পবিত্র স্বভাবের এক ঝলক
সাইয়্যিদাতুনা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, একদা তাকে হুজুর পাক (ﷺ) এর আখলাকে কারীমা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলাে। উত্তরে তিনি বললেন, তার আখলাক ছিলাে পবিত্র কুরআন। হাদীছ করার বাহ্যিক অর্থ এরূপ কুরআনে কারীমে যে উত্তম আখলাক এবং প্রশংসনীয় গুণাবলীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি সে সমস্ত গুণে ভূষিত ছিলেন। কাযী আয়ায (رحمة الله) আশ শিফা' গ্রন্থে এর অতিরিক্ত বিবরণ দিয়েছেন। বলেছেন, কুরআনের পছন্দ ছিল তার পছন্দ আর কুরআনের অসন্তুষ্টিই ছিলাে তার অসন্তুষ্টি। মােট কথা, হুজুর পাক (ﷺ) এর সন্তুষ্টি ছিলে আল্লাহতায়ালা হুকুমের যথাযথ বাস্তবায়ন এর মধ্যে, আর তার সন্তুষ্টির ছিলে আল্লাহতায়ালা হুকুমের অস্বীকৃতি ও অবাধ্যতায়। উপরোক্ত হাদীছের মর্মার্থ এরকম যা উল্লেখ করা হয়েছে।
আওয়ারেফুল মাআরেফ' গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর উক্ত হাদীছের মর্মার্থ ছিলে এরূপ কুরআনে কারীম ছিলাে হুজুর পাক (ﷺ) এর মার্জিত চরিত্র। 'আওয়ারেফুল মাআরেফ এর গ্রন্থকার হযরত শায়খ এ সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। যার সারকথা এরূপ—হুজুর আকরাম (ﷺ) এর পবিত্র অন্তঃকরণ থেকে শয়তানের হিসসাকে নিষ্ক্রান্ত করার পর তাকে ধৌত করে পবিত্র করা হয়েছে। এরপর তাঁর পবিত্র প্রবৃত্তি মানবীয় বৈশিষ্ট্যময় প্রবৃত্তির পরিসীমায় এনে স্থির করা হয়েছে। তারপর উক্ত প্রবৃত্তির মানবীয় বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী এই পরিমাণ অবশিষ্ট রেখে দেয়া হয়েছে, যা কুরআন নাযিলের উপযোগী হয়। কেননা নবিতা ঐ মহামানব হতে পারে, যার মধ্যে মানবীয় বৈশিষ্ট্য পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকে। পূর্ণ মানবীয় বৈশিষ্ট্যের বিপরীত যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য হুজুর পাক (ﷺ) এর মধ্যে বিদ্যমান ছিলাে তা বের করে দেয়া হয়েছে। যে সমস্ত গুণাবলী আদব ও শালীনতাময় তথা নবুওয়াতের নাচের উপযোগী তা অবশিষ্ট রেখে দেয়া হয়েছে, যাতে মাখলুকাতের উপর রহমত বর্ষণ ও উম্মতের আখলাক-চরিত্র মার্জিত করার মাধ্যম হয়। মর্মার্থ এই যে, হুজুর আকরাম (ﷺ) এর মধ্যে কতিপয় মানবীয় গুণাবলী এজন্য অবশিষ্ট রেখে দেয়া হয়েছে, যাতে মানুষ তাঁকে তাদের নিজের আকৃতি ও স্ব-শ্রেণীভুক্ত দেখতে পায় যাতে তাঁর প্রতি তাদের মহব্বত ও আকর্ষণ জন্মে।
