ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও ক্ষমাগুণ


এখন যে আলোচনার অবতারণা করা হচ্ছে, তা হুজুর আকরাম (ﷺ) এর ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও ক্ষমার মহান গুণাবলী সম্পর্কে। এসব গুণাবলী নবুওয়াতের মহান গুণাবলীর অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর শক্তি ব্যতীত নবুওয়াতের ভার বহন করা সম্ভব নয়। জগতে যারা নবী রাসূল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তারা সকলেই ধৈযের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে গেছেন। এই মর্মে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ফরমান, আপনার পূর্বে সকল রসূলগণকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে। যে মিথ্যারােপ তাদের প্রতি করা হয়েছে এবং যে যন্ত্রণা তাদেরকে দেয়া হয়েছে তারা তার উপর ধৈর্য ধারণ করেছেন।


আল্লাহপাক তাঁর হাবীব (ﷺ) কে ধৈর্য ধারণ করার জন্য এরশাদ "ফরমান আপনি উলুল আযম পয়গম্বর গণের মতাে ধৈর্য ধারণ করুন।" আল্লাহতায়ালা আরও এরশাদ করেন- “আপনি তাদেরকে মাফ করে দিন, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন। ধৈর্যের মহা গুণটি যাবতীয় আনুগত্য ও ইবাদতের হৃদপিণ্ড তোলা এবং সমস্ত কল্যাণ ও সৌন্দর্যের উৎস। কেননা নেকী অর্জনের ক্ষেত্রে বাধাবিপত্তি আসবেই। সে সময় যদি ধৈর্য ধারণ না করা যায় তবে তা সফলতা লাভ করেনা। এ পরিপ্রেক্ষিতে ছবির’ গুণটিকে পূর্ণ ঈমান বলা হয়েছে। আবার কখনও কখনও ছবির গুণটিকে নিসফে ঈমান বা ঈমানের অর্ধেক বলা হয়েছে। অই সমস্ত ক্ষেত্রে ছবরের উদ্দেশ্য হবে গােনাহর কাজ পরিহার করা এবং গুনাহ থেকে আত্মরক্ষা করে চলা। কেননা ঈমানের চাহিদার অর্ধাংশ গােনাহুবর্জন আর বাকি অর্ধাংশ আনুগত্য ও ইবাদত বাস্তবায়ন। এস্থানে যে ছবর বা ধৈর্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার অর্থ মানুষের পক্ষ থেকে যে দুঃখ-যন্ত্রণা, যুলুম-অত্যাচার আসবে তা বরদাশত্ করে নেয়া। সাইয়্যেদুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) এর উপর যে যন্ত্রণা ও নির্যাতন এসেছে, তা অন্যান্য নবী রসূলগণের তুলনায় অনেক বেশী ও অধিকতর কঠিন ছিলাে। এ সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ) স্বয়ং বর্ণনা করেছেন, আমাকে যে কষ্ট দেয়া হয়েছে, ইতিপূর্বে আর কোনাে নবীকে এরূপ কষ্ট দেয়া হয়নি। আর এরকম নির্যাতন ভােগ করার কারণ এই যে, তিনি উম্মতের ইসলাম গ্রহণ করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী আগ্রহী ছিলেন। অন্যান্য নবীগণের নির্যাতনের তুলনায় তার উপর নির্যাতন বেশি হয়েছে।


বর্ণিত আছে, আমর বিল মা'রুফ সম্পর্কে যখন আয়াত নাযিল হলাে এবং জাহেল কে ক্ষমা করার ব্যাপারে যখন হুকুম আরোপিত হলো, তখন হুজুর আকরাম (ﷺ) হজরত জিবরাইল (আ) এর কাছে এর ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করলেন। হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) বললেন, আমি যতক্ষণ রববুল ইজ্জতের কাছ থেকে এ সম্পর্কে জানতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে এ সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে না। অতঃপর হযরত জিবরাইল (عليه السلام) আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে জেনে নিয়ে বললেন, আল্লাহ তায়ালা এরকম এরশাদ করেছেন, যে আপনা থেকে দূরবর্তী হবে আপনি তার নিকটবর্তী হবেন। আপনাকে যে বঞ্চিত করবে আপনি তাকে দান করবেন, আপনার উপর যে অত্যাচার করবে আপনি তাকে মাফ করে দিবেন।


হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, রসূলে খােদা (ﷺ) জীবনে কখনও তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপারে বা ধনসম্পদের কারণে কারও প্রতি প্রতিশােধ কার্যকর করেন না। তবে যখন কেউ আল্লাহ তায়ালার হালালকৃত বস্তুকে হারাম করেছে, তখন তিনি তার বদলা নিতে কুণ্ঠাবােধ করেননি। হুজুর আকরাম (ﷺ) উহুদের যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ও কঠিনতম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। কাফেররা তার মোকাবেলা করেছে, তার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, কঠিনতম দুঃখ যন্ত্রণা প্রদান করেছে। কিন্তু সে উহুদের প্রান্তরে তিনি ছিলেন ধৈর্যের অটল হিমাদ্রিতুল্য। প্রচন্ড নির্যাতন ভােগ করা সত্ত্বেও তিনি যে শুধু ধৈর্য ধারণ করেছিলেন, তাদেরকে ক্ষমা করেছিলেন তাই নয় বরং তাদের প্রতি করুণা প্রদর্শন করেছেন। তাদের ভালোবাসায় অন্তর বিগলিত করে দিয়েছেন। তাদের মূর্খতা ও জুলুমবাজের হাসিমুখে বরণ করেছেন। এদেরকে অক্ষম হিসাবে মূল্যায়ন করেছেন। হৃদয়নিংড়ানাে ভালোবাসার প্রস্রবন থেকে উথলে উঠেছে মহান দোয়ার অমিয় বাণী, হে আল্লাহ! আপনি আমার কাওমকে হেদায়েত দান করুন। এরা অবুঝ। এরা অজ্ঞ। অন্য এক বর্ণনায় আছে তিনি এরকম দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ আপনি এদেরকে ক্ষমা করে দিন।' কাফেরদের নির্যাতন যখন চরম আকার ধারণ করলাে, সাহাবায়ে কেরামের নিকট অসহ্য মনে হতে লাগলাে, তখন তারা আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনি যদি এদের উপর। বদদোয়া করেন! আল্লাহ তায়ালা যেন তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। দয়ার সাগর, করুণার সিন্ধু আল্লাহর হাবীব এরশাদ করলেন, আমি মানুষকে অভিসম্পাত করার জন্য প্রেরিত হয়নি। বরং সত্যের দাওয়াত দেওয়ার জন্য আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে। দুনিয়ায় রহমত হিসেবে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে।


