হাস্যরসিকতার ধরণ
হুজুর আকরম (ﷺ) এর হাস্যরসিকতার ফলাফল ও তার বরকত আকাংখা গণনা করা এবং সীমিত করা সম্ভব নয়। একদিন হজরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه) এর কন্যা যিনি হুজুর পাক (ﷺ) এর রবীবা ছিলেন—হুজুরের কাছে এলেন। ঐ সময় হুজুর পাক (ﷺ) সবেমাত্র গােছল সেরেছেন। তিনি রসিকতা করে তার মুখের উপর পানি ছিটিয়ে দিলেন। এ পানির বরকতে তার চেহারা এমন এক অপূর্ব লাবণ্য প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলে যা কখনাে চেহারা থেকে বিলুপ্ত হয়নি। যৌবনের লাবণ্য সর্বদাই তার চেহারায় বিরাজ করতো।
হজরত মুহাম্মদ বিন রবী' একজন নব দীক্ষিত সাহাবী। যখন তার বয়স পাঁচ বৎসর তখন একদিন হুজুর আকরম (ﷺ) তাঁর বাড়ীতে গেলেন। তার বাড়িতে একটি কূপ ছিল। হুজুর আকরাম (ﷺ) বালতি দিয়ে পানি তুলে সে পানি পান করলেন।পানি পান করার পর রসিকতা করে হুজুর (ﷺ) তাঁর সিক্ত মুখখানা হযরত মুহাম্মদ ইবন রবী এর চেহারাতে সংস্থাপন করলেন। এর বরকতে তাঁর স্মরণ শক্তি এতাে প্রখর হয়েছিলাে যার বদৌলতে তাকে বর্ণনাকারী সাহাবীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। তার বর্ণনাকৃত হাদীস বুখারী শরীফে আনা হয়েছে।
হুজুর আকরাম (ﷺ) এর রসিকতা মূলক ঘটনাবলীর মধ্যে একটি অন্যতম ঘটনা এক বেদুইন ব্যক্তি, নাম তার যাহের। তিনি গ্রামাঞ্চল থেকে হুজুর আকরম (ﷺ) এর জন্য কখনাে কখনাে হাদিয়া হিসাবে এমন তরিতরকারী নিয়ে আসতেন যা হুজুর (ﷺ) পছন্দ করতেন। হুজুর আকরম (ﷺ) তাকে শহরের জিনিসপত্র যেমন কাপড় চোপড় ইত্যাদি দান করতেন। হুজুর (ﷺ) তাকে ভালােবাসতেন। তিনি বলতেন, যাহেরের সাথে আমার বন্ধুত্ব আছে। আমি তার শহুরে বন্ধু। একদিন হুজুর (ﷺ) বাজারে গিয়ে দেখলেন, যাহের সেখানে দাড়িয়ে আছেন। অমনি তিনি তার পেছন দিক দিয়ে গিয়ে দু’হাত মুবারক দিয়ে তার চোখের উপর চেপে ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে লাগলেন এবং এক পর্যায়ে তাকে চোখ বন্ধ অবস্থায় জাপটে ধরে ফেললেন এবং নিজের পবিত্র বক্ষের সঙ্গে তার পিঠখানা মিলিত করে ফেললেন। তিনি হুজুর (ﷺ) কে চিনতে না পেরে বলতে লাগলেন, কে আমাকে জাপটে ধরেছে? শেষে তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে তিনি আর কেউ নন্ স্বয়ং হুজুর (ﷺ), তখন নিজেকে বন্ধনমুক্ত করার চেষ্টা করলেন না। তার পিঠকে হুজুর আকরম (ﷺ) এর সীনা মুবারকের সাথে আরও নিবিড় করে রাখলেন এবং পৃথক করার জন্য কোনােরূপ ইচ্ছাই করলেন না। কিছুক্ষণ পর হুজুর (ﷺ) বললেন, এখানে এমন কেউ আছে যে এ গোলামকে ক্রয় করতে পারে। এ কথা শুনে যাহের বললাে, ইয়া রসূলুল্লাহ আপনি আমাকে দূষিত ও কম দামের জিনিস মনে করলেন? তখন হুজুর (ﷺ) তাকে বললেন, তুমি তাে আল্লাহ তায়ালার নিকট দূষিত এবং স্বল্প মূল্যের নও, বরং তুমি এক দুর্মূল্য বস্তু।
খাদ্যবস্তুর কোন দোষ ত্রুটি বর্ণনা না করা হুজুর আকরাম (ﷺ) এর অন্যতম বিনয়। যদি মনে চাইতাে খেয়ে নিতেন, আর মনে না চাইলে রেখে দিতেন। একথা তিনি কখনাে বলতেন না যে, এ খাবার ভালাে নয়। টক হয়ে গেছে, লবণ বেশী হয়েছে বা কম হয়েছে, শুরবা ঘন হয়ে গিয়েছে বা পাতলা হয়ে গেছে—এরূপ বলাবলি করতেন না।