হুজুর (ﷺ) যদি নিরেট ফেরেশতাদের গুণে গুণানিত হতেন, তা হলে মানুষ সন্ত্রস্ত হয়ে যেতাে এবং নবীর প্রতি ভালােবাসা ও আকর্ষণ সৃষ্টি হতােনা। ফলে মানুষ দূরে সরে যেতো। কাজেই রাসূল (ﷺ) এর মধ্যে মানবীয় গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য মাখলুকাতের জন্য রহমত ও উম্মতের আখলাক মার্জিত হওয়ার কারণ বটে। একারণেই মানবীয় প্রবৃত্তির অভ্যন্তরে মানবীয় গুণাবলীর মূল প্রবিষ্ট করণের মাধ্যমে অধিক যুলমত ও ঘনত্ব প্রদান করা হয়েছে। এবং ইমান ও ইসলামের মাধ্যমে তার মূলােৎপাটন করে দিয়ে ইমানকে কলবে সুদৃঢ় করে দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, তােমার অন্তরকে এ কুরআনের এর মাধ্যমে প্রশান্ত করে দেয়ার জন্য আমি তা নাযিল করেছি। আর কলবে প্রশান্ত অবস্থা সৃষ্টি হয় এযতেরাব বা চাঞ্চল্যকর অবস্থার পর। কেননা প্রবৃত্তির তৎপরতা তার গুণাবলীর বহিঃপ্রকাশ এর সাথে সম্পৃক্ত। এজন্য কলব ও নফসের মধ্যে একটি সম্পর্ক ও যােগসূত্র রয়েছে।
যেমন হুজুর আকরম (ﷺ) এর সম্মানিত ব্যক্তিত্ব আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল তখন, যখন তার দান্দান মোবারক শহীদ করা হয়েছিল এবং নূরানী চেহারা রক্তে রঞ্জিত করা হয়েছিলাে। ঐ সময় তিনি মনের খেদ কিভাবে ব্যক্ত করেছেন। তারা সংশোধিত হতে পারে কিভাবে, যারা আমাদের নবীর চেহারা রক্তরঞ্জিত করে দিয়েছে। অথচ তিনি তাদেরকে তাদের প্রভুর দিকেই আহ্বান করছেন। ঐ সময় আল্লাহতায়ালা তার পবিত্র কলবকে 'ছাবেতা' অবস্থা প্রদানের উদ্দেশ্যে নাযিল করলেন, বন্ধু হে! একাজের ব্যাপারে আপনার উপর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে, সকলকে আপনি সংশোধন করে ফেলে।' এরপর নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র হৃদয় ছবরের পরিচ্ছদ পরিধান করলাে। এযতেরাব (চাঞ্চল্য) এর হাল থেকে সকুনত (প্রশান্তি) এর হালে উপনিত হলাে। এরকম বিভিন্ন অবস্থা ও কারণের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে হুজুর আকরম (ﷺ) এর উপর কুরআনের আয়াতসমূহ নাযিল হতে থাকে এবং তার পবিত্র কলবকে অধিকতর পরিমার্জিত ও পরিচ্ছন্ন করা হতে লাগলো। এমনকি কুরআনুল কারীম তার আখলাকে রূপান্তরিত হলাে। হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর বাণীর (কুরআনই ছিলাে তার চরিত্র মর্মার্থ এটাই। তবে প্রকৃত অবস্থা এই যে, হুজুর আকরম (ﷺ) এর মাকামের হাকীকত এবং মহান অবস্থার নিগুঢ় রহস্য পর্যন্ত পৌছতে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি ও বিবেক অক্ষমতা স্বীকার করতে বাধ্য। তার মহান মর্যাদা নিগুঢ়তত্ব কেবল আল্লাহ পাক জানেন। যে আল্লাহ তায়ালার যাতে পাকের রহস্য সম্পর্কে হুজুর আকরম (ﷺ) এর মতাে আর কেউ অবগত হতে পারেননি। যেমন আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, উহার তাবীর আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর কেউ জানে না।
কবির ভাষায় ?
