মেরাজ শরীফের আলোচনা
বিশেষ থেকে বিশেষতর, উৎকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টতর, পূর্ণ থেকে পূর্ণতর এবং বিস্ময়কর মোজেজা হচ্ছে মেরাজ। কোনো নবী বা রসুলকে এহেন মোজেজা দেয়া হয়নি। এই মেরাজ শরীফের মাধ্যমে নবী করীম (ﷺ) কে মাকামে উলিয়া পর্যন্তপৌঁছানো হয়েছে। সেখানে পৌঁছে তিনি যা অবলোকন করেছেন, তা অন্য কেউই দেখেননি। এ সম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘পবিত্রতা ওই মহান সত্তার যিনি তাঁর বিশেষ বান্দাকে রাতের একাংশে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত পরিভ্রমণ করালেন। যে মসজিদে আকসার চতুষ্পার্শ্বে আমি বরকত দান করেছি।’ এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমি (আল্লাহ্) আমার কুদরতের নিদর্শন তাঁকে দেখাবো। নিশ্চয় সেই আল্লাহ্ যিনি প্রকৃত শ্রবণকারী এবং প্রত্যক্ষকারী। এসরা শব্দের অর্থ নিয়ে যাওয়া, সায়ের বা ভ্রমণ করানো। আল্লাহ্তায়ালা রসুলে আকরম (ﷺ) কে মক্কা মুকাররমা থেকে মসজিদে আকসায় নিয়ে গেলেন- এটুকুকে অস্বীকার করলে কাফের হয়ে যাবে। কেনোনা তা কিতাবুল্লাহ্ দ্বারা প্রমাণিত। তারপর মসজিদে আকসা থেকে আকাশ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার নাম হচ্ছে মেরাজ। এটুকু মশহুর হাদীছসমূহের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। রসুলেপাক (ﷺ) এর ভ্রমণের এ অংশটুকু যদি কেউ অস্বীকার করে তাহলে সে বেদাতী, ফাসেক এবং লাঞ্ছিত। এছাড়া আনুষংগিক ছোট খাট আশ্চর্যজনক এবং সূক্ষ্ম ঘটনাদি বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। সেগুলো যদি কেউ অস্বীকার করে তাহলে সে মূর্খ এবং বঞ্চিত। মেরাজ সম্পর্কে বিশুদ্ধ মাযহাব এই যে, এসরা এবং মেরাজ উভয়টিই জাগ্রত অবস্থায় এবং সশরীরে সংঘটিত হয়েছিলো। সাহাবা, তাবেয়ীন এবং তাবে তাবেয়ীনগণের মশহুর আলেমগণ এবং তাঁদের পর মোহাদ্দেছ, ফকীহ্ এবং এলমে কালাম শাস্ত্রবিদগণের মাযহাব এইমতের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। এ সম্পর্কে বহু সহীহ্ হাদীছ এবং সহীহ্ খবর মুতাওয়াতির হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। কেউ কেউ আবার এরকম মত পোষণ করেছেন, পবিত্র মেরাজ স্বপ্নে এবং আত্মিকভাবে হয়েছিলো।
এই দু’ই মতের সামঞ্জস্য বিধান এভাবে করা হয়েছে যে, রসুলে করীম (ﷺ) এর মেরাজ বিভিন্ন সময়ে হয়েছিলো। তন্মধ্যে একবার সংঘটিত হয়েছিল জাগ্রত অবস্থায়। অন্যান্য সময় হয়েছিল স্বপ্নযোগে, আত্মিকভাবে। সেগুলোও আবার কিছু হয়েছিলো মক্কা মুকাররমায় এবং কিছু হয়েছিলো মদীনা মুনাওয়ারায়। আর স্বপ্নের মেরাজও ওহী। কেনোনা এ কথায় ঐকমত্য রয়েছে যে, আম্বিয়া কেরামের স্বপ্নও ওহী। সন্দেহের অবকাশ নেই। নিদ্রিত অবস্থায়ও তাঁদের অন্তর জাগ্রত থাকে। নিদ্রিত অবস্থায় তাঁদের চোখ মুদ্রিত থাকতো, যেমন মোরাকাবার হালতে রসুলেপাক (ﷺ) এর চোখ মোবারক মুদ্রিত থাকে। আর এই মুদ্রিত রাখার কারণ হচ্ছে, মোরাকাবার অনুভূতিতে জাগতিক প্রভাব যেনো অনুপ্রবেশ করতে না পারে। কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী (رحمة الله) বলেন, নবী করীম (ﷺ) স্বপ্নযোগে যা কিছু লাভ করতেন, তা ছিলো তাউতিয়া এবং তায়সির হিসেবে। অর্থাৎ বিধান বা অবস্থাকে বুঝিয়ে দেয়া এবং সহজসাধ্য করে দেয়াই ছিলো তার উদ্দেশ্য। যেমন নবী করীম (ﷺ) এর কাছে ওহী আগমনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি সুস্বপ্ন দর্শন করতেন, যাতে করে ওহীর কঠিন ভার হালকা অনুভূত হয় এবং মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ সাপেক্ষে উক্ত গুরুদায়িত্বটি সহজে বহন করতে পারেন।
নবী করীম (ﷺ) এর মেরাজ প্রথমে কয়েকবার স্বপ্নযোগে সংঘটিত হয়েছিলো, যেহেতু জাগ্রত অবস্থায় মেরাজ সংঘটিত হবে। আল্লাহ্পাকের পরিকল্পনা ছিলো সেরকমই। মেরাজ স্বপ্নে হয়েছিলো- এ কথার প্রবক্তারা বলেছেন, স্বপ্নের মেরাজ নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে হয়েছিলো। কোনো কোনো আরেফীন বলেছেন, রসুলেপাক (ﷺ) এর এসরা এবং মেরাজ বহুবার সংঘটিত হয়েছিলো। তাঁরা এ সংখ্যা চৌত্রিশ ছিলো বলে উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে একটি হয়েছিলো সশরীরে, জাগ্রত অবস্থায়। আর বাকীগুলো হয়েছিলো স্বপ্নযোগে, আত্মিকভাবে। আবার একশ্রেণী এমন বলে থাকেন, এসরা- যা মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত হয়েছিলো তা ছিলো সশরীরে। আর সেখান থেকে আকাশে যে মেরাজ হয়েছিলে, তা স্বপ্নের মাধ্যমে আত্মিক অবস্থায় হয়েছিলো। তারা উপরোক্ত আয়াতে কারীমার মাধ্যমে দলীল দিয়ে থাকেন। তাঁরা বলেন, এসরার শেষ সীমায় মসজিদে আকসাকে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের কথা এই যে, সশরীরে এসরা যদি মসজিদে আকসার পরেও হয়ে থাকতো, তাহলে কোরআন মজীদে এর উল্লেখ করা হতো। এ কথা উল্লেখ করলে তো নবী করীম (ﷺ) এর বুযুর্গী, সম্মান, প্রশংসা এবং আল্লাহ্তায়ালার কুদরত ও বিস্ময় আরও অধিক প্রতিভাত হতো। তাঁদের এহেন বক্তব্যের উত্তরে বলা হয়েছে, আয়াতে কারীমায় বিশেষ করে মসজিদে আকসাকে উল্লেখ করা হয়েছে, এর কারণ হচ্ছে, উক্ত স্থানটিকে কেন্দ্র করে ঝগড়া ও মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছিলো। তাই সেস্থানটিকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
নবী করীম (ﷺ) যে বাইতুল্লাহ শরীফ থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেছেন, মসজিদে আকসা দর্শন করেছেন একথা কুরায়েশরা অস্বীকার করেছিলো। শুধু তাই নয়, কাফেররা নবী করীম (ﷺ) এর কাছে মসজিদে আকসার কী কী আলামত রয়েছে, এ সম্পর্কেও জানতে চেয়েছিলো এবং তার অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করে নবী করীম (ﷺ) কে দস্তুরমত পরীক্ষা করেছিলো। আর সে কারণেই উক্ত স্থানটির উল্লেখ বিশেষভাবে করা হয়েছে। এটা এসরার শেষ সীমা বুঝানোর উদ্দেশ্যে বলা হয়নি। এ সম্পর্কে কোরআনের আয়াতও রয়েছে। সুরা আন নাজ্মে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। আন নাজ্মে যা বলা হয়েছে এবং যা ঘটেছে, সেগুলো সম্পর্কে কিছু কিছু চিন্তাবিদ মন্তব্য করে থাকেন যে, রসুলেপাক (ﷺ) হজরত জিব্রাইল (عليه السلام)কে দেখেছিলেন এবং তাঁর নৈকট্য লাভ করেছিলেন- এটাই বুঝানো হয়েছে আন নাজ্ম এর বর্ণনায়। কিন্তু সুসাব্যস্ত ও সুপ্রমাণিত কথা এটাই যে, এর দ্বারা মেরাজের ঘটনাই বলা হয়েছে।
