দানশীলতা


'জুদ' ও সাখা' শব্দদ্বয়ের আভিধানিক অর্থ একই। কামুস অর্থাৎ অভিধান গ্রন্থে দেখানাে হয়েছে জুদ মানে সাখা আর সাখা মানেই জুদ। সাররাহ নামক গ্রন্থে এর অর্থ করা হয়েছে বীরত্ব। এ সম্পর্কে সংকলিত আছে যে, سخاوت 'সাখাওয়াত' এক স্বভাবগত গুণের নাম। যার বিপরীত শব্দটি হচ্ছে شح 'শুহ' অর্থাৎ বখিলী। এ বখিলী মানুষের সত্তাগত ও সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য। তাই سخي ‘সখী' শব্দের প্রয়োগ আল্লাহতায়ালার ক্ষেত্রে বৈধ নয়। কেননা, তথায় তবিয়ত ও নফস বলতে কিছু নেই। জুদ এর বিপরীত শব্দ হচ্ছে بخل 'বুখল' বা বখিলী। এটি একটি অর্জনযোগ্য বৈশিষ্ট্য। কাজে প্রত্যেক সখী জাওয়াদ কিন্তু প্রত্যেক জাওয়াদ সখী নয়। আর জাওয়াদ এর হাকীকত এই যে, কোনাে গরয এবং বিনিময় তলব করা ছাড়া দান করা। তাই জাওয়াদ সিফতটি আল্লাহ তায়ালার একটি সিফত। কেননা, আল্লাহতায়ালা কোনো গরয ও বিনিময় ছাড়াই সমস্ত যাহেরী ও বাতেনী নেয়ামতসমূহ, অনুভব ও জ্ঞানগত যাবতীয় পূর্ণতা মাখলুকাত কে দান করেছেন। আল্লাহ তায়ালার পর আজওয়াদুল আজওয়াদীন বা দানশীলগণের সেরা দানশীল হলেন তাঁর প্রিয় হাবিবের জনাব মোহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মুজতবা (ﷺ)। তার পর দানশীল হলেন উম্মতের মধ্যে উলামায়ে কেরাম, যারা এলমে দ্বীন বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করে থাকে। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা সর্বাধিক দানশীল তারপর বনী আদমের মধ্যে আমি সর্বাধিক দানশীল। অতঃপর আমার পর যারা ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেবেন এবং তার প্রসারের কাজে নিয়োজিত থাকবে।


কাযী আয়ায মালেকী (رحمة الله) জুদ এবং সাখাওয়াত এর সঙ্গে অতিরিক্ত আরও দু'টি গুণকে মিলিত করেছেন। 

সে দু'টি গুণ হচ্ছে كرم 'করম' (মহানুভবতা) ও سماحت ‘সামাহাত' (ক্ষমাশীলতা)। তিনি বলেন, এই সব শব্দগুলির অর্থ প্রায় কাছাকাছি। তবে ওলামায়ে কেরাম এই শব্দ সমূহের অর্থের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। তাদের মতে এমন বস্তু যা মর্যাদাশালী ও মূল্যবান তা যদি মনের খুশিতে খরচ করা হয়, তাহলে তা হবে মহানুভবতা। তাকে আবার حريت ‘হুররিয়াত' ও বলা হয়। যার অর্থ স্বাধীনতা। এ শব্দটি نزالت 'নাযালাত’ এর বিপরীত। 'সাররাহ' নামক গ্রন্থে نزالت 'নাযালাত' এর অর্থ করা হয়েছে, নীচতা, মন্দ স্বভাব! نزل -نزيل ‘নাযাল’ ও নাযীল উহা থেকেই নির্গত।

