশ্য অর্থ দ্বারা এটাই বুঝা যায় যে, উড়নাখানা তাঁর দেহ মোবারকের উপর ছিলো এবং দেহ আচ্ছাদিত ছিলো। উম্মুল মুমিনীনগণের পর্দার অর্থ দেহকাঠামোও দেখা যাবে না- এরকম নয়। তবে ওই সকল অঙ্গ যা প্রয়োজনে মেয়েরা খুলতে পারে, যেমনহাত, মুখ- এগুলো তাঁদের জন্য খোলা হারাম ছিলো। 


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষ আরেকটি দিক এই যে, তাঁর সাহেবজাদীগণের সন্তান-সন্তুতির বংশ পরিচয় রসুলেপাক (ﷺ) এর মাধ্যমেই হয়। পিতৃ বংশের মাধ্যমে তাঁরা পরিচিত হতেন না। নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, প্রত্যেক নবীর আওলাদ তাদের পৃষ্ঠ হতে আর আমার আওলাদ আলী কা. এর পৃষ্ঠ হতে। হজরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর শান সম্পর্কে হাদীছ শরীফে এসেছে, এদ’ুজন আমার কন্যার পুত্র। হে আল্লাহ্! আমি এদেরকে ভালবাসি। তুমিও এদেরকে ভালবাসো। আর যারা এদেরকে ভালবাসে, তুমি তাদেরকেও ভালবাসো। অপর এক হাদীছে এসেছে, ‘আমার এ দু’সন্তান দুনিয়ার সুগন্ধী।’ বর্ণিত আছে, নবী করীম (ﷺ) সাইয়্যেদা হজরত ফাতেমা (رضي الله عنه) কে বলতেন, আমার ফরযন্দ দু’জনকে আমার কাছে আনো। তারপর তিনি তাঁদের দেহের সুঘ্রাণ শুঁকতেন এবং বুকের সঙ্গে তাঁদেরকে জড়িয়ে ধরতেন। 


হজরত ইমাম হাসান (رضي الله عنه) সম্পর্কে বলতেন, নিশ্চয়ই আমার এই ফরজন্দ একজন সাইয়্যেদ বা নেতা। এক হাদীছে বর্ণিত আছে, হজরত ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) এর মধ্য থেকে কোনো একজন মসজিদে নববীতে এসে নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র পৃষ্ঠদেশের উপর বসে গেলেন। তিনি (ﷺ) তখন সেজদায় ছিলেন। সেজদা থেকে মাথা উওোলন করতে বিলম্ব করলেন। নামাজান্তে সাহাবায়েকেরাম নবী করীম (ﷺ) কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! সেজদা এত দীর্ঘ করার কারণ কী? সেজদার সময় কি ওহী এসেছিলো? রসুল (ﷺ) বললেন, আমার পিঠে আমার ফরজন্দ সওয়ার হয়েছিলো। সে স্বেচ্ছায় পিঠের উপর থেকে নেমে যাওয়ার আগে মাথা ওঠানো আমার কাছে পছন্দনীয় মনে হচ্ছিলো না। হজরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (رضي الله عنه) যে নবী করীম (ﷺ) এর বংশধর হিসেবে পরিচিত, তার প্রমাণ আয়াতে মুবাহালাতে রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘আমি আমার সন্তানদেরকে ডাকবো।’


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক এই, তিনি এরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন সমস্ত সবব ও নসব বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন পার্থিব সম্পর্ক দ্বারা কোনো লাভ হবে না। কিন্তু আমার সবব ও নসব ঠিক থাকবে। নসবের অর্থ আওলাদ আর সববের অর্থ বৈবাহিক সম্পর্ক। এই পরিপ্রেক্ষিতে হজরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) হজরত ফাতেমা (رضي الله عنه) এর জনৈকা কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। উদ্দেশ্য এই ছিলো যে, এই বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে তিনি যেনো নবী করীম (ﷺ) এর সববের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারেন। এই ঘটনা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনা যথাস্থানে আসবে ইনশাআল্লাহ্। মহানবী (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, তাঁর সাহেবজাদীগণের বর্তমানে তাঁদের স্বামীগণের জন্য অন্য বিয়ে বৈধ ছিলো না। অর্থাৎ তাঁরা জীবিত আছেন, এমতাবস্থায় স্বামীগণ অন্য কোনো রমণীর পাণি গ্রহণ করবেন এবং একস্থানে সতীন হয়ে সাহেবজাদীগণ ঘর করবেন, এটা বৈধ ছিলো না। 


এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। হজরত আলী মুর্তজা (رضي الله عنه) এক সময় ইচ্ছে করলেন, আবু জাহেলের কন্যাকে বিয়ে করবেন, যিনি মুসলমান হয়ে মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরত করেছিলেন। হজরত ফাতেমা (رضي الله عنه) একথা জানতে পেরে নবী করীম (ﷺ) এর খেদমতে এসে আরয করলেন, আপনার কাওমের লোকেরা তো বলে যে, রসুলুল্লাহ তাঁর সাহেবজাদীগণের বেলায় কোনো অমঙ্গল কামনা করেন না। আলী আবু জাহেলের কন্যাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন, অথচ আপনি কিছু বলছেন না। 


