সিদরাতুল মুনতাহা


নবী করীম (ﷺ) কে সিদরাতুল মুনতাহার দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। এটি হচ্ছে সৃষ্টজীবের কর্মতৎপরতা এবং এলেমের সমাপ্তিস্থল। আল্লাহ্তায়ালার হুকুম এখানেই নাযিল হয়। এখান থেকে যাবতীয় আহকাম গ্রহণ করার জন্য ফেরেশতারা অপেক্ষমান থাকে। এস্থান অতিক্রম করার অধিকার ও ক্ষমতা কারো নেই। সবকিছু এখানে এসে শেষ হয়ে যায়। ফেরেশতাগণ নিুজগত থেকে ঊর্ধ্বজগতে যা কিছু নিয়ে যান এবং ঊর্ধ্বজগত থেকে হুকুম ও বিধান সংক্রান্ত যা কিছু নিয়ে নিুজগতে অবতরণ করেন, এ সবের সংযোগস্থল হচ্ছে সিদরাতুল মুন্তাহা। মাখলুকের দিক থেকে কেউই এস্থান অতিক্রম করতে পারেনি। কেবল রসুলেপাক (ﷺ) এর ব্যতিক্রম। এ স্থানে আসার পর হজরত জিব্রাইল থেমে গেলেন এবং নবী করীম (ﷺ) থেকে পৃথক হয়ে গেলেন। রসুলেপাক (ﷺ) জিব্রাইলকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন জায়গা এবং পৃথক হওয়ার কারণ কী? তিনি আরও বললেন, এমন স্থানে তো কোনো বন্ধু বন্ধুকে একা ফেলে যেতে পারে না। হজরত জিব্রাইল বললেন, আমি যদি আর এক আঙ্গুলও সামনে অগ্রসর হই, তাহলে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবো।


কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, রসুলেপাক (ﷺ) জিব্রাইল (عليه السلام) কে বললেন, কোনো নিবেদন থাকলে বলুন। আমি তা জনাবে বারী তায়ালার কাছে পেশ করবো। জিব্রাইল বললেন, আমার নিবেদন এটাই, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্তায়ালা যেনো আমার বাহুকে আরও প্রশস্ত করে দেন, যাতে আপনার উম্মতকে আমার বাহুতে বহন করে পুলসিরাত পার করে দিতে পারি। 


এই বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, সিদরাতুল মুনতাহা ষষ্ঠ আসমানে অবস্থিত। আবার অন্য বর্ণনায় এসেছে, পুলসিরাত সপ্তম আসমানে অবস্থিত। পরস্পরবিরোধী দুই বর্ণনার দ্বন্দ্ব সমাধান হতে পারে এভাবে, সিদরাতুল মুনতাহার মূল হয়তো ষষ্ঠ আকাশে। আর তার শাখাসমূহ সপ্তম আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। সিদরাহ্ শব্দের অর্থ বরই গাছ। এটির নাম সিদরাতুল মুনতাহা রাখার স্বার্থকতা সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ)ই ভালো জানেন। গাছটির তিনটি বিশেষত্ব রয়েছে। ১. এর ছায়া সুদীর্ঘ। ২. এর ফল অত্যন্ত সুস্বাদু। ৩. এর ঘ্রাণ অত্যন্ত মনমুগ্ধকর। ইসলামের সাথে এ গাছটির সাদৃশ্য রয়েছে, যা অন্তরের বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি এবং কাজের বাস্তবায়নের সমন্বয়ে গঠিত হয়। মাটিতে গাছ যেমন লাগানো হয়, আকাশে সম্ভবতঃ সেই গাছটি ঐভাবেই লাগানো আছে। মাটিতে গাছ যেমন প্রতিপালিত হয়, সেরকম বাতাসেও গাছ প্রতিপালিত হতে পারে। এটা আল্লাহ্তায়ালার কুদরতের বাইরে নয়। যেমন রসুলেপাক (ﷺ) শূন্যম-লে, হাওয়ায় ভ্রমণ করেছিলেন। আবার এমনও হতে পারে যে, গাছটি জান্নাতের মাটিতে পুঁতে দেয়া হয়েছে। যেমন বেহশতী বৃক্ষরাজি বেহেশতের মাটিতে প্রোথিত আছে। আবার এমনও হতে পারে, বৃক্ষটি কোথাও পুঁতে দেয়া হয়নি। নিছক আল্লাহ্তায়ালার কুদরতের মধ্যে তার স্থিতি। প্রকৃত অবস্থা আল্লাহ্পাকই ভালো জানেন। 