 অভিধান গ্রন্থে তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এরকম -


النزل والنزيل الخسيس من الناس الملحتقر

احواله في جميع أحواله


অর্থাৎ নাযাল ও নাযীল ঐ ব্যক্তিকে বলা হয় যে নীচ প্রকৃতির এবং তার যাবতীয় স্বভাব আচরণে নিকৃষ্টতা এবং মন্দ ভাব রয়েছে। 'সামাহাত' শব্দের ব্যাখ্যায় এরকম বলা হয়েছে যে, সামাহাত' এমন একটি গুণ যে, কোন ব্যক্তি কোন বস্তু নিজে অধিক উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও মনের খুশিতে অন্যকে দান করে দেয়। এর বিপরীত শব্দ হচ্ছে ‘শাকাস' যার অর্থ কঠিন স্বভাব। যেমন বলা হয় 'রাজুলুন رجل شكاس শাকসুন' (কঠিন স্বভাবের লোক), قوم 'কওমুন শাকসুন' (অমুক কওম কঠিন স্বভাবের)। شكاوة 'সাখাওয়াত' এর অর্থ হচ্ছে সহজভাবে কোনােকিছু খরচ করা এবং যা ভালাে নয় তা হাসিল করা থেকে বেঁচে থাকা। আর ‘জুদ' এর অর্থও তাই। এর বিপরীত শব্দ হচ্ছে تقتير  'তাকতীর' যার অর্থ খরচ করার ক্ষেত্রে কৃপণতা করা। সারাহ গ্রন্থে তাকবীর এর অর্থ করা হয়েছে পরিবার পরিজনের বেলায় খরচ করাতে কৃপণতা করা।


কাযী আয়ায (رحمة الله) বলেন, রাসূল পাক (ﷺ) এর যাবতীয় গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মানুষের যতটুকু অবগতি, সে সমস্ত গুণাবলীতে তাঁর সমকক্ষ হবে এমন কেউ নেই।


সাইয়্যিদুনা হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে, হুজুর আকরম (ﷺ) সর্বাধিক সুন্দর, সবচেয়ে বড় বাহাদুর এবং সর্বাধিক দানশীল ছিলেন। তার কারণ এই যে, হুজুর আকরম (ﷺ) এর ব্যক্তিসত্তা, সম্মানিত নফস ও তার মেজাজ সর্বাধিক ভারসাম্যপূর্ণ ছিলাে। এ তিনটি গুণে যিনি গুণানবিত হতে পারবেন, তার কার্যাবলী হবে সর্বোচ্চ সুন্দরতম, তার সুরত হবে সবচেয়ে কমনীয় এবং তার চরিত্র হবে সুন্দর। হুজুর আকরম (ﷺ)এর মধ্যে জিসমানী ও রুহানী কামালাত ছিলাে। তার মধ্যে দৈহিক ও চারিত্রিক উভয় প্রকারের সৌন্দর্যের সমন্বয় ঘটেছিল। তাই তিনি সর্বাধিক মহানুভব, সবচেয়ে বেশী প্রশস্তহৃদয় ও দানবীর ছিলেন। কোনাে ব্যক্তি কিছু যাঞ্চা করলে 'না' বলেছেন এরকম ঘটনা হুজুর আকরম (ﷺ) এর জীবনে একটিও নেই। ছহি হাদীস সমূহে এরকমই বর্ণনা এসেছে। তিনি সকল প্রার্থনা কবুল করতেন এবং প্রার্থিত বস্তু দান করতেন। এমর্মে তার প্রশংসায় কবি ফরযদক বলেন, হুজুর আকরম (ﷺ) শাহাদের বাক্য ব্যতীত কখনাে لا 'লা' কথাটি উচ্চারণ করেননি। যদি তাশাহহুদ বা কালেমা শাহাদাত না থাকতাে তাহলে তাঁর 'লা' (না) সমূহ نعم 'নাআম' (হাঁ) এ পরিণত হতাে।


প্রার্থনাকারীকে দেয়ার মতাে হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু না থাকলে তিনি অপেক্ষা করতেন, ভালােকথা বলে মন সন্তুষ্ট করার প্রয়াস পেতেন এবং নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করতেন। কিন্তু প্রকাশ্যে এরকম বলতেননা, তােমাকে কিছু দিতে পারবাে না।