তাদের কথায় আশ্চর্য হতে হয়, যারা বলে, উহুদের যুদ্ধের মর্মান্তিক অবস্থায় হুজুর পাক (ﷺ) এর অন্তরাত্মায় কম্পন এসেছিলাে এবং তিনি অধৈর্য ভাব প্রকাশ করেছিলেন। যেহেতু তখন তিনি এ জাতি কেমন করে কামিয়াব হবে' বাক্য দ্বারা খেদোক্তি প্রকাশ করেছিলেন। এবং তখন আল্লাহ তায়ালা আপনাকে কোনাে অধিকার দেয়া হয়নি' এ আয়াত নাযিল করেছিলেন। নবী করীম (ﷺ) এর শানে তাদের এরূপ চিন্তাধারা দেখে বড়ই আক্ষেপ হয়। অথচ ليس لك من الامر شئ 'লাইসালাকা মিনাল আমরে শাইউন' বা كيف يفلح قوم 'কাইফা ইয়াফরাহু কাওমুন' কোনােটিই নবী করীম (ﷺ) ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার খেলাফ হিসেবে প্রমাণ নয়। নরী করীম (ﷺ) তাে এ জাতি কেমন করে সফল হবে' বাক্য দ্বারা কাফেরদের আচরণের প্রতি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আর আল্লাহতায়ালা আপনাকে অধিকার দেয়া হয়নি' বাক্য দ্বারা তার প্রিয় হাবীব (ﷺ) কে সান্তনা প্রদান করেছেন। ধৈর্য ও ক্ষমা গুণ হুজুর পাক (ﷺ) এর পবিত্র সত্তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। তবে আহযাবের যুদ্ধে (খন্দকের যুদ্ধে) কাফেররা যখন তাকে আসরের নামাজ আদায় করতে দিলো না, তখন তিনি কাফেরদের জন্য বদদোয়া করেছেন, যাতে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে আযাব প্রদান করেন। তখন তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ তায়ালা যেন তাদের বাড়িঘর ও কবর সমূহকে অনলপূর্ণ করে দেন। এমনিভাবে তিনি আরবের ঐ সকল কবীলার জন্য বদদোয়া করেছিলেন, যারা অসহায় দুর্বল মুসলমানগণকে বিভিন্ন সময়ে অত্যাচারে জর্জরিত করে তুলতাে। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে আছে 'লাইসালাকা মিনাল আমরে শাইউন' আয়াতখানা তখনই নাযিল হয়েছে। হুজুর পাক (ﷺ) যে সমস্ত ক্ষেত্রে কাফেরদের প্রতি বদ দোয়া করেছিলেন তা ছিলাে দ্বীন ইসলামের হকের স্বার্থে এবং মুসলমানগণের হক নষ্ট হওয়ার কারণে। অধিকন্তু আল্লাহ তায়ালার এই নির্দেশ, “হে নবী (ﷺ)! আপনি কাফের ও মুনাফেকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং তাদের উপর কঠোরতা অবলম্বন করুন' এর পরিপ্রেক্ষিতে বদ দোয়া করেছিলেন। তিনি ঐ সমস্ত হতভাগ্যদের কেউ বদ দোয়া করেছিলেন, যারা নামাজ আদায় কালে হুজুর পাক (ﷺ) এর পিঠ মোবারকের উপর উটের ভুঁড়ি চাপিয়ে দিতে।


