ন্যায় পরায়ণতা, আমানতদারিতা, চারিত্রিক পবিত্রতা ও সত্যভাষণ
হুজুর আকরম (ﷺ) শ্রেষ্ঠ ন্যায় বিচারক, আমানতদার, সর্বাধিক দয়াপরবশ এবং সত্যভাষী ছিলেন। নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে তার দুশমন ও বেগানা লুকের যার স্বীকৃতি প্রদান করতাে। তাঁরা তাঁকে মােহাম্মদ আলআমীন বলে ডাকতাে।
ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন যে, হুজুর (ﷺ) এর নাম যে আলআমীন হয়েছিলাে, তার কারণ এই যে তাঁর মধ্যে যাবতীয় সৎ গুণাবলী সন্নিবেশিত ছিলাে। আল্লাহ তায়ালার বাণী مطاع ثم امين এর ব্যাখ্যায় অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এ সত্যের দিকেই গিয়েছেন আমীন এর উদ্দেশ্য হুজুর পাক (ﷺ) এর সম্মানিত সত্তা। 'শেফা নামক পুস্তকে এরকমই বলা হয়েছে।
কাবা গৃহ সংস্কারের সময় কুরাইশ বংশের চারটি পুত্র যখন হাজারে আসওয়াদ সংস্থাপন করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মতানৈক্যের সংকট সৃষ্টি করেছিলেন, তখন সকলেই এ কথার উপর একমত হয়েছিল যে, আগামীকাল ভোরবেলা যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম খানায়ে কাবায় প্রবেশ করবে, আমরা সকলেই তার সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। পরদিন সর্বপ্রথম হুজুর আকরম (ﷺ) কাবা শরীফের চত্বরে প্রবেশ করলে সকলেই বলতে শুরু করলে, এতে মোহাম্মদ, এতে আলআমীন। তিনি যা ফয়সালা প্রদান করবেন, আমরা সকলেই তা মেনে নেবে। হুজুর (ﷺ) একখানা চাদর এনে চাদরের চার কোণের চার গোত্রের দলপতি কে ধরিয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি স্বহস্তে হাজরে আসওয়াদ এখানে তুলে নিয়ে চাদরের মাঝখানে রেখে দিলেন। হাজারে আসওয়াদের এ ঘটনা ঘটেছে হুজুর পাক (ﷺ) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে, খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (رضي الله عنه) এর জন্মের বৎসর। ইসলামী যুগের আবির্ভাবের পূর্বে কুরাইশ বংশের লোকেরা হুজুর আকরাম (ﷺ) কে বিচারক এবং মধ্যস্থতাকারী তৃতীয় পক্ষ নির্ধারণ করতাে। হুজুর পাক (ﷺ) স্বয়ং এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালার কসম, নিশ্চয়ই আমি আকাশেও বিশ্বস্ত এবং যমীনেও বিশ্বস্ত।
হযরত আলী মুতর্জা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, একবার অভিশপ্ত আবু জাহেল রসূলুল্লাহ (ﷺ) কে লক্ষ্য করে বললাে, আমরাতাে আপনার প্রতি মিথ্যারােপ করিনা বা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলেও মনে করি না। আপনি কখনও মিথ্যা কথা বলেন না। তবে আপনি যে দ্বীনের কথা নিয়ে এসেছেন সেগুলিকে আমরা মিথ্যা মনে করি। —আবু জাহেলের উক্তি কতই না বাজে, অর্থহীন, দুর্বোধ্য এবং স্ববিরোধী রাসূল (ﷺ) কে যখন সত্যবাদী বলে মানা হলাে, তখন তিনি যা কিছু বলছেন তাকে অবশ্যই সত্যরূপে গ্রহণ করা উচিত। এরপর এমন বিরোধিতা ও অহংকারের কি বা মূল্য থাকতে পারে? এই সময় আল্লাহ তায়ালা এ আয়াত নাযিল করেন, হে আমার প্রিয় হাবীব(ﷺ), নিশ্চয়ই এরা আপনাকে মিথ্যারােপ করছে না। কিন্তু এ যালেমেরা আল্লাহতায়ালার আয়াতসমূহ অস্বীকার করছে।
উপরোক্ত আয়াতে কারীমার বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে। তবে এখানে মোটামুটি মমার্থ এরকম—আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবীব (ﷺ) কে সান্তনা স্বরূপ বলছেন, হে মাহবুব। আপনি চিন্তামুক্ত থাকুন। দুশ্চিন্তার কোনাে কারণ নেই। এরা আমার উপর মিথ্যা অপবাদ রটাচ্ছে। তাই নিশ্চয়ই।