বান্দা মিসকীন (শায়েখ আবদুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী) বলেন, আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন, আমার কুদরতের নিদর্শনসমূহ তাঁকে দেখাবো এ উদ্দেশ্যে আমি ভ্রমণ করিয়েছি- এ আয়াতখানা মেরাজের সাথে যুক্ত। কথাটির তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ্তায়ালা তাঁর হাবীব (ﷺ)কে মসজিদে আকসায় নিয়ে গেলেন। তারপর সেখান থেকে আকাশে নিয়ে গেলেন। আকাশে নিয়ে নিদর্শন দর্শন করানোর কারণ এই যে, আল্লাহ্তায়ালার কুদরতের বিস্ময়কর নিদর্শনসমূহ তো আকাশেই, আর চূড়ান্ত পর্যায়ের অলৌকিকতা ও মোজেজার বহিঃপ্রকাশ তো সেখান থেকেই হয়ে থাকে। তাই এই মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্তায়ালা তাঁর হাবীব (ﷺ) এর এই ঘটনা মসজিদে আকসা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখেননি।
ঊর্ধ্বাকাশে যে মেরাজ হয়েছিল, তা শুরু হয়েছিলো মসজিদে আকসা থেকে। মসজিদে আকসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রেক্ষিতেই। নবী করীম (ﷺ) এর মেরাজ স্বপ্নযোগে সংঘটিত হলে কাফেরেরা একে অসম্ভব মনে করতো না। আর দুর্বল ইমানদাররা এর কারণে ফেতনায় পতিত হতো না। তাছাড়া স্বপ্নে দর্শিত ঘটনাবলী বাস্তবে সংঘটিত হওয়ার প্রচলন অপ্রসিদ্ধ। আসরা শব্দের ব্যবহারও স্বপ্নের ক্ষেত্রে হয় না। সুতরাং এটাই প্রমাণিত হয় যে, এসরা যখন জাগ্রত অবস্থায় সংঘটিত হয়েছে, তখন তার পরবর্তী সংঘটিত মেরাজও বাস্তবেই হয়েছে। এরপরও বলতে হয়, মেরাজ স্বপ্নযোগে হয়েছে- এরকম প্রমাণও নেই। নবী করীম (ﷺ) এর মেরাজ শরীফ স্বপ্নযোগে হয়েছে বলে যারা দাবি করেন তাঁদের সন্দেহের কারণ কয়েকটি।
১. ‘যা আমি আপনাকে দেখিয়েছি ওই স্বপ্নকে আমি কেবল মানুষের পরীক্ষার জন্য বানিয়েছি।’ এই আয়াতকে কোনো কোনো মুফাসসির মেরাজের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে থাকেন। কেনোনা রুইয়া নিদ্রাবস্থায় স্বপ্নে কিছু দেখাকে বলা হয়। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, এখানে রুইয়া বা স্বপ্ন শব্দ উল্লেখ করে হুদাইবিয়া বা বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে নবী করীম (ﷺ) যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাকেই বুঝানো হয়েছে। আহলে এলেম রুইয়া শব্দকে চাক্ষুষ দর্শন অর্থেও প্রয়োগ করে থাকেন। যেমন কবি মুতানাব্বি তার কবিতায় বলেছেন। কোনো কোনো আহলে এলেম বলেছেন, যেহেতু মেরাজ শরীফ রাত্রি বেলায় হয়েছে তাই এক্ষেত্রে রুইয়া শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
