পূতঃপবিত্রা স্ত্রীগণের সঙ্গে সদাচার


হুজুর আকরাম (ﷺ) তাঁর পূত পবিত্র স্ত্রীগণের সঙ্গে খুবই উত্তম ব্যবহার করতেন। তাঁদেরকে সাহচর্য ও মানসিক শান্তি প্রদান করতেন। আনসার গণের শিশুদের এনে আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর কাছে খেলাধুলা করার জন্য ছেড়ে দিলেন। আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) যে পাত্রে পানি পান করতেন, হুজুর পাক (ﷺ) সেই পাত্রে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতেন এবং যেখানে আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) মুখ লাগাতেন হুজুর (ﷺ)ও সেখানেই মুখ লাগাতে। হুজুর (ﷺ) যখন মেসওয়াক করতে চাইতেন মেসওয়াক করা প্রথমে আয়েশা (رضي الله عنه) এর হাতে দিলেন। তিনি তা নিজের মুখে চিবিয়ে মোলায়েম করে দিলে হুজুর (ﷺ) তার হাত থেকে নিয়ে মেসওয়াক করতেন। এটা শেষ সীমার ‘তাওয়ায়ু' ও আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার নিদর্শন। রোজাদার থাকা অবস্থায় হুজুর আকরাম (ﷺ) আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর উরুর উপর হেলান দিলেন এবং তার চুম্বন গ্রহণ করেন। তিনি হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) কে হাবশীদের খেলা (তীর নিক্ষেপ) দেখাতেন। আর আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) তখন তার গণ্ডদেশ হুজুর (ﷺ) এর কাধে মোবারকের উপর হেলান দিয়ে রাখে। এসব ঘটনা আয়েশা (رضي الله عنه) এর বাল্য বেলার ঘটনা। একদিনের ঘটনা—হুজুর আকরাম (ﷺ) আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর সঙ্গে দৌড় প্রতিযােগিতা করলেন। আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) নবী করীম (ﷺ) এর সঙ্গে দৌড়ে জিতে গেলেন। কিছুদিন পর আবার দৌড় অনুষ্ঠিত হলাে। এবার হুজুর (ﷺ) আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) কে হারিয়ে দিলেন। প্রথম দৌড়ে আয়েশা (رضي الله عنه) জিতে যাওয়ার কারণ এই ছিলাে যে, তখন তার শরীর স্বাভাবিক ধরনের ছেলে। আর পরের বার যেহেতু তুলনামূলকভাবে আগের চাইতে অনেকটা হৃষ্টপুষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন, তাই দৌড়ে হুজুর আকরম (ﷺ) এর সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। দ্বিতীয় দৌড়ে হেরে গেলে নবী করিম (ﷺ) তাঁকে বললেন, প্রথম বারে হেরে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয় বারে জিতে তার বদলা নিলাম।


একদিন হুজুর আকরাম (ﷺ) হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) এর ঘরে শরীফ আনলেন। হজরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه) তার জন্য খাবার পাঠালেন। খাবারের পাত্র নিয়ে ঘরে প্রবেশ করার সময় হযরত আয়েশা সিদ্দিকার (رضي الله عنه) হাতে লেগে পাত্রটি মাটিতে পড়ে গেলাে। পাত্র ভেঙে টুকরাে টুকরাে হয়ে গেলো আর আহার্য দ্রব্য মাটিতে ছড়িয়ে পড়লে। হুজুর (ﷺ) ভাঙা পাত্রের টুকরাগুলি কুড়িয়ে নিলেন এবং খানাগুলিও মাটি থেকে উঠিয়ে নিয়ে অন্য একটি পাত্রে রেখে উপস্থিত সকলের প্রতি ওয়াহী পেশ করে বললেন, এই দুঃখজনক ঘটনার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। এরপর হুজুর (ﷺ) হজরত আয়েশা (رضي الله عنه) এর ঘর থেকে একখানা ভালাে পেয়ালা নিয়ে খাদেমের মাধ্যমে হজরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه) এর নিকট পাঠিয়ে দিলেন। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, হযরত আয়েশার (رضي الله عنه) ঘর থেকে খাবার নিয়ে এসে বললেন, পেয়ালা বদলে পেয়ালা এবং খানা বদলে খানা দেয়া হলাে। এসব ক্ষেত্রে মানুষের অত্যধিক রাগের উদ্রেক হয়ে থাকে। কিন্তু রাগের বশবর্তী হয়ে শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকা উত্তম চরিত্রের নিদর্শন। তার দলীল স্থাপন করেছেন হযরত মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ (ﷺ)। এ ধরনের অবস্থায় স্ত্রীকে শাস্তি দিলে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি নেমে আসে। কেননা দুঃখ ও রাগের অবস্থায় নারী জাতির মর্যাদার কথা স্মরণ থাকেনা।


