ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে নবী করীম (ﷺ) এর চিকিৎসা
নবী করীম (ﷺ) তিব্বী দাওয়া অর্থাৎ খাদ্য বা পানীয় বস্তুর মাধ্যমেও কোনো কোনো সময় চিকিৎসা করেছেন। নবী করীম (ﷺ) এর তিব্বিয়া চিকিৎসা ছিলো ওহীর মাধ্যমে। হাঁ, কোনো কোনো সময় কিয়াস, এজতেহাদ ও অভিজ্ঞতার আলোকেও তিনি চিকিৎসা করেছেন।
তিব্বিয়া চিকিৎসা করে থাকলেও রূহানী চিকিৎসার উপরই তিনি গুরুত্ব দিতেন বেশী। কেনোনা এটা অধিকতর পূর্ণ ও উচ্চ মর্যাদাশালী এবং বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এক হাদীছে পাওয়া যায়, তিনি পাতলা পায়খানার ক্ষেত্রে মধু খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বোখারী ও মুসলিম শরীফে হজরত আবু সাইদ খুদরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি রসুলেপাক (ﷺ) এর কাছে এসে বললো, আমার ভাইয়ের পেটের অসুখ হয়েছে। আরেক বর্ণনায় এসেছে, তার পাতলা পায়খানা হচ্ছে। রসুলেপাক (ﷺ) তাকে মধুপান করানোর কথা বললেন। তাকে মধু পান করানো হলো। এতে আরও বেশী করে তার দাস্ত হতে লাগলো। রসুলেপাক (ﷺ) বললেন, আল্লাহ্তায়ালা সত্য বলেছেন (অর্থাৎ ওহীর মাধ্যমে তার চিকিৎসা সম্পর্কে যা বলে দিয়েছেন তা সত্য) কিন্তু তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যা বলছে। মুসলিম শরীফের বর্ণনায় আছে, তৃতীয়বারও তাকে তাই করতে বললেন। তারপর চতুর্থবার সে এলে রসুলেপাক
(ﷺ) তাকে একই হুকুম দিলেন। তাতে তার দাস্ত আরও বেড়ে গেলো। ইমাম আহমদের বর্ণনায় আছে, চতুর্থবার জানানোর পর যখন রসুলেপাক (ﷺ) তাকে মধু পান করাতে বললেন, তখন তাকে আবার মধুপান করানো হলো এবং এতে তার দাস্ত বন্ধ হয়ে গেলো। তখনই রসুলেপাক (ﷺ) বলেছিলেন, আল্লাহ্তায়ালা সত্য বলেছেন, তোমার ভাইয়ের পেটই মিথ্যা বলছে। হাদীছ শরীফে এসেছে, তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যা বলছে। হেজাযবাসীগণ বলেন ‘মিথ্যা বলেছে’ কথার অর্থ ‘ভুল করেছে’। যেমন বলা হয়ে থাকে ‘তোমার কান মিথ্যা শুনেছে’ মানে শুনতে ভুল করেছে। সুতরাং হাদীছ শরীফের অর্থ হবে যা বলা হয়েছে তা সত্যই কিন্তু তোমার কৃতকর্মে ভুলের সংমিশ্রণ রয়েছে। পেট মিথ্যা বলেছে এ কথার অর্থ এই নয় যে, নবী করীম (ﷺ) এর দেয়া দাওয়ার ধারণ ক্ষমতা তার নেই। সে তার উপযুক্ত নয়- এ রকম চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। বরং তার কাজে ভুলভ্রান্তি ছিলো। তাই ঔষধ কাজ করছিলো না।
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (رحمة الله) বলেন, মধুপানের নির্দেশ সম্ভবতঃ ওহীর আলোকেই হয়েছিলো। ওহীর মাধ্যমে তিনি হয়তো জানতে পেরেছিলেন, মধুর দ্বারাই লোকটির পেটের পীড়া দূর হয়ে যাবে। তাৎক্ষণিকভাবে যখন তার ফল পরিলক্ষিত হলো না, তখন লোকটি হয়তোবা সন্দেহ করেছিলো। আর সে কারণে রসুলেপাক (ﷺ) ‘তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যা বলছে’- এই মন্তব্য করেছিলেন।
কিছু কিছু ধর্মদ্রোহী এমন বলে থাকে, মধু দেহের মধ্যে প্রবাহ সৃষ্টিকারী একটি পদার্থ। পাতলা পায়খানা নামক দৈহিক তরল প্রবাহ দূরীকরণার্থে মধুর ব্যবহার সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হলো কেনো? তাদের মস্তিষ্কে এ ধরনের প্রশ্নের উদয় হওয়া সম্পর্কে কোরআন করীমই পরিষ্কারভাবে নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছে ‘তাদের সংকীর্ণ জ্ঞান যা আয়ত্ত করতে পারেনি, সে ব্যাপারে তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে।’ চিকিৎসকগণ একমত যে, কোনো রোগের চিকিৎসা রোগীর বয়স, অভ্যাস, সময়, গৃহীত খাদ্য, ব্যবস্থাপনা এবং শারীরিক শক্তি অনুসারে বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে।