আল্লাহ ছাড়া আর কেউ হুজুর আকরম (ﷺ) এর প্রকৃত কদর ও মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত হতে পারে না। যেমন, হুজুর আকরম ( ﷺ) شছাড়া আল্লাহ তায়ালাকে কেউ চিনতে পারেনি। তার মাকাম বা মর্যাদা যেহেতু সর্বাধিক উন্নত, কাজেই সে সম্পর্কে অবহিত লাভ মানুষের জ্ঞান বুদ্ধির উর্ধে।
কবির ভাষায় ?
‘তিনি যেরকম, হুবহু সেরকম কি কোথাও কোনাে চক্ষু দেখতে সক্ষম হবে? প্রত্যেক ব্যক্তিই আপন আপন জ্ঞান বুদ্ধি ও ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী তাকে বুঝার জন্য চেষ্টা করে থাকে।'
হাদীছের মর্মার্থ আলোচনা অনেক কিছু উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তার শান ও মর্যাদা অনুধাবন পরিসীমার বাইরে। যদি ধরেও নেয়া হয় যে, তাকে অনুভব করা যায় অর্থাৎ বাহ্যিক দেহ মুবারককে চর্মচক্ষু দ্বারা অবলোকন করা সম্ভব, তবে দৃষ্টিশক্তির ধারণ ক্ষমতার উর্ধে এটা নিশ্চিত। যেমন, একটি বিশাল পর্বত দৃষ্টি সীমার বেষ্টনীতে আসে না। যদি বলা হয় তিনি বােধগম্য অর্থাৎ আকলের মাধ্যমে তাকে বুঝা যায়। তবে এটা নিশ্চিত আকল কিন্তু তাকে পূর্ণভাবে লাভ করতে অক্ষম। যেমন আল্লাহ তায়ালার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে পূর্ণভাবে বোঝা যায় না। আল্লাহ তায়ালা যেখানে তার আখলাকের বিশেষণে আমীন (মহান) শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং তার জন্য যে মর্যাদা নিরূপণ করেছেন, সেখানেও আমীন শব্দ ব্যবহার করেছেন। সুতরাং তার মহত্বের নিগূঢ়তা সম্পর্কে ধারণা করতে অভিজ্ঞান অক্ষম হতে বাধ্য। এ সম্পর্কে পূর্বেও আলোচনা করা হয়েছে। এতে সকলের ঐকমত্য হয়েছে যে, আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রশংসনীয় আখলাক ও সুন্দর গুণাবলী সবই সৃষ্টিগত, মৌলিক ও প্রাকৃতিক। তাদের এ মহান আখলাক অর্জন করার ব্যাপারে কোনরূপ চেষ্টা সাধনা বা রিয়াতের কোনােরূপ ভূমিকা নেই। এর কোনো প্রয়ােজনও দেখা হয়নি। বিশেষ করে সাইয়্যেদুনা জনাব মোহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) এর
ব্যাপারে তাদের কোনো প্রশ্নই আসেনা। যেহেতু তিনি সুমহান আখলাক ও প্রশংসনীয় গুণাবলী দ্বারা সজ্জিত ও মার্জিত হয়ে দুনিয়াতে তাশরীফ এনেছেন। যেমন কবি বলেছেন -
তাঁকে তালীম ও আদব শিক্ষা দেয়ার কিইবা প্রয়ােজন? যেহেতু তিনি নিজেই শিক্ষক হয়ে তাশরীফ এনেছেন।
তার মর্যাদার পর্দায় কোনা রূপ রূপান্তর ও পরিবর্তনের কোনা
অবকাশ নেই। তার এমন কিছু কিছু আহকাম ও কীর্তি রয়েছে, যাতে সৃষ্টিগত মানবীয় বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায় না। সেগুলিও বিশেষ স্থান ও অবস্থানের সাথে সম্পৃক্ত। মাহাত্ম অনুধাবন করার ব্যাপারে মানুষের অনুমান সে পর্যন্ত ভ্রমণ করতে অক্ষম। তাঁর হাকীকত সম্পর্কে রাব্বুল ইযযতই অবহিত আছেন। যেন কবির ভাষায় ‘ধারনা গণ্ডিতে আনয়ন করা থেকে তিনি অনেক উর্ধে।'