একথা শুনে নবী করীম (ﷺ) মিম্বরের উপর দ-ায়মান হেেলন এবং খোতবা দিলেন। বললেন, আমি তো আবুল আসের সঙ্গে আমার কন্যার বিয়ে দিয়েছি। ইনি রসুলুল্লাহ্র জামাতা। হজরত যয়নব (رضي الله عنه) কে তাঁর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন এবং তিনি তখন ছিলেন জীবিত। রসুল (ﷺ) বললেন, এখন পর্যন্ত সে আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করে আসছে এবং আমার সন্তুষ্টির প্রতি নজর রেখেছে। ফাতেমা আমার কলীজার টুকরা। কেউ তাকে কষ্ট দিক, তাকে পরীক্ষায় ফেলুক- তা আমার পছন্দ নয়। যা ফাতেমাকে কষ্ট দেয়, তা আমাকেও কষ্ট দেয়। শুনলাম, আলী মুর্তজা নাকি আবু জাহেলের কন্যাকে বিয়ে করতে চায়। আল্লাহর কসম! রসুলের কন্যা আর আল্লাহর শত্রুর কন্যা একসঙ্গে কোনো ব্যক্তির ঘর করতে পারে না। তার উচিত হবে ফাতেমাকে তালাক দিয়ে আবু জাহেলের কন্যাকে বিয়ে করা। 


একথা শুনে হজরত আলী মুর্তজা (رضي الله عنه) ওযরখাহী পেশ করলেন এবং আবু জাহেলের কন্যাকে বিয়ে করার ইচ্ছা পরিত্যাগ করলেন। এরপর রসুলেপাক (ﷺ) হজরত আলী (رضي الله عنه) এর উপর হারাম করে দিলেন যে, হজরত ফাতেমা (رضي الله عنه) এর জীবদ্দশায় তাঁর সতীন যেনো না হয়। বললেন, হে আলী! আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং তোমাকে সাবধান করে দিতে চাই, তুমি যেনো ফাতেমাকে কষ্ট না দাও। এতে আমাকে কষ্ট দেয়া হয়। এই হাদীছখানা যদিও বিশেষভাবে হজরত ফাতেমা (رضي الله عنه) এর ব্যাপারে প্রযোজ্য, তবুও অন্যান্য সাহেবজাদীগণের বেলায়ও একই হুকুম। এছাড়া বুঝানো হয়েছে, তাদের সকলের বেলায়ই সতীন গ্রহণ করা রসুলেপাক (ﷺ) কে কষ্ট দেয়াকে অপরিহার্য করে। তাই এই বিধান সকল সাহেবজাদীর বেলায় প্রযোজ্য হয়েছে। 


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, মসজিদে নববীতে যে মেহরাব নির্মিত আছে, তার ডান বা বাম দিকে দাঁড়িয়ে চিন্তা ভাবনা করে যদি কেবলা সোজা করতে চায় তবে এধরনের চিন্তাভাবনা ও এজতেহাদ বৈধ হবে না। শায়েখুল ইসলাম আবু যুরাআ এক ব্যক্তি সম্পর্কে ফতওয়া দিয়েছিলেন- লোকটি মেহরাবে নববীর পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে অস্বীকার করেছিলো। বলেছিলো, আমি কেবলার দিক ঠিক করার জন্য এজতেহাদ করবো এবং এজতেহাদ করে সেই দিকে ফিরে নামাজ আদায় করবো। এখন সে যদি মসজিদে নববীর বর্তমান মেহরাব নবী করীম (ﷺ) এর জামানায় তৈরী হয়েছিলো বলে জেনে এজতেহাদ করার চিন্তা করে থাকে, তাহলে সে মুরতাদ হয়ে গিয়েছে। নাউযুবিল্লাহ্! আর যদি সে এরকম মনে করে যে, এই মেহরাবখানা নবী করীম (ﷺ) এর জামানায় তৈরী মেহরাব নয়, বরং পরবর্তীতে তৈরী করা হয়েছে এবং এতে পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে, তাহলে তাকে মুরতাদ হওয়া থেকে বাঁচানো যাবে। বর্ণনা পাওয়া যায় যে, নবী করীম (ﷺ) যখন মসজিদে নববীতে নামাজে দ-ায়মান হতেন, তখন তাঁর সম্মুখ থেকে সমস্ত পর্দা সরিয়ে দেয়া হতো। রসুলেপাক (ﷺ) এর দৃষ্টির সামনে খানায়ে কাবা উপস্থিত থাকতো। সেই হিসেবে কেবলার হুবহু বরাবরই মসজিদে নববীর মেহরাব তৈরী করা হয়েছিলো। 


