❏ অভিশপ্ত ইয়াযীদঃ
❏ কৃত:- মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান
==> ষাট হিজরী পর্যন্ত ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাস নিষ্কলুষ, ন্যায়নীতি ও বিজয়াদি দ্বারা সমৃদ্ধ থাকার পর যে লোকটা ইসলামের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছিলো, সে ছিলো হযরত আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه]’র কুপুত্র ইয়াযীদ। এক মহান সাহাবী, ওহী লিখক ও ন্যায়পরায়ণ শাসক সাহাবীর সন্তান হয়েও ইয়াযীদ ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনভার লাভের পর পিতার শিক্ষা ও দীক্ষা এবং অন্যান্য বুযুর্গ ব্যক্তিদের নসীহত ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে তার ব্যক্তিগত দুশ্চরিত্র, বিলাসিতা, ইসলামী অনুশাসনের প্রতি উদাসীনতা বরং অবজ্ঞা ইত্যাদিকেই চরিতার্থ করেছিলো। তিন বছর নয় মাসের শাসনামলে সে দ্বীন ও গণ মানুষের কোন কল্যাণ করে সুনাম তো অর্জন করতে পারেনি বরং তার নানাবিধ কুকর্ম ও স্বৈরাচার এবং অযোগ্যতা দ্বারা গোটা মুসলিম জাতির বহু অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
মুসলমান মাত্রই কোন ব্যক্তি ও তার কৃতকর্মের ধরন নির্ণয় করেন- কিতাবুল্লাহ্, সুন্নাতে রসূল, ইজমা’ ও ক্বিয়াসের আলোকে।
সুতরাং ইয়াযীদ এবং তার কৃতকর্মগুলোকে এতদ্ভিত্তিতে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করলে সে পলীদ (নাপাক), মাল‘ঊন (অভিশপ্ত), ধিক্কৃত ও পরিত্যাজ সাব্যস্ত হয়েছে; কিন্তু একশ্রেণীর অবিবেচক, ইসলামী নীতিমালার প্রতি উদাসীন ও ভ্রান্ত আক্বীদা পোষণকারী লোক ইয়াযীদকে নির্বিচারে ‘আমীরুল মু’মিনীন ও উদারপন্থী ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করতে দ্বিধাবোধ করছেনা। তারা ইয়াযীদের কৃতকর্ম, ধর্ম বিশ্বাস ও অমার্জনীয় সীমালংঘনগুলোকে হালকা করে দেখে তার পক্ষে উকালতি করতে গিয়ে উল্টো ফুলের চেয়েও পবিত্র ইমাম হযরত হোসাঈন [رضي الله عنه]’র অশালীন সমালোচনার মতো ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। অথচ সহীহ্ হাদীস শরীফে আছে, যখন কোন ফাসিক্ব বা পাপাচারীর প্রশংসা করা হয়, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা ক্রোধান্বিত হন এবং এ ক্রোধের কারণে তাঁর আরশ কেঁপে ওঠে। আর প্রশংসাকারী তার নির্লজ্জতা ও ইসলামের প্রতি তার বিদ্বেষকেই প্রকাশ করে।
উল্লেখ্য যে, ইয়াযীদের অপকর্ম ও সেগুলোর পরিণাম সম্পর্কে ইসলামের নির্ভরযোগ্য কিতাবগুলোতে গ্রহণযোগ্য আলোচনা মওজূদ রয়েছে। পক্ষান্তরে, কিছুসংখ্যক বিধর্মী ইতিহাসবিদ ও বাতিলপন্থী লেখকের মন্তব্যাদি সরলপ্রাণ মুসলমান এবং এ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানশূন্য মানুষকে বিভ্রান্ত করে আসছে। তাই এ নিবন্ধে ইয়াযীদের আসল পরিচয় প্রামান্য কিতাব-পুস্তকাদির আলোকে আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছি।
○》 ইয়াযীদ কে?