উলামায়ে কেরাম বলেন, হুজুর আকরম (ﷺ) এর  দ্বারা কথা বলাতে দান করা থেকে মানা করে দেয়া নিশ্চিত হয় না। আবার এটাও নিশ্চিত হয় না যে, উরখাহীর ভিত্তিতে তিনি লা বলতেন না। অথচ এক জামাতের কাছে তিনি উযরখাহী পেশ করে লা বলেছেন এরূপ বর্ণনা তাে পাওয়া যায়। ঐ জামাতের লোকেরা হুজুর আকরাম (ﷺ) এর কাছে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সওয়ারী চেয়েছিলাে। তখন তিনি তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আমি তাে এমন কোনো সওয়ারী পাচ্ছিনা যাতে তােমাদেরকে আরােহন করাতে পারি। উলামায়ে কেরাম বলেন, لا اجدما أحملكم عليه   'লা আজিদু মা আহমিলুকুম আলাইহে' এবং لا أحملكم 'লাআহমিলুকুম' (আমি তােমাদেরকে আরােহন করাবাে না) এ দু কথার অনেক পার্থক্য আছে। যদিও হুজুর আকরম (ﷺ) আশআরী সম্প্রদায়ের ব্যাপারে 'লাআহমিলুকুম' বলেছেন। এমনকি তাদের ব্যাপারে কোনাে কোন ক্ষেত্রে তিনি কসম করেও বলেছেন, ওয়াল্লাহ লা আহমিলুলুম (আল্লাহর কসম! আমি তােমাদেরকে আরােহন করবে না।) এরকম স্থানের উক্তি সম্পর্কে সমাধান এরকম হয়তো হুজুর আকরম (ﷺ) এর কাছে তখন কোনাে সওয়ারী ছিলােনা। সওয়ালকারীদের এ সম্পর্কে জানাও ছিলাে। তা সত্ত্বেও তারা হঠকারীতার আশ্রয় নিয়েছিলাে এবং রাসূল আকরম (ﷺ) কে উত্যক্ত করছিলাে। তখন তিনি তাদের এ ধরনের আচরণ এবং লাভকে অবদমনের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের উক্তি করেছেন। এরকম ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাব।