একদিন হজরত সাওদা (رضي الله عنه) হুজুরপাক (ﷺ) এর জন্য শুরু নিয়ে এলেন। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) হযরত সাওদা (رضي الله عنه) কে বললেন, তুমিই পান করে। কিন্তু তিনি তা পান করলেন না। হজরত আয়েশা (رضي الله عنه) পুনরায় তাঁকে বললেন, তুমি এ শুরবা পান করে ফেলে, নতুবা আমি তােমার মুখে মেখে দেবাে। তিনি তাতেও পান করলেন না। এরপর হজরত আয়েশা (رضي الله عنه) হযরত সাওদা (রা) এর মুখের উপর উক্ত শুরবা লেপন করে দিলেন। হুজুর আকরম (ﷺ) তা দেখে হাসছিলেন। তিনি হজরত সাউদা (رضي الله عنه) কে বললেন, ঠিক আছে তুমিও তার মুখে মেখে দাও। হজরত সাউদা (رضي الله عنه) হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর মুখের উপর শুরবা লেপন করে দিলেন। হুজুর (ﷺ) তা দেখে পুনরায় হেসে উঠলেন।


স্ত্রীগণের প্রতি হুজুর পাক (ﷺ) এর আচরণ এমন ছিলাে যে, তাঁরা কখনাে রাগ করলে বা মেযাজ দেখালে তার জন্য তিনি কোনােরপ শাস্তি আরােপ করতেন না। তিনি তাদের অক্ষম মনে করতেন। আর তাদের উপর শরীয়তের আহকাম ও আদল প্রয়ােগ করলে নেহায়েত মােলায়েম ও নম্রতার সাথে করতেন।


কোন ব্যক্তি যদি হুজুর আকরম (ﷺ) এর জীবন সম্পর্কে নিগুঢ়ভাবে চিন্তা করে যে, তিনি পরিবার-পরিজন, সাহাবী, ফকীর-মিসকীন, এতীম বিধবা, মেহমান, আগন্তুক ইত্যাদির প্রতি কি রকম আচরণ করতেন তাহলে জানতে পারবে, হুজুর পাক (ﷺ) এর জ্যোতির্ময় অন্তরে তা ও দয়া মেহেরবানীর এমন এক সীমাহীন অবস্থা বিরাজিত ছিলাে যা অন্য কোন মাখলুকের ক্ষেত্রে কল্পনাও করা যায়না। তার পাশাপাশি শরীয়তের হদ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তিনি এতে কঠোর ছিলেন যে, কোনাে মাখলুক সে সীমায় পৌছতে কখনাে সক্ষম হবে না। তার আখলাক ও আমল সমূহের নিগুঢ় তত্ত্বে পৌছা কারাে পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা তার আমল ও আখলাক সম্পূর্ণই মােজেজা এবং নবুওয়াতের নিদর্শন।


হুজুর আকরম (ﷺ) সকলের সঙ্গে হাসি-খুশী ও খােলামেলা আচরণ করতেন। সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে মিলেমিশে কথাবার্তা বলতেন। কখনাে কখনাে তাঁদের সঙ্গে হাস্যরসিকতাও করতেন। তবে এসবের উদ্দেশ্য ছিলাে মনোরঞ্জন। রসিকতা ভাবভঙ্গি ও আলােচ্য বিষয় কিন্তু অর্থহীন ছিলােনা। বাচ্চাদের সঙ্গে নিজে খেলাধুলা করতেন এবং তাদেরকে নিজের কোলে বসাতেন। আযাদ, গােলাম, বাঁদী মিসকীন নির্বিশেষে সকলের দাওয়াত কবুল করতেন। কখনাে রোগীর সেবা শুশ্রূষা করার জন্য মদীনা শরীফের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত চলে যেতেন। কোনাে কোনাে হাদীস শরীফে অবশ্য হাস্য রসিকতা ও খেলতামাশা করা সম্পর্কে নিষেধ করা হয়েছে। ঐ সমস্ত হাদীছ দ্বারা খেলতামাশা ও হাস্য রসিকতা অতিরঞ্জিত করাকে বুঝানাে হয়েছে। আর অতিরঞ্জিত করার অর্থ হচ্ছে এমন খেলতামাশা ও হাস্য রসিকতায় লিপ্ত হওয়া যার কারণে মানুষ আল্লাহ পাকের স্মরণ ও দ্বীনের চিন্তা ফিকির থেকে অমনোযোগী হয়ে যায়। আর যে উক্ত কাজকে সার্বিক ও বিশুদ্ধ রাখতে পারবে, তার জন্য এটা মােবাহ বা বৈধ। আবার এ সবের উদ্দেশ্য যদি হয় কাউকে খুশি করা ও তার হৃদয় জয় করা (দ্বীনের খাতিরে) তাহলে এটা মােস্তাহাব। যেমন হুজুর আকরাম (ﷺ) করে থাকতেন।