নবী করীম (ﷺ) এর বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি যদি নবী করীম (ﷺ) কে স্বপ্নে দেখে, তবে নিঃসন্দেহে সে তাঁকেই দেখে। কেননা, শয়তান কখনও তাঁর আকৃতি ধারণ করতে পারে না। তাকে এই শক্তি দেয়া হয়নি যে, সে রসুলেপাক (ﷺ) এর আকৃতি ধারণ করে মানুষকে ধোঁকা দিবে। নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, যে আমাকে স্বপ্নে দেখলো, সে সত্যই আমাকেই দেখলো। হাদীছখানার তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ্তায়ালা শয়তানকে এমন শক্তি প্রদান করেছেন, সে তার ইচ্ছা মতো আকৃতি ধারণ করতে পারে। কিন্তু রসুলেপাক (ﷺ) এর পবিত্র আকৃতি ধারণ করার শক্তি তাকে দেয়া হয়নি। কেননা, তিনি হচ্ছেন হেদায়েতের প্রকাশস্থল। আর অপরপক্ষে শয়তান হচ্ছে গোমরাহীর প্রকাশস্থল। হেদায়েত ও গোমরাহী পরস্পর বিপরীত বস্তু। এমনকি শয়তান পরওয়ারদেগারে আলম আল্লাহ্তায়ালার আনুমানিক আকৃতি ধারণ করতে পারে এবং মানুষকে ধোঁকায় ফেলতে পারে। কেননা, আল্লাহ্তায়ালা হেদায়েত ও গোমরাহীর সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু রসুলেপাক (ﷺ) এর পবিত্র সত্তা কেবলই হেদায়েত। কোনো কোনো আলেম বলে থাকেন, এই ফযীলত বা বিশেষত্ব সকল আম্বিয়া কেরামের জন্যই। শয়তান কোনো নবীরই আকৃতি ধরতে পারে না। তবে মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবের লেখক এই ফযীলতকে কেবলর সুলেপাক (ﷺ) এর জন্যই নির্ধারণ করেছেন।

 

দর্শনের ক্ষেত্রে নবী করীম (ﷺ) কে কোনো বিশেষ আকৃতিতে দেখাও শর্ত নয়। যে কোনো ব্যক্তি তাঁকে যে কোনো সুরতে দেখে থাকুক না কেনো, নিঃসন্দেহে সে তাঁকেই দেখেছে মনে করতে হবে। অবশ্য এক্ষেত্রে কেউ কেউ সন্দেহ করেছেন। তাঁদের মতে তাঁকে বিশেষ আকৃতিতে দেখা শর্ত। কথাটির অর্থ এই যে, রসুলেপাক (ﷺ) এর পবিত্র আকৃতি যে রকম ছিলো, ঠিক সেরকমই দেখতে হবে। কেউ কেউ আবার এ বিষযটিকে আরও কঠিন করে দিয়েছেন। তাঁদের মত হচ্ছে, রসুলেপাক (ﷺ) দুনিয়া থেকে পর্দা করার সময় যেরকম ছিলেন, হুবহু সেরকমই দেখতে হবে। এমনকি দুনিয়া থেকে বিদায়কালে যে কয়খানা দাড়ি মোবারক শাদা হয়ে গিয়েছিলো, তার সঠিক হিসেবও দর্শনের শর্তের অন্তর্ভূত করেছেন। ওই সময় তাঁর দাড়ি মোবারকের চুল বিশ খানার অধিক শুভ্র ছিলো না। তাঁকে ওইরকমই দেখতে হবে। তাঁরা বলে থাকেন, একবার স্বপ্নবিশারদ ইবনে শীরিনের নিকট এক ব্যক্তি রসুল (ﷺ) এর দীদার সম্পর্কে বললো। তিনি বললেন, তাঁকে কী আকৃতিতে দেখেছো? রসুলেপাক (ﷺ) এর আকৃতি যেরকম ছিলো, ওই রকম বলতে না পারলে তিনি বলতেন, রসুলেপাক (ﷺ) এর জিয়ারত তোমার হয়নি। আলেমগণ বলেন, এই হাদীছের কোনো সহীহ্ সনদ নেই। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