বান্দা মিসকীন অর্থাৎ শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিছে দেহলভী (رحمة الله) বলেন, হুজুর আকরম (ﷺ) এর পবিত্র মুখ থেকে লা শব্দ জারী না হওয়ার দ্বারা তার মধ্যে কোনরূপ কৃপণতা ছিলে না এটা বুঝানো হয়েছে। বরং তার অন্তর ছিলে মহান আর হস্ত মুবারক ছিলে প্রশস্ত। বখিল ও আন্তরিক বলহীন লোকেরা কি রকম করে থাকে, তিনি এরূপ কখনও করতেন না। তার জবান মোবারক থেকে ‘লা নির্গত না হওয়ার বক্তব্যের তাৎপর্য এটাই। হুজুর আকরাম (ﷺ) এর দানশীলতা সম্পর্কে বর্ণনা আছে, কেউ তার কাছে কিছু চাইলে পেয়ে যেতাে। কথাটি দ্বারা তার দানশীলতা প্রমাণিত হয় বটে। তবে একথাটির আরও গভীর তাৎপর্য আছে। তা হচ্ছে এই যে, হুজুর পাক (ﷺ) যাঞ্চাকারীর জন্য যা উপযোগী হতে তিনি তাকে তা দান করতেন। আবার কোন কোন সময় এমনও হতে যে, প্রার্থনাকারী মঙ্গলার্থে কোনাে জিনিস দান করা থেকে বিরতও থাকতেন। যেমন কোনাে মুআমেলা ও হুকুম সংক্রান্ত ব্যাপার হলে দান করা থেকে বিরত থাকতেন। দান করলে যদি মেলার আয়োজনের ক্ষেত্রে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হতে বা তাকে কোনােরূপ সংশােধন করার প্রয়ােজন পড়তাে, আর দান করলে সে সংশােধনের ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টির আশংকা থাকতাে, তা হলে সেক্ষেত্রে দান করা থেকে বিরত থাকেন। আবার দান করার দ্বারা লোভী হয়ে যাবে, চাওয়ার মতাে একটি ঘৃণিত স্বভাবে অভ্যস্ত হয়ে যাবে বলে যদি তিনি আশংকা করে—তবে দান করা থেকে বিরত থাকে। এ সম্পর্কে হযরত হাকীম ইবনে হাযম (رضي الله عنه) এর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তিনি উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদিজাতুল কুবরা (رضي الله عنه) এর ভ্রাতুষ্পুত্র ছিলেন এবং রসূল করীম (ﷺ) এর দরবারে একজন গ্রহণযােগ্য ব্যক্তি ছিলেন। একদা তিনি নবী করীম (ﷺ) এর নিকট কোনাে একটি বস্তু প্রার্থনা করেছিলেন। হুজুর (ﷺ) তাকে সে বস্তু দান করেন নি। বরং তাকে বলেছিলেন, 'আমি অবশ্য ইচ্ছা করলে বস্তুটি তোমাকে দিতে পারি। কিন্তু এ দানের সঙ্গে এক প্রকারের কালিমা এবং ঘৃণা সঙ্গী হয়ে যাবে। তাই তিনি তাকে নসীহত করেছেন, পারতপক্ষে সওয়াল না করাই ভালো। হুজুর আকরাম (ﷺ) এর এরূপ উপদেশ শুনে পরবর্তী জীবনে তিনি এমন হয়েছিলেন যে, হাত থেকে যদি চাবুক পড়ে যেতাে, উঠিয়ে দেয়ার জন্য কাউকে কখনাে বলতেন না।


হযরত আবু যর গিফারী (رضي الله عنه) একদা কোন একটি আমলের খায়েশ করলেন। হুজুর আকরম (ﷺ) এরশাদ করলেন, হে আবু যর। তুমি দুর্বল হও আমলের খাহেশ করাে না। কারও কাছে কোনাে কিছু চেয়ােনা। এমন কি হাতের লাঠিও পড়ে গেলে কারও সাহায্যে উঠানাের চিন্তা করােনা। হজরত আবু যর গিফারী (رضي الله عنه) একজন শ্রেষ্ঠ সাহাবা এবং বড় সাধক ছিলেন। তার মত ছিলাে যে, কোনাে মাল জমা করা ও তা সঞ্চিত করে রাখা হারাম। যাকাত আদায় করলেও।