➡ ফায়দা
উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, কোনো খাবারের দোষ বর্ণনা করা অন্যায় এবং সুন্নতের খেলাফ। এ সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম বলেন, নিছক সংশোধনের উদ্দেশ্যে দোষ আলোচনা করা যেতে পারে। যদি এরকম বলে যে, মাল নষ্ট করা হলাে অথচ খাবার যথামানের তৈরী হলাে না, তাহলে এরূপ বলা জায়েয হবে। তদুপরি লক্ষ্য রাখতে হবে, এরূপ আলােচনা বা বক্তব্যের দ্বারা পাচকের মনে আঘাত লাগে কিনা। যদি তার মনে আঘাত লাগে তবে না বলাই উত্তম।
হুজুর পাক (ﷺ) এর ‘তাওয়াযু' বা বিনয়ের আরেকটি প্রকৃতি এরকম—যে সময় সাধারণভাবে দুনিয়ার নিন্দা বাদ করা হবে, তখন হুজুর পাক (ﷺ) বলতেন, তােমরা দুনিয়াকে মন্দ বলােনা। গালি দিওনা। কেননা, দুনিয়া হচ্ছে একটি উত্তম বাহন যা মুমেন ব্যক্তিকে অকল্যাণ থেকে কল্যাণের এবং নাজাতের দিকে পাঠিয়ে দিতে পারে। হুজুর পাক (ﷺ) যমানাকে গালি দিতেও মানা করতেন। যেমন হাদীসে কুদসীতে এসেছে, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, তােমরা যমানাকে গালি দিওনা। কেননা আমিই তাে যমানা।
হুজুর আকরাম (ﷺ)এর কথায় কোনো অবাস্তব কিছু থাকবে না। যেমন রাজা বাদশাহ বা দুনিয়াদার লোকদের বলে থাকে। তবে হ্যাঁ, তার দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য অবশ্য অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। কেননা পরিবার পরিজনের সাথে তিনি যখন স্বীয় গৃহে নিরিবিলিতে অবস্থান করতেন, ঐ সময় অযাচিতভাবে কেউ সেখানে প্রবেশ করলে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। তাই অনুমতির প্রয়োজন ছিল।
হুজুর আকরম (ﷺ) বলতেন, তােমরা আমাকে ইউনুস ইবন মুতাই (عليه السلام) এর উপর মর্যাদা দিওনা এবং মুসা (عليه السلام) এর উপর আমাকে প্রাধান্য দিও না। এ কথার মধ্যে তার বিনয়ের আভাস পাওয়া যায়। এ ধরনের আরও অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। হুজুর আকরাম (ﷺ) যে এরশাদ করেছেন, আমি বনী আদমের সরদার' বা এজাতীয় যে সমস্ত বর্ণনা আছে, তা দ্বারা বাস্তবতা ও আল্লাহর নেয়ামতের স্বীকৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। তদুপরি আল্লাহ তায়ালার আদেশ মান্য করা হয়েছে। যেহেতু আল্লাহতায়ালা আদেশ করছেন, আপনার প্রভুর নেয়ামত সম্পর্কে বর্ণনা করুন। কোনাে কোনাে ওলামায়ে কেরাম এর উত্তর এভাবে প্রদান করেছেন যে, হুজুর আকরাম (ﷺ) لا تفضلوا ‘লাতুফাদ্দেলু' বা এ জাতীয় কথা এই সময় বলেছেন যখন তিনি سيد ولد ادم'সাইয়্যিদুল বুলদে আদাম’ “সমস্ত বনী আদমের সরদার" এ মর্মে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেননি। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা যথাস্থানে করা হবে ইনশাআল্লাহ।
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী]
© | সেনানী এপ্স |