রাসূলগনের পারস্পরিক মর্যাদা


আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ফরমান, 'ঐ রসূলগণ, আমি তাদেরকে একে অপরের উপর মর্যাদা দিয়েছি। অন্য জায়গায় এরশাদ হয়েছে, 'নিশ্চয়ই আমি কোন কোন নবীকে কোন কোন নবীর উপর মর্যাদা দিয়েছি।' এই দু'খানা আয়াতই নবীগণের পারস্পরিক মর্যাদার তারতম্যের স্পষ্ট প্রমাণ। তারা একজন আরেকজনের তুলনায় মর্যাদাশীল। একথাটি দ্বারা মুতাযিলাদের মতকে খন্ডন করা হয়েছে। তারা নবীগণের পারস্পরিক পদ মর্যাদার তারতম্য হওয়ার বিরোধী। তাদের মতে তারা সকলেই সমান মর্যাদার অধিকারী। একদল এরকম বলে থাকে যে, হজরত আদম (عليه السلام) পিতা হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেষ্ঠ। তবে এই মতটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কেননা আলােচনা তাে হচ্ছে নবুওয়াতের দিক দিয়ে উত্তম হওয়া প্রসঙ্গে। আলোচনার প্রসঙ্গ তার পিতা হওয়ার দিক দিয়ে নয়।


অনেক সময় দেখা যায় পিতার তুলনায় পুত্র অধিক কামালাত ও ফযীলতপূর্ণ হয়ে থাকে। যদিও পিতা পিতৃত্বের দিক দিয়ে তার যথাযথ হকের অধিকারী। আবার আরেক দল এরকম বলে থাকে যে, এক্ষেত্রে নীরবতা অবলম্বন করাই সমীচীন। এই মতের ব্যাপারে আশ্চর্য হতে হয়। কেননা নাস কুরআনে যেখানে পরিষ্কারভাবে আষীয়ায়ে কেরামের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিচ্ছে। সেখানে নীরবতা অবলম্বন করার কি অবকাশ থাকতে পারে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ফরমান, নবীগণের মধ্যে কতিপয় এমন আছে, যাদের সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা কালাম করেছেন মুফাসসিরীনে কেরাম বললেন, এর দ্বারা হযরত মুসা (عليه السلام) কে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তার সঙ্গে কোণের মাধ্যম ব্যতিরেকেই কথােপকথন করেছেন। প্রকৃত অবস্থা এই যে, উক্ত আয়াতের বৈশিষ্ট্য দ্বারা হজরত মুসা (عليه السلام) কি, খাছ করার কোন যুক্তি নেই। কেননা এটা তার সুসাব্যস্ত কথা যে, হুজুর সাইয়্যেদুল মুরসালীন (ﷺ) এর সাথে আল্লাহ তায়ালা শবে মেরাজ কোনােরূপ মাধ্যম ছাড়াই কথা বলেছেন। তবে মুসা (عليه السلام) এর সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার কালাম করা বিশেষভাবে সংঘটিত হয়েছে। আর সম্ভবত উক্ত বিশেষত্বের এবং নেয়ামত অর্জন করার কারণেই তিনি কলীম হিসাবে খ্যাত হয়েছেন।


যে সময় সাইয়্যেদে আলম (ﷺ) আরশের উপরে গেলেন এবং এমন স্থানে পৌছলো, যেখানে মাখলুকের জ্ঞান পৌছে না। হুজুর পাক (ﷺ) যে পর্যন্ত পৌছলেন, ঐ পর্যন্ত অন্য কারও পৌছাও সম্ভব হয়নি। যেখানে পৌছে তিনি আল্লাহতায়ালার সঙ্গে যে কালাম করলেন, তাতাে অন্যান্যগণকে যে মর্যাদা ও পূর্ণতা প্রদান করা হয়েছে তার চেয়ে আরও অনেক উর্ধ্বে। অনেক পরিপূর্ণতার। সেদিকে লক্ষ্য করে আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন, তিনি তাদের কারও মর্যাদাকে কয়েকগুণ উন্নত করে দিয়েছেন।' মুফাসসিরীনে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, এই আয়াত দ্বারা হুজুর আকরম (ﷺ) কে বুঝানাে হয়েছে। তারা বলেন যে, আল্লাহ তায়ালার বাক্যের মর্যাদা প্রাপ্ত ব্যক্তি কে, এ ব্যাপারে স্পষ্ট রাখা হয়েছে। এ দ্বারা হুজুর আকরাম (ﷺ) এর তাযীম, সম্মান ও উচ্চ মর্যাদা বুঝেনা উদ্দেশ্য। কালামের তরিকা বা ভাষার অলংকার এলেম যার আছে তার নিকট বিষয়টি অস্পষ্ট নয়।