_____________
নাম ইয়াযীদ, পিতা হযরত আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه], কুনিয়াৎ ‘আবূ খালিদ’ উমাইয়া বংশোদ্ভূত। সে ওই হতভাগা লোক, যার কপালে নিরপরাধ আহলে বায়ত-ই কেরামের হত্যাযজ্ঞের কালো দাগ লেগে আছে। এরপর থেকে প্রতিটি যুগে ইসলামী দুনিয়া তাকে তিরষ্কার করে আসছে এবং করতে থাকবে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার নাম ঘৃণা ভরে নেওয়া হবে। এ অপবিত্র-অন্তর বিশিষ্ট, পাষাণ হৃদয় এবং বংশের কলঙ্ক (ইয়াযীদ) ২৫ হিজরীতে আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه]’র ঘরে মায়মূন বিনতে মুনজাদিল কিলাবিয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে। সে অতিমাত্রায় মোটা, কুৎসিৎ চেহারা বিশিষ্ট, বেশী চুল সম্পন্ন, দুশ্চরিত্র, বদ মেজাজ, ফাসিক্ব বা পাপাচারী, মদ্যপায়ী, অপকর্মে অভ্যস্ত, যালিম এবং বে-আদব (গোস্তাখ) ছিলো।
[সূত্র. ‘সাওয়ানিহ্-ই কারবালা’, কৃত. সদরুল আফাযিল সৈয়দ নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী [رحمه الله عليه]]
রাজকীয় পরিবেশে সে লালিত হয়। হযরত আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه] তার লালন-পালনের ক্ষেত্রে কোনরূপ ত্রুটি করেননি। তিনি শুরু থেকেই লেখাপড়ার সাথে সাথে তাকে রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়মাবলীও শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি দু’ বার তাকে আমীরুল হজ্জ নিয়োগ করেন। কয়েকটা যুদ্ধেও সে অংশগ্রহণ করেছিলো। আরবী সাহিত্য ও কাব্যের প্রতি তার ঝোঁক ছিলো যথেষ্ট। সে কবিতা রচনা ও আবৃত্তিতে দক্ষতাও লাভ করেছিলো। অন্যদিকে শিকারের প্রতি তার আগ্রহ ছিলো প্রবল। সে কয়েক প্রকারের শিকারী কুকুর পালন করতো ক্রমশ এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তজ্জন্য লোকেরা তাকে পছন্দ করতো না। হযরত আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه]’র ইন্তিকালের পর ইয়াযীদ ৬০ হিজরীর রজব মাসে সিংহাসনে বসেছিলো।
[সূত্রঃ তারীখে ইসলাম, কৃত. ড. হামীদ উদ্দীন]
অবশ্য কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে ৬৮০ খ্রিস্ট্রাব্দে এপ্রিল মাস, মোতাবেক ৬১ হিজরির সা’বান মাসে হযরত আমীরে মু‘আভিয়া [رضي الله عنه]’র ইনতিক্বালের পর ইয়াযীদ সিংহাসনে অধিষ্টিত হয়।
[সূত্রঃ ইসলামের ইতিহাস, কৃত. হাসান আলী চৌধুরী]
○》 ইয়াযীদের মৃত্যুঃ
_____________
ইয়াযীদ ইবনে মু‘আভিয়া ৩৯ বছর বয়সে ৬৪হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে মৃত্যুবরণ করেছে। বাবুস্ সগীরাহ্ গোরস্তানে তাকে গোরস্থ করা হয়। [সূত্রঃ হায়াতুল হায়াওয়ান: কৃত. আল্লামা কামাল উদ্দীন দামিরী]