হুজুর আকরাম (ﷺ) এর মহান চরিত্র যদি তাওয়াজ্জুহ বা বিনয়, প্রেম ভালোবাসা ও হাসিখুশি ভাব না থাকতো, তবে কোনো ব্যক্তির পক্ষে তাঁর কাছে উপস্থিত হওয়ার এবং তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার সাহস হতােনা? কেননা তাকে চূড়ান্ত সীমার শান-শওকত, ভীতিপ্রদ ভাবগাম্ভীর্য, বিশালতা ও ঐশ্বর্য প্রদান করা হয়েছে। সীরাত বিশেষজ্ঞগণ বর্ণনা করেছেন, হুজুর আকরাম (ﷺ) ফজরের সুন্নত আদায় করার পর হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) কে যদি জাগ্রত পেতেন, তাহলে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। অন্যথায় জায়নামাজের উপর এক পার্শ্বে কাত হয়ে আরাম করতেন। এরপর বাইরে এসে জামাতে ফরজ আদায় করতেন। তার কারণ এই যে, রাত জাগরণ করে ইবাদত বন্দেগী, কুরআন তেলাওয়াত ও যিকির আযকারে মশগুল থাকার মাধ্যমে হক তায়ালার পক্ষ থেকে তার উপর যে নূরের বর্ষণ হতে, নৈকট্য ও বিশেষত্ব লাভের পরিপ্রেক্ষিতে হক তায়ালার পক্ষ থেকে কালাম শ্রবণ করা, মুনাজাত কবুল হওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে তার উপর এমন এক অবস্থার উদ্ভব হয় তার বর্ণনা প্রদান করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। ঐ হাল বিদ্যমান থাকাকালে হুজুর পাক (ﷺ) সঙ্গে সাক্ষাত করা বা তার সােহবতে অবস্থান করা কারও পক্ষেই সপ্ভব হতাে না। তাই তিনি উক্ত হাল থেকে কিঞ্চিৎ হালকা হওয়ার জন্য হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর সঙ্গে কথােপকথন করতেন বা জায়নামাজে গড়াগড়ি করে আরাম করতেন। যাতে হযরত আয়েশা (رضي الله عنه) এর ভালোবাসা থেকে প্রাপ্ত বীর তার উক্ত হালের পরিবর্তনে সহায়ক হয়। অথবা যে যমীন সমস্ত সৃষ্টির মূল তাতে গড়াগড়ি দিয়ে হালের পরিবর্তন আনতে প্রয়াস পেতেন। এহেন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উক্ত উচ্চতর মাকাম থেকে যখন অবতরণ করতেন,তখন মাখলুকাতের প্রতি মুতাওয়াজ্জিহান হবেন। আর এরূপ করার কারণ হচ্ছে, তিনি মুসলমানগণের প্রতি বিনম্র এবং দয়াবান ছিলেন। যেমন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, তিনি মুমিনগণের প্রতি দয়ালু'। এ সূক্ষ্ম তত্ত্ব খানা 'মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে ইবনুল হাজ্জ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে।


বান্দা মিসকীন অর্থাৎ হযরত শায়েখ শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিছে দেহলভী (رحمة الله) বলেন, হুজুর আকরম (ﷺ) এর এইরূপ হাল উপরােক্ত মাকামের সাথে নির্দিষ্ট ছিলাে এমনটি নয়। বরং তিনি সর্বদাই আ’লা ইল্লীন (উর্ধগামী গণের উর্ধতম) এবং কুরব (নৈকট্য) এর মাকামে অবস্থান করতেন। যাহেরে তিনি মাখলুকাত এর সাথে সম্পর্ক ও সম্মিলন বজায় রাখলেও বাতেনে উক্ত সম্পর্ক ও সম্মিলন রাখতেন না। নিশ্চয়ই হুজুর পাক (ﷺ) তার স্নেহ পরায়ণতা ও মেহেরবানী ভিত্তিতে যে আল্লাহ তায়ালার হুকুমে দাওয়াত ও আহকাম পৌছানাের দায়িত্বে নিয়ােজিত হয়েছেন, এটা আহাদিয়াতের মহান মাকাম থেকে মানবীয় বৈশিষ্ট্যের দিকে অবতরণ । তাই তিনি মানুষের সঙ্গে উঠা বসা করেছেন। আল্লাহপাকের বাণী ‘আমি কি আপনার বক্ষ সম্প্রসারিত করে দেইনি?' অনুসারে তার মধ্যে এই আমানত পরিপূর্ণ রূপে রাখা হয়েছে। যাতে করে তিনি পরিপূর্ণ তার সাথে হকের দাওয়াত মাখলুকাতের কাছে পৌছে দিতে পারেন। রাত জাগরণের সময় এবং সুবেহ সাদেকের সময় হুজুর পাক (ﷺ)এর সময়সমূহের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সময়—গুরুত্বপূর্ণ দুটি মাকাম। এ দু’টি মাকামের পূর্ণতা হুজুর পাক (ﷺ) এর জন্য খাছ। তবে তাঁর উম্মতের আউলিয়ায়ে কেরাম তার পূর্ণ অনুসরণের মাধ্যমে উক্ত মাকাম দ্বয়ের অংশ বা ফয়েজ পেয়ে থাকেন।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী] 


© | সেনানী এপ্স |

Top