হুজুর পাক (ﷺ) এর নবুওয়াত সম্পর্কে ইহুদীদের জ্ঞান


কিছু বর্ণনা এমন পাওয়া যায়, যাতে মনে হয় যে, হুজুর পাক (ﷺ) এর নবুওয়াতের সত্যতা সম্পর্কে ইহুদীদের পূর্ব থেকেই জানা ছিলাে। তবে তাদের মধ্যে যারা মন্দ তারা তার আত্মপ্রকাশের পর শত্রুতা বশতঃ তাকে অস্বীকার করেছিলাে। তবে যাদের অবস্থার সাথে তওফীক ও হেদায়েতে রব্বানী শামিল হয়েছিল, তারা ওই মন্দ লোকের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।


তারা তো সর্বদাই তৌরিত কিতাব শিক্ষা ও অনুশীলনের সময় হুজুর আকরাম (ﷺ) সম্পর্কে আলােচনা করে এবং নিজেদের সন্তান সন্ততিদের মধ্যে এর আলোচনা করে। তার হুলিয়া মোবারক কি রকম হবে—তারও বর্ণনা করে। হিজরত ও আবির্ভাবের স্থান নির্ধারণ করে তারা বলে যে, নবীর আখেরুজ্জামান মক্কা মুকাররমা থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় স্থায়ী হবেন। কিন্তু যখন হুজুর পাক (ﷺ) মদীনায় এলেন, তখনই তারা হিংসাত্মক পন্থা অবলম্বন করলাে এবং বলতে লাগলাে যে ইনি ওই ব্যক্তি নন তার সম্পর্কে আমরা তোমাদেরকে বলে আসছিল। তারা তখন তার বৈশিষ্ট্য সমূহের বিকৃত বর্ণনা দিতে লাগলাে। কিন্তু তাদের এই রদবদল সত্বেও দলিল ও সাক্ষী সমূহ তৌরিত কিতাব সমুজ্জ্বল ছিলে।


আউস গোত্রের এক ব্যক্তি আবু আমির পাদ্রী ছিল। আউস ও খাযরাজ গােত্রে তার চেয়ে অধিক হুজুর আকরম (ﷺ) এর প্রশংসা ও গুণাগুণ বর্ণনাকারী আর কেউ ছিলনা। এরা মদীনার ইহুদীদের মহব্বত করতাে, তাদের সঙ্গে উঠাবসা করতাে। তাদের কাছে রসূল করীম (ﷺ) এর ছানা সিফাত ও দ্বীন ইসলাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতাে, তারা হুজুর পাক (ﷺ) এর সিফাত তার কাছে ব্যক্ত করে বলে যে, মদীনা হবে তার হিজরতের স্থান। এরপর সে ইহুদীদের কাছ থেকে তাইমা নামক স্থানে গেলে এবং সেখানকার লোকদের কাছ থেকেও এরকম শুনতে পেলে। এরপর সে শামদেশে গিয়ে সেখানকার নাসারাদের কাছে হুজুর পাক (ﷺ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারাও তার কাছে হুজুর আকরম (ﷺ) এর ছানা সিফাত এই রকম বর্ণনা করলো। এরপর আবু আমের নির্জনতা অবলম্বন করলো এবং পাদ্রী হয়ে গেলে। পাদ্রীর মতে লেবাস পরিধান করা শুরু করলা। এরপর থেকে সে সব সময়ই বলে, আমি মিল্লাতে হানাফিয়া দ্বীনে ইব্রাহিম এর অনুসারী এবং নবীয়ে আখেরুজ্জামান এর আবির্ভাবের অপেক্ষায় রয়েছি।


উক্ত আবু আমের থেকে জিনের নারীরা হুজুর আকরাম (ﷺ) এর সিফাত ও আলামতের বর্ণনা শুনেছিলাে। কিন্তু হুজুর আকরম (ﷺ) যখন আত্মপ্রকাশ করলেন, তখন সে স্বীয় অবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে মুনাফেকীর বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে লাগলাে। সে হুজুর আকরম (ﷺ) কে এরূপ প্রশ্ন করতাে, হে মােহাম্মদ (ﷺ) আপনি কোন ধর্মের উপর আবির্ভূত হয়েছেন? তিনি বলতেন, মিল্লাতে হানিফিয়া। তখন সে বলতাে, না আপনি তা অন্য ধর্মের সাথে মিশ্রিত করে ফেলেছেন। হুজুর পাক (ﷺ) বলতেন, না। বরং আমি তাকে অধিকতর উজ্জ্বল ও পাক সাফ করে নিয়ে এসেছি। তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে আরও বলেছিলেন, হে আবু আমের! অই সমস্ত সংবাদের কি হলাে, আমার ছানা সিফাত সম্পর্কে ইহুদীরা যা তােমার কাছে ব্যক্ত করেছিলাে? তখন সে বলেছিলাে, আরে আপনি তাে নন, ইহুদীরা যে সমস্ত ছানা সিফাত বর্ণনা করেছিলাে তা আপনার মধ্যে নেই। হুজুর পাক (ﷺ) তখন বলেছিলেন, হে আবু আমের, তুমি মিথ্যা বলছাে। আবু আমের বললাে, আমি মিথ্যা বলছিনা বরং আপনি অসত্য বলছেন। হুজুর আকরম (ﷺ) তখন বললেন, মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ তায়ালা নিঃস্ব ও অসহায় অবস্থায় ধ্বংস করবেন। এরপর আবু আমের মক্কা ফিরে গেলাে এবং কুরাইশদের ধর্মের অনুসরণ করতে লাগলাে।