২. হাদীছ শরীফে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, ‘অতঃপর আমি জাগ্রত হলাম’- এ কথায় প্রমাণ হয়, মেরাজ জাগ্রত অবস্থায় সংঘটিত হয়েছিলো। ‘আমি জাগ্রত হলাম’ এ কথার তাৎপর্য এই যে, ফেরেশতা আসার পূর্বে তিনি নিদ্রায় ছিলেন। সেই নিদ্রা থেকে তিনি জাগলেন এবং জিব্রাইল (عليه السلام) তাঁকে বোরাকে সওয়ার করিয়ে নিলেন। অথবা এর অর্থ এও হতে পারে, মেরাজের যাবতীয় ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর তিনি নিদ্রা থেকে জাগ্রত হলেন। যেমন হাদীছ শরীফে এসেছে আমি জেগে উঠতেই দেখি মসজিদে হারামে শুয়ে আছি। অথবা এর অর্থ যখন সকাল হলো তখন আমি মসজিদে হারামে। অথবা জাগ্রত হওয়ার কথা সম্ভবতঃ নবী করীম (ﷺ) অন্য কোনো নিদ্রা থেকে জাগ্রত হওয়া সম্পর্কে বলেছেন, যা বাইতুল হারামে আসার পর হয়েছিলো।
নবী করীম (ﷺ) এর এসরা সারারাত্রি ব্যাপী ছিলো না, বরং রাতের কিয়দংশে হয়েছিলো। কোনো কোনো মুহাক্কেক বলেন, এসতেকাফ এর অর্থ এফাকা অর্থাৎ চেতনতা। উক্ত চেতনাবস্থা থেকে মেরাজের অবস্থায় উপনীত হওয়া। নবী করীম (ﷺ) কে যখন আসমান ও যমীনের মালাকুতের বিস্ময়কর ও সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো দেখানো হয়েছিলো, মালায়ে আ’লা এবং তথাকার আল্লাহ্তায়ালার বড় বড় নিদর্শনাবলী এবং চূড়ান্ত পর্যায়ের ভেদের বস্তুসমূহ অবলোকন করানো হয়েছিলো, তখন তাঁর হাল অত্যন্ত কঠিন হয়ে গিয়েছিলো এবং তাঁর বাতেন বা অন্তর্জগত নিদ্রার অবস্থা সদৃশ হয়ে গিয়েছিলো। আহলে এলেমগণ বলেন, মালাকুত অর্থাৎ আল্লাহ্তায়ালার কুদরতের জগত দর্শনকালে তিনি যদিও জাগ্রত ছিলেন, তথাপিও সে অবস্থাটা ছিলো একপ্রকারের অনুভূতির অনুপস্থিতি। আর সে অবস্থাটাকেই আহলে এলেম নিদ্রা ও জাগরণ এ দু’য়ের মধ্যবর্তী একটি অবস্থান বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। প্রকৃত প্রস্তাবে সেটা জাগ্রত অবস্থাই। কিন্তু অনুভূতির অনুপস্থিতিকে কেউ কেউ নিদ্রা বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কোনো কোনো বর্ণনাতেও এরকম এসেছে, তিনি (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আমি তখন নিদ্রা ও জাগরণ দু’এর মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলাম। কেউ কেউ এই হাদীছের ব্যাখ্যা এরকম করেছেন যে, নাওম এর অর্থ হলো, তিনি নিদ্রিতদের মতো শায়িত ছিলেন। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, আমি তখন হাজারে আসওয়াদের নিকটে প্রায় শায়িত অবস্থায় ছিলাম। আবার কখনও এক পাশে শায়িত ছিলাম- এরকম বলা হয়েছে। হজরত আনাস (رضي الله عنه) কিন্তু এরকম অবস্থা অবলোকন করেননি। তিনি রসুল (ﷺ) থেকে বর্ণনা শুনেছেন। মেরাজের ঘটনা হিজরতের পূর্বে ঘটেছিলো। আর হজরত আনাস (رضي الله عنه) তো হিজরতের পর নবী করীম (ﷺ) এর সাহচর্যে গিয়েছিলেন। তদুপরি তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র সাত আট বৎসর। আলেমগণ এরকমই ব্যাখ্যা করেছেন। হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর বর্ণিত হাদীছের অবস্থাও তদ্রূপ। তিনি বলেছেন, রসুলেপাক (ﷺ) এর দেহ মোবারক সে রাত্রিতে বিছানা থেকে হারিয়ে যায়নি। আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর এই হাদীছটি ওই সম্প্রদায়ের দলীল, যাঁরা বলেন, নবী করীম (ﷺ) এর মেরাজ সংঘটিত হয়েছিলো স্বপ্নযোগে।