একবার এক লোক হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه)কে বললো, আমি স্বপ্নে রসুলেপাক (ﷺ) কে দেখেছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আকৃতিতে দেখেছো? লোকটি বললো, সাইয়্যেদুনা হজরত ইমাম হাসান (رضي الله عنه) এর আকৃতিতে দেখেছি। হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বললেন, তুমি সত্যই দেখেছো। এ সম্পর্কে কোনো কোনো আলেম আবার এরকমও বলে থাকেন, তাঁকে বিশেষ আকৃতিতে এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্যের সাথে দেখা তাঁর হাকীকতের এদরাক। আর অন্য আকৃতিতে দেখা তাঁর মেছালের এদরাক। যাই হোক এক্ষেত্রে সঠিক কথা এটাই, যার উপর মোহাদ্দেছীনে কেরাম একমত হয়েছেন— যে কোনো সুরতেই দেখা হোক না কেনো, প্রকৃতপক্ষে তা রসুলেপাক (ﷺ) এরই দীদার। তবে বিশেষ সুরতে দেখা অধিকতর পূর্ণ ও উত্তম। দর্শনে আকৃতির তারতম্য, চেতনার দর্পনের তারতম্য অনুসারে হয়ে থাকে। যার চেতনা ইসলামের নূরে যতটুকু আলোকিত, তার দর্শনও সেই পরিমাণ পূর্ণ। মুসলিম শরীফে আছে, যে আমাকে স্বপ্নে দেখলো সে অচিরেই আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখবে। কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে এই হাদীছ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ১. উক্ত দর্শনের অর্থ হবে আখেরাতের দর্শন। এ সম্পর্কে অবশ্য উলামায়েকেরাম বলে থাকেন, আখেরাতে তো সকল উম্মতই তাঁর দীদারে ধন্য হবে। তাহলে এ কথার বিশেষত্ব কোথায়? উলামায়ে কেরাম বলে থাকেন, উক্ত দর্শন দ্বারা এক বিশেষ ধরনের দর্শন এবং বিশেষ রকমের নৈকট্য বুঝতে হবে। ব্যাপারটি এরকম হতে পারে, গোনাহ্গারেরা পার্থিব আকর্ষণে লিপ্ত হয়ে দুর্ভাগ্যের কারণে দর্শন থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু তাঁকে স্বপ্নে দর্শনকারীরা ব্যর্থতা থেকে সুরক্ষিত থাকবে। ২. অপর এক দৃষ্টিকোণ থেকে উল্লিখিত হাদীছের ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়— জাগ্রত অবস্থায় দর্শন লাভের অর্থ, স্বপ্নে দর্শিত বস্তু ও তার ব্যাখ্যা সঠিক হিসেবে চিহ্নিত হওয়া। এই ব্যাখ্যাটি অবশ্য রসুলেপাক (ﷺ) এর জামানার লোকদের জন্য। এই হাদীসে সুসংবাদ দেয়া হচ্ছে, যে ব্যক্তি তাঁকে স্বপ্নে দেখবে, অচিরেই সে তাঁর সাহচর্য লাভে ধন্য হবে। এই ব্যাখ্যাটি স্পষ্ট। অন্যান্য বর্ণনাতেও এরকম বুঝা যায়। যেমন একটি বর্ণনা— এক ব্যক্তি রসুল (ﷺ) এর কাছে নিবেদন করলো, আমার পিতা অতি বৃদ্ধ। তাই রসুলেপাক (ﷺ) এর দরবারে উপস্থিত হতে পারছেন না। তবে তিনি স্বপ্নে আপনাকে দেখেছেন। তখন নবী করীম (ﷺ) বলেছিলেন, যে আমাকে স্বপ্নে দেখেছে, অচিরেই সে জাগ্রতাবস্থায় আমাকে দেখতে পাবে। হাদীছের মর্মার্থ এও হতে পারে যে, আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং সে পথের পথিকদের জন্য এটি একটি সুসংবাদ। তাঁরা পথিকদের স্বপ্ন দর্শনের মাধ্যমে স্তরে স্তরে উন্নতি সাধন করে এক পর্যায়ে উক্ত নেয়ামত লাভে ধন্য হতে পারবেন এবং জাগ্রত অবস্থায় তাঁকে দর্শন করার সৌভাগ্যও লাভ করতে পারবেন। কিন্তু রসুলেপাক (ﷺ) এর দুনিয়া থেকে প্রস্থানের পর জাগ্রত অবস্থায় তাঁর দর্শন লাভ সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম মতানৈক্য করে থাকেন। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবের লেখক তাঁর শায়েখ থেকে বর্ণনা করেছেন- তিনি এরকম বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম বা তৎপরবর্তীগণের মধ্যে এমন কেউ নেই, যিনি নবী করীম (ﷺ) এর ওফাতের পর জাগ্রত অবস্থায় তাঁকে দেখেছেন। আর একথাতো খুব ভালোভাবেই প্রমাণিত আছে যে, নবী করীম (ﷺ) এর ইন্তেকালের পর হজরত ফাতেমা (رضي الله عنه) বিরহব্যথায় জর্জরিত ছিলেন। সহীভাবে প্রমাণিত যে, বিরহযন্ত্রণায় 

তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে তিনি নবী করীম (ﷺ) এর ওফাতের ছ’মাস পর দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তাঁর আবাস তো ছিলো নবী করীম (ﷺ) এর রওজা শরীফের পাশেই। কিন্তু এরকম বর্ণনা কেউ করেননি যে, তিনি জাগ্রত অবস্থায় নবী করীম (ﷺ)কে দেখেছেন। কিন্তু কোনো কোনো সালেহীন নবী করীম (ﷺ) এর দর্শন সম্পর্কে স্ব স্ব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।