পরবর্তীতে উক্ত আবু আমের শাম দেশে যাওয়ার পথে একান্ত নিঃস্ব ও অসহায়ভাবে মােসাফিরি অবস্থায় হুজুর পাক (ﷺ) এর বদ দোয়ার ফল মৃত্যুবরণ করে। আবু আমেরের এই ঘটনাটি থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে যতক্ষণ কারও তৌফিক ও হেদায়েত নসীব না হয় ততক্ষণ প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতা এর জন্য কোনাে কাজে আসে না। ‘আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা করেন সিরাতুল মুস্তাকিমের প্রতি হেদায়েত দান করেন।


উক্ত আবু আমেরের পুত্র ছিলেন হযরত হানযালা (رضي الله عنه), তাঁকে গাছীলে মালায়েকা' বলা হয়। তিনি হুজুর পাক (ﷺ) এর দরবারে হাযির হয়ে ইমান গ্রহণ করলেন। তাকে একজন শ্রেষ্ঠ সাহাবা হিসাবে গণ্য করা হয়। তিনি যে গাছীলে মালায়েকা' হিসাবে খ্যাত হয়েছিলেন তার একটা ঘটনা রয়েছে। এমর্মে ইবন হেব্বান তার সহীহ হাদীছ গ্রন্থে এবং হাকিম তার গ্রন্থ মুস্তাদরেক এর সাথে শায়খাইনের শর্তানুসারে উক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটি হলো এরকম তিনি বিবাহিত ছিলেন। ওই দিনই তাঁর বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়েছিলাে। তিনি স্ত্রীর সাথে বাসরযাপন শেষ করেছিলেন। হঠাৎ করে উহুদের যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলাে। তিনি অস্থির হয়ে গেলেন। জানাবত থেকে পাক হওয়ার জন্য গোসল সম্পন্ন করার মতাে অবসরটুকুও তিনি পাননি। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেন কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে গেলেন। বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে তিনি উহুদের প্রান্তরে শাহাদতের শুরা পান করলেন। হুজুর পাক (ﷺ) দেখতে পেলেন যে, ফেরেশতাগণ তাকে গোসল করাচ্ছে। হুজুর পাক (ﷺ) বললেন, হানযালার প্রকৃত অবস্থাটি কি? অন্য শহীদদের মাঝখান থেকে নিয়ে ফেরেশতাগণ তাকে গোসল দিচ্ছে কেনে? (কেননা ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম—যুদ্ধের ময়দানে কেউ শহীদ হলে তখন তাকে গোসল দিতে হয় না এবং তার দেহ থেকে বস্ত্র ও অপসারণ করা হয় না। আর এখানে তাে দেখা যাচ্ছে ফেরেশতাগণ তাকে গোসল দিচ্ছে?)।


অন্য এক বর্ণনায় আছে, রাসূল (ﷺ) বললেন, সে জুনুবী ছিলাে। নিজের স্ত্রীর কাছ থেকে এই অবস্থাতেই উঠে এসেছে। পরে যখন তাঁর স্ত্রীর কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলাে, তখন তিনি এরকম অবস্থাই বর্ণনা করেছিলেন। এ হাদীছের উপর ভিত্তি করেই ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) জুনুবী শহীদ কে গোসল দেয়ার বিধান সাব্যস্ত করেছেন। তবে সাহেবাইন ও ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) এর বিপরীত মত পোষণ করতেন। তারা বলে থাকেন যে, ঐ গোসল যা জানাবতের কারণে ফরজ হয়েছিলাে, শরীরের বৃত্ত থেকে বান্দার বেরিয়ে যাওয়ার পর তার হুকুম রহিত হয়ে গিয়েছে। তার মৃত্যুর কারণে যে গোসল অপরিহার্য হয়, তা শাহাদাতের কারণে রহিত হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় তার উপর আর কোন গোসল ফরজ রইলারে?


ইমাম আযম আবু হানীফা (رحمة الله)? দলিল হিসাবে হজরত হানযালা (رضي الله عنه) এর ঘটনাকে উপস্থাপন করে থাকেন এবং হুজুর পাক (ﷺ) এর এরশাদ, যা বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে তিনি জুনুবী ছিলেন, তাঁকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে থাকেন।


এখন তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল এবং হজরত আদম (عليه السلام), ইব্রাহীম (عليه السلام) ও অন্যান্য নবীগণের সহিফা সমূহ হুজুর আকরাম (ﷺ) এর মর্যাদা ও গুণাবলী সম্পর্কে যে সমস্ত তথ্য পাওয়া যায়, তার বর্ণনা উপস্থাপন করা হবে।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 



© | সেনানী এপ্স |

Top