এক হাদীসে উল্লেখ আছে, হুজুর আকরাম (ﷺ) কোন বস্তু কোনাে একটি সম্প্রদায়কে দেয়ার জন্য দান করলেন। তখন হজরত ওমর ইবন খাত্তাব (رضي الله عنه) কোনাে ব্যক্তিকে কিছু দিতে সুপারিশ করলেন। প্রকৃত অবস্থা ছিলাে এরকম যে, এই ব্যক্তি উক্ত জিনিস পাওয়ার উপযােগী। হজরত ওমর (رضي الله عنه) বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আমার জানা মতে সে মুমিন। - এরকম তিনি তিনবার বললেন। হুজুর পাক (ﷺ) এরশাদ করলেন, এমন অনেক লোক আছে যাদের তাদের সংশোধনের জন্য না দেয়াটাই আমি পছন্দ করি। হুজুর আকরাম (ﷺ) হযরত ওমর (رضي الله عنه) এর মতাে দু বার সে ব্যক্তি সম্পর্কে মুমিন বা মুসলিম শব্দের প্রয়ােগ করলেন। (অর্থাৎ সে মুমিন বা মুসলমান আছে কথা ঠিকই)। তারপরও যখন হজরত ওমর (رضي الله عنه) হুজুর (ﷺ) কে বারবার অনুরোধ করছিলেন, তখন তিনি উপরোক্ত মন্তব্য করলেন। এঘটনাটি থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার আখলাকের সাথে নিজের আখলাকে তৈরী করে নেয়। যেমন আল্লাহ তায়ালা কোন বান্দা যদি মহব্বত করেন তখন তাকে দুনিয়ারী সুখ সামগ্রী থেকে বঞ্চিত করেন। আর যাকে আল্লাহ তায়ালা ভালােবাসেন না, তাকে দুনিয়াতে অঢেল সম্পদ দান করে থাকেন। এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন অবশ্য উদয় হওয়ার অবকাশ রয়েছে। তা হচ্ছে এই যে, এখানে হুজুর (ﷺ) দান করার ব্যাপারে অসম্মতি প্রকাশ করেছেন। তাহলে কি তিনি এখানে না' শব্দ ব্যবহার করেননি? এর উত্তর এই যে, ‘না’ শব্দ ব্যবহার ছাড়াই— উক্ত অসম্মতি প্রকাশ করা সম্ভব। সম্ভবতঃ তিনি ঐ রূপই করে থাকবেন। ওয়াল্লাহু আ'লামু।


মোটকথা এই যে, হুজুর আকরাম (ﷺ) কোন সওয়ালকারী বিমুখ করতেন না। তার কাছে দেয়ার মতাে কিছু না থাকলে বলতেন, আমার নামে কারও কাছ থেকে কর্জ করে নাও। যখন আমার কাছে কিছু এসে যাবে, তখন তা পরিশােধ করে দেবাে। একদিন তার কাছে কোন এক ব্যক্তি কিছু চাইলে হুজুর (ﷺ) বললেন, আমার কাছে তাে তেমন কিছু নেই। তুমি যাও, কারাে কাছ থেকে কর্জ করে নাও। একথা শুনে হজরত ওমর ফারুক (رضي الله عنه) আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনার ক্ষমতার বাইরে যা, সে ব্যাপারে তাে আল্লাহপাক আপনাকে বাধ্য করেননি। কথাটি হুজুর পাক (ﷺ) এর পছন্দ হলাে না। এরপর একজন আনসারী হুজুর পাক (ﷺ) কে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনি যথেষ্ট দান করুন। আরশের অধিপতি যিনি, তাঁর কাছ থেকে কোনো স্বল্পতার আশঙ্কা করবেন না। একথা শুনে হুজুর (ﷺ) মৃদু হাসলেন। চেহারা মুবারকে উৎফুল্লতা প্রতীয়মান হলাে এবং তিনি বললেন, আমাকে এমনই হুকুম করা হয়েছে।


ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেন, একদিন হুজুর পাক (ﷺ) এর কাছে নব্বই হাজার দেরহাম আনা হলাে। তিনি সেগুলি চাটাইয়ের উপর রেখে বন্টন করতে লাগলেন। কোনাে প্রার্থনাকারীকে বঞ্চিত করলেন না। এভাবে সমস্ত দেরহাম দান করে দিলেন।