ওলামায়ে কেরাম বলেন, আম্বিয়া কেরামের জন্য যে সম্মান ও মর্যাদার কথা আলোচিত হয়েছে, তা তিন প্রকার। 

(১) কোন নবীর নবুয়তের নিদর্শন ও মােজেজা এই পরিমাণ অধিক স্পষ্ট, বিখ্যাত, শক্তিশালী এবং উজ্জ্বল হয়ে থাকে যে পরিমাণ তাঁর উম্মত অধিকতর পরিচ্ছন্ন জ্ঞানী, সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে থাকে।

(২) অথবা যে নবীর ব্যক্তিত্ব অধিকতর উত্তম, পরিপূর্ণ এবং সুস্পষ্ট হবে। ব্যক্তিগত উদ্ধৃষ্টতা ঐ সমস্ত বৈশিষ্ট্যের দিকে ধাবিত হয়ে থাকে, যাতে নবীর মোজেজা, উঁচু মর্যাদা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে। 

(৩) অথবা সে নবী গােপন মিলন বা দর্শনের মতাে উপহার দ্বারা ধন্য হবেন।


এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমাদের নবী করীম (ﷺ) এর মোজেজা সমূহ ও নবুওয়াতের নিদর্শনাবলী অত্যধিক স্পষ্ট, পরিপূর্ণ উজ্জ্বল এবং দীর্ঘস্থায়ী ছিলাে। তার পদ মর্যাদা ছিলাে সর্বাধিক উন্নত, এবং শান শওকত ছিলাে অধিকতর মহান ও পূর্ণাঙ্গ। তাঁর উম্মত হচ্ছে সর্বাধিক পবিত্র, জ্ঞানী ও সংখ্যাগুরু। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদ প্রমাণ করে, 'তোমরা সর্বোৎকৃষ্ট উম্মত। সমন্বিত ফাযায়েল ও কামালাত বলতে যা বুঝায় তাদ্বারা ভূষিত হয়েছেন হুজুর আকরম (ﷺ) এর উম্মত। নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র সত্তা অধিকতর পরিপূর্ণ ও পবিত্র। তার বৈশিষ্ট্যসমূহ, কারামত ও কামালতসমূহ মহান, প্রসিদ্ধ, অধিকতর স্পষ্ট। তার মর্যাদা সমস্ত রসূলগণের মর্যাদার চেয়ে উন্নত, সমস্ত মাখলুকের চেয়ে পরিচ্ছন্ন, সুস্পষ্ট ও উত্তম।