○》 শাসনকালঃ
_____________
ইয়াযীদ, মতান্তরে ৩ বছর ৯ মাস শাসনকার্য পরিচালনা করেছে। ঐতিহাসিক আল ফাখরী, ফম ক্রেমার ও ইবনুত্ তিকতারের মতে ইয়াযীদের এ শাসনকাল তিন(০৩)টি দুষ্কর্মের জন্য কুখ্যাত ছিলো। প্রথম বছরে সে হযরত হুসাঈন ইবনে আলী [رضي الله عنه]’কে ও আহলে বায়তের নিরপরাধ লোকদেরকে শহীদ করেছে। দ্বিতীয় বছরে মদীনা শরীফের বিরুদ্ধে তার সৈন্য প্রেরণ করে মদীনা মুনাওয়ারাকে লুণ্ঠন ও অবমাননা করিয়েছে। আর তৃতীয় বছরে সে কা’বা শরীফের উপর হামলা করেছে ও কা’বার গিলাফে অগ্নিসংযোগ করেছে। এ তিনটি ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে এক অতি ভয়াবহ প্রভাব বিস্তার করেছিলো। [সূত্রঃ ইসলামের ইতিহাস: প্রথম খন্ড, কৃত, হাসান আলী চৌধুরী]
○》 ইয়াযীদের অন্যান্য দুষ্কর্মঃ
___________________
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে হানযালাহ্ আল গাসীল [رضي الله عنه] বলেন, ‘‘আল্লাহরই শপথ, আমি ইয়াযীদকে তখনই ত্যাগ করেছি ও তার নিকট থেকে দূরে সরে গিয়েছি, যখন আমার আশঙ্কা হয়েছিলো যে, তার অসৎ কাজগুলোর কারণে আসমান থেকে পাথর বর্ষিত হবে কিনা। (যেভাবে হযরত লূত [عليه السلام]-এর সম্প্রদায়ের উপর বর্ষিত হয়েছিলো)
শাসনভার হাতে নিয়ে এ হতভাগা ‘মুহাররামাত’ (যেসব নারীকে বিবাহ্ করার হারাম)-এর সাথে বিবাহ্ করা বৈধ বলে ঘোষণা করলো, সুদের মতো হারাম কাজকে বৈধ বলে ঘোষনা দিয়ে প্রকাশ্যে তা চালু করছিলো। মদীনাতুর রসূল [ﷺ]-এর অবমাননা, কা’বাতুল্লাহর মানহানি ও গিলাফে কা’বায় অগ্নি সংযোগ করিয়েছিলো। দূরদর্শী ও গূঢ় রহস্যজ্ঞানী সাহাবীগণ তখনই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, যখন মুসলিম রাজ্যের শাসনভার এ হতভাগার হাতে এসেছিলো। ৫৯ হিজরীতে হযরত আবূ হোরায়রা [رضي الله عنه] আল্লাহর দরবারে দো‘আ করেছিলেন, ‘‘হে আমার রব, আমি তোমার দরবারে পানাহ্ (আশ্রয়) চাচ্ছি ৬০ হিজরীর প্রারম্ভ ও অল্পবয়স্ক ছেলেদের রাজত্ব থেকে।’’ এ দো‘আ কবুল হয়েছিলো। তিনি ৫৯ হিজরীতে মদীনা তাইয়্যেবায় ওফাত পান। অর্থাৎ ৬০/৬১ হিজরীতে ইয়াযীদ সিংহাসন দখল করেছিলো; এর পূর্বে তিনি ওফাত পেয়ে যান। সাহাবী-ই রসূল হযরত আবুদ্ দারদা [رضي الله عنه] হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার বিষয়বস্তু হচ্ছে- হুযূর-ই আক্বদাস এরশাদ করেছেন, ‘‘আমার সুন্নাতকে সর্বপ্রথম বদলে ফেলবে উমাইয়া বংশের এক লোক, যার নাম হবে ইয়াযীদ।’’ হযরত আবূ ওবায়দাহ্ [رضي الله عنه] থেকেও একই বিষয়বস্তুর হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