সিদরাতুল মুনতাহা থেকে প্রবাহিত হয়েছে চারটি নহর। দু’টি জাহেরী আর দু’টি বাতেনী। বাতেনী নহরগুলো জান্নাতে চলে গিয়েছে। আর জাহেরী নহর দুটো এই পৃথিবীর নীল ও ফোরাত। হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) এর হাদীছ থেকে বুঝা যায়, চারটি নহরই জান্নাতের। সেগুলো হচ্ছে নীল, ফোরাত, সীহান ও জীহান। আবার কেউ কেউ বলেছেন, নহরসমূহ জান্নাতের একথার মানে জান্নাতের কল্যাণ ও পরিণাম, যা চিরস্থায়ী হবে। কেউ কেউ বলেছেন, জান্নাতের নহর মানে জান্নাতের অস্তিত্ব থেকে নির্গত নহর। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


নহরে নীলের অবস্থা বেহেশতী বস্তুর অবস্থার মতই রহস্যময় ও সূক্ষ্ম, যা বুঝতে বুদ্ধি ক্লান্ত হয়ে যায়। এছাড়াও বেহেশতে পানি, দুধ, মধু ও শরাবের নহর প্রবহমান। কোরআন মজীদে এরকম উল্লেখ করা হয়েছে। আবু হাতেম হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (ﷺ) সপ্তম আকাশ পেরিয়ে একটি নহর দেখতে পেলেন। ইয়াকুত ও যমরুদ পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে নহরটি। তার পাশে পড়ে থাকা পেয়ালাগুলো স্বর্ণ, চাঁদি, ইয়াকুত, মোতি এবং যবরযদের। তার পানি দুধের চেয়ে শাদা এবং মধুর চেয়ে মিষ্টি। এতদৃষ্টে নবী করীম (ﷺ) বললেন, ভ্রাতা জিব্রাইল! এটা কী? তিনি উত্তর দিলেন, এটা হাউযে কাওছার, আল্লাহ্তায়ালা এটা আপনাকে দান করেছেন। হজরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, জান্নাতে একটি নহর রয়েছে। নাম সালসাবিল। তা থেকে দু’টি ধারা নেমে এসেছে।একটির নাম কাউছার আর অপরটির নাম রহমত। গোনাহ্গার বান্দা দোযখে জ্বলে পুড়ে যখন কালো হয়ে যাবে এবং নবী করীম (ﷺ) এর শাফায়াতে তারা যখন দোযখ থেকে বের হবে, তখন এই নহরের পানি দিয়ে তাদেরকে গোছল করানো হবে। তারপর তারা পুনরায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। 


সিদরাতুল মুনতাহা পাখি এবং পতঙ্গের ন্যায় নূর দ্বারা বেষ্টিত। তার প্রত্যেকটি পাতায় একজন ফেরেশতা বসে আছে। এটি এমন এক স্থান যার সংজ্ঞা নির্ণয় ও বর্ণনা প্রদান জ্ঞান ও অনুমানের আয়ত্তাতীত। এখানে আসার পরও নবী করীম (ﷺ) এর সামনে শরাব, দুধ ও মধুর পেয়ালা পেশ করা হলো। এবারও তিনি দুধই পছন্দ করলেন। এরপর নবী করীম (ﷺ) এর নিকট বাইতুল মামুর পরিদৃষ্ট হলো। পর্দা সরিয়ে দেয়া হলো। এ সম্পর্কে হাদীছ শরীফে বর্ণনা এসেছে, অতঃপর আমার সামনে বাইতুল মামুর উপস্থিত করা হলো। এই হাদীছের ব্যাখ্যায় এরকম বলা হয়েছে যে, নবী করীম (ﷺ) এবং বাইতুল মামুরের মধ্যে হয়তোবা আরও অনেক আলম বিদ্যমান। ওই সকল আলম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার মতো শক্তি তাঁর ছিলো না। তাই এ সকল থেকে পর্দা সরিয়ে দেয়া হলো এবং সবকিছুই তিনি (ﷺ) ভালোভাবে দেখে নিলেন। 