একজন আবার অর্থাৎ ইহুদীদের ধর্মযাজক, তার নাম ছিল ইবনসা'না—তিনি বর্ণনা করেন, পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে নবুওয়াতের যেসমস্ত আলামত আমি পেয়েছি, তার সব কয়টি হুজুর আকরাম (ﷺ) এর মধ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অবলােকন করেছি। তবে দু'টি বিষয়ে আমি পরীক্ষা করতে পারিনি। তার একটি হচ্ছে এই, তাওরাত কিতাবে উল্লেখ আছে, তার সহিষ্ণুতা অধৈর্যতাকে বৃদ্ধি করতে পারবে না। অপরটি হচ্ছে, কঠিন যুলুম অত্যাচার তার ধৈৰ্য্য ও সহিষ্ণুতাকে বাড়িয়ে দেবে। দুটি বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করার উদ্দেশ্যে আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু তার কোন সুরাহা করতে পারিনি। তবে কিভাবে আমি তার এলেম ও সহিষ্ণুতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে তার ঘটনাটি এরূপ—আমি একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের ভিত্তিতে হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছ থেকে খেজুর ক্রয় করেছিলাম। মাল হস্তগত করার পূর্বে আমি তার মূল্য পরিশোধ করে দিয়েছিলাম। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার দু'তিন দিন পূর্বেই আমি তার কাছে গেলাম। তার চাদর মুবারক চেপে ধরে রাগত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, হে মুহাম্মদ (ﷺ) এতদিনে তুমি আমার প্রাপ্য কেননা আদায় করাে নি? খােদার কসম, আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর হয়ে তুমি পাওনা আদায়ে টালবাহানা করে! আমার এহেন অশালীন উক্তি শুনে হযরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) বললেন, ওরে আল্লাহর দুশমন! রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে তুমি এমন অশালীন উক্তি কেন করলে? বেতিক্রমীমূলক কথাবার্তা যা আমি শুনলাম, হুজুর পাক (ﷺ) এর নাফরমানি হবে বলে যদি আশংকা না করতাম তাহলে এক্ষুনি আমার তরবারি তোমার মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে দিতে। হযরত ওমর (رضي الله عنه) এর রাগান্বিত বাক্য শুনে হুজুর পাক (ﷺ) বিম্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, হে ওমর! আমি এবং এ ব্যক্তি তোমার মুখ থেকে এর বিপরীত কথা শুনবো আশা করেছিলাম। — এ কথার অর্থ এই, হুজুর পাক (ﷺ) এটাই বুঝাতে চেয়েছেন যে, এ ব্যক্তির পাওনাটা তুমি আমার কাছ থেকে উত্তমভাবে আদায় করে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারতে। আর তাকেও সুন্দর ব্যবহার করার ব্যাপারে শিক্ষা দিতে পারতে। হুজুর পাক (ﷺ) বললেন, ওমর! এখন যাও তার পাওনাগুলাে আদায় করে দাও। অধিকন্তু তাকে যে তুমি ধমক দিয়ে ভয় দেখিয়েছ, সে জন্য আরও বিশ সাঁ খেজুর অতিরিক্ত দিয়ে দিও। হযরত ওমর (رضي الله عنه) রাসূল (ﷺ) এর নির্দেশ মোতাবেক কাজ করেন। 

এ ঘটনাটির পর উক্ত ইয়াহুদী ধর্ম যাজক বললেন, হুজুর আকরাম (ﷺ) এর জ্যোতির্ময় মুখমণ্ডলের মধ্যে নবুওয়াতের সমস্ত আলামত আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। কিন্তু এ দু'টি ব্যাপারে আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি। আজ আমি তার যথাযথ প্রমাণ পেয়ে গেলাম। ভাই ওমর! আপনাকে সাক্ষী রেখে আমি ঘােষণা দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনাে উপাস্য নাই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল।


হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) এর বর্ণিত হাদীসে আছে, একদিন হুজুর পাক (ﷺ) এক মজলিশ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তার সাথে সাথে আমরাও উঠে দাঁড়ালাম। তখন একজন বেদুইন লোক এলো। সেই লোকটি হুজুর পাক (ﷺ) এর কাঁধ মোবারকের উপর যে চাদর খানা ছিল তা সজোরে চেপে ধরলাে। চাদর ধরে সে এতাে জোরে টান দিলাে যে, চাদরের চাপে হুজুর পাক (ﷺ) এর কাঁধ মুবারকের চামড়া কিঞ্চিৎ ছিড়ে গেলাে। হুজুর পাক (ﷺ) বেদুইন লােকটির দিকে তাকালেন, সে কি বলতে চায় তা বুঝতে চেষ্টা করলেন। লােকটি বললাে, আমি যে দু'টি উট নিয়ে এসেছি তা খাদ্য দিয়ে বোঝাই করে দিতে হবে। কেননা আমার বাল বাচ্চা আছে, তাদেরকে খাওয়াতে হবে। আর আপনি আপনার নিজের মাল বা আপনার বাপদাদার মালততা আর দিচ্ছেন না! (বাইতুল মাল থেকে দিবেন, তাতে আপনার আপত্তি কোথায়?)


লোকটির কথা শুনে হুজুর পাক (ﷺ) বললেন, তুমি চাদর দিয়ে আমাকে আটকে রেখেছ। ছেড়ে না দিলে আমি মাল দিয়ে কেমন করে? বেদুইন বললাে, খােদার কসম! আপনি যতক্ষণ আমার এ দু'টি উট বােঝাই করে না দেবেন, ততক্ষণ আমি আপনাকে ছাড়ছিনা। তখন হুজুর পাক (ﷺ) জনৈক সাহাবীকে ডেকে বলে দিলেন, এ লােকটির একটি উট খেজুর আর অপরটি যব দিয়ে বোঝাই করে দাও! —এ ঘটনাটি আবু দাউদ শরীফে বর্ণনা করা হয়েছে। ইমাম বুখারী (رحمة الله) এ ঘটনাটিই আনাস (رضي الله عنه) থেকে এভাবে বর্ণনা করেছেন হজরত আনাস (رضي الله عنه) বলেন, একদা আমি হুজুর আকরম (ﷺ) এর সঙ্গে যাচ্ছিলাম। ঐ সময় হুজুর আকরাম (ﷺ) এর কাঁধ মোবারকের উপরের শক্ত ডােরা বিশিষ্ট একখানা রাজরানী চাদর ছিল। অকস্মাৎ একটি বেদুইন লােক নিকটে এসে চাদর ধরে হুজুর (ﷺ) কে টান দিলে এবং চাদর দিয়ে তাকে শক্ত ভাবে পেচিয়ে ধরলো। হযরত আনাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, আমি তখন হুজুর পাক (ﷺ) এর কাঁধ মুবারকের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রুক্ষ ডােরা বিশিষ্ট চাদরের চাপে হুজুর পাক (ﷺ) এর কাঁধের চামড়া ছিলে গেছে। লােকটি তখন বলতে লাগলাে, 'হে মােহাম্মদ (ﷺ)! আল্লাহর প্রদত্ত (গনীমত) মাল থেকে আমাকেও প্রদান করার জন্য হুকুম দিন।' হুজুর পাক (ﷺ) লােকটিকে নিরীক্ষণ করে মৃদু হাসলেন তারপর তাকে কিছু দান করার জন্য আমাকে হুকুম করলেন।