শাফাআত সংক্রান্ত হাদীস করার প্রতি চিন্তা করা উচিত। হাশরের দিনে আল্লাহর সমস্ত মাখলুক একত্রিত হয়ে শাফাআতকারীর অনেষণ করতে থাকবে। তারা হযরত আদম (عليه السلام), হজরত নূহ (عليه السلام), হজরত ইব্রাহীম (عليه السلام), হজরত মূসা (عليه السلام) এবং হজরত ঈসা (عليه السلام) এর নিকটে যাবে এবং তাদের জন্য বারীতায়ালার কাছে শাফাআত প্রার্থনা করবে। সকলেই এই মাকামের জিম্মাদারী কবুল করার ব্যাপারে নিজ নিজ অক্ষমতা প্রকাশ করবেন এবং বলবেন, এ কাজ আমার নয়। পরিশেষে সমস্ত মাখলুক সাইয়্যেদুল মুরসালীন (ﷺ) এর কাছে এসে উপস্থিত হবে। তখন তিনি বলবেন, হ্যাঁ, এ কাজ, আমার কাজ। এরপর তিনি আল্লাহতায়ালার বারেগাহে হাজির হবেন। (হাদীছের শেষ পর্যন্ত)। এই হাদীছ, ছাড়াও নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, 'আমি বনী আদমের সরদার, আরো বলেছেন, 'আমি বনী আদমের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত। কেউ কেউ বলেন, 'আদম সন্তান বলতে মানবজাতিকে বুঝানাে হয়েছে; যার মধ্যে হজরত আদম (عليه السلام)ও দাখিল আছেন। অন্য আরেক বর্ণনায় আছে, আমি কিয়ামতের দিনে মানবজাতির সরদার হবাে’ —সবচাইতে উত্তম দলীল হচ্ছে এই হাদীছ, 'আদম (عليه السلام) এবং তিনি ব্যতীত যতাে লােক; সকলেই আমার পতাকা তলে অবস্থান করে।' কেউ কেউ আবার হুজুর আকরম (ﷺ) এর শ্রেষ্ঠত্বকে এই আয়াত দ্বারা প্রমাণ করে থাকেন 'তােমরা সর্বোত্তম উম্মত সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য তােমাদেরকে আবির্ভাব করা হয়েছে। এতে কোনােরূপ সন্দেহ নেই যে, উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভব করে দ্বীনের পরিপূর্ণতার উপর। আর দ্বীনের পরিপূর্ণতা তাে নবীর পূর্ণতার অনুগামী, যে নবীর আনুগত্য করে উম্মতেরা।


ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (رحمة الله) নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে নবী করীম (ﷺ) এর শ্রেষ্ঠত্বের দলীল গ্রহণ করে থাকেন। আয়াতের মধ্যে আল্লাহতায়ালা আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রশংসা করেছেন প্রশংসনীয় গুণাবলীর মাধ্যমে। আয়াতে নবীগণ সম্পর্কে মুহাম্মদ (ﷺ) কে বলা হলাে, ঐ হযরত গণ আল্লাহ তাআলা তাদেরকে হেদায়েত দান করেছেন, সুতরাং আপনি তাদের রাস্তায় চলুন। আয়াতে কারীমার মর্মানুসারে বুঝা গেলাে হুজুর পাক (ﷺ) কে তাদের রাস্তায় চলার জন্য হুকুম করা হয়েছে। কাজেই উক্ত হুকুম বাস্তবায়ন করা তার উপর ওয়াজিব হয়ে গেলাে। তিনি উক্ত হুকুম প্রতিপালন করলে পূর্বের সমস্ত আম্বিয়াগণের যাবতীয় সৌন্দর্য ও কামালাত হুজুর পাক (ﷺ)এর মধ্যে সন্নিবেশিত হলাে। সমস্ত সৌন্দর্য ও কামালাত যা ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিলাে তা এক জায়গায় সঞ্চিত হলাে। কাজেই তিনি এর মাধ্যমে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করলেন। এই দলীলখানা বেশ সূক্ষ্ম। যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে এরকম ধারণার সৃষ্টি হয় এর দ্বারা হুজুর আকরম (ﷺ) শ্রেষ্ঠত্ব খর্ব হয়েছে। কেননা তাকে পূর্ববতী আম্বিয়া কেরামের অনুসরণ ও আনুগত্য করার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু এস্থানে অনুসরণ ও আনুগত্য দ্বারা মুআফেকাত, আনুকূল্য বা আনুরূপ্য বুঝানাে হয়েছে। আম্বিয়া কেরামগণ সকলেই যখন তার পূর্বে অতিক্রম করে গিয়েছেন এবং তিনি সকলের পরে এসেছেন, এজন্য এখানে 'একতেদা' (অনুসরণ) শব্দ প্রয়ােগ করা হয়েছে। হুজুর পাক (ﷺ) কে যেখানে মিল্লাতে ইব্রাহীমের আনুগত্য করার জন্য হুকুম করা হয়েছে, সেখানেও এরকম অর্থ বুঝে নিতে হবে। অধিকন্তু হুজুর আকরম (ﷺ) এর দাওয়াত অন্যান্য সমস্ত নবীগণের সকলের দাওয়াতের তুলনায় অনেক বেশী এলাকায় পৌছেছে। কাজেই পৃথিবীর মানুষ অন্যান্য নবীগণ কর্তৃক দাওয়াতের তুলনায় হুজুর পাক (ﷺ) এর দাওয়াতের মাধ্যমে বেশী উপকৃত হয়েছে। কাজেই হুজুর আকরম (ﷺ) সমস্ত নবীগণের তুলনায় অধিকতর পূর্ণ সন্দেহ নেই। মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যে মানুষকে উপকৃত করে।