বাইতুল মামুর ওই মসজিদ, যা খানায়ে কাবার ঠিক বরাবর উপরে অবস্থিত। বাইতুল মামুর যদি পৃথিবীতে পতিত হতো তবে কাবা গৃহের উপরেই পড়তো। আদম (عليه السلام) পৃথিবীতে আসার পর তাঁর জন্যই এই বাইতুল মামুরকে ঊর্ধ্বজগত থেকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনা হয়েছিলো। তাঁর ইনতেকালের পর তাকে আবার ঊর্ধ্বাকাশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। 


পৃথিবীতে খানায়ে কাবার যা মর্যাদা, আকাশে বাইতুল মামুরের মর্যাদাও সেইরূপ। ফেরেশতাগণ ঊর্ধ্বাকাশে এই ঘরকে তওয়াফ করে এবং তার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করে, যেমন দুনিয়াতে কাবা গৃহের তওয়াফ এবং তার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করে থাকে আদম সন্তানেরা। 


দৈনিক সত্তর হাজার ফেরেশতা বাইতুল মামুর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে এসে থাকে। জিয়ারত শেষে ফিরে গেলে আর কোনেদিন যিয়ারতের সৌভাগ্য তাদের হয় না। এভাবেই দৈনিক তাদের গমনাগমন হচ্ছে। বাইতুল মামুর সৃষ্টির সময় থেকেই এই নিয়ম জারী আছে। এটা আল্লাহ্তায়ালার বৃহত্তর কুদরতের নিদর্শন। আল্লাহ্তায়ালা এতো অধিক সংখ্যক ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন, যা কল্পনায় ধারণ করা অসম্ভব। হাদীছ শরীফে এসেছে, আসমান যমীনের এমন এক বিঘত জায়গাও বাকী নেই, যেখানে ফেরেশতারা সেজদা করেনি। আর সাগরবক্ষে এমন এক বিন্দু পানিও নেই, যার উপর আল্লাহ্তায়ালা কোনো না কোনো ফেরেশতা নিয়োজিত রাখেননি। হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আসমানে একটি নহর আছে, যার নাম ‘নহরুল হায়াত’। 


জিব্রাইল (عليه السلام) দৈনিক ওই নহরে গোসল করে থাকেন। গোসল শেষে বাইরে এসে পাখাগুলো ঝাড়া দেন। তখন তাঁর পাখা থেকে সত্তর হাজার পানির ফোটা ঝরে পড়ে এবং আল্লাহ্তায়ালা প্রতি ফোঁটা থেকে একজন করে ফেরেশতা সৃষ্টি করেন। 


এই ফেরেশতারাই দৈনিক বাইতুল মামুরে জিয়ারতের জন্য উপস্থিত হন এবং সেখানে নামাজ আদায় করেন। পুনরায় আর কখনো এখানে আসার সুযোগ পান না। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে এরকম বর্ণনা করা হয়েছে। 


ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (رحمة الله) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে ‘তোমরা যা জানো না এমন জিনিস আল্লাহ্তায়ালা সৃষ্টি করেন’ এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, আতা, মুকাতিল এবং যেহাক প্রমুখ এলমে তাফসীরের ইমামগণ হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) সূত্রে বর্ণনা করেছেন, আরশের ডান দিকে নূরের একটি নহর রয়েছে, যা সাত আসমান, সাত যমীন এবং সাত আলমের সমতুল্য। হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) দৈনিক সেখানে গোসল করেন এবং তাঁর নিজস্ব নূরকে এবং সৌন্দর্যকে আরও বর্ধিত করেন। গোসল সমাপনান্তে তিনি যখন পাখাগুলো ঝাড়া দেন, তখন আল্লাহ্তায়ালা প্রত্যেকটি ফোঁটা থেকে কয়েক হাজার ফেরেশতা সৃষ্টি করেন। এ সৃষ্টিধারা কিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে। 