হুজুর আকরাম (ﷺ) এর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সম্পর্কে যে সমস্ত বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, তাতে দেখা যায় তার জান ও মালের উপর কতােইনা অমানুষিক নির্যাতন এসেছে, কিন্তু সেগুলিকে তিনি হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন। জালেমদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ সব তিনি করেছেন একটি মাত্র আশায়—যদি তারা মুসলমান হয়ে যায়। যাবতীয় নির্যাতন ভোগ করে তাদের অন্তর জয় করতে চেয়েছেন। যাতে ইসলাম কবুল করে। যাতে আল্লাহর পথে, শান্তির পথে ফিরে আসে। নবী করীম (ﷺ) এর প্রশংসনীয় গুণাবলী সম্পর্কে এরকম বর্ণিত আছে, জীবনে তিনি কখনও কাউকে কটু কথা বলেন এবং কারও কটু কথার বদলাও গ্রহণ করেন নি। বরং শুধু ক্ষমা করবেন, ক্ষমা করে যেতেন। এক হাদীসে এরূপ বর্ণিত আছে, তিনি কাউকে কখনও গালি দিতেন না, ফাহেশা কালাম বা অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ করতেন না। কখনও কাউকে অভিসম্পাত করতেন না। ‘অশ্লীলতা' শব্দটি দ্বারা কথা, কাজ ও স্বভাব সবকিছুর অশ্লীলতা বুঝায়। তবে এ শব্দটির ব্যবহার সাধারণতঃ কথার ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।


হুজুর পাক (ﷺ)-এর পবিত্র গুণাবলী বর্ণনা করতে যেয়ে এক জায়গায় এমন বলা হয়েছে যে, তার কালাম ফাহেশা ও ছিলেনা, মুতাফাহহাশও ছিলা না। এ কথার মর্মার্থ এই যে, ফাহেশা কথা বলার অভ্যাস হুজুর পাক (ﷺ) এর ছিলােনা বা কখনও তিনি ইচ্ছা করেও ফাহেশা কথা বলতেন না। মুতাফাহহাশ কথাটির অর্থ হচ্ছে ফাহেশা, অশ্লীল বা রুক্ষ কথা ইচ্ছা করে তাকাল্লুফ সাথে করা। ফাহেশা কথা এর চেয়ে বেশি সাধারণ অর্থবোধক।


কেউ যদি এরূপ প্রশ্ন করে, এ ঘটনাটি তো সহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত যে, হুজুর আকরাম (ﷺ) উকবা ইবনে মঈন, আব্দুল্লাহ ইবন হানযাল এবং অন্যান্য কাফের, যারা তাকে বিভিন্নভাবে দুঃখ কষ্ট দিতে, তিনিতো তাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অথচ হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে, তিনি ব্যক্তিগত কারণে কারও প্রতিশােধ গ্রহণ করেননি। তাহলে এর বৈধতা কতটুকু? তখন এর উত্তরে বলতে হবে হুজুর পাক (ﷺ) যে তাদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা কোন ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণ নয়। বরং এটা আল্লাহ তায়ালার হুরমত সমূহকে ধ্বংস করে দিয়ে। আবার কেউ কেউ এভাবে উত্তর দিয়েছেন, তিনি যে প্রতিশােধ গ্রহণ করেননি বলা হয়েছে তার অর্থ, যতক্ষণ কেউ কুফুরীর সীমায় না পৌছাতে ততক্ষণ তাদের থেকে প্রতিশোধ নিতে না। হুজুর পাক (ﷺ) এর চাদর মুবারক ধরে টান দেয়ার ঘটনা বা এ জাতীয় অন্যান্য ঘটনার ক্ষেত্রে উক্তরূপ সমাধান বুঝে নিতে হবে। দাউদির মতে প্রতিশোধ গ্রহণ না করার অর্থ মাল সম্পদ সম্পর্কিত ব্যাপারে কোনাে প্রতিশােধ গ্রহণ করতেন না। হুজুর পাক (ﷺ) এর ক্ষমাশীলতার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত লবীদ ইবনুল আসাম ইয়াহুদীর ঘটনা, যে তাকে যাদু করেছিল এবং খয়বরের ঐ ইয়াহুদি নারীর ঘটনা, যে হুজুর পাক (ﷺ) কে বিষ মিশ্রিত বকরীর রান খাইয়েছিলাে। দয়াল নবী তাদেরকে নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।