এ প্রসঙ্গে উহুদ যুদ্ধের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। যখন হুজুর আকরাম (ﷺ) এর দান্দান মুবারক শহীদ হলাে। মাথা মুবারক যখম হয়ে নূরানী মুখমণ্ডল রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেলাে। সাহাবায়ে কেরামের নিকট এ দৃশ্য বড়ই হৃদয়বিদারক ছিল। তারা নিবেদন করতে লাগলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (ﷺ) আপনি এদিকে বদ দোয়া করবেন যাতে এরা কৃতকর্মের যথাযোগ্য শাস্তি ভাগ করে। করুণার সিন্ধু মহান রাসুল এরশাদ করলেন, আমাকে তার বদ দোয়া ও অভিসম্পাতকারী হিসেবে দুনিয়াতে পাঠানো হয়নি। বরং আল্লাহর মাখলুককে আল্লাহতায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক করে দিতে এবং তাদেরকে দয়া ও ভালােবাসা প্রদান করার উদ্দেশ্যে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে। তখন তিনি তাদের উদ্দেশ্যে এ দোয়া করেছিলেন, হে আমার আল্লাহ। আমার কাওমকে তুমি হেদায়েত দান করে, তাদের জ্ঞান নেই। এক্ষেত্রে মহান রাসুল ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা চরম ও পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। কোথায় চিন্তা? কোথায় ক্লেশ? বিচলিত হওয়ার বিন্দুমাত্র চিহ্ন তার মধ্যে নেই।
শায়েখ সাহেব ‘আওয়ারেফুল মাআরেফ' গ্রন্থে যে উল্লেখ করেছেন, হুজুর আকরম (ﷺ) এর মহান সত্তায় প্রথমে হরকত, বিচলিত অবস্থা এবং অধৈর্যের বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল। অতঃপর আয়াতে কারীমা অবতরণের মাধ্যমে ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচ্ছদ পরিধান করানাে হয়েছে। ফলে, তার অভ্যন্তরে প্রশান্তি ও স্থিতিশীলতার আবির্ভাব ঘটেছে। এই মিসকীন (শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله) এ ধরনের বাক্য ব্যবহার করতে ভীত সন্ত্রস্ত। যদিও এগুলি এলমী নীতিমালার কিয়াসের ভিত্তিতে সঠিক বলে ধরে নেয়া যেতে পারে, তবুও হুজুর পাক (ﷺ) এর প্রতি আদব প্রদর্শনের শানের পরিপন্থী। উপরােক্ত বক্তব্য কাছাকাছি তিনি আরও বলেছেন যে, হযরত
আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর كان خلقه القران হাদীস খানা এক গভীর রহস্যের দিকে ইঙ্গিত প্রদান করছে যে, হুজুর আকরম (ﷺ) এর চরিত্র আখলাকে রব্বানীর বাহ্যিক রূপায়ণ। কিন্তু উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা) আল্লাহ তায়ালার আজমত বা মহত্বের দিকে লক্ষ্য রেখেছে।
তিনি এরূপ বলতে চেয়েছেন যে, হুজুর আকরাম (ﷺ) এর মহান আখলাক আখলাকে এলাহীর প্রকাশস্থল। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) মহান আল্লাহতায়ালার জালালাতে শানের সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রেখে বলেছেন যে, তিনি (ﷺ) আল্লাহ তায়ালার আখলাকে রঞ্জিত হয়েই জন্মগ্রহণ করেছেন। কাজেই তিনি উক্ত বক্তব্যের ভাব কিভাবে ব্যক্ত করেছেন, কুরআন ছিলে তাঁর চরিত্র। হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর প্রতি লজ্জাশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে এবং প্রকৃত অবস্থা সূক্ষ্ম রূপকথার মাধ্যমে গােপন রেখে এভাবে বলেছেন। এটা তার আকলের পূর্ণাঙ্গতা ও আদবের পরিপূর্ণতার পরিচায়ক। অপরপক্ষে, উক্ত বর্ণনাখানি হুজুর আকরম (ﷺ) যে সুমহান ও সীমাহীন সুন্দর আখলাকের অধিকারী ছিলেন সেদিকেও ইঙ্গিত করছে।
