পবিত্র কেশরাজি
হযরত কাতাদা (رضي الله عنه) বলেন, আমি হযরত আনাছ (رضي الله عنه) কে রাসূলুল্লাহ, (ﷺ) এর পবিত্র কেশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, হুজুর পাক (ﷺ) এর মাথার চুল رجل রাজিল জাতীয় ছিলাে। রাজিল শব্দটি ر‘র’এর মধ্যে যবর ও ج 'জীম' এর মধ্যে যের দিয়ে পড়তে হবে। তার অর্থ হচ্ছে নরােম বা মােলায়েম। চুল মােবারক সম্পর্কে অন্যান্য বর্ণনায় سبط 'সাবত (যবর ও 'বা সাকিন যোগে) শব্দ এসেছে। যার অর্থ নরোম ও ঝুলন্ত চুল। আবার قطط 'কাতাত' (কাফ- এ যবর ও তা এ যের যােগে) শব্দও পাওয়া যায়। যার অর্থ শক্ত ও পেঁচানাে চুল। হাবশীদের চুলের ন্যায়। এদেশে যাকে থােকা চুল বা কোকড়ানো চুল বলা হয়। চুলের বর্ণনায় আবার কোন কোন হাদীসে জাআদ শব্দও পাওয়া যায়। যার অর্থ শক্ত ও পেঁচানাে চুল। আসলে পুরাপুরি জাআদ জাতীয় চুল ছিলাে না বরং তার চুল মােবারক ছিলাে নেম, লম্বা ও থােকা বাঁধা।سبط 'সাবত ও ' قطط'কাতাত' শব্দদ্বয়ের মুকাবিলায় জাআদ শব্দের ব্যবহার জায়েয হয় না। আবার কোনো কোনো হাদীসে জাআদ রহিত করা হয়েছে। কেননা জাআদ কঠিন ও কুঁকড়ানাে চুলকে বলা হয়। হুজুর আকরম (ﷺ) এর চুল সাবত জাতীয় ছিলাে। কাতিত জাতীয় নয়। বরং দুই এর মাঝামাঝি চুল ছিলাে। যাকে رجل'রাজিল' বা নরোম মােলায়েম চুল বলা হয়। তার মাথার চুল কানের মধ্যখান পর্যন্ত লম্বা ছিলাে। অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায় কান পর্যন্ত অন্য আরেক বর্ণনানুসারে দু'কানের লতি পর্যন্ত লম্বা ছিলাে। তাছাড়া কাঁধ পর্যন্ত বা প্রায় কাঁধ পর্যন্তএরপ বর্ণনাও আছে। এরূপ বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে সামঞ্জস্যের বিধান হচ্ছে এই যেহুজুর পাক (ﷺ) কখনও কখনও চুলে তেল ব্যবহার করতেন বা চিরুনী দিয়ে মাথা আঁচড়াতেন, তখন চুল লম্বা হয়ে যেতাে। আর অন্য সময় তার বিপরীত থাকতাে। অথবা চুল যখন লম্বা হয়ে যেতাে তখন কাঁধ পর্যন্ত থাকতাে আবার যখন চুল ছােটো করে ফেলতেন তখন খাটো হয়ে যেতাে।
মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে আছে, হুজুর (ﷺ) যখন দীর্ঘদিন ধরে চুল ছাঁটতেন না, তখন চুল লম্বা হয়ে যেতাে। আবার যখন হেঁটে ফেলতেন তখন চুল ছােটো হয়ে যেতাে। মাজমাউল বিহার কিতাবেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। এই বর্ণনা দ্বারা আরেকটি ব্যাপারে জানা গেলাে যে, হুজুর (ﷺ) স্বীয় চুল কর্তন করতেন। মস্তক মুণ্ডন করতেন না। আর মস্তক মুন্ডন করার ব্যাপারে তিনি স্বয়ং এরশাদ করেছেন যে, তিনি হজ ও ওমরা ব্যতীত মস্তক মুন্ডন করতেন না। আল্লাহ তায়ালাই এ ব্যাপারে সর্বাধিক জ্ঞাত।
হযরত উম্মে হানী (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন, হুজুর আকরাম (ﷺ) যখন মদীনা মুনাওয়ারা থেকে মক্কা মুয়াযযামায় তাশরীফ আনলেন তখন তার মাথা মুবারকে চুলের চার খানা খা টোন ছিলাে। মাথার চুল লম্বা রাখা সুন্নত। তবে উপরােক্ত প্রচলন বহু প্রাচীন কাল থেকেই আরবদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তবে এক্ষেত্রে চুলের প্রতি লক্ষ্য রাখা, তেল ও চিরুনী ব্যবহারের মাধ্যমে চুলের প্রতি যত্ন নেওয়া অপরিহার্য। হুজুর আকরাম (ﷺ) স্বীয় কেশরাজি অধিক চিরুনি ব্যবহার করতেন। কারো মাথার চুল আলু থালু ও অবিন্যস্ত দেখলে তিনি তা পছন্দ করতেন না। তাকে লক্ষ্য করে এরূপ বলেছেন ‘তুমি কি কখনো তাকে (শয়তানকে) দেখেছো?' তদ্রুপ তিনি অতিমাত্রায় পরিপাটি করা লম্বা চুলও অপছন্দ করতেন। ভারসাম্যকৃত মধ্যম প্রকার চুলকে বেশি পছন্দ করতেন। চুলে তেল চিরুনি ব্যবহারে অক্ষম ব্যক্তির জন্য খাটো করে চুল রাখাই উত্তম।