এরকম অন্য আরেক দিনের ঘটনা, হুজুর পাক (ﷺ) চক্ষু মুদ্রিত অবস্থায় কায়লুলা করছিলেন। হঠাৎ চোখ খুলে দেখতে পেলেন, এক আরব বেদুইন তার শিরা মোবারকের উপর তরবারি উত্তোলিত করে দাড়িয়ে আছে। বেদুইনটি বললাে, এখন আপনাকে আমার এ তরবারীর আঘাত থেকে কে রক্ষা করবে? কে আপনার হেফাজত করবে? হুজুর পাক (ﷺ) বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন হলেন না। শান্ত গম্ভীর স্বরে বললেন, আল্লাহ্। ব্যাস এতটুকুই কথা। বেদুইনটির হাত কেঁপে উঠলাে। ঝন ঝন শব্দে তরবারী মাটিতে পড়ে গেলাে। হুজুর পাক (ﷺ) তরবারীটি তুলে নিলেন। স্বাভাবিক স্বরে বললেন, এখন তােমাকে কে বাঁচাবে? বেদুইনটি কেঁপে উঠলাে। তার সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপতে লাগলো। করুণার হিমাদ্রি, দয়ার সাগর মহান রাসুল (ﷺ) প্রতিশোধ নেবে, তা-কি হতে পারে? তিনি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে হেসে তাকে সান্তনা দিলেন। মাফ করে দিলেন অনুতপ্ত আরব বেদুইন ।এরপর লোকটি তার কওমের লোকদের কাছে গিয়ে বলতে লাগলাে, ওহে! তোমরা শোনো। আজ আমি সর্বোত্তম এক মহান ব্যক্তির কাছ থেকে এসেছি। আরেক দিনের ঘটনা, সাহাবায়ে কেরাম একটি লােককে হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে নিয়ে এসে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! এটি আপনার দুশমন। তার অভিপ্রায়, সুযোগ পেলে আপনাকে হত্যা করবে। আল্লাহর হাবীব এরশাদ করলেন, কোনাে চিন্তা করােনা। তারপর লােকটিকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি যদি আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে এসে থাকো, তবে জেনে তা সম্ভব হবে না। তুমি আমার উপর সফল হতে পারবে না।


এ সমস্ত ঘটনা যা বিবৃত হলাে, হুজুর পাক (ﷺ) এর সুমহান আখলাক ও অসীম ধৈর্য্য-সহিষ্ণুতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।


মদিনার মুনাফিক সম্প্রদায় যারা সুযোগ সন্ধান করে—আড়াল থেকে তারা মহানবী (ﷺ) কে নানারূপ যন্ত্রণা দিয়ে, আবার যখন সামনে আসে, তখন তাদের খোশামোদ ও চাটুকারিতার অন্ত থাকবে না। মুনাফিকদের এ ধরনের কপট আচরণ ও তৎপরতার কারণে সব মানুষের অন্তর থেকে ঘৃণা উৎসারিত হতাে। কিন্তু দয়াল নবী এদের প্রতি কিরূপ আচরণ করলেন? এদের প্রতি কঠোরতা অবলম্বন করার জন্য আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে এরশাদ হয়েছে, হে নবী! আপনি কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন, এদের উপর কঠোরতা অবলম্বন করুন। —কিন্তু নবী পাক (ﷺ) এর দয়ায় ভরা অন্তর থেকে স্বাভাবিকভাবে কঠোরতা আসতে চায়না। তিনি তাদের জন্য ক্ষমা, রহমত ও ইস্তেগফারের দরজা উন্মুক্ত রাখেন, তাদের জন্য এখন দোয়া করতে থাকেন। তখন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করলেন-হে মাহবুব! আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন আর নাই করেন, আল্লাহপাক তাদেরকে কখনাে ক্ষমা করবেন না।'—এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর হুজুর পাক (ﷺ) আল্লাহতায়ালার কাছে আরয করলেন, মাবুদ! আপনি যেহেতু ক্ষমা চাওয়া না চাওয়া উভয়টার উপর আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, তাই ইস্তেগফার আমি গ্রহণ করলাম। আল্লাহপাক এরশাদ করেন, আপনি যদি সত্তর বারও তাদের জন্য এসতেগফার করেন, তবুও না। তখন হুজুর পাক (ﷺ) আরয করলেন, হে আল্লাহ আমি সত্তর বারের চেয়েও বেশী তাদের জন্য আপনার কাছে ক্ষমার দরখাস্ত করবো। এটা হুজুর পাক (ﷺ) সম্মানীয় স্বভাব। কাফের মুনাফেকরা তার উপর যুলুম অত্যাচার করেছে, তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে, আর তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত।


এক্ষেত্রে একটি প্রশ্নের অবকাশ আছে যে, 'সতুর বার' কথাটি দ্বারা তাে কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা বোঝানো হয়নি। কথাটি আধিক্য বোঝানোর জন্য বলা হয়েছে, তাহলে হুজুর পাক (ﷺ) কেমন করে বললেন সত্তুর বারের চেয়েও বেশী ক্ষমা চাইবাে?” এর উত্তর হচ্ছে এই যে, তিনি সীমাহীন ক্ষমা-গুণের কারণে আয়াতে কারীমার শাব্দিক অর্থের দিকে লক্ষ্য করে এ রকম আর করেছেন। এমনকি তার ক্ষমা-গুণের প্রাবল্য এতে অধিক ছিল যে, রইসুল মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর পুত্রকে তিনি একজন খালাস মুসলমান ছিলেন, হুকুম দিয়েছিলেন তাঁর পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার জন্য। এ আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর যখন মৃত্যু হলাে, হুজুর আকরম (ﷺ) স্বীয় জামাখানা দেহ মুবারক থেকে খুলে তার কাফন বানিয়ে দিলেন এবং তার জানাযার নামাজ পড়ার জন্য এরাদা করলে। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (رضي الله عنه) বিস্মিত হয়ে হুজুর পাক (ﷺ) এর জামার দামন মুবারক আঁকড়ে ধরে আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনি এমন একজন মুনাফেকের জানাযা পড়ানাের জন্য উদ্যত হয়েছেন, যে ছিলাে সমস্ত মুনাফেক সম্প্রদায়ের সরকার। হুজুর পাক (ﷺ) স্বীয় জামার দাম মুবারক হযরত ওমর (رضي الله عنه) এর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, ওমর তুমি দূরে থাকো! এই মুহূর্তে আল্লাহ পাক এ আয়াত নাযিল করলেন, 'হে নবী (ﷺ) মুনাফেকদের থেকে যে কেউ মৃত্যুবরণ করবে, আপনি কোনোদিন তাদের জানাজার নামাজ পড়বেন না এবং তাদের কবরের কাছে দণ্ডায়মান হবেন না। এ হুকুম জারী হওয়ার পর হুজুর পাক (ﷺ) উক্ত এরাদা পরিত্যাগ করলেন। উম্মতের উপর তাঁর সীমাহীন ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও মমত্ববােধ ছিলাে এটা সত্য। কিন্তু আল্লাহপাকের তরফ থেকে যখন এর নিষিদ্ধ তার হুকুম জারি হয়ে গেছে, তখন তিনি আর কি করতে পারেন?