এক বিবৃতিতে আছে, সেখানে যতগুলো ফেরেশতা আল্লাহ্তায়ালার তসবীহ পাঠ করেন, আল্লাহ্তায়ালা তার প্রত্যেক তসবীহ থেকে একেকজন ফেরেশতা সৃষ্টি করে দেন। বান্দা মিসকীন (শায়েখ আবদুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী) বলেন, আকাশে ফেরেশতাগণের তসবীহ থেকে যদি আল্লাহ্তায়ালা ফেরেশতা সৃষ্টি করেন, তাহলে পৃথিবীতে আল্লাহ্পাকের দরবারের খাস সালেহ বান্দাগণের তসবীহ তাহলীলের দ্বারাও আল্লাহ্তায়ালা ফেরেশতা সৃষ্টি করতে পারেন। এটা বিচিত্র কিছু নয়। আল্লাহ্তায়ালা সবকিছুর উপর পূর্ণক্ষমতাবান। 


মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়ার গ্রন্থকার বলেন, হজরত জিব্রাইল (عليه السلام) এর পাখার পানির ফোঁটা থেকে যে সকল ফেরেশতা সৃষ্টি হয়, তারা নিমোক্ত ফেরেশতাবৃন্দের বহির্ভূতঃ


১. যারা সর্বাক্ষণিক আল্লাহ্তায়ালার ইবাদতে রত। ২. যারা উদ্ভিদ এবং রিযিক সৃষ্টি এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত। ৩. যারা বনী আদমের দেহের আকৃতি বানানোর কাজে নিয়োজিত। ৪. যারা বৃষ্টিবর্ষণের সাথে জড়িত। ৫. যারা জুমার দিন মুসল্লিগণের তালিকা প্রস্তুত করেন। ৬। যারা জান্নাতের প্রহরী। ৭. যারা দিন এবং রাতে বান্দাগণের আমলনামা প্রস্তুত করার জন্য পৃথিবীতে আগমন করেন। ৮. ওই সত্তর হাজার ফেরেশতা যারা সব সময় রসুলেপাক (ﷺ) এর রওজা শরীফে হাজির থাকেন এবং সেখানকার আমল লিপিবদ্ধ করেন। ৯. ওই সকল ফেরেশতা যারা নামাজী ব্যক্তির সুরা ফাতেহা শেষ হলে আমীন বলেন এবং সামিআল্লাহুলিমান হামিদাহ শেষ হলে রাব্বানা লাকাল হামদ বলেন। ১০. ওই সকল ফেরেশতা যারা নামাজের জন্য অপেক্ষাকারীদের জন্য আল্লাহ্পাকের কাছে দোয়া করতে থাকেন। ১১. স্বামীর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও যে সকল স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে নিশি যাপন করা থেকে দূরে থাকে তাদের উপর লানত বর্ষণ করার জন্য যারা নিয়োজিত। ১২. প্রত্যেক আসমানে আপন আপন দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাবৃন্দ। 


হাদীছ শরীফে এসেছে, যে সকল ফেরেশতা আরশবহনকারী, তাদের প্রত্যেকের চেহারা এবং শরীর ভিন্ন ভিন্ন ধরনের একের সঙ্গে অপরের সাদৃশ্য নেই এবং তারা এত বিশাল আকৃতির যে, তাদের ডানার একটি পালক দ্বারা সমস্ত পৃথিবী আচ্ছাদিত হতে পারে। আরশ বহনকারী ফেরেশতা আটজন। তাদের দেহ এতো বিশালকায় যে, এক কানের লতি থেকে আরেক কানের লতি পর্যন্ত দু’শ বছরের দূরত্ব। আরেক বর্ণনায় আছে, সাত’শ বছরের দূরত্ব। আবুশশায়খ স্বীয় কিতাব ‘আলউযমা’য় অনেক বিস্ময়কর বস্তুর বর্ণনা দিয়েছেন। এ সকল বিস্ময়কর সৃষ্টি থেকে খালেক মালেক বারী তায়ালার মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা উচিত। তাঁর শক্তি ও শান কতো ব্যাপক কতো বিশাল! 


