উম্মতে মোহাম্মদী (ﷺ) এর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য
মহানবী (ﷺ) এর উম্মতে মরহুমার মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যও বেশুমার। আর এ সমূহ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যগুলোও রসুলেপাক (ﷺ) এর প্রতি ধাবিত। কেনোনা তিনি একটি অনুগত উম্মতের নবী। এখানে একটি কথা ভালোভাবে জেনে রাখতে হবে, যদিও জ্বীন ও ইনসান উভয়ই তাঁর উম্মত এবং উভয় জাতিরই তিনি নবী, তথাপি বিশেষত্ব ও যোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্তায়ালার যে করুণা প্রকাশ পেয়েছে, তা কেবল মানুষের মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে। ‘তোমরা সর্বোত্তম উম্মত, মানুষের জন্য তোমাদিগকে বের করা হয়েছে’ আল্লাহ্পাকের এই সম্বোধন, সরাসরি রসুলেপাক (ﷺ) এর সাহাবীগণের প্রতি। কেনোনা, ইমানের দিক দিয়ে তাঁরাই অগ্রগামী আর তাঁরা আল্লাহ্পাকের নৈকট্যভাজন। আরও বলা হয়েছে ‘তোমরা ভালো কাজের আদেশ করো, আর মন্দ কাজের প্রতিবন্ধক হও।’ প্রকৃতপ্রস্তাবে উত্তম উম্মত হওয়ার জন্য উপরোক্ত গুণ দু’টিই শর্ত। নবী করীম (ﷺ) এর সংসর্গের কারণে সাহাবা কেরামের মধ্যে উক্ত গুণগুলো পরিপূর্ণরূপে প্রস্ফুটিত হয়েছিলো। তাঁরা ওই সকল ব্যক্তি, যাঁরা মহানবী (ﷺ) এর সুন্দর অবয়ব সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর নূর ও নিদর্শনের ফয়েজ সঞ্চয় করেছিলেন মাধ্যম ব্যতিরেকেই। এর দ্বারা আরেকটি সত্য প্রকাশিত হলো যে, এই উম্মতের পরবর্তীগণের তুলনায় পূর্ববর্তীগণই শ্রেষ্ঠ। এ ব্যাপারে নবী করীম (ﷺ) এর ভাষ্যও রয়েছে, ‘সবচেয়ে উত্তম যুগ হলো তাদের যুগ, যাদের মধ্যে আমি আছি। এরপর উত্তম তারা, যারা তাদের পূর্ববর্তীগণকে পেয়েছে। অতঃপর উত্তম তারা, যারা তাদের পূর্ববর্তীগণকে পেয়েছে। মশহুর এ তিনটি স্তরের প্রথমে রয়েছেন সাহাবা, তারপর তাবেয়ীন। তারপর তাবে তাবেয়ীন। সহীহ্ বোখারীর এক হাদীছ দ্বারা চতুর্থ স্তরেরও সন্ধান পাওয়া যায়, যাকে আতবায়ে তাবা বলা হয়েছে।
এরপর রসুলেপাক (ﷺ) এরশাদ করেছেন, অতঃপর মিথ্যার প্রসার ঘটবে। হাদীছাংশের তাৎপর্য এই যে, উক্ত তিন বা চারটি স্তরের পর পূর্ববর্তীগণের মধ্যে যেরকম দ্বীনদারী, সত্যবাদিতা, সততা ও সুসম্পর্ক ছিলো, তা লোপ পেয়ে যাবে এবং মিথ্যা, ধোঁকাবাজি ও অপবাদ ব্যাপকতা লাভ করবে। সাহাবা কেরামের দলে এমন লোকও আছেন, যাঁরা নবী করীম (ﷺ) কে এক পলক দেখার পর ইমান এনেছেন। এরপর আপন কাজ কর্মে লিপ্ত হয়ে গিয়েছেন। দীর্ঘকালব্যাপী নবী করীম (ﷺ) এর খেদমতে হাজির হবার সুযোগ আর পাননি। এই শ্রেণীর সাহাবীগণের ব্যাপারে কোনো কোনো আলেম মত পেশ করেন, পরবর্তী লোকদের উপরে তাঁদেরও ফযীলত ও শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। উলামা কেরামের এরূপ মতামতের উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়। তাঁরা যদি বুঝিয়ে থাকেন, নবী করীম (ﷺ) এর দর্শন ও মোশাহাদার বরকতে এক মুহূর্তেও ওই পূর্ণতা অর্জিত হতে পারে, যা অন্যান্যরা দীর্ঘ সময়ের সাধনায় অর্জন করতে পারে না, তাহলে ব্যাপারটি তাওয়াককুফ সাপেক্ষ। এরদ্বারা সাহাবা কেরামের ব্যক্তিগত মর্যাদার তারতম্যকে উপেক্ষা করা হয়। আর এটাতো বাস্তবতার পরিপন্থী - এ কথা স্বীকার করা সত্ত্বেও এ মহান সত্যটি অনস্বীকার্য যে, নবী করীম (ﷺ) এর দর্শন ও মোশাহাদা এমন এক মহান মর্যাদা যা অন্যান্য যাবতীয় কামালাত ও মর্যাদা থেকে অধিকতর পরিপূর্ণ। কোনো ফযীলত ও মর্যাদাই সংসর্গের সমতুল্য হতে পারে না। মোটকথা, যা কিছুই বলা হোক না কেন, সংক্ষিপ্ততম সংসর্গ লাভকারীও তাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ, যাঁরা সোহবত ও দর্শন থেকে বঞ্চিত। উসুলীনদের জামাত ‘সোহবত’ শব্দটির ব্যবহারে প্রথম জামাত অর্থাৎ দীর্ঘ সংসর্গ লাভকারী সাহাবীগণের জামাতকে নির্দিষ্ট করে থাকেন। অথচ এটা মোহাদ্দেছীনের জামাতের পরিপন্থী। তাঁদের মতে সোহবত শব্দের ব্যবহার সংক্ষিপ্ততম সময়ের দর্শন ও সাক্ষাতের ক্ষেত্রেও হতে পারে।