সহীহ বুখারী শরীফে হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত হয়েছে, একবার হুজুর আকরম (ﷺ) এর কাছে বাহরাইন থেকে কিছু সামগ্রী আনা হলাে। তিনি বললেন, এগুলি মসজিদে ছড়িয়ে দাও। একথা বলে তিনি মসজিদ থেকে বাইরে চলে এলেন এবং তার দিকে দৃষ্টিপাতও করলেন না। যখন পুনরায় মসজিদে এলেন, তখন নামাজ আদায় করলেন। নামাজের পর সামগ্রীগুলাের কাছে গেলেন এবং ঐগুলিকে সকলের মধ্যে বন্টন করতে শুরু করলেন। এমন সময় হজরত আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (رضي الله عنه) এসে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্। আমাকেও এখান থেকে কিছু দান করুন। কেননা আমি আমার নিজের এবং আকীল (رضي الله عنه) এর ফিদইয়া দান করেছি। একথা শুনে হুজুর আকরম (ﷺ) হজরত আব্বাস (رضي الله عنه) এর চাদরকে এমনভাবে ভরে দিলেন যে, তিনি তা উঠিয়ে নিতে অক্ষম হয়েছিলেন। তখন হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (ﷺ)! আপনি কাউকে হুকুম দিন যেনাে এগুলি আমার জন্য বহন করে নিয়ে দেয়। হুজুর আকরম (ﷺ) বললেন, না চাচাজান। এটা হতে পারেনা। আপনি যতােটুকু বহন করতে পারেন, ততােটুকুই গ্রহণ করুন। হুজুর পাক (ﷺ) তাকে এই কথা বলেছিলেন তার লােভপ্রবণতাকে দূর করার জন্য এবং তাকে আদব ও সৌজন্য দেখানোর জন্য। এরপর হজরত আব্বাস (رضي الله عنه) উক্ত মাল ঘাড়ে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। হুজুর পাক (ﷺ) বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর তিনি যখন সেখান থেকে উঠলেন, তখন আর এক দিরহাম অবশিষ্ট ছিলোনা। হযরত ইবনে আবী শায়বা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, উক্ত মালের পরিমাণ ছিল এক লাখ দিরহাম। এ মালগুলি হযরত আলা ইবন হাযরী বাহরাইন থেকে কর আদায় করে হুজুর পাক (ﷺ) এর খেদমতে প্রেরণ করেছিলেন। আর এটা ছিলাে সর্বপ্রথম আদায়কৃত কর যা হুজুর (ﷺ) এর নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল।


হুনায়ন বিজয়ের দিবসে হুজুর পাক (ﷺ) এর দানশীলতার এবং মহানুভবতার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিলাে, তা ছিলাে সীমা, সংখ্যা ও অনুমানের গণ্ডিবহির্ভূত। কেননা, ঐ দিন প্রত্যেক আরবীয় ব্যক্তি শত শত উট ও হাজার হাজার বকরি লাভ করেছিলেন। ঐ দিনের বেশির ভাগ দানই ছিলে মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। যাতে দুর্বল ঈমানের অধিকারী ব্যক্তিরা পার্থিব সাহায্যের প্রভাব ঈমানের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া ঐ শ্রেণীর লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। হুজুর পাক (ﷺ) তাকে প্রথমবার একশত বকরী দান করলেন। এরপর আবার একশত বকরী দান করলেন এবং তৃতীয় বার আরও একশত বকরী দান করলেন। আল্লামা ওয়াকেদী (رحمة الله) এর কিতাবে কিতাবুল মাগাযীতে এরকম বর্ণনা করা হয়েছে যে, ঐ দিন সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া এত উট-বকরী লাভ করেছে যে, তার প্রান্তর ভরপুর হয়ে গিয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে সেই দিন সফওয়ান (رضي الله عنه) বলেছিলেন, “আমি সাক্ষ্য দিয়ে বলছি যে নবী করীম (ﷺ) ব্যতীত আর কোন লোক দানশীলতায় এরকম বীরত্ব প্রদর্শন করতে পারবে না।" হুজুর পাক (ﷺ) দানের মাধ্যমে উক্ত ব্যাধির চিকিৎসা করলেন যার মিশ্রন তার মধ্যে ছিলাে।


আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও তার পুত্র অপরিচ্ছন্ন অন্তরবিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। ঐ দিন আবু সুফিয়ান এসে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ (ﷺ)! আজকে কুরাইশ বংশের মধ্যে আপনার মতে সম্পদশালী আর কেউ নেই। কাজেই এখান থেকে আমাদেরকেও কিছু দান করুন। হুজুর (ﷺ) মৃদু হেসে হযরত বেলাল (رضي الله عنه) কে বললেন, তাকে চল্লিশ আওকিয়া রৌপ্য এবং একশত উট দিয়ে দাও। আবু সুফিয়ান বললেন, আমার পুত্র এযীদকেও এর কিছু অংশ দান করুন। আবু সুফিয়ানের এক পুত্রের নাম ছিলাে এযীদ (رضي الله عنه)। আর উনি হযরত মুআবিয়া (رضي الله عنه) এর ভাই ছিলেন। তাই হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) উক্ত নাম অনুসারে তার পুত্রের নাম রেখেছিলেন এজিদ। হুজুর (ﷺ) কথার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে পুনরায় চল্লিশ আওকিয়া রৌপ্য ও একশত উট প্রদান করলেন। 

আবু সুফিয়ান (رضي الله عنه) বললেন, আমার আরেক পুত্র মুআবীয়াকেও অংশ দেয়া হােক। 

হুজুর (ﷺ) তাকেও ঐ পরিমাণ মাল প্রদান করলেন। এবার হযরত আবু সুফিয়ান (رضي الله عنه) আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)। আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আল্লাহর কসম, যুদ্ধের সময় আপনি যেরকম মহানুভব ছিলেন শান্তির সময়ও তেমনি মহানুভব আছেন। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে উত্তম পারিতোষিক প্রদান করুন। এ ঘটনা হাওয়াযেন ও হুনায়ন বিজয় অধ্যায়েও বর্ণনা করা হবে। মক্কা বিজয়ের ঘটনার পর সেই আলােচনা আসবে। অবশ্য আলােচনাটি পুনরাবৃত্তি মনে হবে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তা পুনরালােচনা নয়। কারণ, এজাতীয় আলােচনা যতোই আসবে তবে তা থেকে মেশক আম্বরের সুবাস উদগিরিত হবে।


হাওয়াযিন কাবিলাকে পরাজিত করার পর সে কবীলা থেকে মুসলিমবাহিনী অনেক বাঁদী পেয়েছিলেন। তা থেকে ছয় হাজার বাদীকে হুজুর আকরম (ﷺ) তাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। উক্ত যুদ্ধে মুসলিমবাহিনী যেসমস্ত গনীমত লাভ করেছিলেন, তার সমষ্টি ছিলাে নিম্নরূপ -

১। ছয় হাজার মানুষ। ২। বিশহাজার উট, ৩। প্রায় চল্লিশ হাজার বকরী এবং চার হাজার আওকিয়া রৌপ্য। একেক আওকিয়ার ওজন ছিলাে চল্লিশ দেরহাম। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া এর গ্রন্থকার হিসাব করে বলেছেন যে, হুনায়ন বিজয়ের সময় হুজুর পাক (ﷺ) মানুষকে যে দান করেছিলেন সে মালের সংখ্যা ছিলাে প্রায় পাঁচ হাজার। বান্দা মিসকীন অর্থাৎ শায়েখ মুহাদ্দিছে দেহলভী (رحمة الله) বলেন, হুজুর আকরম (ﷺ) এর দানশীলতা ও বদান্যতা সীমা, সংখ্যা, অনুমান ও কিয়াসের গণ্ডিবহির্ভূত ছিলাে। যা কিছু বিদ্যমান ছিলাে হুজুর (ﷺ) এর বদান্যতা শুধু তার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তার চেয়ে লক্ষ গুণ মাল ও যদিও তার কাছে আসতে, তবুও তার দানের অবস্থা এরকম থাকতাে।


প্রকৃত প্রস্তাবে দানশীলতা ও বদান্যতা সাব্যস্ত হওয়ার জন্য উপস্থিত গুণাবলী শর্ত নয়। বরং এগুণটি সত্তাগত, প্রকৃতিগত ও জন্মগত হয়ে থাকে এবং এর প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ অন্যরূপ হয়ে থাকে। প্রকৃত দানশীল ব্যক্তি যা কিছু হাতে আসে তাই দান করে দিয়ে থাকেন এবং এ দানের কারনে দারিদ্র ও অনটন আসার আশঙ্কা ঘুনাক্ষরেও তাদের অন্তরে প্রবেশ করে না।