হাদীছ শরীফে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমি যখন সপ্তম আকাশে আরোহণ করলাম, তখন ইব্রাহীম খলীলকে বাইতুল মামুরে হেলান দেয়া অবস্থায় দেখতে পেলাম। তার সাথে এক বিরাট জামাত উপবিষ্ট। আমি তাঁকে সালাম প্রদান করলাম। তিনিও প্রত্যুত্তর দিলেন। সেখানে আমি দেখলাম আমার উম্মত দু’ধরনের। একদল শাদা পোশাক পরিহিত। তাদের পোশাকগুলো কাগজের মতো মিহি। অপর জামাতটি ময়লা পোশাক পরিহিত। শাদা পোশাক পরিহিত লোকগুলো বাইতুল মামুরের নিকটে আমার সঙ্গে মিলিত হলো। আর ময়লাকাপড় পরিহিত লোকেরা রইলো পিছনে। আমি শাদা পোশাক পরিহিত লোকদেরকে সঙ্গে নিয়ে বাইতুল মামুরে নামাজ আদায় করলাম। পোশাকের পরিচ্ছন্নতা ও শুভ্রতা সুন্দর আমলের ইঙ্গিতবহ। যেমন ‘আপনার লেবাসকে পবিত্র করুন’ আয়াতে কারীমার তাফসীরে বলা হয়েছে। হাদীছ শরীফে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমি ইব্রাহীমের কাছে এমন একদল লোক দেখতে পেলাম, যারা কাগজের মতো সুন্দর এবং শুভ্র। সেখানে আরেক দল লোক ছিলো যাদের দেহবর্ণ অন্ধকার ও কৃষ্ণ। অতঃপর তারা একটি নহরের কাছে এলো এবং সেখানে গোসল করলো। তাতে তাদের কালিমা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। এরপর তারা আরেকটি নহরের কাছে এলো এবং পুনরায় সেখানে গোসল করলো। তাতে তাদের দেহমন পরিপূর্ণভাবে শুভ্র সুন্দর লোকদের মতো হয়ে গেলো। রসুলেপাক (ﷺ) শাদা বর্ণের লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? আর কালো বর্ণের লোকগুলোই বা কারা? আর হেলান দিয়ে বসে আছেন যিনি, তিনি কে? নহর দু’টিই বা কিসের, যার পানিতে ওরা গোসল করলো? 


জিব্রাইল জবাব দিলেন, যিনি হেলান দিয়ে বসে আছেন, তিনি আপনার পিতা ইব্রাহীম। শাদা বর্ণের পোশাক পরিহিত লোকগুলো আপন ইমানকে অন্যায়ের কালিমা দ্বারা কলংকিত করেননি। কৃষ্ণবর্ণের লোকগুলো তাদের সৎকর্মকে অসৎকর্মের সঙ্গে মিশ্রিত করে ফেলেছিলো। কিন্তু পরে তারা তওবা করাতে আল্লাহ্তায়ালা তাদের উপর রহমত করেছেন। আর নহরগুলো হচ্ছে প্রথমটি নহরে রহমত, দ্বিতীয়টি নহরে নেয়ামত। আরেকটি নহর হচ্ছে, শরাবান তহুরার নহর। কোরআন পাকে এ কথা বলা হয়েছে। 