কোন কোন উলামা এ ঘটনার কারণে ভাবে ব্যক্ত করেন যে, তিনি মুনাফিক সরদার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর পুত্রের মন রক্ষার্থে কাজ করতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি একজন নিষ্ঠাবান ও নেককার সাহাবী ছিলেন। তিনি হুজুর পাক (ﷺ) এর নিকট জানাযা পড়ানোর জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। তাই তিনি তাঁর আবদার রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। হুজুর আকরাম (ﷺ) তার জামা মুবারক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই কে যে দান করেছিলেন, তার কারণ ব্যাখ্যা করে কোনাে কোনাে আলেম এরূপ বলেন যে, বদরের যুদ্ধে হুজুর পাক (ﷺ) এর চাচা হজরত আব্বাস (رضي الله عنه) যখন বদরের অন্যান্য কয়েদী গানের সঙ্গে বন্দী হয়েছিলেন, তখন বস্ত্রহীন হওয়া কারণে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাকে একখানা জামা দান করেছেন। হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) দীর্ঘদেহী হওয়ার কারণে তার গায়ে লাগতে পারে এমন জামা আর কারো কাছে ছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তখন তাকে একটি জামা দিয়ে উপকার করেছেন। তার প্রতিদানে হুজুর পাক (ﷺ) স্বীয় জামা মুবারক কাফন স্বরূপ তার গায়ে দিয়ে দিয়েছিলেন।


মোট কথা, এ সমস্ত আলোচনা দ্বারা কথাটা বোঝানোর প্রয়াস হয়েছে যে, হুজুর আকরাম (ﷺ) এর আখলাক কত মহান, কত সুন্দর ছিলাে। মুনাফিকরা কখনও তাঁকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি, নানা রকম যন্ত্রণায় জর্জরিত করেছে। কিন্তু তিনি তাদের এরকম আচরণের বিপরীতে শুধুই সদাচরণ করে গেছেন। এ থেকেই আন্দাজ করা যেতে পারে যে, কাফের মুনাফিকদের প্রতি যার দিলে এতে মমতা ছিলাে, মুখলেস মুসলমানদের জন্য তার দিলের অবস্থা ছিলাে কেমন। এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, 'নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের উপর রয়েছেন।'


উম্মতে মুসলিমার উপর হুজুর আকরাম (ﷺ) এর স্নেহ মমতা কেমন ছিলে, এবার এ প্রসঙ্গে আলোচনায় আসা যাক। হুজুর পাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন, উম্মতের মধ্যে কেউ যদি কবিরা গুনাহ করে ফেলে বা কেউ কাউকে কোনােরূপ কষ্ট প্রদান করে, তবে যেনাে যতদূর সম্ভব তা গােপন রাখার চেষ্টা করা হয়। আরও ইরশাদ ফরমান, কেউ যদি কোন মুহাররামাত এর সঙ্গে অবৈধ কাজে লিপ্ত হওয়ার গুনাহ গুনাহগার হয়, তাহলে উচিত হবে তা গোপন রাখা, ফাঁস না করা। উম্মতের মধ্যে কারও উপর যদি শরীয়তের শাস্তি কায়েম হয়, তাহলে তাকে তিরস্কার, ঘৃণা গালিগালাজ অভিশম্পাত না করে। আল্লাহপাকের দরবারে তার জন্য যিনা ক্ষমা প্রার্থনা করে। উম্মতের প্রতি তার হুকুম ছিলে এরকম। এ প্রসঙ্গে তিনি ইরশাদ ফরমান, তোমরা কোন মুসলমানকে লানত করোনা, কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে ভালােবাসে। এই হাদীছ দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষের অন্তরের গােপন অবস্থার উপর দৃষ্টিপাত করেন। যদিও প্রকাশ্যে তার দ্বারা কোনো অপরাধ, অবিশ্বাস বা লাঞ্ছনাকর কাজ সংঘটিত হয়ে যায়।


সহীহ বুখারী শরীফ উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, একবার এক ব্যক্তি হুজুর পাক (ﷺ) এর নিকট আসার জন্য অনুমতি চাইলাে। তিনি অনুমতি দিলেন। হুজুর পাক (ﷺ) লােকটিকে দেখে মন্তব্য করলেন, এ লােকটি তার এলাকার নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। কিন্তু লােকটি যখন হুজুর পাক (ﷺ) কাছে বসে গেলাে, তখন তিনি উৎফুল্ল হলেন। খুশির ভাব প্রকাশ করলেন। লােকটি যখন নবী করীম (ﷺ) এর দরবার থেকে চলে গেলে, তখন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ (ﷺ)! লােকটি যখন প্রথমে এসে প্রবেশ করলাে তখন আপনি এমন এমন মন্তব্য করলেন। আর যখন সে আপনার নিকট বসে গেলাে তখন আনন্দ ও উৎফুল্লতার ভাব প্রকাশ করলেন। এর তাৎপর্য কি? হুজুর আকরম (ﷺ) বললেন, হে আয়েশা! তুমি আমাকে কখনও কি কর্কশ ভাষী দুর্ব্যবহারকারী হিসেবে দেখেছে? তবে একথা সত্য যে, যাকে মানুষ যুলুম অত্যাচারের কারণে ভয় করে, তার তরফ থেকে ক্ষতির আশংকায় মানুষ তা থেকে দূরে সরে থাকে, এমন লোক আল্লাহ তায়ালার নিকট নেহায়েত মন্দ।