হুজুর পাক (ﷺ) যখন কোনো অভাবী লোক কে দেখবে, তখন নিজের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও খাদ্য পানীয় অভাবীর হাতে তুলে দিলেন। তিনি বিভিন্ন প্রকারে দান খয়রাত করতেন। কাউকে হেবা করতেন। কাউকে হক থেকে দান করতেন, কাউকে ঋণের বােঝা থেকে মুক্ত করতেন, কাউকে সদকা প্রদান করতেন। আবার কাউকে হাদিয়া প্রদান করতেন। কখনো এমন হতো যে, কোন দোকানির কাছ থেকে কাপড় ক্রয় করে মূল্য পরিশোধ করার পর আবার সেই কাপড় তাকেই দান করে দিয়েছেন। কখনাে এমন হতাে যে, তিনি কারাে কাছ থেকে কিছু কর্জ করতেন এবং তাঁকে তা দেয়ার সময় বেশী দিয়ে দিতেন। কখনাে কাপড় খরিদ করে তার মূল্যের চেয়ে বেশি দিয়ে দিন। কখনো কারো কাছ থেকে হাদিয়া গ্রহণ করেন এবং তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি তাকে বিনিময় দিয়ে দিতেন।


একদা এক মহিলা হুজুর পাক (ﷺ) এর নিকট কিছু সুন্দর সুস্বাদু খেজুর নিয়ে এলাে। হুজুর পাক (ﷺ) এজাতীয় খেজুর খুব পছন্দ করতেন। হুজুর পাক (ﷺ) বিনিময়ে বাহরাইন থেকে আনীত অলংকারাদি দিয়ে মহিলার দু’হাত ভরে দিলেন।


যে কোনাে প্রকারে সম্ভব হতে হুজুর পাক (ﷺ) দান খয়রাত হাদিয়া ইত্যাদি মানুষকে প্রদান করতেন, যদিও তাঁর নিজস্ব জিন্দেগী অত্যন্ত ফকিরী হালে অতিবাহিত হতে। কোন সময় এক মাস, কোন সময় দু'মাস একটানা এভাবে অতিবাহিত হবে যে, হুজুর পাক (ﷺ)এর পবিত্র গৃহে আগুন জ্বলে না। অনেক সময় ক্ষুধার তাড়নায় পেট মোবারক উপর পাথর বেঁধে নিতেন। এই যে, হুজুর পাক (ﷺ) এর ফকিরী, দৈন্য ও অক্ষম অবস্থা এটা ধন সম্পদ না থাকার কারণে ছিলাে এমনটি নয়। বরং মানুষকে সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে যে যাহেদানা জিন্দেগী তিনি পছন্দ করতেন, সেই কারণেই এমনটি হতাে। কোনাে কোনাে সময় হুজুর পাক (ﷺ) তাঁর স্ত্রীগণের জন্য মাসিক ব্যয়সমূহ জোগাড় করে তাদেরকে দিয়ে দিতেন। কিন্তু নিজের জন্য কিছুই তা থেকে বাঁচিয়ে রাখতেন না।


নবী করীম (ﷺ) সাধারণভাবে সমগ্র বনী আদমের উপর সবচেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন। তার দানশীলতা ও বদান্যতার বিভিন্ন ধরন ছিলাে। জাগতিক বস্তু দান করা ছাড়াও এলেম দান করা, আল্লাহর বান্দাদের জন্য দ্বীনে হকের হেদায়েত দান করা ইত্যাদি বদান্যতার পর্যায়ভুক্ত। যার সার্বিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে হুজুর পাক (ﷺ) এর মাধ্যমে।


➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী] 


© | সেনানী এপ্স |

Top