ইবাদতের ক্ষেত্রে উম্মতে মোহাম্মদীর বৈশিষ্ট্য


অতীতের আসমানী কিতাবসমূহে যে সকল ফযীলত ও মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব এই উম্মতে মরহুমার জন্য নির্ধারিত। কাজেই উক্ত গুণাবলী অর্জনের জন্য সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। কেনোনা উত্তম ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণ তো এটাই। আর এতে কোনই সন্দেহ নেই যে, এই উম্মতের প্রথম সারির লোক অর্থাৎ সাহাবা কেরাম ও তাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ উক্ত গুণাবলীর চরম শিখরে ছিলেন। 


উম্মতে মোহাম্মদীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আল্লাহ্তায়ালা তাদের জন্য গনিমতের মাল হালাল করে দিয়েছেন। পূর্ববর্তী কোনো উম্মতের বেলায় তা হালাল ছিলো না। পৃথিবীর সমগ্র ভূখ-কে তাদের জন্য মসজিদ বা নামাজের উপযোগী বনিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা যেখানে ইচ্ছে সেখানেই নামাজ আদায় করতে পারবে। মৃত্তিকাকে পবিত্র বানিয়ে দেয়া হয়েছে। পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম বানিয়ে দেয়া হয়েছে। পানি না পাওয়া বা পানি ব্যবহার করতে অক্ষম হওয়া অবস্থায় মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে দেহ পবিত্র করতে পারবে। রসুলেপাক (ﷺ) এর বৈশিষ্ট্যের আলোচনাতেও এরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। কাজেই উম্মতও তাঁর সঙ্গে ওই সমস্ত গুণাবলী ও বিধানের অংশীদার। কোনো কোনো আলেম অজুকেও এই উম্মতের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পরিগণিত করে থাকেন। তাঁদের দলীল এই হাদীছখানা, অজুর আলামতের দ্বারা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চমকিত থাকবে। এমতাবস্থায় আমার উম্মতকে কিয়ামতের ময়দানে ওঠার জন্য ডাক দেয়া হবে। 


এর হাকীকত এমনও হতে পারে, অজুর পুরস্কার উম্মতে মোহাম্মদীর জন্যই নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। অন্য কেউ তা পাবে না। ফতহুল বারী কিতাবে হজরত সারা (رضي الله عنه) এর ঘটনা বর্ণনান্তে উল্লেখ করা হয়েছে-


অত্যাচারী কাফের বাদশাহ্ নমরুদ যখন বিবি সারাকে বন্দী করতে চাইলো, তখন তিনি অজু করে নামাজে মশগুল হয়েছিলেন। জুরায়হ রাহেব এর কিসসার মধ্যে তাঁর সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে, তখন তিনি অজু করে নামাজ পড়েছিলেন এবং আশপাশের বাচ্চাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলেন। তাহলে দেখা যায়, অজু কেবল এই উম্মতের বৈশিষ্ট্য নয়। অজু পূর্বেও ছিলো। 


এই উম্মতের বিশেষত্ব হচ্ছে, অজুর কারণে অঙ্গের ঔজ্জ্বল্য এবং নূরানিয়াত। মুসলিম শরীফে হজরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, রসুলেপাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন, ললাটের ঔজ্জ্বল্য তোমরা ছাড়া অন্য কেউ পাবে না। উম্মতে মোহাম্মদীর বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। অতীতের উম্মতসমূহের নামাজ ছিলো চার ওয়াক্ত। এশার নামাজ কোনো উম্মতেরই ছিলো না। সর্বপ্রথম আমাদের নবী (ﷺ) এশার নামাজ আদায় করেছিলেন। হাদীছ শরীফে এসেছে, রসুলেপাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন, এশার নামাজ রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বিলম্ব করে আদায় করো। কেনোনা অতীতের উম্মতগণের নামাজসমূহের উপর তোমাদেরকে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। তাছাড়া আযান, একামত এবং বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম বলা - এগুলোও উম্মতে মোহাম্মদীর বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো উম্মতের উপর এসবের হুকুম অবতীর্ণ হয়নি। 


হজরত সুলায়মান (عليه السلام) অবশ্য স্বতন্ত্র। কেনোনা তিনি সাবা সম্প্রদায়ের রাণী বিলকিসের নিকট লিখিত পত্র বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম দ্বারা আরম্ভ করেছিলেন। আমীন বলাও উম্মতে মোহাম্মদীর একটি বৈশিষ্ট্য। 


হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর বর্ণনায় আছে, রসুলেপাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন, ইহুদীরা আমাদের প্রতি অন্য কোনোকিছুর কারণে এত বেশী হিংসা করে না, যত বেশী হিংসা করে জুমার নামাজের জন্য। আল্লাহ্তায়ালা আমাদেরকে হেদায়েত দান করেছেন। তদ্রুপ ইমামের পিছনে আমীন বলাকেও তারা হিংসা 