এদেরকে যথােপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবে। এর দৃষ্টান্তটি এরকম, যেমন কোনাে একদল লোক কোন এক প্রভুর লোককে দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণা দিচ্ছে। এতে প্রভু উক্ত ব্যক্তিকে সান্ত্রনা প্রদান করে বলছেন যে, এরা তােমাকে দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণা প্রদান করছে এটা আমি জানি। এরা প্রকৃতপ্রস্তাবে তোমাকে দুঃখ-কষ্ট দিচ্ছে না, আমাকেই যন্ত্রণা দিচ্ছে। আমি অবশ্যই এদেরকে শাস্তি দান করবাে। কথিত আছে, আখনাস ইবন শুরাইক বদরের যুদ্ধের দিন আবু জাহেলের সঙ্গে মিলিত হলাে। আখনাস আবু জাহেলকে লক্ষ্য করে বললাে, হে আবুল হাকাম, (এটা আবু জাহেলের উপাধি ছিলাে) এস্থানে তুমি আর আমি ভিন্ন তৃতীয় কেউ উপস্থিত নেই যে আমাদের কথা শুনতে পারবে। তুমি এখানে আমার কাছে সত্য করে বলতাে দেখি, মােহাম্মদ (ﷺ) সত্যবাদী না মিথ্যাবাদী? তখন অভিশপ্ত আবু জাহেল উত্তর করলাে, খােদার কসম নিঃসন্দেহে মােহাম্মদ (ﷺ) সত্যের উপর আছেন। তিনি সত্যবাদী, মিথ্যাবাদী কখনও নন।
রােমের বাদশাহ হারকাল ও আবু সুফিয়ান (رضي الله عنه) এর কথােপকথন সংক্রান্ত হাদীসে উল্লেখ আছে যে, বাদশাহ হারকাল আবু সুফিয়ান এর কাছে, হুজুর আকরম (ﷺ) এর গুণাবলী সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন এবং তার মাধ্যমেই হুজুর (ﷺ) এর নবুওয়াতের প্রমাণ পেয়েছিলেন। তিনি আবু সুফিয়ান (رضي الله عنه) কে প্রশ্ন করলেন 'তুমি কি ঐ দলভুক্ত ছিলে যারা মােহাম্মদ (ﷺ) কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করতে?' অর্থাৎ তার নবুওয়াতের ঘোষণার পূর্বে তোমরা কখনও কি তাকে মিথ্যাবাদী জানতে? আবু সুফিয়ান জবাব দিয়েছিলেন, আল্লাহর কসম, তিনি কখনও মিথ্যাবাদী ছিলেন না। হারকাল তখন বললেন, তিনি যদি এমনই হয়ে থাকেন তাহলে আল্লাহর যাতে পাক সম্পর্কে তিনি মিথ্যা বলবেন এটা কেমন করে সম্ভব হতে পারে?' বাদশাহ হারকালের এ উক্তিটি নবুওয়াতের আলামত সম্পর্কে পরিচিতি লাভ করার ক্ষেত্রে অধিকতর সহায়ক তাতে সন্দেহ নেই। হাদীস খানা বুখারী শরীফের প্রথম খণ্ডে আছে। তাছাড়া মেশকাত শরীফের শরাহ গ্রন্থ এর বিস্তারিত তরজমা ও ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে।
নযর ইবন হারেছ একদিন কুরাইশদেরকে লক্ষ্য করে বললাে, মােহাম্মদ (ﷺ) তাে তােমাদের কাছেই ছােটকাল থেকে বড়াে হয়েছেন। তােমাদের সব কাজেই তাকে তােমরা পছন্দ করে আসছে, তাকে তােমরা ভালবেসে আসছে। কথাবার্তায় তিনি সবচেয়ে বেশী সত্যবাদী, আমানতদারীতে সকলের চেয়ে মহান। এ মুহূর্তে যখন কেশাগ্রে বাধকোের ছাপ পরিস্ফুট হয়ে উঠলাে, আর দ্বীন ও মিল্লাতের কথা নিয়ে যখন তিনি তােমাদের কাছে তশরীফ আনলেন, তখনি তােমরা তাকে যাদুকর বলে আখ্যায়িত করতে লাগলে। খােদার কসম, তিনি কক্ষণও যাদুকর নন। এই নযর ইবন হারেছ অবশ্য কাফের ছিলাে। কুফুরী পর্দায় তার কলব আচ্ছাদিত ছিলাে। কিন্তু লােকটি ছিলাে বুদ্ধিমান। তার বিচারবােধ ছিলাে সত্যের অনুকূলে। কিন্তু হলে কি হবে? অন্যান্যদের অন্তরের উপরে যে পুরু পর্দা পড়েছিলাে। তার অন্তর থেকে পর্দা উন্মােচিত হলেও অন্যান্যদের পুরু পর্দা এসে তার কলবকে পুনরায় ছেয়ে ফেলতাে।