যেমন হজরত বাযরীর ‘তাওছীকু আরবাসুল ইমানের মধ্যে’, ইবনে আবী হুমায়রা তাঁর কিতাব বাহজাতুন্নফুস এর মধ্যে, আফীফ ইয়াফেয়ী তাঁর রওজাতুল বাইয়্যাহীন এবং তাঁর অন্যান্য রচনায়। শায়েখ সফিউদ্দীন ইবনুল মনসুর তাঁর পুস্তিকায় এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ায় ইবনে আবীহুমায়রার উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, নবী করীম (ﷺ) এর দর্শন সম্পর্কে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীগণের একটি দল আলোচনা করেছেন। তাঁরা সকলেই জাগ্রত দর্শনকে সমর্থন করেন। বলেন, আমরা রসুল (ﷺ) কে স্বপ্নে দেখেছি এবং পরে জাগ্রত অবস্থায় দেখেছি। তাঁরা পেরেশানী ও বিপদাপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় সম্পর্কেও নবী করীম (ﷺ) থেকে সমাধান লাভ করেছেন বলে বর্ণনা করেছেন। রসুল (ﷺ) তাঁদেরকে মুক্তিলাভের উপায় বলে দিয়েছেন। আউলিয়ার কারামত অস্বীকারকারীদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। কেননা, এ সম্পর্কিত সকল বর্ণনাই তাদের কাছে মিথ্যা। আর আউলিয়ার কারামত বিশ্বাসীরা এটাকে বিশ্বাস করবেই। শেষ কথা এই যে, জাগ্রত অবস্থায় তাঁকে দর্শন করা ওলীগণের কারামতেরই পর্যায়ভুক্ত। কেননা আউলিয়া কেরামের নিকট এ জাতীয় অস্বাভাবিক ব্যাপার সংঘটিত হওয়া বিচিত্র নয়। এ ব্যাপারে অন্য কারও অধিকার নেই। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ার গ্রন্থকার বর্ণনা করেন, শায়েখ আবুল মনসুর তাঁর পুস্তিকায় বলেছেন, আহলে কামালগণ বয়ান করেছেন, কোনো এক সময় শায়েখ আবুল আব্বাস কুসতুলানী রসুল করীম (ﷺ) এর দরবারে হাজির হলে তিনি এরশাদ করলেন, আল্লাহ্তায়ালা তোমার হস্ত ধরেছেন হে আহমদ! শায়েখ আবু মসউদ থেকে মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ার গ্রন্থকার বর্ণনা করেছেন, আমি তোমাদের শায়েখ আবুল আব্বাস এবং ওই জামানার কতিপয় মাশায়েখ ও সালেহ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। অতঃপর সকল দিক থেকে মনযোগ ছিন্ন করে আমি অন্য ব্যাপারে মশগুল হয়ে গেলাম। আমার তখন এনকেশাফ (আত্মিক বিকাশ) শুরু হয়ে গেলো। আমি শায়েখকে নবী করীম (ﷺ) এর দরবারে দেখলাম। সেখানে রসুলেপাক (ﷺ) সর্বশেষে আমার সঙ্গে মুসাফেহা করলেন। 


হজরত শায়েখ আবুল আব্বাস ছাবা বলেন, একদা আমি নবী পাক (ﷺ) এর দরবারে হাজির হলাম। দেখলাম, নবী করীম (ﷺ) আউলিয়া কেরামের নামে হুকুম ও ফরমান রচনা করছেন। আমার এক ভাইয়ের (যার নাম ছিলো মোহাম্মদ) নামেও তিনি একটি ফরমান রচনা করলেন। আমি আরজ করলাম, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমার নামে তো কোনো ফরমান রচনা করলেন না। রসুলেপাক (ﷺ) এরশাদ করলেন, তোমার অন্য মাকাম রয়েছে। ইমাম হুজ্জাতুল ইসলাম স্বীয় গ্রন্থ আলমুন্তাদ মিনাদ্দালাল এ উল্লেখ করেছেন, আরবাবে কুলুব ব্যক্তিরা জাগ্রত অবস্থায়ই ফেরেশতা এবং আম্বিয়া কেরামের রূহসমূহ দেখে থাকেন, তাঁদের কণ্ঠস্বর শুনতে পান। তাঁদের কাছ থেকে নূর অর্জন করতে পারেন এবং বিভিন্নভাবে ফায়দা লাভ করতে সক্ষম হন। সাইয়্যেদ সফীউদ্দীন ও সাইয়্যেদ আফীফউদ্দীনের পিতা হজরত সাইয়্যেদ নূরুদ্দীন আল হাই থেকে বর্ণনা করা হয়েছে- তিনি বর্ণনা করেছেন, জিয়ারতের সময় কখনো কখনো তিনি নবী করীম (ﷺ) এর রওজা শরীফ থেকে সালামের জবাব শুনতে পেতেন। তিনি সালামের জবাব দিতেন এভাবে, হে আমার সন্তান তোমার উপর সালাম। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ায় এরকম অনেক কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। 