করে।


এই উম্মতের বৈশিষ্ট্যের আরেকটি দিক হচ্ছে, নামাজের মধ্যে রুকু করা। হজরত আলী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, সর্বপ্রথম আমরা রুকু করেছি আসরের নামাজে। আমরা তখন রসুল করীম (ﷺ) এর কাছে নিবেদন করেছিলাম, এ রুকুটি কী- এরকম তো আপনি আগে করেননি। তিনি (ﷺ) বললেন, এটা করার জন্য আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে। এই হাদীছ থেকে বুঝা যায়, আমাদের ধর্মেও প্রাথমিক অবস্থায় রুকুর প্রচলন ছিলো না। পরবর্তীতে এর হুকুম হয়েছে। অবশ্য কোরআন মজীদে এক জায়গায় আছে ‘হে মরিয়ম! আপন প্রভুর আনুগত্য করো, আর রুকু ও সেজদা করো। এই আয়াতে বুঝা যায়, পূর্ববর্তী উম্মতের উপরও রুকুর বিধান ছিলো। উত্তর এই যে, এখানে কুনুত, রুকু ও সেজদা এসব কিছুকে দায়েমী কুনুত বা নিরবচ্ছিন্ন আনুগত্য বুঝতে হবে। আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তি, যে অহর্নিশি সেজদারত ও দ-ায়মান অবস্থায় আল্লাহ্তায়ালার আনুগত্য করে।’ এখানে কুনুত অর্থ আনুগত্য, কিয়াম এবং খুশু বা একাগ্রতা। সেজদার অর্থ নামাজ। যেমন আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘সেজদার পরে’ অর্থাৎ নামাজের পরে। রুকুর অর্থ একাগ্রতা ও বিনয়। আয়াতের মধ্যে রুকুর পূর্বে সেজদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এদ্বারাও বুঝা যায় এই রুকুর অর্থ নামাজের রুকু নয়, বরং একাগ্রতা ও বিনয় প্রকাশ্য অর্থে রুকু নয়। কেনোনা নামাজের মধ্যে রুকুর পূর্বে সেজদা দেয়ার বিধান নেই। উল্লিখিত তাওজীহ ও হজরত আলী (رضي الله عنه) এর বর্ণনার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপর রুকু করার বিধান ছিলো না। নামাজে ও যুদ্ধক্ষেত্রে এই উম্মত সারিবদ্ধ হলে ঐরূপ মর্যাদা ও নৈকট্য লাভ করে, যেরূপ ফেরেশতাবৃন্দ সারিবদ্ধভাবে আল্লাহ্তায়ালার হুকুম তামীল করে নৈকট্য লাভ করেন। এটাও এই উম্মতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অধিকন্তু যদি এরূপ বলা হয়, নামাজের জামাতও এই উম্মতের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, তবে আল্লাহ্তায়ালা এ ব্যাপারে সর্বাধিক পরিজ্ঞাত। 


এই উম্মতের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাহিয়া বা সালাম। হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর বর্ণিত হাদীছের শেষাংশে সালামের কথা রয়েছে। অবশ্য হাদীছে উল্লিখিত শব্দের জাহেরী অর্থ নামাজান্তে সালাম ফিরানো। তবে তাহিয়া ও সালাম শব্দের বাহ্যিক অর্থ, সাক্ষাতের সময় পরস্পরে সালাম বিনিময় করা। 


এই উম্মতের বৈশিষ্ট্যের আরেকটি দিক হচ্ছে জুমার নামাজ। জুমার নামাজ অন্য কোনো উম্মতের উপর আরোপিত ছিলো না। যেমন, হাদীছ শরীফে এসেছে, জুমার দিন, উম্মতে মোহাম্মদীর ওই দিন, যেই দিনটি আল্লাহ্তায়ালা তাদেরকে অনুগ্রহ করে দিয়েছেন। সুতরাং এ দিনে আমি আল্লাহ্ তাদের জন্য, আর অনুগৃহীত মানুষেরাও আমার জন্য। ইহুদীরা এই দিন উদযাপন করে শনিবারে। আর নামাজ উদযাপন করে রবিবারে।