আমীরুল মু'মিনীন হযরত আলী (কঃ) বলেন, আমি মাথার চুলকে এই সময় থেকে দুশমন মনে করতাম যেদিন থেকে রাসূল পাক (ﷺ) কে এ কথা বলতে শুনেছি, প্রত্যেক চুলের ফাঁকে নাপাক থাকে। পরবর্তী সময়ের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিগণ বিশেষ করে মাশায়েখ, দরবেশ ও আবেদ বান্দাগণের ভিতর চুল খাটো করে রাখার যে রীতি তার কারণ সম্ভবত এটা। তারা চুলে তেল চিরুনি ব্যবহার করতে অক্ষম ছিলেন অথবা কাজের জন্য তাদের ফুরসত মিলছে না।
ফয়দা
চুল রাখার ব্যাপারে সুন্নত তরীকা ওটাই যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। সাইয়েদুল হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে এসেছে, হুজুর পাক (ﷺ) চুলে‘সদল’ (স্বাভাবিকভাবে চুলকে ছেড়ে দেয়া) করতেন। আহলে কিতাবরাও চুলে সদল করতাে। মুশরেকরা কিন্তু চুলে ফরক (সিঁথি) করতাে। সদলের অর্থ হচ্ছে চুলকে কপালের দিক থেকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে পিছনের দিকে ছেড়ে দেয়া। আর ফরকের অর্থ হচ্ছে চুল সমূহকে পরস্পরে পৃথক করে এমন ভাবে মাথা আঁচড়ানো যাতে মধ্যবর্তী স্থানে সিঁথি তৈরী হয়ে যায়। হুজুর পাক (ﷺ) যে চুলে সদল করতেন তার কারণ হচ্ছে, যে সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে স্পষ্ট কোনো বিধান এখনো আসে নাই, যে সমস্ত ব্যাপারে তিনি আহলে কিতাবদের আনুরূপ্য পছন্দ করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি চুলের সিঁথি করতে শুরু করেছিলেন। এর উপর ভিত্তি করে উলামায়ে কেরাম বলেন, চুলে সিঁথি করা সুন্নত। কেননা হুজুর (ﷺ) সদল পরিহার করে পরবর্তীতে ফরকের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এক্ষেত্রে মূল কথা হচ্ছে তাকে এরকমই হুকুম দেয়া হয়েছিলাে। কাজেই সদল করার নিয়মটি রহিত হয়ে গিয়েছে। আবার এ-ও হতে পারে এই, ফরক করার নিয়ম হুজুর (ﷺ) এর ইজতিহাদের ভিত্তিতে সেলাই। কারণ, ফরক করায় আহলে কিতাবদের বিরােধিতা করা হয়। আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে আদেশ করা হয় নি এমন কাজের ব্যাপারে তিনি আহলে কিতাবদের অনুরূপ ছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি তাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেন। আল্লাহ তায়ালা যেন তাকে আহলে কিতাবদের থেকে অমুখাপেক্ষীতা দান করলেন তখন তাদের আনুরূপ্যকেও বর্জন করলেন। মােট কথা হচ্ছে, সদল এবং ফরক উভয়ই জায়েয। তবে ফরক করাটা অধিকতর পছন্দনীয় এবং উত্তম। আলেমগণ এরূপ মত পোষণ করেন। তবে অধিকতর উত্তম মত হলে, চুল আঁচড়ানোর সময় যদি এমনি সিঁথি বেরিয়ে আসে তবে সিঁথি করে দেবে। নতুবা চুলকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দিতে হবে।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী]
© | সেনানী এপ্স |