[সূত্রঃ সাওয়ানিহে কারবালা, কৃত. সদরুল আফাযিল [رحمه الله عليه]]
○》 সহীহ্ হাদীসসমূহে ইয়াযীদ সম্পর্কে সতর্কবাণীঃ
______________________________________
ইমাম বোখারী, হযরত আবূ হোরায়রা [رضي الله عنه]’র বরাতে বর্ণনা করেছেন, হুযূর-ই আক্রাম এরশাদ করেন, ‘‘আমার উম্মতের ধ্বংস (অপূরণীয় বিপর্যয়) ক্বোরাঈশের ছেলেদের হাতে হবে।’’ হযরত আবূ হোরায়রা [رضي الله عنه] বলেন, ‘‘তোমরা চাইলে আমি তার এবং তার পিতার নামও বলে দিতে পারি। সে হলো অমুখের পুত্র অমুক।’’ ইমাম আমর ইবনে ইয়াহিয়া বলেন, ‘‘আমি আমার দাদার সাথে সিরিয়া যেতাম। আমি সেখানে অল্পবয়স্ক যুবকদের দেখেছি। ইয়াযীদও তাদের মধ্যে ছিলো।’’ তাঁর ছাত্রগণ আরয করলেন, ‘‘তাহলে আপনি তার সম্পর্কে ভালভাবে জানতেন।’’ হযরত আমর ইবনে ইয়াহিয়া মারওয়ানকেও ওইসব অভিশপ্ত যুবকদের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। তিনি এ হাদীস শরীফকে উমাইয়া বংশের লোকদের বেলায় প্রযোজ্য বলেছেন।
সহীহ্ বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘কিরমানী’ তে আল্লামা কিরমানী বলেছেন, ‘‘হাদীস শরীফে ‘আহদাস’ শব্দ এসেছে।) ‘আহদাস’ হচ্ছে উঠতি বয়সের যুবকগণ। তাদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হচ্ছে ইয়াযীদ। সে সাধারণত বয়স্ক বুযুর্গদেরকে শহরগুলোর নেতৃত্ব থেকে নামিয়ে অল্পবয়স্ক আত্মীয়-স্বজনদেরকে শাসক নিয়োগ করেছিলো।
সমস্ত ব্যাখ্যাকারী, হযরত মোল্লা আলী ক্বারীসহ একথার উপর একমত যে, হাদীস শরীফে উল্লেখিত غِلْمَةُ قُرَيْش (ক্বোরাইশ বংশের ছেলেগণ)-এর মধ্যে ইয়াযীদ অবশ্যই রয়েছে।
হযরত আবূ হোরায়রা [رضي الله عنه] বলেন, হুযূর রাহমাতুল্লিল আলামীন [ﷺ] এরশাদ করেন-
تَعَوَّذُوْا بِاللهِ مِنْ رَأْسِ السِّتِّيْنَ وَاِمَارَةِ الصِّبْيَانِ
[হে লোকেরা! (হিজরী) ষাট সালের প্রারম্ভ ও ছেলেদের আমীর বা শাসক হওয়া থেকে আল্লাহর পানাহ্ (আশ্রয়) কামনা করো।] [মিশকাত শরীফ: ৩২৩পৃ.]
‘
ছেলেদের শাসক হওয়া’ মানে মূর্খ প্রকৃতির ছেলেদের রাজত্ব। যেমনঃ ইয়াযীদ ইবনে মু‘আভিয়া, মারওয়ান ইবনে হাকামের ছেলেরা। (সূত্র. মোল্লা আরী ক্বারী)
অন্য হাদীসে, হুযূর-ই আক্রাম তাঁর পবিত্র স্বপ্নে এদেরকেই মিম্বরের উপর খেলাধুলা করতে দেখেছিলেন। হুযূর-ই আক্রামের একটি হাদীসে এমনও বর্ণিত হয়েছে, যা আল্লামা সুয়ূত্বী ‘তারীখুল খোলাফা’য়, ইমাম ইবনে হাজর ‘সাওয়া-ইক্বে মুহরিক্বাহ্’য়, শায়খ মুহাম্মদ সাবগান ‘ইস‘আফুর রাগিবীন’-এ ‘মুসনাদ-ই আবূ ইয়া’লা’ থেকে বর্ণনা করেছেন-
لاَ يَزَالُ اَمْرُ اُمَّتِىْ قَائِمًا بِالْقِسْطِ حَتّى يَكُوْنَ اَوْلُ مَنْ يُثَلْمِهُ رَجَلٌ مِّنْ بَنِىْ اُمَيَّةَ يُقَالُ لَه يَزِيْدُ