হুজুর পাক (ﷺ) এর এ বক্তবের দুটি অর্থ হতে পারে। 

(১) হুজুর পাক (ﷺ) লােকটির প্রতি এরূপ ভাব দেখানাের ব্যাপারে অক্ষম ছিলেন। কোমল অন্তরের কারণে লােকটি মন্দ হওয়া সত্বেও তার প্রতি রূঢ় আচরণ করতে পারেননি। খুশির ভাবের বহিঃপ্রকাশটি আপনাআপনিই হয়েছে। শুধু তাই নয়, এরূপ লোকের প্রতি রূঢ় আচরণ করতে মানা করেছেন তাহলে মানুষ। ঘাবড়ে গিয়ে কাছে আসতে কুণ্ঠাবোধ করে, দূরে সরে যাবে। 

(২) এও হতে পারে যে, ঐ ব্যক্তির যে দোষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা তার ধনদৌলতের প্রাচুর্যতার দিকে লক্ষ্য করে বলা হয়েছে। লােকটি মন্দ হওয়া সত্বেও তার ধনদৌলত কারণে তার মন্দ কাজের প্রতিবাদ কেউ করতে পারেনা। ক্ষতি করার ভয়ে মানুষ তাকে লৌকিক সম্মান করে।


ওলামায়ে কেরাম বললেন, হুজুর পাক (ﷺ) মন্দ লোকের সাথে সদাচরণ করেছেন তার মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। তার ব্যবহারে সন্তুষ্ট হলে তার মাধ্যমে তার গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে পারে এই ছিল হুজুর (ﷺ) এর উদ্দেশ্য। যেহেতু লোকটি তার গোত্রের সরদার ছিলান। তখন প্রশ্ন জাগে যে, হুজুর (ﷺ) যে তার সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করলেন, এটা কি গীবতের পর্যায়ে পড়ে না? তার উত্তর হলাে, এটা গীবতের পর্যায়ভুক্ত নয়। কেননা, নবীগণকে আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে এ সত্যটি পৌছানো হয় থাকে, যে গানে তাঁরা তাঁদের উম্মতের যাবতীয় দোষ ত্রুটি পর্যবেক্ষণ এবং পর্যালােচনা করেন। দোষ ত্রুটি প্রকাশ করে দেন। তা না হলে উম্মত হেদায়েত পাবে কেমন করে? এটা উম্মতের জন্য নসীহত ও সংশােধনের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু উম্মতের অবস্থা এর বিপরীত। তারা একে অপরের দোষ চর্চা ও গীবত করে থাকে। তদুপরি উম্মতের জন্যও তাে এ বিধান আছে, কেউ যদি বেপরোয়া ভাবে ফেসবুক কুফরী বা অন্যায় অনাচার কাজে লিপ্ত হয়, তখন তার দোষসমূহ প্রকাশ করে দেয়া জায়েয। আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় হাবীব (ﷺ) এর মধ্যে সৃষ্টি গত বৈশিষ্ট্য এরকম করে দিয়েছিলেন যে, সুন্দর চরিত্র, বিনয়, নম্রতা, প্রফুল্লতা ইত্যাদি যাবতীয় গুণাবলীর সময় তাঁর মধ্যে ছিলাে। উক্ত ঘটনাটিতে উম্মতের জন্য এই শিক্ষা রয়েছে যে, কোনাে দুরাচারী কাছ থেকে যদি উক্তরূপ ক্ষতির আশংকা হয়, তবে দোষ আলােচনা পরিহার করে চলতে হবে। বিনয় ও হাসিখুশি সাথে তার সঙ্গে আচরণ করতে হবে। তার ক্ষতি ও ফাসাদ থেকে নিজকে রক্ষা করে চলতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে ভালাে ব্যবহার যেনাে চাটুকারিতায় পরিণত না হয়। এ দু’এর মধ্যে পার্থক্য হলাে ক্ষতি থেকে বাঁচা ও নিজের মান ইজ্জত বাঁচানোর উদ্দেশ্যে যে ব্যবহার করা হয়, তাকে ভালো ব্যবহার বলে। আর দুনিয়াবী স্বার্থসিদ্ধির মানসে যে ভালাে ব্যবহার করা হয়, তাকে বলা হয় চাটুকারিতা।


কোনাে কোনাে আলেম এ দুটি শব্দের ব্যাখ্যা এরূপ করেছেন যে, ভালো ব্যবহার হচ্ছে দুনিয়াবী কার্যাবলী, দুনিয়ার কল্যাণ বা সংশোধন, দ্বীনের কল্যাণ বা সংশোধন, অথবা উভয়ের কল্যাণ বা সংশোধনের উদ্দেশ্যে কিছু করার কাজটি করা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ। কোন কোন সময় তা মুস্তাহসান বা প্রশংসনীয়ও বটে। আর চাটুকারিতা হচ্ছে, দ্বীনের কার্যাবলীকে দুনিয়াবী কল্যাণ বা দুনিয়া হাসিলের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা। হুজুর আকরাম (ﷺ) উক্ত সরদার লোকের সাথে যে আচরণ করেছেন, তা দুনিয়াবী আচার ব্যবহার, কথা ভালো ব্যবহার, নেম মার্জিত আচরণ। হুজুর পাক (ﷺ) তার সঙ্গে উক্তরূপ আচরণ করেছেন সত্যিই, কিন্তু তার জবান মোবারক থেকে উক্ত নায়েক সম্পর্কে কোনরূপ প্রশংসাসূচক বাক্য বের হয়নি। যাতে বাস্তবের বিপরীত হয়। সুতরাং হুজুর পাক (ﷺ) এর কথা ছিলে হকের বহিঃপ্রকাশ আর কাজ ছিল সুন্দর আচরণমূলক।