পেট থেকে তরল প্রবাহ সৃষ্টি হওয়া সাধারণত অপছন্দনীয় খাদ্য গ্রহণের কারণে হয়ে থাকে। সে খাদ্য পেটে প্রবেশ করে বদহযমের কারণ সৃষ্টি করে। আর সে বদহযম থেকে দাস্ত বা তরল প্রবাহ সৃষ্টি হয়। আর চিকিৎসকগণ তো এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, পাতলা পায়খানার চিকিৎসা হচ্ছে বদহযমের আছর দূর করে দেয়া। আর সেটা পেটের ভিতর থেকে দূর করতে হলে তরল প্রবাহ সৃষ্টি করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
মধু যদি প্রবাহ সৃষ্টিকারী পদার্থই হয়, তাহলে তা উপরোক্ত উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক ভূমিকাই রাখবে। কাজেই বদহযমের সঞ্চিত বর্জ্যগুলো পেট থেকে বের করার জন্য নবী করীম (ﷺ) মধু পান করানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ্র হাবীব (ﷺ) কতইনা সুন্দর বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার প্রয়োগ করেছিলেন। খাদ্যগ্রহণ ও হযম কাজের প্রতিবন্ধক উপসর্গকে দূর করে দিয়ে পাকস্থলীকে খাদ্যগ্রহণের উপযোগী করে তুলতে পারে এমন ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিলেন।
পাকস্থলীতে খাদ্যকণা কিছু কিছু জমে থাকে। সেগুলোর সাথে কোনো চটচটে পদার্থ মিশ্রিত হলে পাকস্থলীতে বৈকল্যের সৃষ্টি হয়। সে তখন স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। তখনই হযমে ব্যাঘাত দেখা দেয় এবং ভুক্ত খাদ্যদ্রব্যগুলোকে পঁচিয়ে ফেলে। কাজেই তখন এমন ঔষধের প্রয়োজন, যে ঔষধ দুষিত জিনিসগুলো পেট থেকে বের করে দিতে পারে। এ হিশেবে মধুর চেয়ে অধিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, কার্যকর এবং উপকারী আর কিছু হতে পারে না। বিশেষ করে মধুকে যখন গরম পানির সাথে মিশিয়ে অল্প অল্প করে পান করানো হয়। অল্প অল্প করে বার বার মধু পান করানোর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম কারণ আছে। তা হচ্ছে, ঔষধের পরিমাণ এমন হওয়া উচিত, যা রোগীর অবস্থার অনুকূলে হয়। রোগ অনুপাতে ঔষধের পরিমাণ কম হলে রোগ সম্পূর্ণভাবে সারবে না। আর বেশী হয়ে গেলে বরদাশত হবে না। দেহের শক্তি কমে আসবে। রোগের মাত্রা বেড়ে যাবে। তাই দেহের শক্তি এবং রোগের প্রকোপ অনুসারে মধু অল্প অল্প করে না দেয়া হলে তরল প্রবাহ আরও বাড়বে। এজন্যই বারবার মধু পান করানোর হুকুম দেয়া হয়েছিলো। বলা হয়েছিলো, আল্লাহ্ সত্য বলেছেন। তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যা বলছে। অবশেষে মধুর পরিমাণ যখন এমন হলো, যতটুকু পেটের উপসর্গগুলো বের করে দিতে সক্ষম, তখনই এর উপকারিতা ও কার্যকারিতা প্রকাশ পেলো।
আমীরুল মুমিনীন হজরত আলী মুর্তযা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, যখন কেউ কোনো রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে যাবে, অন্য এক বর্ণনায় আছে, যখন তুমি কোনো রোগ থেকে আরোগ্য চাইবে, তখন এই কাজটি করবে— নিজের স্ত্রীকে দেয়া মহরের টাকা থেকে কিছু নিয়ে সেই টাকা দিয়ে মধু কিনতে হবে। তারপর আল্লাহ কিতাব থেকে কোনো কোনো আয়াতে শেফা পেয়ালায় লিখবে। লেখাটুকু বৃষ্টির পানি দ্বারা ধৌত করে তার সাথে মধু মিশ্রিত করে পান করবে। আল্লাহ্তায়ালা শেফা দান করবেন। এ আমলটি করার পিছনে কোনো কোনো আলেম যুক্তি দেখিয়ে থাকেন, আল্লাহ্তায়ালা কোরআনে পাকে এরশাদ করেছেন আমি কোরআনে উহাই নাযিল করেছি, যা মানুষের জন্য শেফা। বৃষ্টির পানিতে বরকত আছে, এ সম্পর্কে কোরআনে পাকে বলা হয়েছে ‘আমি আকাশ থেকে বরকতময় পানি বর্ষণ করে থাকি’। আরও বলা হয়েছে, ‘পবিত্র পানি বর্ষণ করে থাকি।’ মহরের টাকায় বরকতের ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, তোমাদের স্ত্রীগণ যদি তাদের মহরের অর্থ থেকে মনের খুশিতে কিছু প্রদান করে, তাহলে তা মনের খুশিতে খাও। কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে ‘মধুর মধ্যে মানুষের জন্য শেফা রয়েছে।’ শেফা ও বরকতের সামগ্রীগুলো প্রস্তুত হয়ে গেলে আল্লাহ্তায়ালা অবশ্যই শেফাদান করবেন। আল্লাহ্তায়ালাই প্রকৃত শেফা প্রদানকারী।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]
© | সেনানী এপ্স |