অর্থাৎ : আমার উম্মতের বিষয়াদি ঠিকঠাক থাকবে যতক্ষণ না এক প্রথম ব্যক্তি তাতে ফাটল ধরাবে, সে হচ্ছে বনী উমাইয়ার এক ব্যক্তি, যার নাম ‘ইয়াযীদ’।
তিনি আরো বর্ণনা করেছেন-
سَمِعْتُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ اَوَّلُ مَنْ يُّبَدِّلُ سُنَّتِىْ رَجَلٌ مِّنْ بَنِىْ اُمَيَّةَ يُقُالُ لَه يَزِيْدُ
‘‘আমি হুযূর-ই আক্রাম রসূলুল্লাহ্ [ﷺ]’কে এরশাদ করতে শুনেছি, প্রথম ব্যক্তি, যে আমার সুন্নাতকে বদলে ফেলবে, সে বনী উমাইয়ার এক ব্যক্তি হবে, যার নাম হবে ইয়াযীদ।’’
○》 ইয়াযীদ সম্পর্কে বুযুর্গ ব্যক্তিদের মন্তব্যঃ
________________________________
এক ব্যক্তি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয [رضي الله عنه]’র সামনে ইয়াযীদকে ‘আমীরুল মু’মিনীন’ বলেছিলো। তিনি লোকটাকে ‘বিশটি কশাঘাত’ করেছিলেন। (২০ দুররা মেরেছিলেন।)
[সূত্রঃ ‘সাওয়া-ইক্বি মুহরিক্বাহ্ ও তারীখুল খোলাফা, পৃ. ১৪৬]
ইয়াযীদের সমসাময়িক হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে হানযালাহ্ গসীলুল মালাইকাহ্ [رضى الله عنهما] ইয়াযীদ সম্পর্কে বলেছেন- ‘‘সে উম্মে ওয়ালা, কন্যা ও বোনদের সাথে বিবাহের প্রচলনদাতা, মদ্যপায়ী ও নামায বর্জনকারী।’’
[সূত্রঃ তারীখুল খোলাফা, পৃ. ১৪৬]
হযরত শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী [رحمه الله عليه] ও লিখেছেন- ‘‘ইয়াযীদ-ই পলীদ ছিলো ফাসিক্ব-ফাজির (পাপাচারী), খোদাদ্রোহী, লুণ্ঠনকারী ইত্যাদি। এসব বিষয়ের পক্ষে অকাট্য প্রমাণাদি রয়েছে।’’ ইমাম হোসাঈন [رضي الله عنه]’র বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়ে তাঁকে শহীদ করার নেপথ্যে ইয়াযীদের হাত রয়েছে। এ-ই শায়খ মুহাক্বক্বিক্ব ‘আলাল ইত্বলাক্ব ‘জযবুল ক্বুলূব’-এ লিখেছেন, হযরত ইমাম আলী মাক্বামের শাহাদাতের পর সর্বাপেক্ষা মন্দ ও গর্হিত কাজ ও ঘটনা ইয়াযীদের শাসনামলে ঘটেছিলো, তা হচ্ছে ‘হাররার ঘটনা’। এ ঘটনায় ইয়াযীদ তার সেনাপতি মুসলিম ইবনে ওক্বাবাহকে বিরাট সেনাবাহিনীর সাথে মিলে মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পাঠিয়েছিলো। আর বলেছিলো, ‘‘যদি তাঁরা আনুগত্য স্বীকার না করেন, তাহলে তিনদিন যাবৎ এ ভূ-খন্ডকে তোমার জন্য মুবাহ্ করা হলো।’’ (হত্যাযজ্ঞের অনুমতি দেওয়া হলো।) সিরীয় পশুগুলো হেরম-ই পাকে ঢুকে সেটার মর্যাদাকে পদদলিত করেছে। এক হাজার সাতশ’ মুহাজির ও আনসার সাহাবী ও তাবে‘ঈ আলিম, সাতশ’ হাফেয-ই ক্বোরআন এবং দু’ হাজার জনসাধারণকে যবেহ (হত্যা) করেছে। আর হাজার হাজার পর্দানশীন কুমারীর শ্লীলতা নষ্ট করেছে। মসজিদে নবভী শরীফে ঘোড়া দৌঁড়িয়েছে। রিয়াযুল জান্নাতে ঘোড়া বেঁধেছে। (সেগুলোর পায়খানা-প্রস্রাব দ্বারা সেটাকে নাপাক করেছে।) তিনদিন যাবৎ মসজিদে নবভী শরীফে আযান ও নামায হয়নি। হযরত আবূ সা‘ঈদ খুদরী [رضي الله عنه]’র দাড়ি মুবারক উপড়ে ফেলা হয়েছে। রক্ষা পেয়েছিলো একমাত্র তারাই, যারা এহেন দুশ্চরিত্র যালিম ইয়াযীদের বায়‘আত গ্রহণ করেছিলো।
ইয়াযীদের পুত্র দ্বিতীয় মু‘আভিয়া যে খোৎবা (ভাষণ) দিয়েছিলেন, তাও ইয়াযীদের দুর্ষ্কম ও ইসলাম-বিদ্বেষের প্রমাণ বহন করে। (তিনি অবশ্য সৎ ও ন্যায়পরায়ণ লোক ছিলেন।) তিনি বলেন, ‘‘অতঃপর আমার পিতাকে রাজকীয় পোশাক পরানো হয়। সে অনুপযুক্ত ছিলো। রসূল-ই আক্রামের দৌহিত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এর ফলে তার জীবন হ্রাস পেয়েছে, বংশ নিপাত গেছে, সে তার কবরে তার পাপরাশির শাস্তিতে গ্রেফতার হয়ে আছে।’’
তারপর তিনি কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘‘আমাদের সবার জন্য অতি আফসোস ও মনোকষ্টের ব্যাপার হলো তার মন্দমৃত্যু ও মন্দ ঠিকানা (পরিণাম)। সে তো রসূলে আক্রামের সম্মানকে ভূ-লুণ্ঠিত করেছে। মদকে হালাল করেছে, কা’বা শরীফ ধ্বংস করেছে।’’[সূত্রঃ সাওয়া-ইক্ব-ই মুহরিক্বাহ্, পৃ. ১৩৪]
◇ ইয়াযীদের উপর লা’নতঃ
_____________________
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, আল্লামা ইবনে জূযী [رضى الله عنهما] প্রমুখ ইয়াযীদকে লা’নত (অভিম্পাত) করা বৈধ বলে সাব্যস্ত করেছেন। সাইয়্যেদুনা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল [رضي الله عنه] ইয়াযীদকে ‘কাফির’ বলেছেন। তার উপর লা’নত করাকে বৈধ বলেছেন।
আল্লামা সা’দ উদ্দীন তাফতাযানী শাফে‘ঈ [رحمه الله عليه] ‘শরহে আক্বা-ইদ’-এ ইয়াযীদকে কাফির ও লা’নতী বলেছেন; কিন্তু খারেজী সম্প্রদায়ের লোকেরা হযরত উম্মে হাকাম বিনতে মিলহানের হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ইয়াযীদকে সৎকর্মপরায়ণ ও মাগফিরাত (ক্ষমা)-এর উপযোগী বলে থাকে। বস্তুত তারা নিরেট নির্লজ্জতা ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ইসলামের প্রতি তাদের শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ করে থাকে এবং এটা প্রমাণিত করতে চায়; অথচ উক্ত হাদীস শরীফে এমন কোন শব্দ নেই, যা একথা বুঝায় যে, ইয়াযীদ কিংবা কনস্টান্টিনিপোলের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে মাগফিরাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। বস্তুত ‘মাগফূরুন লাহুম’ (তাদেরকে ক্ষমা করা হবে)-এর সুসংবাদ তাদের জন্যই, যারা যুদ্ধ করার সময় মুসলমান থাকে এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঈমানের উপর ক্বায়েম থাকে। আর যদি কেউ ওই যুদ্ধের পর কাফির হয়ে যায়, সে ইমাম ও বিজ্ঞ আলিমদের সর্বসম্মতিক্রমে ওই সুসংবাদের উপযোগী নয়।