উম্মতে মোহাম্মদীর আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, জুমার দিন তাদের জন্য আল্লাহ্তায়ালার দেয়া একটি বিশেষ মুহূর্ত থাকে, যে মুহূর্তে আল্লাহ্তায়ালার কাছে বান্দা প্রার্থনা করলে, তিনি কবুল করেন। বর্ণনাটি সম্পর্কে প্রায় চল্লিশটির মতো মতামত রয়েছে, যেগুলোকে আমি পারস্পরিক সামঞ্জস্যবিধান সাপেক্ষে ‘সুফরাতুস সাআদাহ’ নামক কিতাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তন্মধ্যে বিশুদ্ধতর দুটি মত এই যে (১) সেই মুহূর্তটি হচ্ছে ইমাম খোতবা প্রদানের উদ্দেশ্যে বের হওয়া থেকে নিয়ে জুমার নামাজ সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত। (২) মুহূর্তটি হচ্ছে জুমার দিনের শেষ মুহূর্ত। সাইয়্যেদাতুন্নিসা হজরত ফাতেমা যাহরা (رضي الله عنه) এর মত এটাই। উলামা কেরাম বলেন, হজরত ফাতেমা (رضي الله عنه) জুমা দিবসের শেষ লগ্ন নির্ধারণ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে একজন খাদেম নিয়োজিত করেছিলেন। ওয়াল্লাহু আ’লাম। 


উম্মতে মোহাম্মদীর আরেকটি বিশেষত্ব এই যে, রমজানুল মোবারকের প্রথম রাতে আল্লাহ্তায়ালা তাদের প্রতি বিশেষ রহমতের নযরে তাকান। আর আল্লাহ্তায়ালা যাদের প্রতি রহমতের নযরে একবার তাকান, তাকে আর কখনও আযাব প্রদান করেন না। ওই সময় তাদের জন্য জান্নাতকে সুসজ্জিত করেন। রোজাদারদের মুখের গন্ধকে আল্লাহ্তায়ালা মেশক আম্বরের চেয়ে অধিক ভালোবাসেন। রমজানের প্রতিরাত্রে এ উম্মতের জন্য আল্লাহ্তায়ালার নিকট ফেরেশতারা এসতেগফার করতে থাকে। আর এই এসতেগফার রোজাদারের ইফতার গ্রহণ পর্যন্ত চলতে থাকে।

 

এভাবে শেষরাতে আল্লাহ্তায়ালা সকলকেই ক্ষমা করে দেন। এই রমজান মাসে আল্লাহ্তায়ালা উম্মতকে পাঁচটি বিশেষ অনুগ্রহ করে থাকেন যা পূর্ববর্তী কোনো উম্মতের ভাগ্যে জোটেনি। হাদীছ শরীফে এসেছে, রোজাদার যখন ইফতার করে, তখন ফেরেশতাগণ তাদের জন্য এসতেগফার করে। দুষ্ট জ্বীনকে এ মাসে শিকলাবদ্ধ করা হয়। এই উম্মতের বিশেষত্বের আরও দিক আছে। যেমন, বিলম্বে সেহরী খাওয়া এবং তাড়াতাড়ি ইফতার করা এগুলোকে মোস্তাহাব বানানো হয়েছে। রাতের বেলায় সুবেহ সাদেক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পানাহার করা এবং স্ত্রী সহবাস করাকে মোবাহ করে দেয়া হয়েছে। ইতোপূর্বের উম্মতের বেলায় এসব ছিলো হারাম। ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায়ও এরকম হারাম ছিলো। পরে এ বিধান রহিত হয়েছে। 


এ উম্মতের বিশেষত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে শবে কদর। ইমাম নববী (رحمة الله) ‘শরহে মুহাযযাব’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন, বনী ইসরাইল সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি হাজার মাস পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করেছেন। মুহূর্তের জন্যও তিনি তাঁর তরবারী কোষাবদ্ধ করেননি। একথা শুনে সাহাবা কেরাম আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমরা কি কেউ ওরকম শক্তির অধিকারী হতে পারবো? তখন আল্লাহ্তায়ালা সুরা কদর নাযিল করে শবে কদরকে এই উম্মতের জন্য হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বানিয়ে দিলেন। শবে কদর সম্পর্কে আরও অধিক আলোচনা যথাস্থানে করা হবে ইনশাআল্লাহ্। 


রমজান মাসের রোজা পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও ফরজ ছিলো কিনা সে সম্পর্কে উলামা কেরামের মতভেদ রয়েছে। 


আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতিও ফরজ করা হয়েছিলো’ এ থেকে এ কথাই স্পষ্ট হয় যে, পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও রমজানের রোজা ফরজ ছিলো। ইবনে আবী হাতেম হজরত ইবনে ওমর (رضي الله عنه) থেকে মরফু সনদের ভিত্তিতে বর্ণনা করেন, রমজানের রোজা পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও ফরজ ছিলো। এই হাদীছের সনদের মধ্যে একজন রাবী মজহুল রয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমরা বলি, উক্ত রোজা ছিলো সাধারণ রোজা। সংখ্যা ও সময়ের সাথে সম্পৃক্ত রমজানের যে রোজা, তা নয়। তাহলে কামা দ্বারা যে তশবীহ দেয়া হয়েছে তাও মতলক বা সাধারণ হিসেবেই ধর্তব্য হবে। জমহুরের মতও এরমই। 


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)] 




© | সেনানী এপ্স |

Top