ফাযায়েলে সাহাবা এর অধ্যায়ে একখানা হাদীছ আছে। সাইয়্যেদুনা হজরত আলী মুর্তজা (رضي الله عنه) একদিন দরােজা দিয়ে বের হলেন। তাকে দেখে হুজুর আকরম (ﷺ) বললেন, এ ব্যক্তি আরবের সরদার। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আরবের সরকার নন? হুজুর এরশাদ ফরমালিন - 

أنا سيد العلمين على سيد العرب

  'আমি হলাম সমগ্র আলমের সরদার আর আলী আরবের সরদার'।


উপরােক্ত হাদীস সম্পর্কে হাকিমের মত-হাদীছ খানা সহীহ। তবে কেউ কেউ এ হাদীছকে যয়ীফ বলে থাকেন। যাহাবী অবশ্য এই হাদীছকে মওযু হিসাবে পরিগণিত করেন। ওয়াল্লাহু আ'লাম।


এতক্ষণ যা আলােচনা হলাে,তা হুজুর আকরম (ﷺ) -এর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। তবে এর বিরুদ্ধেও কিছু কিছু দলিল পাওয়া যায়। যেমন কুরআনে কারীমে এসেছে। আমি নবীগণের কারও মধ্যেই কোনাে পার্থক্য করিনা। সহীহাদীছে হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) এর বর্ণনায় পাওয়া যায় আমাকে নবীগণের মধ্যে প্রাধান্য দিওনা। আবার আরেক বর্ণনায় আছে নবীগণের মধ্যে কোনাে প্রাধান্য দিও না। হজরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে নবীগণের মধ্যে কাউকে পৃথক করাে না। হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে আছে, তােমরা কোন বান্দাকে বিশেষিত করাে না, যাতে সে বলতে লাগে যে আমি ইউনুস ইবন মুতই (عليه السلام) এর চেয়ে উত্তম। এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে সে মিথ্যা বললাে। আরও বর্ণিত আছে, কোনাে ব্যক্তি যদি এরূপ বলে যে, আমি ইউনুস ইবন মুতই (عليه السلام) এর চেয়ে উত্তম। তাহলে নিঃসন্দেহে সে মিথ্যা বললাে। খন্ডনকারী উপরােক্ত দলীলগুলির উত্তর এই যে, আল্লাহ তায়ালার এরশাদ, আমরা ইমানের ক্ষেত্রে কারও মধ্যে পার্থক্য করি না। তার মানে আমরা এমন নই যে আবিয়া কেরামের মধ্য থেকে আমরা কারও কারও উপর ইমান আনি, আর কারও কারও উপর ইমান আনিনা। যেমন এই শ্রেণীর লােকদের প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এই আয়াতসমূহের মাধ্যমে, নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলগণের সাথে কুফুরী করে। এবং তারা ইচ্ছা করে আল্লাহ্ ও তার রসুলগণের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করতে।