নবী করীম (ﷺ) এর উম্মতের মর্যাদা ও বিশেষত্ব সাধারণতঃ বেশুমার। এ সম্পর্কে অনেক হাদীছ ও আছার বর্ণিত হয়েছে। তবে সবচেয়ে পরিপূর্ণ মর্যাদা এটাই যে, তাঁরা মোহাম্মদ (ﷺ) এর উম্মত। নবী করীম (ﷺ) যেমন আখেরী জামানার নবী, খাতেমুন্নাবিয়্যীন, সকল নবীর ফাযায়েল ও কামালাত এককভাবে যেমন তাঁর মধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে, সুন্দরতম চরিত্র ও প্রশংসনীয় গুণাবলীর সমাহার ঘটেছে, তেমনি তাঁর উম্মতও খাতেমুল উমাম। দ্বীন ও নেয়ামতের পূর্ণতায় বিশেষিত। এ সম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালা ফরমান, ‘আজ আমি তোমাদের ধর্মকে তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিয়েছি, আর তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সমাপ্ত করে দিয়েছি।’ হজরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, নবী মুসা একদা আল্লাহ্তায়ালার কাছে নিবেদন করলেন, হে আমার প্রভু! আমার উম্মতের মতো আর কোনো উম্মত আছে কি? যাদের উপর তুমি মেঘ খ- দ্বারা ছায়া দান করেছো, আকাশ থেকে মান্না সালওয়া নাযিল করেছো।
আল্লাহ্তায়ালা বললেন, হে মুসা! তুমিতো উম্মতে মোহাম্মদীর ফযীলত সম্পর্কে জানো না। সমস্ত মাখলুকাতের উপর আমার যতটুকু অনুগ্রহ, ঠিক তার সমপরিমাণ অনুগ্রহ সেই উম্মতের উপর। হজরত মুসা (عليه السلام) আরয করলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দেখিয়ে দাও। আল্লাহ্তায়ালা বললেন, তুমি তাদের দেখা পাবে না। যেহেতু তারা শেষ যুগের উম্মত হয়ে দুনিয়াতে আসবে। তবে হাঁ, তোমাকে আমি তাদের কালাম শোনাতে পারি। আল্লাহ্তায়ালা উম্মতে মোহাম্মদীকে ডাক দিলেন। সকল উম্মত সমস্বরে জওয়াব দিল, হে আল্লাহ্। আমরা হাজির, আমরা হাজির। অথচ ওই সময় তারা সকলেই পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহের পৃষ্ঠে এবং মাতা-মাতামহ, প্রমাতামহের রেহেমের মধ্যে ছিলো। আল্লাহ্তায়ালা উম্মতে মোহাম্মদী সম্পর্কে এরশাদ করলেন, তোমাদের ব্যাপারে আমার রহমত আমার গযবের উপর অগ্রগামী, আর ক্ষমা অগ্রগামী আযাবের উপর। তোমরা দোয়া করার আগেই আমি কবুল করে নেবো। কেউ লাইলাহা ইল্লাল্লহ মোহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সাক্ষ্য দিলে আমি তার সমস্ত গোনাহ্ মাফ করে দেবো।’ রসুল করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ্তায়ালা আমার উপরে যখন তাঁর নেয়ামতের বহিঃপ্রকাশ চাইলেন, তখন এরশাদ করলেন, হে মোহাম্মদ! আপনি যখন ভূতচতুষ্টয়ের মধ্যে ছিলেন, তখন আমি আপনার নূরকে ডাক দিয়েছিলাম। আপনার উম্মতকেও ডাক দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো, আপনার উম্মতের কথা মুসাকে শোনাবো। তখন আপনি তুর পাহাড়ে ছিলেন না। এই হাদীছ হজরত কাতাদা (رضي الله عنه)ও বর্ণনা করেছেন। তবে তাঁর বর্ণনার মধ্যে অতিরিক্ত রয়েছে ‘তখন মুসা বললেন, হে আমার রব! আশ্চর্য তো! উম্মতে মোহাম্মদীর কণ্ঠ এতো সুন্দর। এতো আকর্ষণীয়? হে পরওয়ারদেগার! আমাকে তাদের কণ্ঠস্বর শুনিয়ে দাও।’ হজরত আবু নাঈম হুলিয়া নামক কিতাবে পুনরায় হজরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (ﷺ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ্তায়ালা নবী মুসাকে ওহীর মাধ্যমে জানালেন, এ মুহূর্তে কেউ যদি আহমদকে অস্বীকারকারী হয়, তাহলে তাকে দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করবো।’
➥[কিতাবঃ মাদারেজুন নবুওয়াত। মূলঃ ইমাম আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله)]
© | সেনানী এপ্স |