বর্ণিত আছে, শায়েখ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী কুঃ আওয়ারেফুল মাআরেফ কিতাবে গাউছুল আজম শায়েখ আব্দুল কাদের জীলানী (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (ﷺ) বিয়ে করার হুকুম দান পর্যন্ত আমি বিয়ে করার চিন্তাই করিনি। এই কিতাবের লেখক বান্দা মিসকীন (শায়েখ আব্দুল হক ইবনে সাইফুদ্দীন মোহাদ্দেছে দেহলভী) শায়েখ আবুল হাসান আলী ইবনে ইউসুফ শাফেয়ী (رحمة الله) প্রণীত ‘বাহজাতুল আসরার’ এ উল্লেখ করেছেন, শায়েখ আবুল হাসান আলী এবং শায়েখ আব্দুল কাদের জীলানী (رحمة الله) এর মধ্যে মাত্র দু’টি ওয়াসেতা (স্তর) রয়েছে। তিনি শায়েখ আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে শায়েখ আব্দুল্লাহ আযহারী হুসাইনী (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেছেন, আমি হজরত শায়েখ সৈয়দ মুহিউদ্দীন আব্দুল কাদের জীলানী (رحمة الله) এর মজলিশে ছিলাম। ওই সময় তাঁর মজলিশে দশ হাজার লোক উপস্থিত ছিলো। হজরত শায়েখ আলী ইবনে হাইতী গাউছুল আজমের সামনে উপবিষ্ট ছিলেন। তাঁর বসার স্থান এটাই নির্ধারিত ছিলো। হঠাৎ তিনি তন্দ্রাভিভূত হলেন। এমন সময় গাউছুল আজম সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, নীরব হয়ে যাও। সবাই নীরব হলো। ওই সময় তাঁদের নিঃশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ ছিলো না। অতঃপর হজরত গাউছুল আজম মিম্বর থেকে অবতরণ করলেন এবং হজরত শায়েখ হাইতীর সামনে অত্যন্ত আদবের সাথে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে অত্যন্তনিগুঢ়ভাবে তাঁর দিকে লক্ষ্য করতে লাগলেন। শায়েখ আলী হাইতী যখন সচেতন হলেন, তখন গাউছুল আজম (رحمة الله) বললেন, হে শায়েখ! স্বপ্নে কি তুমি রসুল (ﷺ) এর দীদার লাভ করেছো? তিনি বললেন, হাঁ। তখন গাউছুল আজম (رحمة الله) বললেন, এ জন্যইতো আমি আদব সম্মান রক্ষা করেছি,তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস  করলেন,রাসুল (ﷺ) তোমাকে কী নসিহত করলেন? তিনি বললেন, আমাকে আপনার খেদমতে হাজির থাকতে বলেছেন। ওই সময় শায়েখ আলী হাইতী (رحمة الله) বলেছিলেন, আমি যা কিছু স্বপ্নে দেখেছি, হজরত গাউছুল আজম (رحمة الله) তা জাগ্রত অবস্থায়ই দেখে নিয়েছেন। সেদিন ওই মজলিশের সাতজন লোক আল্লাহ্তায়ালার ভয়ে দুনিয়া হতে চিরবিদায় নিয়েছিলো। রসুলেপাক (ﷺ) কে চাক্ষুষ দেখা সম্পর্কিত মাশায়েখগণের উক্তি বর্ণনা করার পর মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ার গ্রন্থকার শায়েখ বদরুদ্দীন হাসান ইবনে আহরাল থেকে উদ্ধৃতি বর্ণনা করেছেন, আউলিয়া কেরাম জাগ্রত অবস্থায় নবী করীম (ﷺ) কে দর্শন করেছেন, একথা মুতাওয়াতিরের স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে প্রমাণিত। আর মুতাওয়াতিরের মাধ্যমে এমন আস্থার সৃষ্টি হয়, যাতে দ্বিধা সন্দেহের অবকাশ আর থাকে না। দর্শন সংঘটিত হওয়ার সময় আউলিয়া কেরামের অনুভূতি বিলুপ্ত হয় এবং তাঁদের মধ্যে এমন এক হালের আবির্ভাব হয়, যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। দর্শনকালে আউলিয়া কেরামের মর্তবা ও হালের তারতম্য হয়ে থাকে। কখনও তাঁরা স্বপ্নে দর্শন করেন। আবার কখনও চেতনা বিলুপ্তিতে নিমজ্জিত হয়ে দর্শন লাভ করে থাকেন, যাকে চাক্ষুষ দর্শন মনে করা হয়। আবার কখনও এমন হয় যে, নিজের খেয়াল ও ধারণার আকৃতিকে দেখে থাকেন এবং মনে করেন, নিদ্রা ও জাগরণের মধ্যবর্তী অবস্থা যাকে তন্দ্রা বলা হয়, এ অবস্থায় রসুলেপাক (ﷺ) এর দর্শন হয়ে থাকে। তবে হাঁ, জাগ্রতহৃদয়, যারা সর্বদাই মোরাকাবা ও তাওয়াজ্জোহের মধ্যে আছেন, প্রবৃত্তির মলিনতা থেকে যাঁরা পূর্ণপবিত্র, দুনিয়া ও দুনিয়াদার থেকে সম্পর্কছিন্নকারী, যাঁরা সর্বদাই রসুলেপাক (ﷺ) এর প্রেমে মত্ত, ধনসম্পদ ও সন্তান- সন্তুতির প্রতি নির্লিপ্ত, তাঁরা নবী করীম (ﷺ) এর দীদার এমনভাবে পেয়ে থাকেন, যেমন পেয়ে থাকতেন সাইয়্যেদুনা গাউছুল আজম হজরত আব্দুল কাদের জিলানী (رحمة الله)। তিনি দিব্য জগতেই রসুলেপাক (ﷺ) এর জিয়ারত করতেন। তাঁর এমন ক্ষমতা ছিলো, যেখানে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না, সেখানে পরাক্রমপ্রভাবিত অবস্থায় কথা বলতে পারতেন। হজরত শায়েখ আবুল আব্বাস মরসী (رحمة الله) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, এক মুহূর্তের জন্য আমার দর্শন থেকে সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) এর সৌন্দর্যরাজি লুপ্ত হলে আমি নিজেকে মুসলমান মনে করতে পারবো না। এই অবস্থা রসুলেপাক (ﷺ) এর সুন্নত, আদব, সুলুক ও তরিকায় অবিরত মুশাহাদা ও হুজুরীর পর্যায়ভুক্ত। বিষয়টি রসুলে আকরম (ﷺ) এর ওই এরশাদের পর্যায়ভুক্ত, যেখানে তিনি বলেছেন, আল এহসানু আন তা’বুদাল্লাহ্ কাআন্নাকা তারাহু- অর্থাৎ এহসান অর্থ এই যে, তুমি আল্লাহ্তায়ালার ইবাদত এরকম অবস্থায় করবে, যেনো তুমি তাঁকে দেখছো। শায়েখ আবুল আব্বাস মরসীর উপরোক্ত বক্তব্যের পর বদরে এহলাল (رحمة الله) বলেছেন, মাশায়েখে কেরামের বক্তব্যগুলোকে বৈধ বলতে হলে এই অর্থ গ্রহণ করতে হবে যে, গাফলত ও নিসইয়ানের পর্দা দ্বারা রসুলেপাক (ﷺ) আচ্ছাদিত নন। অবিরত আমল, মোরাকাবা ও হুজুরীর দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর দর্শন হতে পারে। স্বীয় চোখের দৃষ্টি থেকে রসুলেপাক (ﷺ) পর্দাচ্ছাদিত নন— এরকম অর্থ গ্রহণ করেননি। কেননা এটা হওয়া অসম্ভব। ওয়াল্লাহু আলাম। 