প্রকৃতপক্ষে, ইয়াযীদকে যারা ‘আমীর’, ‘খলীফা’, ধার্মিক ও সৎকর্মপরায়ণ বলে, তারাও লা’নতের উপযোগী এবং ঈমান হারাচ্ছে। এ থেকেও ইয়াযীদের চরিত্রহীনতা ও পাপাচারিতার প্রমাণ পাওয়া যায় যে,
ইয়াযীদ যখন হযরত আবুদ্ দারদা [رضي الله عنه]’র কন্যাকে শাদী করার প্রস্তাব পাঠালো, তখন হযরত আবুদ্ দারদা [رضي الله عنه] এ বলে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, ‘‘তার ঘরে তো কাজের মেয়েরা রয়েছে।’’
আসলে হযরত আবুদ্ দারদা ইঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘‘সে তো ভোগ-বিলাসী ও ব্যভিচারী। কাজের মেয়েরা তার অপকর্মের শিকার হয়ে আছে।
সুতরাং এমন দুশ্চরিত্র লম্পটকে কে তার কন্যার বিবাহ দেবে?’’ সুতরাং হযরত আবদুদ্ দারদা [رضي الله عنه] ইয়াযীদেরই এক সমসাময়িক যুবকের সাথে তাঁর কন্যার বিবাহ্ দিয়েছিলেন।
○》একটি সংশয়ের অপনোদনঃ
________________________
যারা ইয়াযীদের পক্ষে উকালতী করে এবং তার সাফাই গায় তারা সহীহ্ বোখারী শরীফের নিন্মলিখিত হাদীস শরীফকে তাদের পক্ষে দলীল হিসেবে দাঁড় করাতে চায়-
قَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَوَّلُ جَيْسٍ مِّنْ اُمَّتِىْ يَغْزُوْنَ مَدِيْنَةَ قَيْصَرَ مَغْفُوْرٌ لَّهُمْ (بخارى جلد اول : كتاب الجهاد : باب ماقيل فى قتال الروم)
অর্থাৎ নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করেছেন, আমার উম্মতের ওই সেনাবাহিনীকে ক্ষমা করা হবে, যারা রোম সম্রাট ক্বায়সারের শহর (ইস্তাম্বুল)-এর উপর সর্বপ্রথম হামলা করবে।
[বোখারী শরীফ: ১ম খন্ড: জিহাদ পর্ব: রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শীর্ষক অধ্যায়: পৃ. ৪১০]
এ হাদীসের কোন কোন ব্যাখ্যাকারীও এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ইয়াযীদকে ওই প্রথম যুদ্ধের সিপাহসালার ছিলো মর্মে লিখে ফেললেও এ প্রসঙ্গে সঠিক ব্যাখ্যা, অভিমত ও সিদ্ধান্ত নিম্বরূপ:
নিন্সলিখিত প্রশ্নগুলোর জবাবেই এ প্রসঙ্গে সঠিক বিষয়টি বের হয়ে আসে-
১. ইস্তাম্বুলের উপর কতবার হামলা করা হয়েছিলো?
২. ইয়াযীদ তাতে শরীক ছিলো কিনা? শরীক থাকলেও কীভাবে? সিপাহ্সালার হিসেবে, না সাধারণ সৈন্য হিসেবে?
৩. তার এ অংশগ্রহণ কি তার ইচ্ছাকৃত ছিলো, না বাধ্য হয়ে যুদ্ধে রওনা হয়েছিলো? শরীক হলেও উক্ত হাদীস শরীফের সুসংবাদ তার বেলায় প্রযোজ্য কিনা?
