কবর ও হাশরের ময়দানে উম্মতে মোহাম্মদীর বিশেষত্ব


এই উম্মতের জন্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা কবরের মধ্যে গোনাহ্ সহকারে প্রবেশ করবে আর বেগোনাহ্ হয়ে কবর থেকে বের হবে। মুসলমানদের এসতেগফারের উসিলায় তাদেরকে গোনাহ্ থেকে পাক সাফ করে দেয়া হবে। ইমাম তিবরানী হাদীছটি হজরত আনাস (رضي الله عنه) এর মাধ্যমে আউসাত কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এই হাদীছ দ্বারা উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য বিশেষ ধরনের ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়। কোনো কোনো আলেম বলেন, হাদীছখানা শায। কবরের আযাব এই উম্মতের জন্য নির্ধারিত। আল্লাহ্তায়ালা কবরের আযাব দিয়ে তাদেরকে পাক সাফ করে আখেরাতের ময়দানে উপস্থিত করবেন, যাতে অন্য কোনো আযাব আর ভোগ করতে না হয়। এ উম্মতের আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, কিয়ামতের পর হাশরের ময়দানে উপস্থিতির প্রাক্কালে সর্বপ্রথম যমীন বিদীর্ণ করা হবে এই উম্মতের জন্য। এর অর্থ এই, অন্যান্য উম্মতের পূর্বে এ উম্মত কবর থকে বের হয়ে আসবে। হাদীছ শরীফে এসেছে, সর্বপ্রথম আমার জন্য এবং আমার উম্মতের জন্য যমীন বিদীর্ণ হবে। এই উম্মতের আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, হাশরের ময়দানে তাদেরকে যখন ওঠানো হবে, তখন তাদের অজুর অঙ্গসমূহ গুররে মুহাজ্জাল হবে। গুররা ওই শুভ্রতাকে বলা হয়, যা ঘোড়ার কপালে পরিলক্ষিত হয়। আর ঘোড়ার পায়ে শাদা বর্ণ থাকাকে মুহাজ্জাল বলা হয়। অজুর কারণে উম্মতে মোহাম্মদীর কনুই পর্যন্ত হাত ও টাখনু পর্যন্ত পা খুব বেশী পরিমাণে ধোয়া হয়। তাই এই স্থানগুলো হাশরের দিন উজ্জ্বল শাদা বর্ণের হবে। একারণেই মুহাজ্জাল শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আর অজুর সময় মাথার অগ্রভাগ, গর্দান ও মুখম-ল মাসেহ ও ধৌত করা হয় বিধায় এক্ষেত্রে গুররা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এই উম্মতের আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, হাশরের ময়দানে তারা উঁচুস্থানে অবস্থান করবে। 


হজরত জাবের (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, হাশরের ময়দানে আমি এবং আমার উম্মত উঁচুস্থানে অবস্থান করবো। এমন উন্নত স্থান কেউই পাবে না। অন্যেরা আমাদের দলভুক্ত হওয়ার অভিলাষী হবে। কিয়ামতের দিন সকল নবীর নাফরমান উম্মতেরা তাদের নবীগণের উপর মিথ্যা আরোপ করবে। কিন্তু সেইদিন আমরা তাদের নবীগণের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করবো। এ উম্মতের বৈশিষ্ট্যের আরেকটি দিক এই যে, তাদের কপালে সেজদার নিদর্শন পরিলক্ষিত হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘তাদের চেহারায় অর্থাৎ কপালে সেজদার নিদর্শন থাকবে।’ এই আয়াতে উক্ত আলামতটি কি দুনিয়ায় না আখেরাতে হবে সে সম্পর্কে দু’টি মত রয়েছে। 


১. নিদর্শন দুনিয়াতে হবে অর্থাৎ চারিত্রিক সততা, সদাচরণ এবং বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। কেউ বলেছেন, রাত জেগে ইবাদত করার কারণে এ উম্মতের চেহারায় এক প্রকারের হলুদ বর্ণ প্রকাশ পায়, যা দেখে মানুষেরা রোগগ্রস্ত বলে মনে করে। অথচ লোকটি রোগগ্রস্ত নয়। 