রসুলেপাক (ﷺ) এর সওয়ারী আরও উপরে উঠলো। এতো উপরে উঠলো যে, সেখানে কলমের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো। কলমের মাধ্যমে ফেরেশতাগণ আল্লাহ্তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত তকদীর লিপিবদ্ধ করছিলেন। তকদীরে এলাহী চিরন্তন, কিন্তু তার লিখন ক্রিয়াটি অ-শাশ্বত। আর লওহে মাহফুজে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে লেখা হয়েছে আসমান যমীন সৃষ্টিরও আগে। হাদীছ শরীফে এ সম্পর্কেবলা হয়েছে, ভবিষ্যতে যা হবে, কলম তা লিপিবদ্ধ করে শুকিয়ে গেছে। এই হাদীছখানা লওহে মাহফুজের লেখা সম্পর্কিত। নবী করীম (ﷺ) শুনতে পেয়েছিলেন, সেই লেখার আওয়াজ ফেরেশতাগণ মূল লিপি থেকে অনুলিপি করছিলেন। যেমন শবে বরাত ইত্যাদি রজনীতে ভাগ্য লেখা হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে বদল ও বাতিলের অবকাশ থাকে। যেমন আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন- ‘আল্লাহ্তায়ালা যা ইচ্ছে করেন মিটিয়ে দেন এবং যা ইচ্ছে করেন ঠিক রেখে দেন।’ ফেরেশতাবৃন্দের লিপিতে লিপিবদ্ধ করার ব্যাখ্যা এরকমই এসেছে হাদীছ শরীফে। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবের প্রণেতা ইবনে কাইয়্যূম থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন এরকম তিনি বলেছেন, কলম সর্বমোট বারোটি। মর্যাদার দিক দিয়ে সেগুলো একেকটি একেকরকম। তন্মধ্যে সবচেয়ে উঁচুমানের এবং সম্মানিত কলম হচ্ছে কলমে কুদরত, যদ্দ্বারা আল্লাহ্তায়ালা সৃষ্টজীবের তকদীর লিপিবদ্ধ করেছেন। এ মর্মে সুনানে আবু দাউদ কিতাবে হজরত উবাদা ইবনে সামিত (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি রসুলে করীম (ﷺ) কে এরকম এরশাদ করতে শুনেছি, আল্লাহ্তায়ালা সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন কলম। তিনি কলমকে হুকুম করলেন ‘লিখ’। কলম নিবেদন করলো ‘সৃষ্টির পর কী লেখবো?’ আল্লাহ্তায়ালা হুকুম করলেন, কিয়ামত পর্যন্ত যতো মাখলুক সৃষ্টি হবে তুমি তাদের তকদীর লিপিবদ্ধ করো। এটিই সর্বপ্রথম কলম এবং সবচেয়ে সম্মানিত কলম। অনেক মুফাসসির এই কলমের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন, এটা ওই কলম, যার কসম করেছেন আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কোরআনে মজীদে। 


দ্বিতীয় কলম হচ্ছে ওহী লিপিবদ্ধ করবার কলম। তৃতীয় কলম সীলমোহরের কলম, যার মাধ্যমে আল্লাহ্তায়ালা নবী রসুলগণকে চিহ্নিত করেন। চতুর্থ কলম তলবে আবদান অর্থাৎ মাখলুকের দেহের সুস্থতার হেফাজত করার কাজে যে কলম ব্যবহৃত হয়। পঞ্চম কলমও সীলমোহরের কলম, যার দ্বারা আল্লাহ্ নওয়াব বাদশাহ্দেরকে নওয়াবী ও বাদশাহীর জন্য চিহ্নিত করে থাকেন। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের শাসন ও রাজনৈতিক কর্মকা-ের সংশোধন সাধন করা হয়। ষষ্ঠ কলম হিসাব নিকাশের কলম। এ কলম দ্বারা ওই সমস্ত সম্পদের হিসাব নিকাশ করা হয়, যা প্রকাশ করা হয় এবং মাখলুকের জন্য খরচ করা হয় এই কলমকে কলমে আরযাক বা রিযিকের কলমও বলা হয়। সপ্তম কলম হচ্ছে কলমে হুকুম বা হুকুমের কলম, যার মাধ্যমে হুকুমের বাস্তবায়ন করা হয় এবং সৃষ্টজীবের হক ও অধিকার বিদ্যমান রাখা হয়। অষ্টম কলম কলমে শাহাদত যার দ্বারা সৃষ্টিজীবের হক বা অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। নবম কলম কলমে তাবীর এটি ওহী ও সত্য স্বপ্নের কর্মকা-ে ব্যবহৃত হয়। দশম কলম কলমে তাওয়ারীখ। পৃথিবীর ঘটনা এবং ইতিহাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই কলম ব্যবহার করা হয়। একাদশ কলম হচ্ছে লুগাত বা সৃষ্টজীবের ভাষা এবং তার বিস্তারিত অবস্থা লিপিবদ্ধকারী। দ্বাদশ কলম কলমে জামে, যা বাতেলপন্থীদের ভ্রান্ত যুক্তি খ-ন এবং ধর্মে তাহরীফ বা রূপান্তরকারীদের সন্দেহ দূর করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ সমূহ কলমই সৃষ্ট জগতের মুসলেহাত বা কল্যাণের কাজের আয়োজন করে থাকে। এই কলমের মর্যাদা ও বুযুর্গী সম্পর্কে বলতে গেলে কোরআনে করীমের কসমই যথেষ্ট। যেমন কোরআনে করীমে উল্লেখ হয়েছে, নূন, ওয়াল কালামে ওমা ইয়াসতুরুন। এক্ষেত্রে একটা কথা স্পষ্টভাবে বুঝে নিতে হবে। এই কলমের হাকীকত আল্লাহ্ ও তাঁর রসুল ছাড়া আর কেউ জানে না। দুনিয়ার কলমের মাধ্যমে এলেমের বিষয় লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে। কলম সম্পর্কে উপরে যা বর্ণনা করা হলো এসবই মালুমাত (জানিত বিষয়) এর অন্তর্ভূত, যা এলেমেরই গন্ডিভুক্ত।


