সূরা তাহা ও ইয়াসীন


আল্লাহ তায়ালা হুজুর আকরাম (ﷺ) সম্পর্কে এরশাদ করেছেন, ইয়াসীন-হে আমার হাবীব, আমি আপনার উপর কুরআন এজন্য নাযিল করিনি যে আপনি তার কারণে দুরাবস্থায় পড়ে যাবেন। সূরা তাহা নাযিল হওয়ার কারণ হচ্ছে সূরা ইয়াসীন। অর্থাৎ সূরা ইয়াসীন নাযিল হওয়ার পর সূরা তাহা নাযিল হয়। সূরা ইয়াসিন বলা হলাে— ইয়াসীন, বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ, নিশ্চয়ই আপনি রাসূলগণের অন্তর্গত। এরপর সূরা তাহা নাযিল করে জানিয়ে দেয়া হয় যে, আপনি রাসুলগণের অন্তর্ভুক্ত, আপনার উপর কুরআন নাযিল করা হয়েছে, আপনি কোনোরকম দুঃখ কষ্টে নিপতিত হন, আল্লাহপাক সে উদ্দেশ্যে কুরআন নাযিল করেন নি। 'তাহা' হুজুর পাক (ﷺ) এর নাম সমূহের মধ্যেও অন্যতম নাম। আবার এ ‘তাহা’ শব্দ দ্বারা ইনসান বা পুরুষ—এরূপ অর্থও করা হয়ে থাকে। যেমন ‘ইয়াসীন' দ্বারা ইয়া সাইয়্যেদ অর্থ করা হয়ে থাকে। তেমনিভাবে 'তাহা' দ্বারা ইয়া তাহের, ইয়া হাদী অর্থ লওয়া হয়ে থাকে। 


আবার কেউ কেউ এ শব্দটির ব্যাখ্যা এরকমও করে থাকেন যে, আবজাদী সংখ্যা অনুসারে ط বর্ণ দ্বারা নয়টি সংখ্যা আর ه বর্ণ দ্বারা পাঁচটি সংখ্যা, সর্বমােট চৌদ্দটি সংখ্যা বুঝাবে, এবং এ চৌদ্দ সংখ্যার মানে হচ্ছে চৌদ্দতম তারিখের রাতের চাদ অর্থাৎ মােহাম্মদ মােস্তফা (ﷺ)। তবে মুফাসসেরীনে কেরাম এ ধরনের তফসীর ও তাবীলকে বেদআত মনে করেন। তারা তাহা কে আল্লাহতায়ালার নাম হিসেবে গণ্য করে থাকেন। সে যাই হােক উভয় সূরার মধ্যেই হুজুর পাক (ﷺ) এর প্রশংসার বাণী উল্লেখ করা হয়েছে তাতে কোনাে সন্দেহই নেই। যেমন কবির ভাষায় বলা হয়েছে- তুরাইযযুলাউলাকা তুমকি বাসাস্ত, ছানায়েতু তাহা ওয়া ইয়াসী বাসান্ত।


সূরা ইয়াসীনে নবীকরীম (ﷺ) এর সীরাতুল মুস্তাকীমের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার ব্যাপারে ঘােষণা দেয়া হয়েছে। আর সূরা তাহা’ এর মধ্যে মহব্বত ও ভালােবাসা সহযােগে নবীকরীম (ﷺ) কে ইজ্জত সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। হুজুর আকরম (ﷺ) ইবাদত বন্দেগীর মধ্যে বিশেষ করে তাহাজ্জুদ আদায় ও রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে যখন কঠিন কষ্ট করতে লাগলেন; যার ফলে তার কদম মুবারক ফুলে যেতাে এবং সেজন্য কখনও কখনও এক পায়ে দাঁড়িয়ে কিয়ামে লাইল যাপন করতেন, তখন আল্লাহতায়ালা নাযিল করলেন, তাহা আপনি দুঃখকষ্টে নিপাতিত হবেন এজন্যতাে আমি আপনার উপর কুরআন নাযিল করিনি।


‘তাহা' শব্দটি যদি হুজুর পাক (ﷺ) এর নাম হয় তাহলে ননদা বা আহ্বান হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ তাহা’ হবে মুনাদা (আহ্বানকৃত) আর তার পূর্বে হরফে নেদা (আহবানকারী অব্যয়) ধরতে হবে। আর যদি ‘তাহা আল্লাহতায়ালার নাম হয়, তবে কসম হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে বুঝতে হবে। তাহা’ শব্দটি হুজুর আকরম (ﷺ) এর নাম ধরা হলেও কসম হিসাবে ব্যবহার করা বৈধ হবে। পরপর দুখানা আয়াতে কারীমায় এ এলতেফাত (কথায় মােড় পরিবর্তন) দৃষ্টিগােচর হয়। কেননা, প্রথম আয়াতে আলাইকা বলে সম্বােধন করা হয়েছে। আবার তার পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে কিন্তু কুরআন হচ্ছে নসীহত ঐ ব্যক্তির জন্য যে ভয় করে। এখানে ‘লিমান' ‘ঐ ব্যক্তি' বলে নাম পুরুষের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এধরনের এলতেফাতের মধ্যে এক বিশেষ ধরনের মহব্বত ও সম্মান প্রদর্শনের ইঙ্গিত রয়েছে।


এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, হুজুর আকরম (ﷺ) যখন রাত জেগে ইবাদত করতেন, তখন রশি দিয়ে সীনা মুবারক বেঁধে নিতেন। যাতে দ্রিা তাঁকে স্পর্শ করতে না পারে। এমনিভাবে সমস্ত রাত জেগে ইবাদত বন্দেগী করতেন। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ার গ্রন্থকার এটাকে কিয়াম বহির্ভূত বলে মন্তব্য করেছেন। ওয়াল্লাহুআলাম।


কেউ কেউ আবার এরকম বলেন যে, এ আয়াতে কারীমার মর্মার্থ এই যে, হুজুর পাক (ﷺ) যেনাে নিজেকে কষ্টে নিপতিত না করেন, কাফেরদের কুফুরী ও অন্বীকৃতির কারণে মর্মাহত ও দুঃখিত হয়ে যেনাে তিনি নিজেকে তকলীফের মধ্যে ফেলে না দেন। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাে কুরআন মজীদ তাঁর হাবীব (ﷺ) এর উপর অবতীর্ণ করেছেন এ উদ্দেশ্যে যে, তিনি এর মাধ্যমে মানব সম্প্রদায়কে ভীতি প্রদর্শন করবেন। তাদের কাছে কুরআনের প্রচার করবেন। যারা ইমান আনবে স্বীয় মঙ্গলের জন্যই আনবে, আর যারা কুফুরীর উপর হঠকারীতা করবে, তা তারা নিজেদের অমঙ্গলের জন্যই করবে। হুজুর আকরম (ﷺ) এর কর্তব্য তাে শুধু পাঠিয়ে দেয়া। এর বেশী নয়। এ ধরনের মেহেরবানী ও স্নেহশীলতার বাণী অন্য জায়গায় উচ্চারণ করা হয়েছে যেমন, 'সবত আপনি আপনার জীবনকে হালাক করে ফেলবেন তাদের কার্যকলাপ দেখে আক্ষেপ করে করে।'-'তারা যদি এ কথা (কুরআন) এর উপর ইমান না আনে আয়াতের মর্মার্থ এই যে, আল্লাহ তায়ালা তার হাবীব (ﷺ) এর দুশ্চিন্তা দেখে তাঁকে সাস্ত্রনা দিয়ে বলছেন, হে আমার হাবীব; এরা যদি ইমান না আনে তাহলে কি ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের জন্য আপনার জীবনকে ধ্বংস করে ফেলবেন? আলহাদীছ এর অর্থ কুরআন মাজীদ। আল্লাহতায়ালা আরও ইরশাদ ফরমান, 'নিশ্চয়ই আমি জানি যে তাদের কথায় আপনার বক্ষ সংকুচিত হয়ে যায়। এরা আপনার উপর এবং আল্লাহ তায়ালার উপর অপবাদ রটায়। আপনাকে জাদুকর বলে, পাগল বলে, আল্লাহতায়ালার সঙ্গে শরীক নির্ধারণ করে এবং কুরআনের উপর কটুক্তি করে। কাজেই আপনি ধৈ্য ধারণ করুন, কেননা কাফের সম্প্রদায়ের অবস্থা এরকম হয়ে থাকে। আপনি প্রফুল্ল চিত্ত থাকুন। পরিশেষে আপনার জন্যই সাহায্য আসবে। আমি আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য কুরআন নাযিল করিনি যে, সর্বদাই আপনি এর কারণে চিন্তাগ্রস্ত থাকবেন। যেমন অতীতের সমস্ত আম্বিয়া কেরাম ছিলেন। শরহে ছদর (বক্ষ সম্প্রসারণ) করা সত্ত্বেও দরকে ছদর (বক্ষ সংকোচন) সম্ভবত আপনাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আল্লাহ তায়ালা প্রশ্ন করেন, আপনি এরূপ ব্যাকুল হবে কেননা? আমি কি আপনার বক্ষ সম্প্রসারিত করে দেইনি?


এক্ষেত্রে এরকমও হতে পারে যে, উপরােক্ত পরিস্থিতি হয়তাে হুজুর পাক (ﷺ) এর শরহে সদর হাসিল হওয়ার পূর্বে হয়েছিলো।


কোন কোন হৃদয়বান রসিকজন এরকম বলে থাকেন যে, হুজুর আকরাম (ﷺ) ইবাদত বন্দেগী ও শরীয়তের কার্যাবলী আদায় করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ভালোবাসা ও আত্মিক আগ্রহের কারণে যে কঠোরতা ও কৃচ্ছতা অবলম্বন করতেন তার ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম যে, প্রেমান্পদ সাধারণত শক্তিশালী ও ক্ষমতাশালী হয়ে থাকে, আর প্রেমিক বেচারা সর্বদাই হয়ে থাকে দুর্বল ও ক্ষমতাহীন। প্রেমাষ্পদ যদি আপন প্রেমিককে বগলের নীচে ফেলে চেপে ধরে তাহলে এক্ষেত্রে এহেন দুর্বল প্রেমিক বেচারার গতিইবা কি থাকতে পারে? সে তো এক বিশেষ ধরনের কষ্ট অনুভব করবেই। কিন্তু তার সাথে সাথে এক চরম ও পরম সুখানুভূতি তাকে আচ্ছাদিত করে ফেলবে। এরকম কষ্টের ভিতর কিরকম পুলকানুভূতি রয়েছে তার অভিজ্ঞতা কেবল অভিজ্ঞজনের জানা থাকা সম্ভব।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 


© | সেনানী এপ্স |

Top