বান্দা মিসকীন (শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দেছে দেহলভী) বলেন, অবিরত মোরাকাবা, নবী করীম (ﷺ) এর প্রতি মহব্বতের উচ্ছ্বাস ও উপলব্ধি, তাঁর আকৃতি দর্শনের নিরবচ্ছিন্ন চিন্তা তালেব ও সালেকগণের একটি মর্তবা, যার মাধ্যমে সে লাভবান হয়ে থাকে। এই আলোচনাটি চলছে আকৃতি ও মেছালের দর্শনের উপর। যেমন স্বপ্নের মাধ্যমে তাঁর আকৃতি ও মেছাল দর্শন বৈধ। স্বপ্নে যেমন কোনো ব্যক্তির সামনে রসুলেপাক (ﷺ) এর পবিত্র জাওহার (মূলসত্তা) আকৃতিবান হয়ে উদ্ভাসিত হতে পারে। এটা সম্ভব। কেননা শয়তান তাঁর আকৃতি ধারণ করতে অক্ষম। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এরকম অবস্থা জাগরণকালেও সম্ভব। যেমন ঘুমন্ত ব্যক্তি স্বপ্নে দেখে, আর জাগ্রত ব্যক্তি খোলা চোখে দেখে। দেখার কাজটি উভয়ই করতে পারে। বাহজাতুল আসরার কিতাবের বর্ণনা দ্বারা এটাই পরিষ্কার হয়েছে। 