একদল আলেম বলেন, নবী করীম (ﷺ) এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির এক বা দেড় বৎসর পর ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মেরাজ সংঘটিত হয়েছিলো। তাঁদের উক্ত মতানুসারে তো হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর তখন ধারণা ও স্মরণশক্তিই ছিলো না। বরং এমনও হতে পারে যে, তখন তাঁর জন্মই হয়নি। ওয়াল্লাহু আ’লাম।
মোট কথা হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর এই হাদীছ পূর্বোক্ত হাদীছদ্বয়ের তুলনায় অগ্রগণ্য নয়, যা দর্শনের ভিত্তিতে বিবৃত হয়েছে। হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (رضي الله عنه) এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, রসুলেপাক (ﷺ) এর দেহ মোবারক আমা থেকে হারিয়ে যায়নি। এই হাদীছের মাধ্যমে দলীল গ্রহণ করা নিঃসন্দেহে ভুল। পবিত্র কালামে উল্লেখ করা হয়েছে ‘এবং চোখ যা দর্শন করেছে, অন্তর তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেনি।’ এই আয়াতটি স্বপ্নদর্শনকে প্রমাণিত করে না। আয়াতখানার সুস্পষ্টভাব হচ্ছে, তিনি চোখে যা দেখেছেন, তাঁর হৃদয় তাকে অবাস্তব দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেনি। বরং তাঁর চোখের দর্শনকে অন্তর স্বীকৃতি দিয়েছে, অস্বীকার করেনি। তার দলীল হচ্ছে এই আয়াত, ‘ওই সময় তাঁর চোখ বিচ্যুত হয়নি এবং অবাধ্য হয়নি।’
এখন আলোচনায় আসা যাক, দার্শনিকদের বাতেল এবং মনগড়া যুক্তি প্রসঙ্গে। তারা বলে থাকে, ভারী দেহ কখনও ঊর্ধ্বে আরোহণ করতে পারে না। তাছাড়া আকাশের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি হওয়া এবং তা মিলিত হয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। এ জাতীয় কথাবার্তা ইসলামী তরিকায় পরিত্যাজ্য এবং অনর্থক। আরেকদল আছে, যারা মেরাজকে আত্মিক বলে ধারণা করে থাকে। তারাএ মেরাজের উপর অনুমান করে হাশরকেও আত্মিক বলে আখ্যায়িত করে। তারা যে মেরাজকে আত্মিক বলে, তা এই অর্থে নয় যে, স্বপ্নযোগে আত্মার মেরাজ হয়েছিলো। বরং তারা আত্মার বিভিন্ন মাকাম ও অবস্থায় আরোহণ এবং পূর্ণতায় পৌঁছা- এরূপ অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে থাকে। যেমন তারা বলে থাকে, জিব্রাইল এর অর্থ মোহাম্মদ (ﷺ) এর আত্মা, বোরাকের অর্থ তাঁর নফস যা রূহের বাহন ছিলো, যার খাসলত হচ্ছে অবাধ্যতা। এটা কখনও বাধ্য হয় না, যতক্ষণ রূহানী শক্তি তার উপর প্রবল না হয়। তারা আকাশের অর্থ করে নৈকট্যের মাকাম, সিদরাতুল মুনতাহার অর্থ করে চূড়ান্ত মাকাম ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই সম্প্রদায়টি তাদের এহেন মনগড়া ব্যাখ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে হজরত মুসা (عليه السلام) এর ঘটনা প্রসঙ্গেও যেমন ফেরআউন, লাঠি, জুতা ও ওয়াদী ইত্যাদি সম্পর্কেও মনগড়া অর্থ করে থাকে। তারা শব্দ ও বাক্যের বাহ্যিক অর্থকে স্বীকার করলেও বলে, এলেম ও মারেফত বলে একটি বস্তু আছে এবং তারও আলাদা স্তর আছে। তাদের অনুমান অনুসারে হাশর, মেরাজ আত্মিক ও দৈহিক- এ দুয়ের মধ্যবর্তী একটি অবস্থা। ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله)ও বর্ণিত খেয়ালের আবর্তে অবস্থান করতেন। হাশরকে যদি আত্মিক মনে করা হয়, শাব্দিক অর্থের গুরুত্ব না দিলে এবং আকৃতিগতভাবে হাশর হবে বলে মনে না করলে, সুস্পষ্ট কুফুরী করা হবে ও সীমালংঘন হবে। এদের মাযহাব হলো বাতেনী।