ওলীদ ইবন মুগীরা কুরাইশ কাফেরদের সরদাদের মধ্যে অন্যতম ছিলাে। সে একাধিকবার কুরআন পাক শুনেছে। কুরআন শুনে কেঁদেছে। সে মন্তব্য করেছিলাে, কুরআন কোন মানুষের কথা হতে পারেনা। এ কালামে যে মাধুর্য ও চিত্তাকর্ষকতা রয়েছে তা অন্য কালামের নেই। নিঃসন্দেহে এ কালামে মধুরতা বিদ্যমান। এতে আছে 'তালাওয়াত' অর্থাৎ মর্মস্পর্শী ও শান্তিদায়ক বাক্য। সারাহ নামক কিতাবে তেলাওয়াতের অর্থ করা হয়েছে সৌন্দর্য ও হৃদয়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা। কুরআনে পাকে এ গুণ অবশ্যই বিদ্যমান আছে।
হারেছ ইবন আমের ঐ দুষ্ট লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাে যারা লােকসমক্ষে হুজুর (ﷺ) কে মিথ্যারােপ করতাে। কিন্তু এ লোকটি যখন নিরিবিলিতে তার পরিবার পরিজনের সঙ্গে কাটাতে, তখন মন্তব্য করে আল্লাহর কসম মােহাম্মদ (ﷺ) মিথ্যা বলার লোক নন।
একদিন আবু জাহেল হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে এসে তার সঙ্গে মুসাফেহা করলে। এদেখে লােকেরা বলাবলি করতে লাগলাে, একি তুমি মুহাম্মদ (ﷺ) এর সঙ্গে মুসাফেহা করলে কেন? তখন আবু জাহেল বললাে, খোদার কসম! আমি জানি যে মােহাম্মদ (ﷺ) একজন পয়গম্বর। কিন্তু কি করবো বলো! আমরা আবদে মানাফের বংশের অনুসরণকারী কি কখনও ছিলাম? মুশরিকরা যখনই হুজুর (ﷺ) কে দেখতাে, তখনই তারা বলতো "ইনি নবী"। এই তাে ছিলাে মুশরিকদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা।
আহলে কিতাব ইহুদী নাসারারা তাে হুজুর পাক (ﷺ) এর রেসালাত সম্পর্কে খুব ভালােভাবে জানতে এবং বিশ্বাস করতাে। তারা আপন আপন সন্তান সন্তুতিকে যেমন চিনতাে তেমনই চিনতাে হুজুর পাক (ﷺ) কে একজন সত্য নবী হিসাবে (কুরআন)। আর এরা তাে পুরুষানুক্রমে আখেরী যমানার নবীর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলাে। মৃত্যুর সময় তারা আপন আপন সন্তান সন্তুতিকে ওসীয়ত করে বলে যেতাে, আখেরী যমানার নবী আগমন করলে তারা যেন তাদের পূর্বপুরুষদের পক্ষ থেকে সালাম পাঠিয়ে দেয় এবং তারা যেন না, সে নবীর কাছে এই মর্মে আর্য করে যে, আমরা আপনার সাহায্যে আমাদের জান মাল বিসর্জন করে দেবাে। আমাদের সালাম যেনাে তিনি কবুল করেন এবং আমাদেরকে তার গােলামগণের অন্তর্ভুক্ত করে নেন।
বর্ণনা করা হয়েছে যে, ইয়ামনের বাদশাহগণের মধ্যে তুব্বা নামে একজন মুসলমান বাদশাহ ছিলেন। তার কওমের লোক ছিলে কাফের। হুজুর আকরাম (ﷺ) তার সম্পর্কে বললেন, তুব্বা বনী তামীম গোত্রের লােক কিনা এটা আমি জানি না।—উক্ত তুববা বাদশাহ তাঁর সঙ্গে একদল লেক নিয়ে আখেরী জামানার নবী চেনার উদ্দেশ্যে মদীনা মুনাওয়ারায় আগমন করলেন এবং এ সম্মানিত নগরীতে অবস্থান করলেন। সাথী সঙ্গীরা বাদশা কে বলে, আমাদেরকে তাদের সাহচর্যে অবস্থান করা থেকে পরিত্রাণ দিন। (অর্থাৎ পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব থেকে লব্ধ জ্ঞান মুতাবেক হুজুর পাক (ﷺ) এর নবুওয়াত তখন তাদেরকে স্বীকার করে নিতে হবে। তাই তারা এই অক্ষমতা প্রকাশ করলাে)। অন্য এক বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, তারা ঈমান অবশ্য আনেনি, তবে তাদের বংশধরেরা পরবর্তীতে নবী করীম (ﷺ) এর মান্যবর সাহাবী হয়েছিলেন। মদীনা মুনাওয়ারায় আগমনের পর পবিত্র নূর (ﷺ) আহলে কিতাবদের সামনে উদ্ভাসিত হলেন ঠিকই। কিন্তু তারা কুফুরীর অন্ধকারে নিমজ্জিত রয়ে গেলাে। পথভ্রষ্ট রয়ে গেলাে।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী]
© | সেনানী এপ্স |