কোনাে কোনাে উলামা এরূপ বলেন, কুরআন পাকের অর্থ ও তাৎপর্য যেন সীমাহীন, হুজুর আনওয়ার (ﷺ) এর নূর, কীর্তি, আখলাকে হাসানা ও আমাকে জামিলা এসব ঠিক দ্রুত সীমাহীন। তার মহৎ আখলাক ও তার সৌন্দর্যাবলী প্রতিনিয়ত প্রতিটি হালেই সজীবতা ও নবতর ভঙ্গিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। আল্লাহতায়ালা যে এলেম ও মারেফত তাঁকে প্রদান করেছেন, তার প্রকৃত পরিচয় আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সুতরাং তার কোন আংশিক গুণাবলীকে জ্ঞানের আওতায় বেষ্টন করা মানে অগ্রসর হওয়া কোন দুর্লভ বস্তু অর্জন করার ব্যর্থ প্রয়াস তুল্য। ওয়াল্লাহু আ'লামু।
হুজুর পাক (ﷺ) এর এরশাদ (আমার কলব কখনও কখনও তমসাচ্ছন্ন হয়) এর তাৎপর্য সম্পর্কে জনৈক আরেফকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, হুজুর আকরম (ﷺ) এর এ অবস্থাটির হাকীকত কি? তিনি এর জবাবে বলেছেন, হুজুর আকরাম (ﷺ) এর কলব আতহার এবং তার তমসা সম্পর্কে প্রশ্ন না করে যদি অন্য কারও সম্পর্কে প্রশ্ন করা হতাে, তাহলে আমি এর যথাযথ উত্তর প্রদানে সচেষ্ট হতাম। কিন্তু এখানে যে তোমার কথা বলা হয়েছে, তার হাকীকত উদঘাটনে আমি অক্ষম। এ হাদীছ খানার ব্যাখ্যা 'মারাজাল বাহরাইন' নামক পুস্তিকা বিস্তারিতভাবে করা হয়েছে। তবে হ্যা, কুদরতের সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ নবী করীম (ﷺ) এর মধ্যে আন্দোলন ও তাজাল্লির সৃষ্টি করতে। আন্দোলন ও তাজাল্লী তাকে এক হাত থেকে অন্য হাতে নিয়ে যেতে। শরীয়তের বিধানের মধ্যে নাসেখ ও মানসুখ হওয়া তার একটি শাখা স্বরূপ। হুজুর আকরাম (ﷺ) সব সময় সব অবস্থায়ই উন্নতি ও পূর্ণতার মধ্যে থাকেন। কোনো সুমহান হাল থেকে কখনো অবনতি ও নিম্ন গতি কখনও তার সত্তায় স্থান পেতে না। তবে হাঁ, অই সমস্ত উন্নত হাল গুলোর মধ্যে কোন কোন হাল অধিকতর উন্নত ও পরিপূর্ণ হয়ে থাকতাে। যেমন, উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সমস্ত নবীগণই কামেল ও মাসুম। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের কাউকে কাউকে অপরের তুলনায় অধিকতর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। হুজুর আকরম (ﷺ) এর আমল, আনুগত্য ও ইবাদত —এসব শুধুই যে তাকে তালীম দেয়ার উদ্দেশ্যে এবং শরীয়তের অনুকুলে তাকে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তার উপর আরোপিত হয়েছে, এমনটি নয়। (বরং এগুলি আরােপিত হয়েছিলাে তাঁর উম্মতকে তালীম দেয়ার উদ্দেশ্যে)। আমল, আনুগত্য ও ইবাদতের মাধ্যমে যে নূর ও নমুনা উদ্ভাসিত হয়ে