এক হাদীছে বর্ণনা এসেছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমি নবী মুসাকে কয়েক হাজার বনী ইসরাইলের সঙ্গে একসাথে এহরাম বেঁধে তালবিয়া পড়তে পড়তে হজ আদায় করতে দেখেছি। এই অবস্থাটিকে স্বপ্ন আখ্যা দেয়া বাস্তবতার পরিপন্থী। মানবীয় আকৃতিতে ফেরেশতাদের আবির্ভাব সূক্ষ্ম জগতের ব্যাপার। এই প্রেক্ষিতে দিব্যচোখে দর্শন দ্বারা এটা জরুরী হয় না যে, নবী করীম (ﷺ) রওজা শরীফ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। আবার এ দর্শন দ্বারা দর্শনকারীকে পরিভাষাগত সাহাবী আখ্যা দেয়াও যাবে না। তবে হাঁ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁকে অবশ্যই সাহাবীর হুকুমের অন্তর্ভূত করা যাবে। জিকিরের প্রাবল্যের কারণে অনুভূতির অন্তর্ধানের ফলে যদি দর্শন ঘটে এবং যদি নিদ্রা বা স্বপ্নকে সাব্যস্ত নাও করা হয়, তবুও এতে বাধার কোনো কারণ নেই। কেননা মস্তিষ্কে আর্দ্রতার প্রাবল্যের ফলে অনুভূতির যে নির্লিপ্ততা ঘটে তাতেই নিদ্রার সৃষ্টি। আর জাগ্রত অবস্থায় অনুভূতির অন্তর্ধান জিকির-শুহুদের প্রাবল্যের কারণে হয়ে থাকে। আর এ অন্তর্ধানটি জাগ্রত অবস্থায় হয়ে থাকে। নিদ্রিত অবস্থায় নয়। এই আলোচনার সারকথা হচ্ছে, তিরোধানের পর রসুলেপাক (ﷺ) এর দর্শন লাভ করলে সে দর্শন হবে মেছালী বা উদাহরণিক দর্শন। স্বপ্নের মাধ্যমে যেমন দর্শন হয়ে থাকে, তেমনি জাগ্রত অবস্থায়ও হতে পারে। আর মদীনা শরীফের রওজায় তাঁর যে পবিত্র সত্তা বিদ্যমান, তাই প্রতিবিম্বিত হয়ে থাকে। একই সময়ে বিভিন্ন স্থাানে প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হওয়া সম্ভব। সাধারণ ব্যক্তিরা স্বপ্নে পেয়ে থাকেন, আর বিশেষ ব্যক্তিরা জাগ্রত অবস্থাায় লাভ করে ধন্য হন। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ার গ্রন্থ’কার তাঁর নিজস্ব মত এরকম ব্যক্ত করেছেন যে, ওলীগণের কারামত যারা বিশ্বাস করে, তাদের একথা বিশ্বাস করা স্বাভাবিক। আউলিয়া কেরামের শান হচ্ছে, যমীন ও আসমানের সমস্ত ব¯‘ই তাঁদের কাছে উন্মোচিত হতে পারেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। রসুলে পাক (ﷺ) এর দীদারও এই পর্যায়ের। ইমাম গায্যালী (رحمة الله) বলেছেন, সাধারণের স্বপ্নদৃষ্ট বিষয় বিশেষ ব্যক্তিগণ জাগ্রত অবস্থাায় দেখে থাকেন। সাধারণজন যা কষ্টপ্রয়াসের দ্বারা হাসিল করে বিশেষ ব্যক্তিরা তা আল্লাহ্ প্রদত্ত দান হিসেবে পেয়ে থাকেন। ওয়াল্লাহু ইয়াকুলুল হক ওয়া ইয়াহ্দিস্সাবীল (আল্লাহ সত্য বলেন এবং তিনিই রাস্তা দেখান)। 


সতর্কতাঃ স্বপ্নে রসুলেপাক (ﷺ) এর দীদার লাভে ধন্য হওয়াটা যদিও সুসাব্যস্তও প্রমাণিত, তথাপি উলামা কেরাম বলেন, শরীয়তের বিধান সংক্রান্ত ব্যাপারে যদি কেউ স্বপ্নের মাধ্যমে কিছু হাসিল করে, তবে তার উপর আমল করা যাবে না। তবে এটা এই পরিপ্রেক্ষিতে নয় যে, উক্ত র“ইয়াত বা দর্শনের মধ্যে কোনোরকম সন্দেহ রয়েছে। বরং তার কারণ, নিদ্রাবিভোরতায় আচ্ছন্ন হলে ধারণ ও সংরক্ষণ ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। এসম্পর্কে উলামা কেরামের মত এটাই। আহকাম বা বিধান কথাটির তাৎপর্য হচ্ছে, শরীয়তের বিধানের পরিপন্থী কোনো হুকুম বা বিধান লাভ করা। এরকম কিছু হলে তার উপর কিছুতেই আমল করা যাবে না। বিধান সম্পর্কিত ব্যাপার ছাড়া যদি কিছু হাসিল হয়, তা মান্য করা ও আমল করার ব্যাপারে কারও মতবিরোধ নেই। কেননা, এরকম দেখা যায় যে, অনেক হাদীছবেত্তা বর্ণিত হাদীছের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন স্বয়ং নবী করীম (ﷺ)। এরকমও দেখা গেছে যে, হাদীছবেত্তাগণ হাদীছের ব্যাপারে রসুলেপাক (ﷺ) এর নিকট নিবেদন করেছেন, এই হাদীছ আপনার কাছ থেকে এসেছে কিনা? জওয়াবে তিনি হাঁ বা না বলেছেন। জাগ্রত অবস্থাায় দর্শন লাভের দ্বারাও কোনো কোনো মাশায়েখ এলেমের নিঃসংশয়তা হাসিলকরেছেন। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 




© | সেনানী এপ্স |

Top