নূর ও অনির্বাণ প্রদীপ
আল্লাহ রব্বল আলামীন তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) কে সীমাহীন উজ্জ্বল মুনাওয়ার হওয়ার কারণে নাম দিয়েছেন নূর ও সীরাজুমুনীর। তার এই নামকরণের যৌক্তিকতা এ সার্থকতা অবশ্যই আছে। যেহেতু জগৎবাসী তার মাধ্যমে আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও মিলনের পথ পেয়েছে। তার জামাল ও কামালের মাধ্যমেই জগৎবাসী দৃষ্টিশক্তি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই তােমাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে নূর ও নিশ্চিত কিতাব এসেছে। আল্লাহতায়ালা আরও এরশাদ করেন, “হে নবী! নিশ্চয়ই আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী হিসেবে, সুসংবাদ প্রদানকারী ও ভীতি প্রদর্শনকারী রূপে, আল্লাহ তায়ালার হুকুমে তার দিকে আহ্বানকারী এবং আলোকে প্রদানকারী প্রদীপ করে।'
উলামায়ে কেরাম বলেন, হক তায়ালা তার হাবীব (ﷺ) কে প্রদীপের সাথে উপমা দিয়েছেন। উপমা গত ভাবে প্রদীপের চেয়ে সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যে উজ্জ্বলতা বেশি। অথচ আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রদীপের সাথে উপমা দিয়েছেন। এর হেকমত এই যে, হুজুরপাক (ﷺ) এর মৌলিক সত্তা পৃথিবীপৃষ্ট। তাই পৃথিবীর বস্তুর সাথে উপমা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় হেকমত এই যে, প্রদীপ তার প্রতিনিধি রাখতে পারে। এক প্রদীপ থেকে লক্ষ প্রদীপ জ্বালানো যেতে পারে। এর বিপরীতে চন্দ্র বা সূর্য ব্যাপার চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, তারা যত বড় গুণের অধিকারী হোক না কেননা, প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে অক্ষম।
অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে এরূপও বলা যায়, আল্লাহ তায়ালা যে প্রদীপের সঙ্গে তার উপমা দিয়েছেন, সে প্রদীপ মানে সূর্য–এরূপ বলা হলেও অত্যুক্তি হবে না। কেননা, আল্লাহ তায়ালা কোন কোন ক্ষেত্রে সূর্যকে প্রদীপও বলেছেন। যেমন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা আকাশে উজ্জ্বলকারী প্রদীপ (সূর্য) ও চন্দ্র সৃজন করেছেন। আরও বলেছেন, আমি চমকিত প্রদীপ অর্থাৎ সূর্য সৃষ্টি করেছি। সুতরাং সূর্য যেমন তার নূর বিচ্ছুরিত করে জড় জগতের উপকার করে অথচ নিজে কোন কিছু থেকে উপকার গ্রহণ করছে না, তেমনি হুজুর আকরম (ﷺ) এর পূত পবিত্র সত্তা সমগ্র মানব কুলের জন্য স্বীয় আলী নূর সমূহের মাধ্যমে ফায়দা প্রদান করেছেন। কিন্তু তিনি আল্লাহতায়ালার যাতে পাক ব্যতীত অন্য কিছু থেকে কখনো ফায়দা গ্রহণ করেননি। হুজুর আকরাম (ﷺ) কে যদি চন্দ্রের সাথে উপমা দেয়া হয়, তাহলে তা যথাযথ উপমা হবো সন্দেহ নেই। কেননা, চন্দ্র যেমন সূর্যের কাছ থেকে আলা সংগ্রহ করে থাকে, তেমনি হুজুর পাক (ﷺ) আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে নূর লাভ করেছেন। যেমন কুরআনে করীমে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা আসমান ও যমীনের নূর। এই আয়াতে কারিমা থেকে ধারণা পরিষ্কার হওয়া উচিত যে, আল্লাহ তায়ালা আসমান ও যমীনের মধ্যে নূর-এমনটি নয়। অর্থাৎ সে নূর আসমান ও যমীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এ নূর আসমান ও যমীন সহ সমস্ত অস্তিত্বে ব্যাপৃত। আর সে নূর হচ্ছে সমগ্র বস্তুর অস্তিত্বের উৎস ও সবকিছুর হায়াতের মালিক। হুজুর পাক (ﷺ) এর জামাল ও কামাল উপরােক্ত নূরে এলাহীর পরিপূর্ণ প্রকাশস্থল এবং সে নূরের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম। সুতরাং مثل نوره 'মাছালুনূরিহী ’ আয়াতের তফসীর প্রসঙ্গে মুফাসসেরীনে কেরাম বলেন, মুহাম্মাদ (ﷺ) এর কলব স্থিত ঈমানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ দীপাধার যার উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে অনির্বাণ দীপশিখা। অর্থাৎ পবিত্র হৃদয় হচ্ছে দীপাধার আর ইমান হচ্ছে দীপশিখা। মেশকাত বা দীপাধার বলতে বুঝানাে হয়েছে হুজুর আকরম (ﷺ) এর পবিত্র বক্ষ। আর যুজাজা দ্বারা বুঝানো হয়েছে পূতপবিত্র কলব। আয়াতের মিসবাহ শব্দের অর্থ হুজুর আকরাম (ﷺ) এর পবিত্র কলবে অবস্থিত ইমান ও মারেফতের নূর। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা আরও এরশাদ ফরমান, 'আমি কি আপনার পবিত্র বাক্যকে সম্প্রসারিত করছি?' সোনা সম্প্রসারিত করার মধ্যে যে মহান নেয়ামত রয়েছে তা প্রকাশ করণার্থে আল্লাহ পাক প্রশ্নের আকারে তার হাবীব (ﷺ) এর কাছে কথাটি বলেছেন। এই শরহে সদর' এর অর্থ হচ্ছে হুজুর আকরাম (ﷺ) এর সিনা মুবারক কে প্রসারিত করে দেয়া। তার বক্ষ সম্প্রসারণ' হাসিল হয়েছে হক তায়ালার কাছে কৃত যাবতীয় মুনাজাত ও মাখলুকাতকে দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমে। মারেফতের নূর ও এলেম, তওহীদের এলেম, বিস্ময়কর ও সূক্ষ্ম মারেফত লাভের মাধ্যমে তার বক্ষ সম্প্রসারিত হয়েছে। তাছাড়া মূর্খতা, ঘৃণিত কাজের সংকীর্ণতা ও সত্য বিমুখতার প্রতিকূল তিনি যে ধৈর্য ধারণ করেছেন তার মাধ্যমে তার বক্ষ সম্প্রসারিত হয়েছে। গায়রুল্লাহ থেকে সম্পর্ক ছেদের দ্বারাও শরহে সদর হাসিল হয়েছে। কখনো কখনো ওহী নাযিলের স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যমে তা অর্জিত হয়েছে। দ্বীনের প্রচার ও রেসালতের কঠিন ভার বহন করার যে কষ্ট তিনি বরদাশত করেছেন এবং এক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা তাকে যে শক্তি সামর্থ যুগিয়েছেন—এ সমূহের মাধ্যমে হুজুর আকরাম (ﷺ) এর সিনা সম্প্রসারিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, 'আমি আপনার উপর থেকে ঐ বোঝাকে সরিয়ে দিয়েছি যা আপনার মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিচ্ছিলাম।' শরহে সদর বা বক্ষ সম্প্রসারণের সবচেয়ে বড় কারণ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে বুকের মধ্যে নূর প্রতিষ্ঠিত হওয়া যার কারণে বান্দার অন্তর্লোক আলােকিত হয়ে যায়। তাই বলা হয়েছে, নূর যখন কলবে প্রবেশ করে তখন তা সম্প্রসারিত হয়। প্রশস্ত হয়। আর সেই নূরের প্রতিক্রিয়া এই যে, এই নূর অন্তরকে মন্দ স্বভাব থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র করে দেয়। নূরের প্রভাবে হৃদয়ে যে গুণাবলীর আবির্ভাব হয় তার পরিপূর্ণ, সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম টাই ছিলে দৃষ্টির গৌরব মোহাম্মদ মোস্তফা (ﷺ) এর অধিকারে। তাছাড়া তার অনুসরণকারীগণ ও তার পূর্ণ আনুগত্য ও মহব্বতের পরিমাণ অনুসারে নূর বা গুণাবলীর অংশ পেয়ে থাকেন। এ নূরের প্রসঙ্গটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে মফরসল সাআদাত' নামক কিতাব ও কতিপয় ফার্সী পুস্তিকায়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ ফরমান, আমি আপনার নাম ও আপনার আলোচনাকে সুউচ্চ করে দিয়েছি। তা পৃথিবীতে করেছি নবুয়ত দান করে আর আখেরাতে করেছি শাফায়াতের ক্ষমতা দিয়ে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাবীব (ﷺ) এর পবিত্র নামখানা তার স্বীয় বুজুর্গ নামের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। ইসলামের কালেমা, আযান, নামাজ ও সমস্ত খুতবা সমূহে। এমন কোনো খােত্ব দানকারী নেই, এমন কোন তাশাহুদ পাঠকারী নেই এবং এমন কোনো নামাজ আদায়কারী নেই যে আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর সঙ্গে আশহাদু আন্না মােহাম্মদুর রসূলুল্লাহ পাঠ করেনা।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে —রাসূল (ﷺ) বলেছেন, একদা হযরত জিবরাইল (আ) এসে আরয করলেন, আল্লাহ তায়ালাকে জিজ্ঞেস করেছেন, কোন জিনিসের সাথে আপনার নাম কি বুলন্দ করা হয়েছে? আমি বললাম, এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালাই সর্বাধিক অবহিত। তখন আল্লাহতায়ালা বললেন, اذا ذكرت ذكرت معى 'ইয়া যুকিরতা যুকির মায়ী' অর্থাৎ আপনার নাম আমার নামের সঙ্গে উচ্চারিত হবে। তার ঈমান ও নির্ভরশীল করেছে আমার নামের সঙ্গে আপনার নাম উচ্চারণের বিধান দিয়ে। অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলা ব্যতীত ইমান শুদ্ধ হবেনা। শুধু তাই নয়, আপনার জিকিরকে আমার জিকির এবং আপনার আনুগত্যকে আমার আনুগত্য নির্ধারণ করেছি। সুতরাং কেউ যদি আপনার জিকির করে তবে সে আমারই জিকির করবে। কেউ যদি আপনার আনুগত্য করে, তবে আমার আনুগত্য করবে। যে রাসূলের আনুগত্য করলে সেরে আল্লাহ তায়ালারই আনুগত্য করলো।' (আল কুরআন)। বান্দার জন্য আপনার এত্তেবা আমার মহব্বত প্রাপ্তির পূর্বশর্ত করে দিয়েছি। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তায়ালা তার রাসূল (ﷺ) কে বলতে বলেন—তোমরা আমার অনুগত হও, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে মহব্বত করবেন।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]
© | সেনানী এপ্স |