মেরাজ শরীফের প্রমাণ
একথা স্পষ্টভাবে জেনে রাখা উচিত যে, মেরাজ শরীফের বর্ণনায় সাহাবা কেরাম অনেক হাদীছ বর্ণনা করেছেন, যেগুলোকে অর্থগত দিক দিয়ে মুতাওয়াতির হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যদিও কোনো কোনো বিশেষ বিশেষ প্রসঙ্গে বর্ণনার বিভিন্নতা রয়েছে। তন্মধ্যে মশহুর ওই দীর্ঘ হাদীছখানা, যা ইমাম বোখারী ও ইমাম মুসলিম তাঁদের সহীহ্ বোখারী ও সহীহ্ মুসলিম কিতাবদ্বয়ে হজরত কাতাদা, হজরত আনাস এবং হজরত মালেক থেকে বর্ণনা করেছেন।
হাদীছ শরীফে নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র কলব বিদীর্ণ করার কথা এবং তা স্বর্ণের তশতরীতে রেখে যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করার কথা বলা হয়েছে। কলবে হেকমত ও ইমান পুরে দেয়া হয়েছে। তারপর তা পুনরায় স্বস্থানে সংস্থাপন করে সীনা মোবারককে পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক করে দেয়া হয়েছে।
নবী করীম (ﷺ) এর বক্ষ বিদীর্ণ হয়েছে চারবার। সর্বপ্রথম হয়েছে বাল্যকালে, যখন তিনি হজরত হালীমা সাদীয়া (رضي الله عنه) এর কাছে ছিলেন। দ্বিতীয়বার হয়েছিলো বালেগ হওয়ার প্রাক্কালে দশ বছর বয়সের সময়। তৃতীয়বার হয়েছিলো নবুওয়াতপ্রাপ্তির সময়। আর চতুর্থবার হয়েছিলো মেরাজ যাত্রার প্রাক্কালে। আর এটি হয়েছিলো এ কারণে, যাতে পূর্ণ পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা লাভ হয় এবং আলমে মালাকুতে পৌঁছার জন্য পরিপূর্ণভাবে তিনি প্রস্তুত হয়ে যান। নবী করীম (ﷺ) এর এই মেরাজের বক্ষবিদীর্ণের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করার উপর ধারণা করে নামাজের পূর্বে অজু করার যৌক্তিকতা সাব্যস্ত হয়েছে। কেনোনা মুমিনের নামাজ মেরাজেরই নমুনা। পক্ষান্তরে, হজরত মুসা (عليه السلام) যখন তুর পাহাড়ে আল্লাহ্তায়ালার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তখন আল্লাহ্পাকের সঙ্গে তিনি কালাম করলেন ঠিকই, কিন্তু পূর্বপ্রস্তুতিসম্ভূত পবিত্রতা অর্জিত না থাকায় দীদার লাভে বঞ্চিত হলেন।
এই মাকামের সৌন্দর্য লাভ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, যারা প্রকৃতিপূজারী। প্রাকৃতিক বিধানকে প্রাধান্য দিয়ে যারা বলে, বুক ফেঁড়ে কলব বের করলে মৃত্যু অবধারিত। একাজ করলে হায়াতের সাথে সম্পর্ক থাকতে পারে না। আবার একদল জ্ঞানের পূজারী বলে, কলবকে ধৌত করার অর্থ হচ্ছে কলবের পবিত্রতা প্রদান, নশ্বর ও সম্ভাব্যের ময়লা থেকে রসুল (ﷺ) কে বাতেনী পরিচ্ছন্নতা প্রদান করা। আর যারা আহলে ইমান, তাঁরা এগুলোর কোনো রূপ ভাবার্থ না করে, প্রকাশ্য অর্থ ঠিক রেখেই তার উপর ইমান এনে থাকেন এবং তা স্বীকারও করে নেন। তাঁরা এটাই মনে করেন যে, এ জাতীয় কাজ আল্লাহ্তায়ালার জন্য খুবই স্বাভাবিক। আল্লাহ্তায়ালার জন্য অসম্ভব কিছু নেই। স্বর্ণের তশতরীতে তাঁর কলবে আতহারকে ধৌত করার ব্যাপারে যদি কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করে, স্বর্ণের ব্যবহার তো তাঁর শরীয়তে হারাম। এমন হারামকে মেনে নেয়া হলো কেমন করে? উত্তর হচ্ছে এই যে, এটা সম্মানার্থে বলা হয়েছে। স্বর্ণের ব্যবহার এ জগতে হারাম, কিন্তু আখেরাতে বেহেশতের বরতনসমূহ তো স্বর্ণেরই হবে।
আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘হে রসুল! আপনি বলে দিন যে এটা (স্বর্ণ) ইমানদারদের জন্য এজগতে হারাম, কিন্তু কিয়ামতের দিনের জন্য নয়।’ নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, স্বর্ণ এ জগতে কাফেরদের জন্য আর আখেরাতে আমাদের জন্য। মেরাজের ঘটনাটি তো আখেরাত সম্পর্কিত ঘটনা। দুনিয়াভিত্তিক ঘটনা নয়। উত্তর এও হতে পারে যে, এর ব্যবহার তো রসুলেপাক (ﷺ) নিজে করেননি। করেছেন ফেরেশতা। আর ফেরেশতার জন্য শরীয়তের এই বিধান প্রযোজ্য নয়। আরেকটি বলিষ্ঠ উত্তর এও হতে পারে যে, পুরুষের জন্য স্বর্ণ ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছিলো মদীনা মুনাওয়ারায়, মেরাজের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর।
কোনো কোনো ভাববাদী জ্ঞানীজন স্বর্ণ এবং কলবে নবীর মধ্যে সামঞ্জস্য এভাবে সাধন করেছেন যে, স্বর্ণ হচ্ছে বেহেশতী পাত্র আর এটি খনিজ পদার্থের মধ্যে সবচেয়ে ভারী মূল্যবান পদার্থ। মাটি একে নষ্ট করতে পারে না এবং তার মধ্যে জং-ও ধরে না। মানবজাতির কলবসমূহের মধ্যেও তেমনি কলবে নবী (ﷺ) সবচেয়ে ভারী, মূল্যবান এবং সর্বাধিক সুসজ্জিত। তাঁর কলবে ওহীর ভার অর্পিত হয়েছে। অধঃজগতের মৃত্তিকা তাকে নষ্ট করতে পারে না এবং তাতে জড়জগতের কালিমার জং-ও লাগতে পারে না। যাহাব মানে স্বর্ণ আর তার আরেক অর্থ যাওয়া। সুতরাং এই শব্দটির ভাবগত অর্থ এও হতে পারে, আল্লাহ্তায়ালার দিকে যাওয়া।
আবার এর অর্থ এরকমও হতে পারে, নাপাকী দূর করা, পাক সাফ করা। তাছাড়া এর অর্থ চকচকে হওয়া, স্থায়ী থাকা, পরিষ্কার হওয়া ইত্যাদিও হতে পারে। তশতরীকে হেকমত ও ইমান দ্বারা ভরপুর করার অর্থ ইমান ও হেকমতের পূর্ণতার সারবস্তু নূরানী জওহরসমূহ দ্বারা পরিপূর্ণ করা। তশতরীতে রেখে কলবকে ধৌত করার ব্যাপারটি আধ্যাত্মিক দেহ সংক্রান্ত ব্যাপার হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন সুরা বাকারায় রয়েছে, কিয়ামতের দিন হবে বিল্লাহ্ অর্থাৎ ছায়াদার মৃত্যুটি হবে বকরীর আকৃতি এবং মানুষের নেক আমলসমূহ সুন্দর সুন্দর দৃশ্যের মতো হয়ে উদ্ভাসিত হবে এবং তারপর তাকে মীযানের পাল্লায় তোলা হবে।
আহলে আরেফগণ বলেন, মেরাজের ঘটনায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইমান ও হেকমত অনুভবযোগ্য, ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। এটা অনুমিত আত্মিক ব্যাপার নয় বা এটা কোনো আরয বা জড়বস্তুও নয়, যেমন তর্কবিদরা মনে করেন। নবী করীম (ﷺ) বস্তুর হাকিকতের ব্যাপারে সর্বাধিক জ্ঞাত ও পরিচিত। প্রজ্ঞাপূজারীদের দৃষ্টি জাহেরের উপর। ইমান ও হেকমতকে তারা যখন জাওহার থেকে প্রকাশিত হতে দেখে তখন আরয বলে আখ্যায়িত করে, যা কায়েম বিল গায়েরের হুকুম রাখে। মেরাজের উপর বিশ্বাস রাখা নিঃসন্দেহে ইমানের অঙ্গ। আর এটা হেকমতেরও ব্যাপার। ঘটনাটির উপর জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গী ইমানের পূর্ণতার ও বৃদ্ধির অন্তরায়। এ জাতীয় অভ্যাস ইমান ধ্বংসের ব্যাপারে শংকাহীনতার প্রমাণ। নবী করীম (ﷺ) সর্বাবস্থায় এবং সকল মাকামে মহাবীর, সুদৃঢ় এবং সর্বাধিক শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কলবকে আবে যমযম দ্বারা ধৌত করার মধ্যে হেকমত আছে। আহলে এলেমগণ বলে থাকেন, আবে যমযম হৃদয়কে সুদৃঢ় করে থাকে। এ কারণেই তাঁর কলবকে আবে যমযম দ্বারা ধৌত করা হয়েছিলো, যাতে আলমে মালাকুত দর্শনের ক্ষেত্রে অধিকতর শক্তিশালী হয়ে যায়। এই ঘটনা থেকেই কোনো কোনো আহলে এলেম দলীল পেশ করেন যে, আবে যমযম আবে কাউছার থেকে উত্তম। তাই উত্তম পানি দ্বারাই পবিত্র কলবকে ধৌত করা হয়েছে। কারো কারো মত, আবে কাউছার অনেক দূরে ছিলো। যমযম ছিলো নিকটে বিধায় আবে যমযম দ্বারা ধৌত করা হয়েছিলো। এই বক্তব্যটি দুর্বল। এখানে নিকট এবং দূরের প্রশ্ন তোলা সঙ্গত নয়। কেনোনা আল্লাহ্তায়ালার কুদরতের কাছে উভয়টিই সমান। ওয়াল্লাহু আ’লাম।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]
© | সেনানী এপ্স |