বান্দা মিসকীন (শায়েখ আবদুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী) এর ইমানী উদ্দীপনা কথিত তরিকাকে সত্য থেকে দূরবর্তী মনে করে এবং তাকে অস্বীকার করতে চায়। বস্তুতঃ এরা আকৃতি জগতকে স্বাভাবিক দায়েরায়ে এমকান বা সম্ভাব্যের বৃত্ত থেকে দূরবর্তী মনে করে বলে ভাবার্থের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছে। প্রকৃতপক্ষে ইমান হচ্ছে শোনা এবং মানার নাম, যেমন মেরাজের ঘটনায় সাইয়্যেদুনা হজরত আবু বকর সিদ্দীক (رضي الله عنه) করেছিলেন। আর সেদিন থেকেই তিনি সিদ্দীক নামে ভূষিত। আর এই ঘটনাকে অবিশ্বাস করে কোনো কোনো দুর্বল ইমানদার তো ইমানের বৃত্ত থেকে বেরিয়েও গিয়েছিলো। এলমুল একীন তো প্রত্যক্ষ দর্শনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। সে সম্পর্কে আপত্তি তোলা, উচ্চ বাচ্য করা, ভাবার্থের দিকে ঝুঁকে পড়া সম্ভাব্য অসম্ভাব্য নিয়ে যুক্তিবিদ্যার মাপকাঠিতে বিচার বিশ্লেষণ করা, বুদ্ধি এবং তার মাধ্যম দ্বারা তাকে বন্দী করা ইমান এবং বন্দেগী থেকে দূরে থাকার লক্ষণ।
আমাদের অর্থাৎ ইমানদারদের জন্য তো আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলের কথার চাইতে বড় দলীল আর কিছু হতে পারে না। আমরা তাঁর কাছ থেকে যা শুনবো তাইতো আমল করবো। যে সম্পদায় এই কাজটিকে তাকলীদ বা অন্ধ অনুসরণ বলে থাকে, তারা জানে না আমরা কার তাকলীদ করে থাকি। আমাদের তাকলীদ বা অনুসরণ তো ওই মহান পয়গম্বরের তাকলীদ যাঁর পয়গম্বরী সাব্যস্ত হয়েছে মোজেজাসমূহের মাধ্যমে। সুসাব্যস্ত জনের তাকলীদ করাই প্রকৃত তাকলীদ আর এটা কোনো গতানুগতিক তাকলীদ নয়। এটা সিরাতুল মুস্তাকীমে অনুসরণেরই নামান্তর। মুকাল্লেদ তো তোমরাই, যারা স্বীয় বুদ্ধিবাদিতার তাকলীদ করে থাকো এবং প্রবৃত্তির নির্দেশ মতো চলো, যার সত্যাসত্য সুসাব্যস্ত নয়। এ পথ দ্বিধা ও সন্দেহে ভরা। দার্শনিকেরাতো মূলতঃ আম্বিয়া কেরামের সিলসিলাকেই অস্বীকার করে থাকে। তাদের কথায় প্রয়োজন কী? তাদের নবীতো তাদের বুদ্ধি। যুক্তিবাদী ও তর্কবাগীশদের কী যে হলো। চলার পথ সহজ সরল হওয়া সত্ত্বেও তারা পথচ্যুত। রাস্তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে তারা কথা বলে কেনো? সন্দেহের অবতারণা করে মতানৈক্যের সৃষ্টি করে কেনো? তর্কবাগীশদের নিয়ত যদিও দার্শনিকদের বিপরীত, তবু পথ চলার দিক দিয়ে তারাও স্বীয় প্রবৃত্তি এবং দার্শনিকদের দর্শনশাস্ত্রের অনুসরণ করে। এতে করে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করে যাচ্ছে।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]
© | সেনানী এপ্স |