তারা বলে যে, আমরা কারও কারও প্রতি ইমান আনি আর কারও কারও প্রতি কুফুরী করি। এক্ষেত্রে হাকীকত এই যে, কোন একজন রসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা মূলতঃ সমস্ত রসূলগণকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করা। উক্ত মতটির সপক্ষে ওলামায়ে কেরাম দলীল দিয়ে থাকেন এই আয়াতে কারীমার মাধ্যমে এরা যদি আপনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে থাকে, তাহলে আপনার পূর্বের সমস্ত রসূলগণকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সমস্ত নবী রসূলগণের প্রতি সমানভাবে ইমান রাখার দ্বারা এটা সূচিত হয় না যে, তাদের মধ্যে পদ মর্যাদার তারতম্য হতে পারবেনা। এরপর আসা যাক উল্লেখিত হাদীস সমূহের আলােচনায়।


ঐ সমস্ত হাদীছ সমূহের জবাব মুহাদ্দেছীনে কেরাম বিভিন্নভাবে প্রদান করেছেন। কেউ কেউ বলেন, লাতুফাদ্দেলু ওয়ালাতুখাইয়ে শব্দ দ্বারা যে কোনাে নবীকে কোন নবীর উপর প্রাধান্য দিতে বা পছন্দ করতে নিষেধ করা হয়েছে তা ওহীর মাধ্যমে হুজুর পাক (ﷺ) যে সাইয়্যেদুল আম্বিয়া আফযালুল বাশার সাইয়্যেদু বুলদে আদাম এ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পূর্বে ছিলে। এ মত যদি গ্রহণ করা হয় তবে অবশ্যই একটা ব্যাপারে জটিলতা সৃষ্টি হবে যে, এক্ষেত্রে কোনটি পূর্বের ও কোনটি পরের। আবার কেউ কেউ এরকম মত পােষণ করেন, নবীগণের মধ্যে কাউকে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে, যার উপর প্রাধান্য দেয়া হলাে তাকে। কোনোরূপ অবমাননা করা না হয়।


কেউ কেউ এরকম বলেন, কোনাে নবীকে অপর নবীর উপর মর্যাদা প্রদান করার নিষিদ্ধতা নবুওয়াত ও রেসালতের মূল। কেননা সমস্ত নবীগণই নবুওয়াতের মূলের দিক দিয়ে একই সীমায় সীমাবদ্ধ। তবে তাদের মধ্যে যে পারস্পরিক মর্যাদার তারতম্য এটা নবুওয়াতের দিক দিয়ে নয়। বরং ফযীলত বা মর্যাদা। এটা নবুওয়াতের উপর অতিরিক্ত জিনিস। যেমন কেউ কেউ রাসূল। আবার কেউ নবী। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ উলুল আযম পয়গম্বর। তবে এ ধরনের মত পােষণ করলে ভুল থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না।


একথাগুলির বিস্তারিত বক্তব্য হচ্ছে এই যে, কেউ এরকম বলেন যে, আমি ঐ নবী বা রসূলকে ফযীলত প্রদান করি আল্লাহতায়ালা যাকে নৈকট্যের বৈশিষ্ট্য দ্বারা উন্নত করে দিয়েছেন। তারা উম্মত নিয়ামত প্রদান করা, তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা, দ্বীনের উপর ধৈর্য ধারণ করা, রেসালতের দায়িত্ব আদায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা, পথভ্রষ্টদেরকে হেদায়েত করার জন্য সর্বদাই আকাঙ্খিত হয়ে থাকা ইত্যাদির ব্যাপারে সকলেই যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। এ ব্যাপারে কারাে উপরে কোনােরূপ মন্তব্য করা উচিত নয়। কেননা প্রত্যেকেই আপন আপন ক্ষমতার সীমা অনুসারে স্বীয় চেষ্টা সাধনা ও শক্তি প্রয়ােগ করেছেন। তারা যে যতটুকু করেছেন তার চেয়ে বেশী দায়িত্ব আল্লাহ তাদের উপর আরােপ করেননি। কাজে ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে।