উপরে যা বলা হলো সেগুলো তার মধ্যে সত্যিই সীমাবদ্ধ থেকে থাকে, তাহলে তো ভালোই। আর যদি প্রকৃত অবস্থা অন্যরকম হয় তাহলে বুঝে নিতে হবে যে, যা বলা হয়েছে তা সবই মিছালী বা উদাহরণগত বর্ণনা। 


এরপর রসুলেপাক (ﷺ) এর দৃষ্টিতে জান্নাত ও জাহান্নাম উপস্থাপন করা হলো ওই সমূহ রূপ ও সৌন্দর্যাবলীর সঙ্গে যার বর্ণনা কোরআন ও হাদীছে প্রদান করা হয়েছে। তিনি জান্নাতকে দেখতে পেলেন আল্লাহ্তায়ালার রহমতের প্রকাশস্থল রূপে আর দোযখকে দেখলেন আযাব ও গযবের জায়গা হিসেবে। জান্নাত উন্মুক্ত ছিলো। জাহান্নাম ছিলো বন্ধ। রসুলেপাক (ﷺ) সালসাবীল নামক নহরে গোসল করলেন, তাতে তাঁর জাহের ও বাতেন হুদুদ বা সীমানার মলিনতা থেকে পাক সাফ হয়ে গেলো এবং তাঁকে পূর্বাপর সমস্ত ত্রুটি ক্ষমার তাজ দান করা হলো। 


কোনো কোনো বর্ণনায় এরকম এসেছে, অতঃপর নবী করীম (ﷺ) কে জান্নাতের সুন্দর ও পবিত্রতম একটি বৃক্ষের উপর আরোহণ করানো হলো এবং সেই বৃক্ষের ফল খাওয়ানো হলো। তাঁর পৃষ্ঠদেশ নুৎফায় রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিলো। এরপর তিনি পৃথিবীতে অবতরণ করলেন এবং উম্মুলমুমেনীন হজরত খাদীজাতুল কুবরা (رضي الله عنه) এর সঙ্গে নিশিযাপন করলেন। তার ফলে জন্মলাভ করলেন খাতুনে জান্নাত হজরত ফাতেমাতুয যাহরা (رضي الله عنه)। এই বর্ণনা থেকে একটি দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। হজরত ফাতেমা (رضي الله عنه) এর জন্ম হয়েছিলো নবুওয়াতের সাত বৎসর বা তারও আগে। অথচ মেরাজের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর। তবে কি নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বেও কোনো মেরাজ সংঘটিত হয়েছিলো? যদি হয় তবে বুঝতে হবে, সেটা হয়েছিলো স্বপ্নযোগে। সশরীরে নয়। এই ঘটনা সম্ভবত স্বপ্নের ঘটনা। সশরীরে মেরাজের ক্ষেত্রে এই আলোচনা আসে না। 


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 




© | সেনানী এপ্স |

Top