থাকে তা যে হুজুর পাক (ﷺ) এর মধ্যে বিদ্যমান ছিলাে না এমনটি নয়। বরং সেগুলি পূর্ব থেকেই তার মধ্যে বিরাজ করছিলাে। নবুওয়াত ও তার মাকামসমূহ প্রভুর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত দান বৈ-তাে নয়। এটা এস্তফা (মনোনয়ন) ও এহতেবা (নির্বাচনের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এতে কোনো রূপ অর্জন ও রিয়াজের (সাধনার) দখল নেই। এটা নিরন্তর আসরার (ভেদ সমূহ) ও আনোয়ার (নুর সমূহ) এর বহিঃপ্রকাশ। অনবরত ও ধারাবাহিক ওরুদ (ঐশীবাণী অবতরণ) ও জিকির এর উপর নির্ভরশীল। কুরআন অবতরণ, রব্বানী তালীম, রহমানী আদব ও প্রভুপ্রদত্ত আদেশ নিষেধ এসব হচ্ছে সমস্ত কামালাত অর্জনের কফীল বা জিম্মাদার, সমগ্র নূরের বহিঃপ্রকাশের জামিন। ব্যক্তিসত্তার বৈশিষ্ট্য ও মানবীয় স্বভাবকে (নবীকরীম (ﷺ) এর শানে) প্রমাণ করা ঠিক নয়। কারণ এটা মানুষের দৃষ্টিশক্তির যোগ্যতার সাথে সম্পৃক্ত।
কানা খুলুকুহুল কুরআন হাদিসের ব্যাখ্যায় যদি বলা হয় আল্লাহ তায়ালা তাকে কুরআনের মাধ্যমে তাহযীব প্রদান করেছেন।مهزب'মুহাযযাব' (মার্জিত) বানিয়েছেন। তখন উক্ত তাহযীব এর অর্থ হবে কোন উচ্চ মকামে নিমজ্জিত হতে যাওয়ার কারণে নিম্ন মকামের কাজে মন্থরতা দেখা দিলে কিঞ্চিৎ সজাগ করে দেয়া,অবহিত করে দেয়া। যেমন হুজুরে পাক (ﷺ) কখনও কোনাে কাজের জন্য আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বা কোনােকিছু তার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে, আল্লাহপাক তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এগুলি সেই উচ্চ মাকামে নিমজ্জিত হওয়ার ফলেই হয়েছিলাে। উলামায়ে কেরাম বললেন, তাহযীব এর ব্যাখ্যা যদি এরূপ করা হয়, তবে নবী পাক (ﷺ)এর শানে এটা জায়েয রূপে দাঁড় করানোর অবশ্য একটা রাস্তা পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া অন্য কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে এর ব্যাখ্যা করলে হুজুর পাক (ﷺ) এর উচু মর্যাদাকে খব করা হবে।
এটা নিঃসন্দেহে বিপত্তির কারণ হবে, যা কিছুতেই সমীচীন নয়। অভিধান গ্রন্থে তাহযীব শব্দের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। 'তাহযীব হাযবা' শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ তা, পরিচ্ছন্নতা, সঠিকতা ও শুদ্ধি। ‘সাররাহ' গ্রন্থে তাহযীবের অর্থ ধরা হয়েছে মানুষকে পবিত্র করা, যেমন বলা হয়ে থাকে 'পবিত্র মানুষ। আলােচনাসমূহের সারকথা এই যে, হুজুর আকরম (ﷺ) কে সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক পূর্ণতার মাকামে সমাসীন জানতে হবে। তার হাকীকতে হালের রহস্য উদঘাটন করতে অক্ষমতা স্বীকার করা, তাঁর প্রতি আদব সম্মান প্রদর্শন করা তাঁর জালালত ও শানের অধিক নিকটবর্তী বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তায়ালা তৌফিক দানকারী।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী]
© | সেনানী এপ্স |