কেউ কেউ বলেন যে, আমরা এরকম বিশ্বাস রাখি যে, আল্লাহতায়ালা নবীগণকে একে অপরের উপর মর্যাদা দিয়েছেন সাধারণভাবে। তবে আমরা আল্লাহর সৃষ্ট বান্দা যারা আপন সত্তাগত অভিমতের মাধ্যমে একে অপরের উপর ফযীলত প্রদান করা থেকে বিরত থাকি। কেননা আমরা তাে কারও ফযীলত স্বীয় জ্ঞান অনুসারে বর্ণনা করতে অক্ষম বরং কিতাবুল্লাহ ও সুন্নতে রসূলুল্লাহই কেবল তা করতে সক্ষম। যেমন আলােচনার প্রথম দিকে দলীল হিসাবে যা উল্লেখ করা হয়েছে।


ইবন আবী জুমরাহ (رحمة الله) যিনি মালেকী মাযহাবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন, তিনি তার বর্ণিত হাদীছে ইউনুস ইবন মুতই সম্পর্কে বলেন যে, উক্ত হাদীছের মাধ্যমে হুজুর পাক (ﷺ) এর উদ্দেশ্য ছিলাে হক সুবহানাহু তায়ালার দিক, সীমা ও অবস্থাকে রহিত করণ। তাই ইবন খতীব অর্থাৎ ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী বলেন, উক্ত হাদীসে নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, ইউনুস (عليه السلام) এর উপর আমার ফযীলত বা মর্যাদা এই কারণে নয় যে, আমাকে আকাশে উঠানো হয়েছে, আর হজরত ইউনুস (عليه السلام) কে সমুদ্রের গভীরে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমি আল্লাহতায়ালার নৈকট্যভাজন হয়েছি, আর তিনি আল্লাহ থেকে দূরে সরে গিয়েছেন, এই হিসাবে যদি তার উপর আমার মর্যাদা বুঝানাে হয়, তাহলে তাে হকতায়ালার জন্য স্থান ও দিক স্বীকার করতে হয়। অথচ এরূপ ধারণা ভুল। যদিও আমাকে আকাশের সাতটি স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আর হযরত ইউনুস (عليه السلام) কে সমুদ্রের গভীরে নিক্ষেপ করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অবস্থান করার ব্যাপারে তিনি এবং আমি উভয়েই সমান। অন্যান্য নবী এবং ইউনুস (عليه السلام) এর উপর আমার পদমর্যাদা সাব্যস্ত করা ছাড়া আমার জন্য অন্যান্য সম্মান ও কামালাত সবই সাব্যস্ত রয়েছে।


উপরে যে ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা হলাে, পদমর্যাদা যদি সে দৃষ্টিকোণ থেকে সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালার জন্য দিক অবধারিত হয়ে যায়। এরকম কথা ইমাম দারুল হিজরাত অর্থাৎ ইমাম মালেক (رحمة الله) থেকেও বর্ণিত আছে। ইমামুল হারামাইন শরীফাইন থেকেও এ ধরনের বক্তব্য সংকলিত আছে। কোন কোন অভিজ্ঞ ব্যক্তির মধ্যে এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। তারা বলে থাকেন যে, আমরা ওজুদে বারী তায়ালার শানে স্থান সাব্যস্ত করার দিকে নবীগণের ফযীলত দেই না। কেননা, ওজুদে বারীতায়ালার জন্য তাে সমস্ত দিকই সমান।


মালায়ে আ’লা অর্থাৎ উর্ধজগতের মাখলুকের জন্য এই নিম্ন জগত অর্থাৎ দুনিয়ার জগতের মাখলুকের উপর যে প্রাধান্য রয়েছে, এ জগতের তুলনায় অই জগতের যে মর্যাদা রয়েছে, এ হিসাবে আমরা হজরত ইউনুস (عليه السلام) এর উপরে নবীকরীম (ﷺ) কে মর্যাদা দিয়ে থাকি। এ মর্যাদা নির্ধারণটা যেনাে ফযীলত ও মাকানাত, কদর ও মনযেলাতের দিক দিয়ে। স্থান হিসাবে নয়। সুতরাং মর্যাদার নিষিদ্ধতা স্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট, যদ্বারা কুরবে মাকানীর মাফহুম হাসিল হয়। অবশ্য এ মতভেদ আমরা সমর্থন করি না। ফালইয়াত্তাআম্মাল।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 


© | সেনানী এপ্স |

Top