[] উত্তরঃ প্রথম প্রশ্নের জবাবে সঠিক অভিমত হচ্ছে- ইস্তাম্বুলের উপর হামলা কয়েকবার হয়েছিলো: ৪৬ হিজরিতে হযরত আবদুর রহমান ইবনে খালিদের নেতৃত্বে, ৪৯ হিজরীতে সুফিয়ান ইবনে আউফের নেতৃত্বে, ৫২ হিজরীতে, অন্য এক বর্ণনায় ৫৫ হিজরিতে ইয়াযীদের নেতৃত্বে। উল্লেখ্য, এমন ক’টি যুদ্ধে হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী [رضي الله عنه] শরীক ছিলেন এবং ৫২হিজরীতে তিনি সেখানে ওফাত পান এবং ওখানেই তাঁকে দাফন করা হয়।
কনস্টান্টিনিপোল (ইস্তাম্বুল) যে যুদ্ধে বিজিত হয়েছিলো, ওই যুদ্ধে ইয়াযীদ সিপাহ্সালার ছিলোনা; বরং একজন সাধারণ সৈন্য ছিলো। [কামিল: ইবনুল আসীর]
ইয়াযীদ ইস্তাম্বুল (কনস্টান্টিনিপোল)-এর যুদ্ধে সন্তুষ্টচিত্তে যায়নি; বরং তার পিতা হযরত আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه] কঠোর নির্দেশ দিয়ে এবং অন্যথায় কঠোর শাস্তি দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে পথিমধ্যে ‘ফারক্বাদূনা’ নামক স্থানে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ওখানেই থেকে যায়। তখন সে বলেছিলো, ‘‘তখনতো আমার কোন পরোয়া নেই, যখন আমি ‘দিয়ারে সারান’-এ উঁচু কার্পেটে বসা আছি এবং আমার স্ত্রী উম্মে কালসূম আমার বগলে আছে।’’
সুতরাং ইয়াযীদ কোন মতেই ওই সুসংবাদের আওতায় আসবে না। সে ক্ষমা পাবার উপযোগী নয়। এমনকি মতান্তরে সিপাহ্সালার থাকলেও নয়। বিশেষ করে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল [رضي الله عنه] প্রমুখ বলেছেন, ইয়াযীদ কাফির ছিলো। কাফির কোন সৎকর্মের কারণে মাগফিরাত পায় না। সুরা নিসার আয়াত নম্বর ১১ তে একথা এরশাদ হয়েছে।
[সূত্রঃ তাহাফ্ফুযে আক্বাইদ: ৬৬০ পৃ., মিরআত শরহে মিশকাত: ৬ষ্ঠ খন্ড, বাংলা সংস্করণ, পৃ. ২০৪]
পরিশেষে, ইযাযীদ যেমন অভিশপ্ত তেমনি ইয়াযীদীরাও অভিশপ্ত, নির্লজ্জ ও অবিবেচক। অভিশাপ কাফিরকেই দেওয়া যায়। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল [رحمه الله عليه] এজন্যই বলেছেন, ইয়াযীদ কাফির ছিলো, সে অভিশাপেরই উপযোগী। বিশ্ববিখ্যাত আক্বাইদগ্রন্থ ‘শরহে আক্বাইদ’-এ ইয়াযীদকে কাফির ও লা’নতী বলা হয়েছে। সুতরাং ইয়াযীদী তথা যারা ইয়াযীদের পক্ষে শাফাই গায় তারা ইসলামের দুশমন।
পক্ষান্তরে, হযরত ইমাম হোসাঈন [رضي الله عنه]) সত্যের উপর ছিলেন। তিনি ইয়াযীদ ও ইয়াযীদের বাতিল খিলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে ইসলামের গৌরবকেই অক্ষুন্ন রেখেছেন। এর পক্ষেও বহু অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। আর হযরত আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه] একজন ন্যায়পরায়ণ সাহাবী ছিলেন। ইয়াযীদ তাঁর পুত্র ছিলো এবং তাঁর পরবর্তীতে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক হয়েছিলো। তা কীভাবে হলো এবং তজ্জন্য আমীর মু‘আভিয়া [رضي الله عنه]’কে দায়ী করা যাবে না এবং তাঁর বিরুদ্ধে অশালীন ও অমূলক সমালোচনা করা যাবে না। এ মর্মেও অনেক শরীয়তসম্মত ও ঐতিহাসিক প্রমাণাদি রয়েছে।
‘তাহাফ্ফুযে আক্বাইদ’, সাওয়া-ইক্বে মুহারিক্বাহ্, ‘‘হযরত আমীর মু‘আভিয়া’ (কৃত. মুফতী আহমদ ইয়ার খান) ইত্যাদি দ্রষ্টব্য। পরিসরের স্বল্পতার কারণে এ প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা এ নিবন্ধে করা গেলো না। {সংগৃহীত}