২. নিদর্শন প্রকাশ পাবে আখেরাতে। আখেরাতে অজুর স্থানগুলো উজ্জ্বল হবে, যা দেখে সহজেই অনুমিত হবে, লোকটি নামাজী ছিলো। 


শাহর ইবনে হাউশাব থেকে বর্ণিত হয়েছে, উম্মতে মোহাম্মদীর অযুর অঙ্গসমূহ পূর্ণিমার চন্দ্রের মতো ঝকমক করতে থাকবে। আতা খুরাসানী (رحمة الله) বলেছেন, বর্ণিত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে ওই উম্মত, যে পাঞ্জেগানা নামাজ আদায় করবে। এ উম্মতের বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে, তাদের আমলনামা তাদের ডান হাতে দেয়া হবে। ইমাম আহমদ ও বাযযার (رحمة الله) হাদীছখানা বর্ণনা করেছেন। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবেও এরকম উল্লেখ করা হয়েছে। মেশকাত শরীফে ইমাম আহমদ হজরত আবু দারদা (رضي الله عنه) এর মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করছেন, আমি কিয়ামতের দিন আমার উম্মতকে এভাবে চিনতে পারবো, তাদের অযুর অঙ্গসমূহ জ্বলজ্বল করতে থাকবে আর তাদের আমলনামাগুলো তাদের ডান হাতে থাকবে। আর আমি তাদেরকে এভাবেও চিনতে পারবো যে, তাদের আওলাদ তাদের সামনে দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে। 


শায়েখ ইবনে হাজার হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেছেন, তাদের আমলনামা অন্যান্যদের পূর্বেই তাদের ডান হাতে দিয়ে দেয়া হবে। তাদের আওলাদ তাদের সামনে দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবে- এটাও উম্মতে মোহাম্মদীর বৈশিষ্ট্য হওয়া সম্ভব। এই উম্মতের আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, হাশরের ময়দানে তাদের সম্মুখ এবং ডান দিক দিয়ে নূর দৌড়াদৌড়ি করবে। কোরআনুল করীমে এ রকম উক্ত হয়েছে। তাদের বৈশিষ্ট্যের আরেকটি দিক এই যে, তারা স্বয়ং যা আমল করবে তা তো তাদের জন্য কার্যকর হবেই, তাদের উত্তরসুরীরা তাদের জন্য যা করবে, তাও তাদের জন্য কার্যকর হবে। যেমন ইসালে সওয়াব, সদকায়ে জারীয়া এবং এসস্তেগফার ইত্যাদি। অথচ পূর্ববর্তী উম্মতগণের বেলায় ওই আমলই কেবল তাদের জন্য কার্যকর হতো, তারা নিজেরা যা করতো। 


উপর্যুক্ত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইবনে ইকরামা আয়াতে কারীমা- ‘মানুষ নিজেরা যে আমলে সচেষ্ট হবে, তাছাড়া অন্য কোনোকিছু তাদের উপকারে আসবে না।’ এই আয়াতের মাধ্যমে দ্বন্দ্ব উপস্থাপন করেছেন। এই আয়াতে কারীমা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, মানুষ নিজেরা যা আমল করবে, তাছাড়া অন্য কিছু তার উপকারে আসবে না। উক্ত আয়াতের আলোকে উপস্থাপিত দ্বন্দ্বের সমাধানকল্পে উলামা কেরাম কয়েকটি জওয়াব প্রদান করেছেন। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, উপরোক্ত আয়াতে কারীমার বিধান ‘যারা ইমানদার আর তাদের সন্তানেরা ইমানে তাদের অনুগামী, আমি তাদেরকে তাদের পিতাদের সাথে মিলিয়ে দেবো- এই আয়াতের মাধ্যমে রহিত হয়ে গিয়েছে। 


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 




© | সেনানী এপ্স |

Top