হযরত কাযী আয়ায (رحمة الله) বলেন, উক্ত সরদার লোকটি হুজুর পাক (ﷺ) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময় মুসলমান ছিলাে কিনা তা জানা নেই। যদি তখন সে মুসলমান না হয় তাহলে হুজুর পাক (ﷺ) এর মন্তব্য অর্থাৎ তার সম্পর্কে মন্দ বলা এটা গীবতের পর্যায়ে পড়ে না। আর যদি মুসলমান হয় তাহলে তার মুসলমানি বিশুদ্ধ ছিলোনা। এমতাবস্থায় তার প্রকৃত অবস্থাটা বর্ণনা করে দেয়া হুজুর পাক (ﷺ) এর উদ্দেশ্য ছিলাে। যাতে কোনাে অজ্ঞ ব্যক্তি তার ধোঁকায় পতিত না হয়। ঐ লােকটির জীবনালােচনায় পাওয়া যায় যে, হুজুর পাক (ﷺ) এর পার্থিব জীবনে এবং তার ইন্তেকালের পর তার দ্বারা এমন কার্যাবলী সংঘটিত হয়েছিল যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তার ঈমান (থেকে থাকলে) দুর্বল ছিলে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে গেলে দেখা যায় যে, হুজুর পাক (ﷺ) তার সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা একবার বিল গায়েব ও আলামতে নবুওয়াত এর পর্যায়ে পড়ে। লোকটির মধ্যে উক্ত নিকৃষ্ট দোষসমূহ বিদ্যমান থাকা সত্বেও তিনি যে তার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন, তা ছিলাে তার কোমল হৃদয়ের কারণে।


এখন উক্ত সরদার লোকটির পরিচয় ও প্রকৃতি সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনায় আসা যাক। তার নাম ছিল উয়ায়না ইবনে হিসন ইবনে হুযায়ফা ইবন বদর ইবন ফারায়ী। লােকেরা তাকে আহমাকুল মুত্বা বলে ডাকতাে। নির্বুদ্ধিতা ও অহংকারের কারণে তাকে সকলে আহমক বলে। মুত্বা মানে যার আনুগত্য করা হয়। যেহেতু সে গােত্রের সরদার ছিলাে, তাই লােকেরা তার আনুগত্য করে। এ কারণে তাকে মুক্তা বলা হতো।


সহীহ বুখারী শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, একদা উয়ায়না ইবন হিসন ইবনে হুযায়ফা তার ভ্রাতুষ্পুত্র হার ইবন কায়স ইবন হুসাইন এর নিকট এল। আর হার ইবনে কায়েস আমীরুল মুমিনীন সাইয়্যেদুনা হজরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) এর নৈকট্যপ্রাপ্ত এবং মজলিশে শূরার সদস্য গণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। উয়ায়না তার ভ্রাতুষ্পুত্র বললেন, ভাতিজা! আমীরুল মুমিনীন এর দরবারে তোমার তো বেশ মান মর্যাদা আছে। আমি যখন তাঁর নৈকট্য পেতে পারে সে জন্য তুমি তার কাছে আমার পক্ষ থেকে একটি আবেদন পেশ করে। তিনি বললেন, ঠিক আছে, আমি আপনার জন্য তাঁর কাছে আবেদন রাখবেন। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, এর পর হার ইবনে কায়েস তার চাচা উয়ানার ব্যাপারে আমীরুল মুমিনীন এর দরবারে দরখাস্ত পেশ করলেন। হযরত ওমর (رضي الله عنه) আবেদন মঞ্জুর করলেন। তাকে তার নিকট আসার অনুমতি দিলেন।


উয়ায়না যখন হযরত ফারুকে আজম (رضي الله عنه) এর কাছে এলে, তখন বলতে লাগলে, হে খাত্তাব এর সন্তান! আমাকে কিছু মালপত্র প্রদান করুন না। খােদার কসম! আপনি কিন্তু আমাকে বেশী কিছু দেন না, আমাদের প্রতি আপনি ইনসাফ করেন না। তার এরূপ কথা শুনে হযরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) রাগান্বিত হয়ে গেলেন। এমনকি ওকে শাস্তি প্রদানের নিয়ত করলেন। তখন হার ইবন কায়েস বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ তায়ালা তার হাবিব (ﷺ) কে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেছেন, ‘ক্ষমাশীলতা গ্রহণ করুন। সৎকাজের আদেশ করুন আর মূর্খদের প্রতি ভ্রক্ষেপ করবেন না।' হার ইবন কায়স তার চাচা সম্পর্কে মন্তব্য করলেন যে, লােকটি জাহেল। হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, আল্লাহর কসম হজরত ওমর (رضي الله عنه) আয়াতে কারীমার হুকুমের বিন্দু মাত্র লংঘন করলেন না। ফাতহুল বারী' কিতাবে উদ্ধৃত আছে, হযরত সিদ্দিকে আকবর (رضي الله عنه) এর যামানায় উয়ায়না মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয় মুসলমানগণের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। এরপর পুনরায় সে ইসলাম গ্রহণ করে এবং মুরতাদ থেকে তওবা করে। হযরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) এর যমানায় বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এই কিতাবের শেষের দিকে যুদ্ধ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে তার কর্মতৎপরতার ধরন ধারণ ও গতিবিধি সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে ইনশাআল্লাহ, তাতে তার বদ আচরণ ও ধৃষ্টতার পরিচয় পাওয়া যাবে।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী] 


© | সেনানী এপ্স |

Top